ফিলিস্তিন ও যায়নবাদ প্রসঙ্গ : একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা সংকলন : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা (মুল লেখকের আনুমতিক্রমে সংকলিত)
লিখেছেন লিখেছেন সত্যবাক১৯৭৯ ৩১ জুলাই, ২০১৩, ০৮:২০:১০ রাত
ভুমিকা
ফিলিস্তিন ইস্যুটি বর্তমান মানব বিশ্বের অন্যতম একটি বিষাদঘন ইস্যু। মানব ও মানবাধিকার সম্পর্কে যার সামান্যতম অনুভূতি রয়েছে এবং নিজেকে নিপীড়িত মানুষদের পক্ষে বলে মনে করে, এ ইস্যুতে তার নির্লিপ্ত থাকার অবকাশ নেই; বরং এর সাথে নিজের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করা উচিত। কেননা, ফিলিস্তিনের দুঃখ-দুর্দশা ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া দুরূহ, যেখানে একটি জাতি এভাবে প্রায় অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল যাবৎ বিশ্ববাসীর চোখের সামনে নিদারুণভাবে নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়ে চলেছে। অথচ নিপীড়ক জাতি বিশ্বের সমর্থন ও মদদপুষ্ট হয়েছে, আর নিপীড়িত জাতি চিহ্নিত হয়েছে সন্ত্রাসী হিসাবে! হেন অত্যাচার, নিপীড়ন ও নৃশংসতা বাকি নেই যা ফিলিস্তিন জাতির ওপর চালানো হয়নি- নিরীহ-নিরপরাধ জনগণকে হত্যা, নিজের ঘরবাড়ি ও বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করে চিরকালের জন্য উদ্বাস্তু করে দেওয়া, নির্যাতন, বন্দি, নির্বাসন, শিশু ও নারী হত্যা, লুণ্ঠন, অবরোধ, মৌলিক অধিকার হরণ, সহায় সম্পদ বিনাশ, কণ্ঠরোধ, অবাধ চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি ইত্যাদি। অবর্ণনীয় ও চরম অমানবিক নৃশংসতা যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক। অথচ এগুলোর কোন একটি নৃশংসতার ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ক্ষেত্রে একবার সংঘটিত হলেই তা বিশ্বকে প্রকম্পিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজ ষাট বছরেরও অধিক কাল ধরে ফিলিস্তিন জাতির ওপর এ ধরনের নৃশংসতা অবলীলায় ঘটে চলেছে, অথচ এজন্য কোন দুঃখ নেই, নেই কোন প্রতিক্রিয়া। তবে কি ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ও ফিলিস্তিনি জাতির অপরাধ একটাই? আর তা হচ্ছে ভৌগোলিক বিচারে তারা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে- যা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের গ্রাস করা চাই-ই চাই, যে কোন মূল্যে ও যে কোন নৃশংসতায়? তাহলে প্রশ্ন হলো এ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের স্বরূপ কী?
যায়নবাদ হচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ সক্রিয় চক্রের নাম যারা বিগত শতকে তাদের কার্যক্রমের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা অনুসারে প্রতিদিন বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের চিন্তা-চেতনা, এমনকি অনেক বিজ্ঞ লোকেরও এ চক্রের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে যথাযথ পরিচয় না থাকার কারণে প্রায়শই এ বিষয়টি ইসরাইল ইস্যুর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ ইসরাইল প্রসঙ্গটি হচ্ছে যায়নবাদের ব্যাপকভিত্তিক মহাপরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। তাই এ প্রবন্ধে বিশ্ব যায়নবাদের উৎপত্তির প্রেক্ষিত এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ইতিহাসভিত্তিক একটি পর্যালোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
ইহুদিদের ইউরোপে আগমন
ইউরোপ হচ্ছে যায়নবাদের উৎপত্তি স্থল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর আবির্ভাবের পরে এবং ইহুদিগণ কর্তৃক তাঁর ঐশী মর্যাদার প্রতি অবমাননা করার পর রোমান সম্রাট ফিলিস্তিনে আক্রমণ করেন। তিনি আক্রমণ চালিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে নেন এবং অসংখ্য ইহুদিকে হত্যা ও বন্দি করেন। বিজয়ী সৈন্যরা বন্দিদেরকে নিজেদের সঙ্গে রোমে নিয়ে যায়। আর এ ঘটনাই সর্বপ্রথম ইউরোপে ইহুদি জনগোষ্ঠীর পদার্পণের পথ খোলার কারণ হয়। পরবর্তীকালে তাদের বংশবৃদ্ধি ও এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরের ফলে সমগ্র ইউরোপে ইহুদি জাতি ছড়িয়ে পড়ে।
খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকে কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী (অর্থাৎ সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ রাশিয়া) অঞ্চলের জনগণ ইহুদি হয়ে যায়। এরা ‘তুর্কী-কাস্পিয়ান’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা ও অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনগোষ্ঠীই এদেরই বংশধর। ইহুদিরা প্রথম থেকেই বিভিন্ন পেশা, যেমন কারিগরি, বাণিজ্য (বিশেষ করে বয়নকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে), জুয়েলারি এবং আরো পরে এসে মুদ্রা বিনিময় ও ব্যাংকিং এর ন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। ইউরোপে বসবাসকালে ইহুদিরা সবসময় এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিক ও সম্পূর্ণরূপে রক্ষণশীল এক পরিবেশে জীবনযাপন করত। এটাই তাদের অন্য কোন জাতির সাথে মিশে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয় এবং তাদের স্বতন্ত্র একটি জাতিসত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
