স্বামীর করুণা নয়, বরং স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার (মোহরানা)
লিখেছেন লিখেছেন মনিরা ২৭ জুন, ২০১৩, ০৭:৩৯:০৬ সন্ধ্যা
ঘর-সংসার করার পরও স্ত্রীকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত রাখা আর বঞ্চিত রাখার প্রয়োজনে কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়া তথা ধর্মীয় নির্দেশ অমান্য করার ব্যাপারটি আমাদের সমাজে রীতিমত একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তবে ব্যাপারটি এমনই গুরুত্ববহ যে, নিয়মমাফিক ওই ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ানোর মতো বিষয়! তাই বলে রাখা ভালো যে, সে আদালত হচ্ছে আদালতে আখিরাত তথা হাশরের ময়দান।
স্ত্রী জাতির অধিকার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়টি ধর্মীয় আলোচনায় আলোচিত হলেও আলেম-ওলামাদের বক্তব্যে আসলে আরও বেশি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বর্তমান অবস্থা, প্রেক্ষাপট ও সময়ের আলোকে। এ বিষয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন সেসব বুদ্ধিজীবীর নীরবতা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। বিষয়টি ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম সংশ্লিষ্ট হওয়ায় আল্লাহ পরকাল অবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা ওই ব্যাপারে নীরব থাকবেন তা দোষের নয় এবং তা হয়তো মেনেও নেয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাসী কোনো বুদ্ধিজীবী অন্যান্য ব্যাপারে বুদ্ধি খাটালেও ধর্ম প্রদত্ত অধিকারের ব্যাপারে নীরব থাকবেন, সেটা অবশ্যই দোষের ও নিন্দনীয়; তা মেনে নেয়া যায় না। কারণ এ নীরবতা পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য। বিশেষ করে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের জন্য যেমনি ক্ষতিকর, তেমনি ক্ষতিকর নিজের জন্যও। কারণ কোরআন-হাদিস বিবর্জিত বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে আল্লাহর জলদ গম্ভীর ঘোষণা হচ্ছে, ‘তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর-মূর্খ লোক আছে (বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, লেখকদের মধ্যেও), যারা মিথ্যে আসা ছাড়া কোরআনের (হাদিসেরও) কিছুই জানে না।তারা শুধু অমূলক ধারণাই পোষণ করে (সুরা-বাকারা, আয়াত-৭৮)।’ এ জাতীয় একপেশে ধর্ম বিশ্বাসীদের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণা হচ্ছে, ‘যেসব লোক এমন কোনো বৈঠকে (লেখালেখিতে, সভা সেমিনারে তথা লেখার বৈঠকে) অংশগ্রহণের পর উঠে আসে, যেখানে আল্লাহর নাম (ধর্মীয় বিষয়াদি) স্মরণ করা হয় না, তারা যেন মৃত গাধার লাশের স্তূপ হতে উঠে আসে। এরূপ মজলিশ (লেখালেখিও) তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে(মুসলিম)।’ বিশ্বাসী ঈমানদার বুদ্ধিজীবিরা ওই নারী অধিকারের ব্যাপারে কথা বললে, লেখালেখি করলে এবং শিক্ষিত সচেতন স্বামীরা ন্যায্য পাওনা পরিশোধে সচেতন হলে তা নিঃসন্দেহে নারী সমাজের অগ্রযাত্রায় ও স্ত্রীদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে যথেষ্ট সহায়ক হবে এবং ধূলিমলিন পৃথিবীতে জান্নাতের অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
স্বামীদের উদ্দেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘আর স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও সন্তুষ্ট চিত্তে’ (সূরা-নিসা, আয়াত-৪)। মোহরানা কী? এর উত্তরে বলা যায়, বিয়েতে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অপরিহার্য প্রদেয় হিসেবে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী যে অর্থসম্পদ পেয়ে থাকে, তাকে মোহরানা বলে। অন্যভাবে বলা যায়,মোহরানা বলতে এমন অর্থ সম্পদ বোঝায়, যা বিয়ে বন্ধনে স্ত্রীর ওপর স্বামীত্বের অধিকার লাভের বিনিময়ে স্বামীকে আদায় করতে হয়। মনে রাখতে হবে, মোহরানা স্বামীর করুণা নয়, নয় সামাজিক কোনো ট্র্যাডিশন। এ ছাড়া বিয়েরকথাবার্তার সময় মোহরানা ধরতে হবে আর বাসর রাতে মোহরানা মাফ চাইতে হবে বা মাফ নিতে হবে—এমন খেলনা জাতীয় বিষয়ও নয়। স্ত্রীর মোহরানা দেয়ার জন্য আল্লার যে নির্দেশ তা নামাজ-রোজার মতোই কোরআনের নির্দেশ, ফরজ। মোহরানার অর্থসামগ্রী স্ত্রীর একান্ত প্রাপ্য। মোহরানা স্ত্রীর অর্থনীতির নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর এক বিশেষ দান এবং স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচও বটে!
