পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

লিখেছেন লিখেছেন পার্বত্যনিউজ ২৯ জুন, ২০১৩, ০২:১৮:৪৪ দুপুর

মে হে দী হা সা ন প লা শ

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলেই সমতলের অনেক বিজ্ঞজনকে বলতে শোনা যায়, ওটা তো পাহাড়িদের এলাকা। ওখানে বাঙালি নেয়া হলো কেন? বাঙালিরাই ওখানে যত সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং এ কারণে তারা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও দায়ী করে থাকেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যার মূলে কি বাঙালিরা? প্রেসিডেন্ট জিয়াই কি একা বাঙালি পুনর্বাসনের ‘অপরাধ’ করেছেন?

আলোচনার প্রথমেই একটি কথা বলা প্রয়োজন, বাঙালিরা ‘তাড়া খেয়ে’, ‘পালিয়ে’, ‘যাযাবর হয়ে’ বা কারো ‘দয়ায়’ পার্বত্য চট্টগ্রামে যায়নি। কারণ, বাঙালিদের জীবনধারণের উপযোগী স্থান সেটি নয়। কাজেই স্বেচ্ছায় তাদের সেখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও আদিকাল থেকে সেখানে বাঙালীদের যাতায়াত ও বসবাস ছিল। অত:পর বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটাতেই বাঙালিরা সেখানে বসবাস করতে গিয়েছে। গিয়ে মশা, ম্যালেরিয়া ও সাপের কামড়ে, শান্তিবাহিনীর আক্রমণে অনেকেই জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। পাহাড়কে আবাদ করেছে, মানুষের বাসযোগ্য করেছে, পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করেছে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছে। বাঙালিরা যদি এই ত্যাগ স্বীকার করে সেখানে না যেতো, না থাকতো তা হলে কি হতো?

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দীন সংসদে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বাংলাদেশের এই অংশ বহু পূর্বেই হাতছাড়া হয়ে যেত। শুধু এরা দু’জনই নন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের আরো অনেকে এ কথা বলেছেন। কাজেই এ কথা পরিষ্কার যে, বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন, অবস্থান ও আত্মদান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রিয় সার্বভৌমত্বের স্বার্থে।

ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে প্রাচীন মানচিত্র সেখানে বাঙালিরা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বসবাস করতো। এর বাইরেও মোগল আমলে, ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের সেখানে গমনের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে ১৯০০ সালের শাসন বিধি পাস হওয়ার পর বাঙালিদের আর সেখানে গিয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ছিল না। পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা বিশেষ করে কাপ্তাই বাঁধের কাজ করার জন্য প্রচুর সংখ্যক সেনা সদস্যও বাঙালিকে সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তো মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মুখের উপর তাদের দাবিনামা ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘লারমা বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। তোরা কি মনে করেছিস, তোদের সংখ্যা ৪-৫ লাখ। প্রয়োজনে পনেরো, বিশ লাখ বাঙালি পাঠিয়ে তোদের উচ্ছেদ করে দেবো। …তোরা সব বাঙালি হয়ে যা।’ দলিলপত্র ঘাটলে দেখা যায়, পাকিস্তান আমলের মতো করে সেসময়ও বাঙালি ও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিল।

কিন্তু পার্থক্য এই যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় তা ব্যাপকভাবে হয়েছিল এবং জিয়াউর রহমানকেও সেটা করতে হয়েছিল রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের অভ্যন্তরে শান্তিবাহিনীর প্রশ্রয় ও মদদ বৃদ্ধি করেন। নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তিশালী হয়ে শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জেরালো যুদ্ধ শুরু করে। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন ভারত ভাগ হয় তখন পার্বত্য প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে পতাকা বেশ কিছুদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উড়েছিল। ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ রেয়োদাদ রায় প্রকাশিত হবার পর ২১ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিফের রায়ের পরও পাহাড়িরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল রায়ের বিরুদ্ধে। সেই বিশেষ প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ইতিহাসের এ ঘটনাবলী বিবেচনায় না নিয়ে উপায় ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়েই জিয়াউর রহমানকে অতিরিক্ত সৈন্য ও বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রেরণ করতে হয়েছিল।

এছাড়াও জিয়াউর রহমান এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৭৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে সেখানে যোগাযোগসহ বিভিন্ন সেক্টরে বিপুল উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করেন। কিন্তু পাহাড়িরা এই কাজে অভ্যস্ত বা অভিজ্ঞ ছিল না। ফলে উন্নয়ন কাজ সমাধা করার জন্য বাঙালি প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও শ্রমিক প্রয়োজন হয়। শ্রমিকদের পক্ষে গহীন পাহাড় অরণ্যে কাজ করে দিনে দিনে ফিরে আসা সম্ভব ছিলনা। ফলে নিকটবর্তী স্থানে তাদের বসতি গড়তে হয়। কোনো পাহাড়ি শ্রমিক সরকারের কাজে সহায়তা করতে চাইলেও পারতো না শান্তিবাহিনীর হুমকির মুখে। কারণ পাহাড়িরা সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বিরোধী ছিল।

অনেক ক্ষেত্রেই সে পরিস্থিতি আজো বদলায়নি। সন্তু লারমা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকা-ের বিরোধিতা করছেন। বাঙালি ছাত্র ও শিক্ষকরা পড়তে যাবে এই ভয়েই তার এ বাধা। এখনো সরকারি উন্নয়ন কর্মকা-ে কিছু পাহাড়ি ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার পাওয়া গেলেও শ্রমিকদের অধিকাংশই বাঙালি। বাঙালি শ্রমিক ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। কাজেই আজকে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য দেখে দেশি বিদেশি পর্যটকরা মুগ্ধ হন তার পেছনে রয়েছে বাঙালির শ্রম, ঘাম, রক্ত ও আত্মদান। এখানেই শেষ নয়; শিক্ষা, বৃক্ষরোপণ, উন্নত চাষাবাদ ও নাগরিক জীবনের অভিজ্ঞতাও পাহাড়িরা পেয়েছে বাঙালির কাছ থেকেই।

সরকার যদি বাঙালিদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনে তাতে বাঙালিদের ক্ষতি সামান্যই। কারণ সরকারকেই তাদের সকল সুবিধা ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমতলে পুনর্বাসন করতে হবে। কিন্তু পাহাড় থেকে যদি বাঙালিরা চলে আসে, তাহলে সেখানে সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকা- থেমে যাবে। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ‘জুম্ম’ নামক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিদার সন্ত্রাসীদের হাতে। কাজেই বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান তাদের নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে নয়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনেÑ একথা যারা বুঝতে চান না তাদের দেশপ্রেমিক বলার খুব বেশি সুযোগ নেই।

যাইহোক, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও চেষ্টা করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধান করতে। ১৯৭৭ সালে তিনি ট্রাইবাল কনভেনশন গঠন করেছিলেন। তিনি এমএন লারমা ও সন্তু লারমার ভগ্নীপতি ও সংসদ সদস্য উপেন্দ্রলাল চাকমাকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করেছিলেন জনসংহতির সাথে আলোচনার জন্য। তিনি রাঙামাটিতে এ নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনাও করেছিলেন। শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও বন্দি সন্তু লারমাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। কিন্তু মুক্ত সন্তু লারমা শান্তির পথে না গিয়ে মুক্তি পেয়েই ভারতে পালিয়ে যান এবং সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের উপর আক্রমণ শুরু করেন। ফলে জিয়াউর রহমানের আমলে শান্তির সুবর্ণ সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়াই যথেষ্ট। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে শহীদ হন আর পরের মাসে ২০ হাজার পাহাড়ি ভারতে চলে যায় বলে অভিযোগ করা হয়। অর্থাৎ সাধারণ পাহাড়িদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ভারত পার্বত্য সমস্যাটির আন্তর্জাতিককীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে প্রয়োজন হয় শরণার্থীর। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিবাহিনী আরো আক্রমণ শুরু করে পাহাড়ি ও বাঙালি গ্রামগুলোতে। শান্তিবাহিনী পাহাড়িদের ভারতে শরণার্থী হয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। যারা যেতে রাজি হয়নি তাদের পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে এমনভাবে হামলা করে যাতে বাঙালিরা পাল্টা আঘাত দিতে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে হামলা চালাতে বাধ্য হয়। এভাবেই শান্তিবাহিনী নিরীহ পাহাড়িদের ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করে।

শান্তিবাহিনীর এ প্রক্রিয়া রোধ করতেই এরশাদ সরকার গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টি করে নিরাপত্তার আওতায় বাঙালি ও পাহাড়িদের নিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়ায় বাঙালিদের জন্য ১০৯টি গুচ্ছগ্রামে ৩১ হাজার ৬২০ পরিবারের এক লাখ ৩৬ হাজার ২৫৭ ব্যক্তিকে জায়গা-জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। এতে বাঙালিরা নিরাপত্তা পেলেও সরকার প্রদত্ত তাদের বসত ভিটা ও চাষের জমি হারাতে হয়। সেই আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাঙালিরা আর তাদের সেই বসত ভিটা ও আবাদী জমি ফেরত পায়নি। প্রতিবছর খাজনা দিয়ে ডিসি অফিসের খাতায় জমির দখল সত্ত্ব বহাল রাখলেও তাতে বসত করা, আবাদ করা সম্ভব হয় না। কারণ জমিতে চাষাবাদে গেলেই পাহাড়িরা তাদের উপর হামলা করে। পাহাড়ীদের মতে, পাহাড়ের সকল জমিই তাদের। বাঙালীদের অনেক জমি পাহাড়িরা দখল করে নিয়েছে। কোনো জমি দখল করে উঠেছে বৌদ্ধদের কিয়াং- যা সরানোর ক্ষমতা বাঙালি তো দূরের কথা রাষ্ট্রের পক্ষে দুঃসাধ্য। কারণ সে দিকে চোখ দিলেই ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, থাইল্যা-, বার্মা, ই-িয়াতে মিছিল শুরু হয়ে যাবে সাথে সাথে। বাঙালিদের ভূমিহীন করার কৌশল হিসাবে তাদের জমির খাজনা আবার পাহাড়ি হেডম্যানরা নেয় না, ডিসি অফিসে দিতে হয়।

এরশাদ সরকার শান্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষাকল্পে গুচ্ছগ্রামের আদলে চাকমাদের জন্য ১৬টি শান্তিগ্রাম ও মারমা, ত্রিপুরাদের জন্য ৮০টি বড়গ্রাম স্থাপন করেছিল। কিন্তু শান্তিবাহিনীর অব্যাহত হুমকির মুখে সেসব গ্রামের উপজাতীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ভারতে শরণার্থী হয়ে যেতে বাধ্য হয়, অন্যদের কেউ অন্যত্র, কেউ নিজ জমিতে ফিরে বসতি স্থাপন করে। তবে রেশন দেবার দিন এসে রেশন গ্রহণ করতো বহুদিন। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা মালয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। সেই মডেল থেকেই এরশাদ সরকার গুচ্ছগ্রামের ধারণা নিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

গুচ্ছগ্রামে সরকার পরিবার প্রতি একটি ২০ ফুট বাই ২০ ফুট ঘর, মাসিক ৮৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তারপর থেকে সেই পরিবার ভেঙে পুত্র ও নাতির পরিবার হয়েছে। ঘর ও রেশন সেই একই রয়ে গেছে। এখন ৮৫ কেজি চালের পরিবর্তে ৩০ কেজি চাল ও ৫৫ কেজি গম দেয়া হয়। তাও আবার ৩ মাস পরপর। গুচ্ছগ্রামের ২০ ফিট বাই ২০ ফিট ঘরের মধ্যে বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ, জামাই, নাতিদের নিয়ে একসাথে জেলখানার ‘ইলিশ ফাইলের’ মতো করে বসবাস করে বাঙালিরা। এরমধ্যে আবার বাঁধা থাকে গবাদি পশু। বাইরে রাখলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দ্বারা চুরি হবার ভয়ে ঐ ছোট্ট ঘরের মধ্যেই রাখতে হয় তাদের।

gussagram 1

বসতবাড়ি ও ভিটার জমিতে খাজনা দিয়েও তাদের এই মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। পরিবার যতোই আলাদা হোক ৮৫ কেজি চাল/গমের বরাদ্দ ও কার্ড সংখ্যা এখনো শুরুর দিনের মতোই। জরুরি প্রয়োজনে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা কারো কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কার্ড বন্ধকি রেখে টাকা নেয়। ফলে ঐ সময় কার্ডের রেশন সুবিধা গ্রহণ করে কার্ড বহনকারী। সেই দিনগুলো ঐ পরিবারের কাটে অমানবিক কষ্টে। শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য- জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর নূন্যতম উপস্থিতি নেই গুচ্ছগ্রামে।

প্রতি মাসেই একাধিক আন্তর্জাতিক টিম পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের কথা শোনার কোনো আগ্রহ নেই তাদের। এমনকি সক্রিয় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও মিশনারী সংস্থাগুলোরও গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পাহাড়িদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, ও অর্থ নিয়ে ঘুরছে ইউএনডিপি, এমএসএফ, ড্যানিডা, ডিএফএইডি প্রভৃতি। কিন্তু গুচ্ছ গ্রামের বাঙালিদের নিয়ে কোনো প্রকল্প করলে অর্থ দেয় না কোনো দাতা সংস্থা বা এনজিও। অর্থ পেলেও এমন এনজিও’র রেজিস্ট্রেশন দেয় না আঞ্চলিক পরিষদ। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে পাতার পর পাতা ভরে পাহাড়িদের দুঃখ কষ্টের কথা লেখা হলেও তার একটি শব্দও খরচ হয় না গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের জন্য। তারা যেন মানুষ নয়, তাদের যেন কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই। তবে হ্যাঁ, যদি তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়, তাহলে প্রচুর টাকা মিলবে সে ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে এইসব মতলববাজ, একচোখা ও চক্রান্তকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কারণ তাতে তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হবে।

শুধু বিদেশিদের দোষ দিয়ে কি লাভ! পার্বত্য বাঙালিদের জন্য বিমাতাসুলভ আচরণে পিছিয়ে নেই সরকারও। যে সরকার নিজের প্রয়োজনে একদিন সমতল থকে বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ে পুনর্বাসন করেছিল, আজ সেই সরকারই তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।

সমতলের বাঙালীরা খুব খুশী মনে সেখানে যায়নি। কারণ পাহাড়ের জলবায়ু, ভূমিরূপ ও ফুড চেইন তাদের বসবাসের জন্য উপযোগী নয়। পাহাড়ীদের খাবার তাদের বাসস্থানের পাশের পাহাড়ের জঙ্গলের লতা পাতা, পশুপাখি, পোকামাকড়ে চলে যায়। কিন্তু বাঙালীরা তো এমন খাবারে অভ্যস্ত নয়। কাজেই সমতলের বাঙালীদের পূনর্বাসনের পর প্রথমদিকে পাহাড়ে বসবাস কতোটা কষ্টষাধ্য ছিল তা বিবেকবান মানুষমাত্রই অনুধাবন করবেন। তবু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা সেখানে থেকে গেছে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রই যখন তাদের জাতীয় পরিচিতি কেড়ে নিল, তখন পাহাড়ের বাঙালীরা প্রকৃতপক্ষে নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ল। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের ‘বাঙালী’ পরিচয় মুছে দিয়ে অদ্ভুত নতুন এক পরিচয়ে লিখল ‘অউপজাতীয়’। এ পরিচয়ে পাহাড়ে তারা অচ্ছুৎ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। আরো বিস্ময়ের কথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৪ বছর সংগ্রাম করে যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদের বাঙালি হতে বলেছিলেন, তার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পার্বত্য বাঙালিদের ‘বাঙালি’ পরিচয়ের অপমৃত্যু ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলো থেকে তাদের পরিচয় কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন এই অজুহাতে ৪২ বছর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে হাজার দশেক পাহাড়ি সন্ত্রাসী। কিন্তু বাঙালিত্ব হারিয়ে বাঙালিরা বেদনায় মূহ্যমান হলেও পাহাড়িদের মতো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। তারপরও বাঙালিদের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ এতোটুকু কমেনি।

পাহাড়ে ব্যবসা করতে গেলে বাঙালিদের কর দিতে হয়, উপজাতিদের দিতে হয় না। উপজাতিদের ব্যাংকের সুদ ৫%, বাঙালিদের ১৬%। দুই লাখ টাকার নিচের ঠিকাদারী ব্যবসা একচেটিয়া পাহাড়িদের, তার উপরের কাজগুলোরও ১০% পাহাড়িদের জন্য নির্ধারিত। বাকি ৯০ ভাগ ওপেন টেন্ডারে করা হয়। পাহাড়ে এসআই পর্যন্ত পুলিশের সকল চাকরির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। জাতীয়ভাবেও চাকুরীতে ৫% কোটা তাদের জন্য। বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে একই অবস্থা। বাংলাদেশের খ্যাতনামা এনজিও ও বিদেশি দূতাবাসগুলোতে চাকরির ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে অগ্রাধিকার। একজন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ডাবল জিপিএ ফাইভ পেয়েও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে এ বা তার নিচের গ্রেড পেয়ে পাহাড়িরা বুয়েট-মেডিক্যালে চান্স পাচ্ছে। নানা সুবিধায় ওদের জন্য বিদেশে শিক্ষা ও চাকরির দ্বার অবারিত। কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালি শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে অর্ধেক বই পড়ে, বাকি অর্ধেক বইয়ের সরকারি বরাদ্দ নেই। মাদ্রাসা/স্কুলের বেতন দিতে হয় রেশনের চাল/গম থেকে। পাহাড়ের সরকারি চাকরি পাহাড়িদের একচেটিয়া অধিকার। পার্বত্য বাঙালিদের বঞ্চনার কথা লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের মুখে পাহাড়িদের পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের পুনর্বাসনে কোনো কথা শোনা যায় না কারো মুখে। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখভালের জন্য একটা মন্ত্রণালয় করেছে। তারাও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী পাহাড়িদের পুনর্বাসনে গলদঘর্ম। কিন্তু দেশের স্বার্থে আত্মদানকারী বাঙালিদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নেই সেখানে। উল্টো ভূমি কমিশনের নামে এমন এক ব্যবস্থা চালু করেছে যাতে বাঙালিরা পাহাড় ছেড়ে একবারে চলে আসতে বাধ্য হয়। গত ২৫ বছরে গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের আবাদী জমি, বসতভিটা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখা যায়নি। এমনকি তাদের মানবিক ও মৌলিক জীবন যাপনের সুবিধা নিশ্চিত করতেও কেউ এগিয়ে আসেনি।

পার্বত্য বাঙালিদের এই বঞ্চনার কথা সমতলের বাঙালি তথা দেশবাসী খুব সামান্যই জানে। ফলে জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের বঞ্চনার কথা বলা হয় না। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্বত্য বাঙালিদের ঠাঁই হয় না। এমনকি স্থানীয় কমিটির উচ্চপদে তার ঠাঁই খুব বেশী হয়না। এমনকি যে জিয়াউর রহমানের আহ্বানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়েছিল বাঙালিরা, সেই জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন পার্বত্য জেলার ৫ জন নেতা ঠাঁই পেলেও তার একজনও বাঙালি নয়। ফলে বাঙালির স্বার্থে অন্যদলগুলোতো বটেই বিএনপির বাঙালি নেতারাও কথা বলতে পারে না সিনিয়রদের চাপে। ঢাকায় পার্বত্য বাঙালিদের সেমিনারে কোনো বিএনপি নেতা আসতে ভয় পান এজন্য যে, পাহাড়ি নেতারা এসে যদি তার বিরুদ্ধে নেত্রীর কাছে নালিশ করে। যদিও খুব সামান্য পাহাড়িরাই বিএনপিতে ভোট দেয়।

সমতলের ‘রাজাকারদের’ গাড়িতে পতাকা তোলা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আমৃত্যু রাজাকারের পুত্রের গাড়িতে পতাকা উঠেছে, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী, বাঙালি ও সেনাবাহিনী হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের গাড়িতে পতাকা উড়েছে, তা নিয়ে কোনো কথা বলা হয় না।

দু’একটি গণমাধ্যম ছাড়া দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম বাঙালীদেরকে পার্বত্যাঞ্চলের আপদ বলেই ভাবে। বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগ অংশই বিদেশ সফর, ‘সুশীল’ খাতায় নাম তোলার প্রয়োজনে ও টুয়েসডে, থার্সডে পার্টিতে নিমন্ত্রণ হারানোর ভয়ে বাঙালির পক্ষে কথা বলতে নারাজ। বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত একজন রাজনীতিক ও কলামিস্ট আমাকে একবার বলেছিলেন, একটি জাতীয় সেমিনারে পার্বত্য বাঙালিদের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বাসায় ফেরার সাথে সাথে একটি প্রভাবশালী পাশ্চাত্য দেশের দূতাবাস থেকে তার কাছে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় তিনি বাঙালিদের পক্ষে ঐ সেমিনারে কোনো কথা বলেছিলেন কিনা?

বাঙালিদের বিরুদ্ধে লিখলে সাংবাদিকদের বিদেশ সফরসহ নানা সুবিধা মেলে সেখানে, পক্ষে লিখলে ততোটাই অবহেলা ও ঝুঁকির শিকার হতে হয়। সেখানে দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রমোশন ও বিদেশে পোস্টিং মেলে না বাঙালি ঘেঁষা হলে। এক কথায় যে রাষ্ট্রের স্বার্থে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান সেই রাষ্ট্র তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

পার্বত্য বাঙালিরা শুধু রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নয়, এখনো নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অবস্থানের জন্য। অনেকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে না চাইলেও এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও সেনাবাহিনী একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে যেমন বাঙালির অবস্থান অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি বাঙালি না থাকলে সেনাবাহিনীর অবস্থান কষ্টসাধ্য। বাঙালিরা সেখানে সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত একটি ডিফেন্স লাইন তৈরি করেছে- যার গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত জোট সরকারের আমলে বাঙালী নেতা ওয়াদুদ ভুঁইয়া উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবে কিছু বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, বিশেষ করে প্রধান সড়কের বিশেষ বিশেষ স্থানে বসতির অনুমতি দেয়া হয়। এতে করে পার্বত্য অধিবাসী, সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী ও পর্যটকদের উপর অতর্কিত হামলা (এমবুশ), অপহরণ অনেকাংশে হ্রাস পায়।

তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী কিছু বাঙালি আমাকে বহুবার এ কথা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে ‘সন্তুবাহিনী’ হয় আমাদের কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করে মিলে মিশে থাকবে, না হয় ভারতে পালাবে। সম্প্রতিকালে ক্রমাগত সরকার, দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলোর বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক কর্মকা-ের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠী। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অত্যাচার, উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বাঙালি বিদ্বেষমূলক কর্মকা- এবং সেই সাথে সরকার, এনজিও ও দাতা সংস্থারগুলোর একপেশে নীতির কারণে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সহিংস প্রতিবাদের দিকে এগুচ্ছে। উল্লিখিত উক্তিটি তাদের সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

বিষয়: বিবিধ

২২৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File