ইহুদিদের সম্পর্কে ইউরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাসের পাতা উল্টালে প্রমাণ মেলে যে, ইউরোপীয় জাতিগুলো কখনোই ইহুদিদের প্রতি ইতিবাচক দষ্টিভঙ্গি পোষণ করত না; বরং কতিপয় কারণে ইহুদি সম্প্রদায় সেখানে বরাবরই কোণঠাসা ও উপেক্ষিত ছিল। এসব কারণের অন্যতম হলো ইউরোপীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা ইহুদিদের এমন এক সম্প্রদায় বলে বিশ্বাস করত যারা তাদের নবী হযরত ঈসা মসীহকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে এবং এ ঐশী নবীর মর্যাদার প্রতি অবমাননা করেছে। তাই তাদের চোখে ইহুদি সম্প্রদায় হলো একটি বিশ্বাসঘাতক ও পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়। অপরদিকে ইহুদিদের মাঝে এমন কিছু বিশ্বাস প্রচলিত থাকা (যেমন তারা নিজেদের আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত জাতি হিসাবে গণ্য করে, অথচ তাদের মধ্যে অনেক নিকৃষ্ট ও জঘন্য কার্যকলাপ বিদ্যমান), অন্যান্য জাতিকে হীন বলে গণ্য করা, ফিতান-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, বিশ্বাসঘাতকতা করা, সুদ খাওয়া, স্বর্ণরোপ্য জমা করা ইত্যাদি কারণে তাদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আরো তীব্র আকার ধারণ করে ইহুদিদের কিছু অপকর্মের সূত্র ধরে। যেমন নগরীর পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া (যার উদাহরণ ইংল্যান্ড ও জার্মানে বিদ্যমান), অথবা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য খ্রিস্টান শিশুদের জবাই করে রক্ত সংগ্রহ ইত্যাদি। ইউরোপে আঁকাবাকা নাক ও রক্তস্নাত থাবাবিশিষ্ট বিগত শতাব্দীসমূহের ইহুদিদের ছবির উপস্থিতি সেই ইতিহাসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইহুদিদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের এহেন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি তাদের সম্পর্কেও ইহুদিদের অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি উৎপত্তি লাভ করে। যা কিছুই ইহুদিদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তার সবই খ্রিস্টানদের চোখে অসৎ ও বিশৃঙ্খল প্রতীয়মান হয়। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদিদের পক্ষ থেকে খ্রিস্টানদের প্রতিও জন্ম লাভ করে। এ বিষয়টি ক্রমে ক্রমে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাতে রূপ নিতে থাকে। কিছু কিছু ইউরোপীয় সরকার খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতক থেকে ইহুদিদেরকে তাদের পোশাকে বিশেষ এক চিহ্ন ব্যবহার করার নির্দেশ জারি করে, যাতে তাদেরকে অন্যদের মধ্য থেকে চেনা যায়। বিভিন্ন সময়ে ইহুদিদের ওপর নানা আক্রমণের ঘটনা ঘটত। এসব আক্রমণের কোন কোনটা সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে সংঘটিত হত, আবার কোন কোন আক্রমণ সরকারের পক্ষ থেকে এবং তাদের আচরণের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হতো। এসব আক্রমণ কখনো কখনো তাদের হতাহত করা, কখনো বা বিশেষ কোন স্থানে অবরুদ্ধ করে রাখা, আবার কখনো দেশ থেকে বিতাড়ন ও নির্বাসনে প্রেরণের মাধ্যমে পরিণতি লাভ করত।
ইংল্যান্ডের সরকার ছিল তৎকালীন ইহুদিদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এরূপ অন্যতম ইউরোপীয় সরকার। তারা খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে যখন ক্রুসেডের যুদ্ধ শেষ হয়, তখন ইহুদিবিরোধী মনোভাব তীব্ররূপ ধারণ করার প্রেক্ষাপটে সেদেশ থেকে সকল ইহুদিকে বিতাড়িত করে। একই ভাবে ফ্রান্সের সরকারের নামও উল্লেখ করা যায়। তারা খ্রিস্টীয় ১৩০৬ সাল থেকে ১৩৪৯ সালের ব্যবধানে তিন দফায় ইহুদিদের বহিষ্কার করে। স্পেনেও ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের ক্ষমতাসীন হওয়ার মাধ্যমে ইহুদিদের বহিষ্কারাদেশ জারি করা হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, তৎকালীন সরকারগুলো ও তাদের জনগণ ইহুদিদের কর্মকাণ্ডের কারণে এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল যে, তারা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকে ইহুদিনিধন নয়; বরং ফিতনা-ফ্যাসাদ অপসারণ বলে মনে করত।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় কিছু ডকুমেন্ট প্রকাশিত হয়, যাতে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে ইহুদিদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিরোনামে পর্দার অন্তরালে বিপজ্জনক সব পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। ‘Protocols of Jews’ নামে খ্যাত এসব পরিকল্পনায় বিভিন্ন জাতিকে বোকা বানানো এবং তাদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদের নীতিকৌশল সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়। এসব কৌশলের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেপরোয়াবৃত্তির অবাধ প্রচলন, গণমাধ্যমসমূহ হস্তগত করা, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এসব ডকুমেন্ট প্রকাশিত হওয়া আসলে ইহুদি স্কার লুই এর সেই কথাটিই স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলে। তিনি কয়েক বছর পূর্বে বলেছিলেন : ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ফিতনা- ফ্যাসাদের জন্মদাতা আর মূর্খ জল্লাদদের রাজা আমরাই’। ফলে রুশ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধের উদ্রেক হয় এবং তারা ইহুদিদের ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে কিছুসংখ্যক ইহুদি নিহত হয়, যা পরবর্তীকালে সুবিধা হাসিলের উসিলা হিসাবে ইহুদিদের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে একটি ইস্যুতে পরিণত করা হয়।
উপরের আলোচনায় ইউরোপে ইহুদিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি ও তাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তাছাড়াও ইহুদি পণ্ডিতরাও এধরনের ইহুদিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি বা উস্কে দেওয়ার পেছনে স্বয়ং ইহুদি জনগোষ্ঠীর সন্দেহাতীত ভূমিকা ছিল বলে জোরালো মতামত দিয়ে থাকেন। বার্নার্ড লজার একজন শীর্ষস্থানীয় ইহুদি চিন্তাবিদ। তাঁর নামেই আজ একটি ইহুদি সোসাইটি ফ্রান্সে ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি ইহুদিবিরোধী চিন্তা ও মনোভাবের কারণ সম্পর্কে বলেন : ‘ইতিহাসে প্রথম থেকে অদ্যাবধি ইহুদিবিরোধী মনোভাবের কারণ ছিল এটা যে, ইহুদিরা ছিল একটি অসামাজিক শ্রেণি। ইহুদিনিধন চিন্তা প্রকাশ পাওয়ার পেছনে ধর্মীয়, জাতীয় ও অর্থনৈতিক কারণ নিহিত। ইহুদিরা সর্বত্র এবং সবসময় নিজেদের অন্যান্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।’
যদিও বর্তমানে ইহুদিরা তাদের এই ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে এবং এ কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে, তথাপি এতকাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও ইউরোপীয়দের মাঝে এখনো এ দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। আর অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রতিদিন পৈশাচিকতা পরিচালনাকারী যায়নবাদী জান্তাকে অনেক ইহুদি সমর্থন করার কারণে এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধিও পাচ্ছে। এ মর্মে ২০০১ সালে মার্কিন ইহুদি কমিটি কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল প্রণিধানযোগ্য। এ জরিপে ইউরোপের জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় যে : সে কি একজন ইহুদিকে প্রতিবেশী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি আছে? ইতালিতে ৩১ শতাংশ, অস্ট্রিয়ায় ২৬ শতাংশ, রাশিয়ায় ২৪ শতাংশ এবং জার্মানিতে ২২ শতাংশ জনগণ ‘না’বোধক উত্তর প্রদান করে। তাদের কামনা ছিল একজন ইহুদি যেন তাদের প্রতিবেশী না হয়।
যদি মনে করা হয় যে, যায়নবাদ স্বল্প সময়ের মধ্যে এবং কতিপয় ইহুদি কর্মী ও চিন্তাবিদের সংকল্প থেকেই গড়ে উঠেছে, তাহলে এটি একটি অবাস্তব ধারণা মাত্র। তদ্রূপ যদি মনে করা হয় যে, যায়নবাদীদের সমস্ত প্রচেষ্টা একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তা বাস্তবায়িত হওয়ার পর তারা ক্ষান্ত হয়েছে, তাহলে সেটাও যায়নবাদের স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকারই পরিচয় বহন করবে। বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থার একজন উদ্যোক্তা ও ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান এর যায়নবাদের স্বরূপ সম্পর্কিত উক্তিটি তুলে ধরার পর আমরা যায়নবাদী চিন্তা গঠিত হওয়ার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং এর কতিপয় সাংগঠনিক দিক ও ধারা সম্পর্কে আলোকপাত করব। তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি হলো : ‘যায়নবাদী সংস্থা ইসরাইলের সক্ষমতা ও সামর্থ্যে যা রয়েছে তার বহির্ভূত অনেক জিনিস অর্জন করতে সক্ষম। আর এটি হল যায়নবাদী সংস্থার এ রাস্ট্রটির প্রতি একটি বাড়তি অনুদান।’
যায়নবাদী চিন্তা গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতসমূহ
ইহুদি শীর্ষ নেতারা যদিও সবসময় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন তথা তাদের ভাষায় ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-তে প্রত্যাবর্তনের আবশ্যকতা সম্পর্কে নিজেদের সমাজের মাঝে প্রচারনা চালিয়ে এসেছে, কিন্তু খ্রিস্টীয় সতের শতক পর্যন্ত এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের সুনির্দিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য কোন সুসংগঠিত পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা প্রস্তুত হওয়ার সূত্র ধরে বিক্ষিপ্তভাবে এ মর্মে কানাঘুষা শোনা যেত। সম্ভবত নেপোলিয়ান বোনাপার্টের নির্দেশক্রমে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ‘ইহুদিদের উচ্চ পরিষদ’ নামক একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠাকরণ ছিল সাম্প্রতিক শতকগুলোতে ইউরোপে ইহুদিদের সর্বপ্রথম সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। The Grand Sanhedrin খ্যাত এ পরিষদ সুনির্দিষ্ট সংগঠন ও কর্মসূচিসমৃদ্ধ ছিল এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করত।
উনিশ শতকের বিখ্যাত ইহুদি চিন্তাবিদ ও সক্রিয় কর্মী Dr. Leon Pinsker তাঁর Auto-Emancipation শীর্ষক গ্রন্থে সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্টভাবে ‘যায়নবাদ’ পরিভিাষাটির প্রতি ইশারা করেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, ইহুদিদের ফিলিস্তিনে রওয়ানা হওয়ার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থেকে খ্রিস্টের অপেক্ষায় থাকা উচিত হবে না; বরং দুর্দশা লাঘবের জন্য তাদের নিজেদেরই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইহুদিদের এ মনস্কামনা বাস্তবায়ন করা এবং একটি একক ভূখণ্ডে বসবাসের ব্যবস্থা করার নিমিত্তে বিভিন্ন ইহুদি গ্রুপ গঠিত হল। Hibbat Zion তথা ‘যায়নের প্রেমিকগণ’ নামের গ্রুপটি ছিল এ ধরনের অন্যতম ও প্রসিদ্ধতম গ্রুপ। তারা ‘যায়নের অভিমুখে’ স্লোগান তুলে রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ডসহ পরবর্তীকালে আরো কতিপয় দেশে তৎপরতা চালাতে থাকে। Blau-Weiss মুভমেন্ট হলো আরেকটি ইহুদি যুব সংগঠন যারা Hibbat Zion গ্রুপের পরে উৎপত্তি লাভ করে। তারা ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফিলিস্তিনে সর্বপ্রথম ইহুদি জনপদ গড়ে তোলে। কতিপয় ইহুদি ব্যক্তি যায়নবাদী চিন্তা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Benjamin Disraeli ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন মূলত একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি। শৈশবে তাঁর পিতার ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু আজীবন তিনি যায়নবাদী চিন্তা-চেতনা লালন করতেন। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘যায়নবাদী খ্রিস্টান’ বলে আখ্যায়িত করত। তিনি ব্রিটেনের রাষ্ট্রনায়কদের অধুনা ইহুদি চিন্তাধারার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানের জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর নৈতিকতার স্বরূপ সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর এ বিখ্যাত উক্তিটিই যথেষ্ট। তিনি বলতেন : ‘বিজয় লাভের জন্য প্রতারণা, মিথ্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতা কোন পাপ নয়।’
এছাড়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ইহুদি ও ইহুদিদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব Moses Montefiore ও Asher Ginzberg প্রমুখের ন্যায় কর্মীরাও নিজেদের যায়নবাদী বিশ্বাসকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ করেন। আর এ ব্যাপারে বিখ্যাত ধনাঢ্য Rothschild পরিবারের ভূমিকাও ছিল অপরিসীম। এ পরিবারের James de Rothschild এর বিখ্যাত ইহুদি পুঁজিপতি পুত্র Edmond Rothschild যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানের কয়েক বছর পূর্বে জমি ক্রয় এবং নবাগত ইহুদিদের জন্য বসতি গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালান। তিনি এ কাজে ৭০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক স্বর্ণ বিনিয়োগ করেন এবং ফিলিস্তিনে ইদীদের জীবন যাপনের ধারণাকে বাস্তবে সম্ভব বলে তাদের চিন্তাজগতে প্রতিষ্ঠা করেন। উপরিউক্ত আলোচনায় যায়নবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে যেসব প্রেক্ষিত ভূমিকা পালন করে সেগুলোকে একত্র করে এভাবে তালিকাবদ্ধ করা যেতে পারে :
১. ফিলিস্তিন ইহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত মর্মে ইহুদি নেতাদের অবিরাম প্রচারণা।
২. ইহুদি সংস্কৃতিতে তাদের নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করার প্রবণতা- যারা অন্যদের চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং তাদের ওপর শাসন করার অধিকার রাখে। আর এ মর্মে ইহুদি কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় জোরালোভাবে গুরুত্ব আরোপ।
৩. ইতিপূর্বে উল্লিখিত কারণসমূহের ভিত্তিতে ইউরোপীয় দেশসমূহে ইহুদিদের ওপর আক্রমণ সংঘটিত হওয়া এবং এর ফলে তাদের হতাহত হওয়া ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া- যা কোন কোন ক্ষেত্রে যায়নবাদীদের সংগঠিত করে তোলে।
৪. খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে কতিপয় যায়নবাদী হোতার পক্ষ থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে অসহায় ও নিরাশ্রয় জাতি হিসাবে প্রচারনা চালানো এবং এ বিষয়টিকে অসীম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত করে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি ইহুদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহকে বাস্তবায়িত করার নিমিত্তে সংগঠিত হওয়া এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাস গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে তৎপরতা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ।
৫. ইউরোপের কিছু কিছু রাজ-দরবারে, বিশেষ করে ব্রিটেনে প্রভাবশালী ইহুদি লবি নিযুক্ত করা এবং একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ঐসকল দেশের সরকারের ইতিবাচক সাড়া আদায়।
Zionist Organization এর আনুষ্ঠানিক তৎপরতা
যায়নবাদী চিন্তা জন্মের পেছনে যেসব কারণ ও প্রেক্ষিত উল্লেখ করা হলো সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতকের শেষ বছরগুলোতে Zionist Organization উৎপত্তি লাভ করে। এ বছরগুলোতে যায়নবাদী চিন্তাধারকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাড় করা হয়েছিল। শুধু যা প্রয়োজন ছিল তা হলো এ প্রবাহকে সংগঠিত করার জন্য একটি ক্যারিশমেটিক ও কর্মতৎপর নেতৃত্ব। অস্ট্রিয়ায় একটি পত্রিকার সম্পাদক থিওডর হার্জল হলেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রীধারী থিওডর হার্জল বিশ্বাস করতেন ইহুদিরা পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করুক না কেন তারা সকলেই একই সম্প্রদায় তথা জাতির অধিভুক্ত; তারা কোনক্রমেই তাদের পাশ্ববর্তী জাতিসমূহের সাথে মিলেমিশে যেতে পারে না। হার্জল তাঁর সমচিন্তার কতিপয় ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রতিভাবান ইহুদিদের খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হন যারা দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে তাঁর নিকটবর্তী হবে। বিভিন্ন ইহুদি চিন্তাবিদের চিন্তা ও বিশ্বাস সম্পর্কে বলতে হয় যে, যায়নবাদীদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী কিছুসংখ্যক ইহুদি যায়নবাদকে (তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যামতে) ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত। আর যে সমস্ত রেওয়ায়াত ইয়াহুদ পরিত্রাতার আবির্ভাবকে ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে ইহুদিদের একত্র হওয়ার শর্ত বলে মনে করত তারা সেগুলোর প্রতিই ইশারা করত। এ দলটি ‘ধর্মীয় যায়নবাদী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আরেক দল যাদের তত্ত্বদাতা ছিলেন Asher Ginzberg যিনি - Ahad Ha'am - নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি যায়নবাদের সাংস্কৃতিক দিকের ওপরেই বেশি জোর দিতেন। এ দলটি বিশ্বাস করত যে, সকল ইহুদির ফিলিস্তিনে সমবেত হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। শুধু কতিপয় বিশিষ্ট ইহুদি নির্যাসস্বরূপ ইহুদি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়ের জন্য সুসংহতকারী হিসাবে এ ভূখণ্ডে আবাস গড়ে তুললেই চলবে। তারাই এ ভূমিকে গোটা বিশ্বের ইহুদিদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করবে। ‘সাংস্কৃতিক যায়নবাদী’ নামে খ্যাত এ দলটি তাদের এ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ইউরোপের কাছ থেকে এবং অ-ইহুদিদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের বিরোধী ছিল। তাদেরকে তারা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করত না। এতদসত্ত্বেও যে ধারাটি যায়নবাদকে নেতৃত্ব প্রদান করত এবং এর নীতিমালা নির্ধারণ করত সেটা ধর্মীয় যায়নবাদও ছিল না, আবার সাংস্কৃতিক যায়নবাদও ছিল না; বরং এর নেতৃত্ব ছিল থিওডর হার্জল এর হাতে। তিনি ও তাঁর সমমনা লোকেরা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উভয় যায়নবাদী ধারাকে হাতিয়ার হিসাবে মূল্যায়ন করতেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে নয়। আর আদতেই তাঁরা ধর্মের মূল ভিত্তি সম্পর্কে এবং ইহুদি সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন অবগতও ছিলেন না।
স্বয়ং থিওডর হার্জল যায়নবাদীদের একটি সভায় স্পষ্টতই ঘোষণা করেন যে, তিনি জানেন না ইহুদি কালচার (সংস্কৃতি) বলতে কি বোঝায়? American Jews Organization এর তৎকালীন নেতা ইয়াকুব শিফও যায়নবাদী সংস্থা প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে এ আন্দোলনের অগ্রপথিকদের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন : ‘যদি বলি যে, যারা জাতীয়তাবাদী ইহুদি নামে প্রসিদ্ধ তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোকই বে-দ্বীন ও নাস্তিক এবং ইহুদী জাতীয় আন্দোলন তথা যায়নবাদের অধিকাংশ নেতাই দ্বীন ও ধর্মের প্রতি কোন মনোযোগ ও আগ্রহ পোষণ করেন না তাহলে মনে হয় ভুল বলা হবে না।’
যাহোক প্রত্যেক ইহুদি গোষ্ঠীই তাদের নিজ নিজ ধারণা থেকে থিওডর হার্জল ও তাঁর ধারার লোকদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তিনিও তাঁর স্বতন্ত্র পরিচালনা দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ইহুদি চিন্তাবিদ ও কর্মীদলের বিক্ষিপ্ত মতামত যাতে মূল যায়নবাদী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে থিওডর হার্জল বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে ২০৪ জন শীর্ষ ইহুদি নেতাকে সুইজারলাণ্ডের বেসলে (Basle) শহরে একত্র করতে এবং প্রথম আন্তর্জাতিক যায়নবাদী সম্মেলন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হন। উক্ত সম্মেলনে তিনি একটি ইহুদি ভূখণ্ড ও রাষ্ট্র গঠনে আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আর এ কাজে যেসব ইহুদি মহল শৈথিল্য প্রদর্শন করছিল তাদের তীব্র নিন্দা জানান। বেসলে সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ছিল নিম্নরূপ :
যায়নবাদের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করা এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুন দ্বারা এর নিশ্চয়তা বিধান করা। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা আবশ্যক :
ক. ফিলিস্তিনে অভিবাসী কৃষক ও শ্রমিকদের মাধ্যমে ইহুদি বসতিসমূহের বিস্তার ঘটাতে হবে।
খ. স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিভিন্ন দেশের নিয়মকানুন অনুসারে সকল ইহুদির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে ও তাদের সংগঠিত করতে হবে।
গ. ইহুদিদের আবেগ ও জাতীয়তাবোধকে লালন পালন ও শক্তিশালী করতে হবে।
ঘ. যায়নবাদের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন সরকারের সম্মতি ও সমর্থন আদায়ের প্রাথমিক পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে।
থিওডর হার্জল এ আন্দোলনের অন্য অনেক নেতার মতের বিপরীতে গিয়ে অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সমাবেশ ও সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপের প্রভাবশালী সরকার ও মহলসমূহের সাথে লবিং করেন এবং বেসলে সম্মেলনে অনুমোদিত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। হার্জল তাঁর যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেসব রাষ্ট্রনায়কের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের মধ্যে ওসমানি শাসক আব্দুল হামিদ, ইংল্যাণ্ডের যোসেফ চেম্বারলিন ও জার্মানির ২য় উইলহাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯০৪ সালে হার্জল মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক ও প্রভাবশালী মহলের সাথে তাঁর আলোচনা যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্রিটিশদের সহযোগিতা আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। যার ফলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বেলফোর ঘোষণা’ সম্ভব হয় এবং ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন প্রদান করা হয়।
ইউরোপে যায়নবাদীদের সুবিধা পাওয়া
বেলফোর ঘোষণার পর প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, যায়নবাদীদের সমস্ত চেষ্টা কেন্দ্রিভূত হবে ইহুদিদের স্থানান্তরিত করে ফিলিস্তিনে এনে পুনর্বাসন করার মধ্যে। কারণ, ইহুদিদের জাতীয় তহবিল ও এজেন্সি এবং অন্যান্য যায়নবাদী সংস্থাও এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নেপথ্যের মূল খেলোয়াড়রা আরো উচ্চতর কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ অনুসন্ধান করতে লাগল। ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের দেশে ইহুদিদের উপস্থিতির কারণে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা এ পরিস্থিতিকে মোক্ষম সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে ইহুদিদের ইউরোপ মহাদেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজটি সেরে ফেললেন। যায়নবাদীরা পূর্ব থেকেই বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে ইহুদিদের ইউরোপ ত্যাগে সাহায্য করার জন্য ইউরোপীয় সরকারগুলোর মধ্যে নিজেদের জন্য একটি পা রাখার জায়গা বের করার পদক্ষেপ নেয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, যদি ইহুদিদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুদীর্ঘ ইতিহাস না থাকত এবং তারা যে সময় থেকে ইউরোপে উপস্থিত হয়েছিল তখন থেকেই এসব দেশের সরকারগুলোর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য চেষ্টা না চালাত তাহলে ইউরোপীয় সরকারগুলোর কাছে সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে তাদের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গের কয়েক বছরের প্রয়াস নির্ঘাৎ বিফলে পর্যবসিত হতো।
যায়নবাদী সংস্থার আনুষ্ঠানিক কর্মতৎপরতার আগে কোন কোন চিন্তাবিদ ও লেখক ইহুদিদের একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীল নকশার পেছনে তাঁদের যে বিপজ্জনক মতলব গুপ্ত ছিল সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতেন। কিন্তু প্রভাবশালী ইহুদিরা এ বিষয়টিকে ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর একটি স্নায়ু যুদ্ধ বলে অভিহিত করত। ইহুদিদের তৎপরতা যখন আরো ব্যাপক আকার ধারণ করল এবং বড় বড় সরকারি পদে তাদের লোকদের অধিষ্ঠিত করা হলো তখন তারা এ বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিল। তখন প্রমাণিত হলো যে, বেসলে সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহই সব নয়- যা যায়নবাদীরা অনুসরণ করছে। এ সম্পর্কিত একটি উদাহরণ হলো Herzl এর বিক্ষিপ্ত ডায়েরিসমূহ যা তাঁর মৃত্যুর ২৬ বছর পরে প্রকাশ হয়। প্রকাশিত এসব লেখা থেকে জানা যায় যে, বেসলে সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে Herzl এর কিছু ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, যেগুলো তিনি কখনোই যায়নবাদীদের আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা-বিবৃতি ও সভা-সমাবেশে উত্থাপন করতেন না। তাঁর নিগূঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আরবদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে, পত্রপত্রিকা এবং সরকারসমূহের অর্থনৈতিক খাতের ওপর গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তীব্রতর করতে হবে যাতে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়।
সুতরাং যখন Herzl এর ন্যায় দুঃসাহসী ব্যক্তি যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বীয় পন্থাগুলো কৌশলে এড়িয়ে যান তখন এটাই স্বাভাবিক যে, অন্য ইহুদি কর্মীরা এ পন্থাই অনুসরণ করে চলবে। বিখ্যাত মার্কিন শিল্পপতি ও ‘ফোর্ড’ গাড়ি নির্মাণ কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ড ১৯২১ সালে অর্থাৎ বেলফোর ঘোষণার ঠিক ৪০ বছর পরে যায়নবাদীদের প্রোটকলগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেন। অতঃপর এ ব্যাপারে তাঁর অধ্যয়নের ফলাফল তাঁরই কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত একটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। উক্ত গবেষণার একটি স্থানে তিনি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে যায়নবাদীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :
‘যায়নবাদীদের তৎপরতা দুই দিকে কেন্দ্রিভূত হয়েছে : একদিক থেকে তাদের চেষ্টা হলো সকল অ-ইহুদি রাষ্ট্র (অর্থাৎ যেসব রাষ্ট্র তাদের আধিপত্যের অধীনে নেই)-কে উৎখাত করবে। অপরদিকে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। তারা অনেক হৈচৈ শুরু করে। কিন্তু এ সবকিছুই ছিল সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশা বাস্তবায়নের একটি অজুহাত মাত্র। ইহুদি রাষ্ট্রের তত্ত্ব একটি আবরণ মাত্র। এতে আরো অনেক অভিসন্ধি নিহিত রয়েছে। খনিজ সম্পদ এবং বিশেষ করে তেল সম্পদকে হস্তগত করা সেসকল অভিসন্ধির অন্যতম। আর গোপন অভিযান পরিচালনার জন্য শক্তি সঞ্চয় করাও আরেকটি অভিসন্ধি। ইয়াহুদ ইকোনমিক্স ও পলিটিক্স দুটিই তাদের হাতে চায়।’