সামর্থ্যের মধ্যে বিয়ের মোহরানা নির্ধারণ করা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। সামাজিক স্ট্যাটাস বা লৌকিকতার খাতিরে মোটা অংকের মোহরানা ধার্য করে তা পরিশোধ না করা, পরিশোধ করার ইচ্ছে নেই, শুধু একটি অংক স্বীকার করা প্রতারণার শামিল, কবীরা গুনাহ। স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম নির্জন সাক্ষাতে মোহরানার টাকা মাফ চেয়েছেন,এরকম স্বামীর সংখ্যা কী কম? বিয়ের মজলিসে অনেক মানুষের সম্মুখে মোহরানার অংক কবুল করে বাসর ঘরে একাধিক স্ত্রীর কাছে মোহরানা মাফ চাওয়া (মাফ না চেয়ে যে স্বামী সময় চেয়েছেন তাকে অসংখ্য মোবারকবাদ,পৌরুষের অধিকারী হিসেবে তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য) বা মাফের সুযোগ খোঁজা কী আদৌ পৌরুষত্বের পরিচায়ক? অবলা নারীর স্বভাবগত লজ্জার সুযোগে প্রথম সাক্ষাতে স্ত্রীর কাছে মোহরানা মাফ চাওয়া বা মাফ করে নেয়া অথবা মাফের প্রসঙ্গে উত্থাপন করা আর অন্ধকারে কারো গলায় ছুরি ধরে তার সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়ার মধ্যে কী কোনো পার্থক্য থাকতে পারে? পৌরুষের অধিকারী ঈমানদার স্বামী মোহরানা আল্লাহর কর্তৃক নির্ধারিত স্ত্রীর একান্ত এক অধিকার বাসর রাতে তা স্ত্রীকে জানাবেন এটুকুই তো কাম্য এবং করণীয় হওয়া উচিত। মোহরানা স্ত্রীর এমন এক প্রাপ্য, যা তিনি স্বামীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে পাওনা হন। স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে স্ত্রী স্বামীকে সময় দিলে বাকি রাখা চলে। তবে মোহরানার অর্থ আবশ্যিকভাবে পরিশোধ করতে হবে—হোক তা নগদ, কিছু নগদ বাকি অংশ পরে বা কিস্তিতে। ছলে-বলে-কৌশলে বা স্ত্রীর অজ্ঞতার সুযোগে মোহরানা মাফ করিয়ে নিলে তা মাফ না হয়ে হবে জুলুম-প্রতারণা। মোহরানা আদায় না করলে স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকতে হবে, পেতে হবে সাজা। এ ব্যাপারে হাদিসে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে মোহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু মোহরানা আদায় করার তার ইচ্ছে নেই, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে জিনাকারী-ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে’ (মুসনাদে আহমদ)। এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পাঁচ ব্যক্তির ওপর আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যম্ভাবী। তিনি ইচ্ছে করলে দুনিয়াতেই তাদের ওপর তা কার্যকর করবেন, নচেত্ আখেরাতে কার্যকর করবেন (এর মধ্যে এক ব্যক্তি হচ্ছেন)—যে ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীকে মোহরানার থেকে বঞ্চিত করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায়। স্ত্রীর মোহরানার টাকা পরিশোধ করা কত জরুরি তা যেমনি স্বামীদের ভাবতে হবে, তেমনি হবু স্বামীদের সামর্থ্যের মধ্যেই মোহরানা নির্ধারণে সচেষ্ট হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিয়েশাদী সম্পন্ন হয় ধর্মের আলোকে, কোরআন-হাদিস অনুযায়ী। অথচ মোহরানা নির্ধারণে বাপরিশোধে শরয়ী নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা ঈমানদার ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য কাম্য ও শোভনীয় নয়। দাম্পত্য জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য এবং পরকালীন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থেকে বাঁচার জন্য মুসলমান হিসেবে বিবাহ, বিবাহে করণীয় ও বর্জনীয় এবং মোহরসংক্রান্ত নিয়মনীতি আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে। এক্ষেত্রে বর-কনেসহ অভিভাবকদের, বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে মায়েদের সচেতনতা আদর্শ পরিবার গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে নিঃসন্দেহে। নারীদের নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, কথাবার্তা বলেন, লেখালেখি করেন, তারা যদি স্ত্রীদের ইসলাম ধর্মের দেয়া স্বামীদের মোহরানার ব্যাপারেও সোচ্চার হতেন, লেখালেখি করতেন তাহলে কতই না ভালো হতো! আমরা জানি, ঋণখেলাপিসহ বিভিন্ন খেলাপিদের দুনিয়ার কাঠগড়ায় আসামি হতে হয়। মোহরানা খেলাপিরা দুনিয়ার কাঠগড়ায় আসামি না হলেও (তবে বিবেকের কাঠগড়ায় অবশ্যই আসামি কিন্তু!) আখিরাতের কাঠগড়ায় আসামি হতেই হবে। স্ত্রীর মোহরানার অর্থ আদায় করা স্বামীর ওপর যেমন অবশ্য কর্তব্য, তেমনি তা ইবাদতও মনে করে আসুন, বিবাহিতরা স্ত্রীর মোহরানা না দিয়ে থাকলে তা এক্ষুনি দিয়ে দিই আর বিবাহে ইচ্ছুকরা আগে-ভাগেই মোহরানার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করি এবং প্রস্তুতি নেই আর অন্যদেরও মোহরানার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন
বিষয়: বিবিধ
১০৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন