পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

লিখেছেন লিখেছেন পার্বত্যনিউজ ২২ জুন, ২০১৩, ০৬:২৬:০২ সন্ধ্যা

মেহেদী হাসান পলাশ

গত ১৬ জুন পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনী-২০১৩ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা। বিলটি উপস্থাপনের আগে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিলের উপর আপত্তি দিয়ে বিলটি সংসদে উপস্থাপন না করার জন্য স্পিকারকে অনুরোধ করেন। সংসদ সদস্যের আপত্তির মুখে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বিলটি কণ্ঠ ভোটে দেন। বিলটিতে সরকার দলীয় সংসদীয় সদস্যরা হ্যাঁ ভোট ও বিরোধী দলীয় জোট সদস্যরা না ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হ্যাঁ ভোট জয়যুক্ত হলে বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেন ভূমিমন্ত্রী।

বিলটি উপস্থাপনের পর বিলটি পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ৭দিন পর সংসদে উপস্থাপনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরনের জন্য স্পিকার কণ্ঠভোটে দেন। বিরোধী দলীয় সদস্যরা না ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে প্রেরিত হয়। সে হিসাবে আগামী ২৩ জুন সংসদে পরীক্ষিত বিলটি চুড়ান্তভাবে পাশের জন্য উপস্থাপিত হওয়ার কথা।

১৭৫৭ সালের এই ২৩ জুনে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। ২৫৫ বছর পর আরেক ২৩ জুনে পার্বত্য বাঙালীর ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। শুধু বাঙালীর নয় বাংলাদেশের ভাগ্যও হয়তো এ দিনেই লেখা হতে পারে। কারণ এই সংশোধনী প্রস্তাবে এমন কিছু ধারা রয়েছে যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

পার্বত্য চুক্তির ঘ খন্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল চলিবেনা’। অন্যদিকে ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে,‘ উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে এবং একই সাথে তা সংবিধান বিরোধী। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার খণ্ডে ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’ কিন্তু পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশন আইনের ফলে সেখানকার অধিবাসীরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করতে পারবেন না। কমিশন ও এর আইন উপজাতি ঘেঁষা হওয়ায় সেখানে বৈষম্যের শিকার হবেন পার্বত্য বাঙালীরা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেনা।’ কিন্তু কমিশনে সদস্য, সচিব ও কর্মচারী নিয়োগের বেলায় এই বৈষম্য প্রকটাকারে পরিদৃষ্ট।

এখানে কেউ কেউ হয়তো সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ, ২৯(৩)(ক) ধারা উল্লেখ করে ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের’ জন্য সংবিধানের উল্লিখিত ধারার বিশেষ রেয়াতের সুবিধা নিতে চাইবেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের’ মধ্যে ৮৭% শিক্ষিত চাকমারা পড়েন কিনা তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে। একই সাথে যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার পার্বত্য বাঙালীরা কোন বিবেচনায় ‘অগ্রসর’ জনগোষ্ঠীভুক্ত হলেন তাও রাষ্ট্রকে তদন্ত করে দেখতে হবে। কারণ, শিক্ষাদীক্ষা, চাকুরী ও অবস্থানগত সুবিধার কারণে শুধু বাঙালী নয় উপজাতীয় অন্যসকল গোত্র শোষিত হচ্ছে চাকমাদের দ্বারা। পার্বত্যাঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাকিতভাবে বরাদ্দকৃত কোটাসহ সকল প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করছে চাকমা জনগোষ্ঠী। পারফেক্টলি বললে বলতে হয়, চাকমা সমাজের কয়েকটি গোত্র মাত্র। অন্যসকল উপজাতি এ সুবিধার সামান্যই ভোগ করতে পারে।

একইভাবে পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশনের উল্লিখিত ধারা বাংলাদেশ হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ারকে খর্ব করে। সংবিধানের ১০১, ১০২(২) এর উপধারা (অ), (আ), ও ১০৯ ধারার সাথে তা সরাসরি সাংঘর্ষিক।

শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডে ৪ নং ধারায় কেবলমাত্র ‘ পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি’র কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভূমি কমিশন আইনের ৬(ক) ধারায়ও ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’র কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি ও আইন অনুযায়ী কেবল পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করাই এ কমিশনের দায়িত্ব। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। কাজেই বাঙালীদের কোনো কোনো সংগঠন তাদের দাবীতে ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে বাঙালী সদস্য রাখার যে দাবী তুলছে তা, হয় আইন না জানা কিংবা না বোঝার ফল অথবা আপসকামিতার দৃষ্টান্ত। ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে কেন, সকল সদস্যই বাঙালী হলেও তাতে বাঙালীদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই যদি বিদ্যমান আইন বহাল থাকে। অর্থাৎ কমিশন সদস্যরা বিচার করবেন যে আইনে, সে আইন যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙালী ও দেশের স্বার্থের অনুকূল না হবে, সে পর্যন্ত এই কমিশন বাঙালীর স্বার্থ বিরোধী হয়েই থাকবে। অন্য কথায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’ উপজাতীয়দের ‘ঐতিহ্য’ ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ অনুযায়ী বিচার পরিচালিত হলে কমিশনের সদস্য বাঙালী হলেও তাদের কিছুই করার থাকবে না। কারণ বিচার আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

বিস্তারিত

http://parbattanews.com/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%9A%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BE-2/#.UcVjStjqqZQ

বিষয়: বিবিধ

৮৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File