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা গঠনের পর অসংখ্য ইহুদি সংস্থা ও সংগঠন নানাবিধ কার্যক্রম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এসব সংস্থা ও সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ধরনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং নতুন নতুন যায়নবাদী সংস্থার উৎপত্তি লাভের কারণ হয়। তবে যায়নবাদী সংস্থাসমূহের কর্মকাণ্ডের স্বরূপ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে, যায়নবাদীরা যেহেতু সর্বদা তাদের কার্যক্রমে ইহুদি সমাজের ভিতকে মজবুত করার এবং ঐ সকল লোক তৈরি করার উদ্দেশ্যটি গোপন রাখত যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় শক্তিবর্গের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে, অপরদিকে ইসরাইল বিষয়ে তাদের সংস্থাসমূহের আচরণগত দিকটিই ফলাও করে প্রকাশ করত যা পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথে একই ধারার ছিল, তাই এ ধারার গোপন দিকটি সর্বদা অজ্ঞাত ও অজানাই থেকে যায়। নিম্নে এরূপ কিছু যায়নবাদী সংস্থা ও সংগঠনের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা World Zionist Organization (WZO) প্রথমে Zionist Organization নামে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলনে গঠিত হয়। তখন এটি যায়নবাদী সংস্থাসমূহের একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের পরিকাঠামো রূপে ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য একটি বাহ্যিক ইহুদি সোসাইটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। ইহুদিদের মধ্যে যারা যায়নবাদী কর্মসূচিকে গ্রহণ করত তারা সকলেই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হত। Zionist Organization প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই যায়নবাদ একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক, অভিবাসন ও গবেষণা তৎপরতা পরিচালনার উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। এসব উপকরণ তথা মাধ্যমসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেগুলো থিওডর হার্জল-এর এই সংস্থার নেতৃত্বে থাকাকালে (১৮৯৭-১৯০৪ খ্রি.) উৎপত্তি লাভ করে। সেগুলো হলো :
১. ইহুদি ঔপনবেশিক ট্রাস্ট (JEWISH COLONIAL TRUST) : যায়নবাদীদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করত।
২. ইহুদি জাতীয় তহবিল (The Jewish National Fund) : ভূমি ক্রয় করার নিমিত্তে এ তহবিল গঠন করা হয়, যে ভূমি ইহুদি জাতির চিরকালীন সম্পদ হিসাবে থেকে যাবে।
৩. ডিভোল্ট : সংস্থার অফিসিয়াল বডি।
পর্যালোচনা
বিশ্বের অনেক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় তা অতীতের হোক, কিম্বা বর্তমান ও ভবিষ্যতেরই হোক, কোন একভাবে যায়নবাদীদদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণেই বিশ্ব যায়নবাদকে জানা কেবল আবশ্যকই নয়; বরং যায়নবাদী শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য তা প্রাথমিক প্রস্তুতিস্বরূপ। যায়নবাদ হচ্ছে এমন এক আবিষ্কার যার সাথে বিশ্ব কমপক্ষে এক শতককাল ধরে পরিচিত। যে যায়নবাদ অর্ধশতক কাল ধরে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের চেহারা ধারণ করে বিশ্বের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরেছে। যায়নবাদ প্রতিষ্ঠার একেকটি বছর উদ্যাপিত হচ্ছে আর বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে মুসলিম জাহানের জন্য এর কুফল ফুটে উঠছে। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ্বে প্রথম বারের মতো যায়নবাদী ধারণা উত্থাপন করা হয়, প্রতিশ্রুত মসীহ্’র প্রতি বিশ্বাসের সূত্র ধরে। কারণ, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের উপকণ্ঠে অবস্থিত যায়ন (Zion) পাহাড় থেকে আবির্ভূত হবেন। আর প্রতিশ্রুত মসীহ্’র আবির্ভাবের জন্য যথোপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিবেশ প্রস্তুত করা অপরিহার্য ছিল। এর ফল দাঁড়ায়, এ অঞ্চলে ইহুদিদের একটি স্বদেশ গড়ে তোলা। আর ইহুদিরা যে ঐতিহাসিক ধারণা পোষণ করে হযরত দাউদ ও সুলায়মান আলাইহিমাস সালামের আমলে এ অঞ্চলে তাদের একটি রাষ্ট্র ছিল, এ কারণে তাদের পূর্বের চিন্তায় এ অভিযাত্রা জ্বলে ওঠে। এ গতি আরো বেগবান হয়ে ওঠে যখন ইহুদি সাহিত্যিকরা লিখিতভাবে বিশ্বের ইহুদিদের ওপর আপতিত নিদারুণ নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁরা পরিত্রাণের একটি মাত্র উপায় নির্দেশ করেন। তা হলো ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস আরো পুরাতন। কোন কোন ঐতিহাসিক একে হযরত মূসা (আ.)-এর আমল থেকেই বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ হযরত সুলায়মান (আ.)-এর শাসনামল ও ফিলিস্তিনে ইবরানি (ইহুদি) রাষ্ট্রের পতনের পরের সময় থেকে বলে মনে করেন, যখন ইহুদিরা ১২ আসবাতে বিভক্ত হয়ে এ ভুমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব যায়নবাদী আন্দোলন ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎপত্তি লাভ করে কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বর্ণনার মাধ্যমে। সাহিত্যভিত্তিক যায়নবাদ ইহুদি ও প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। তারা সমগ্র বিশ্বে ইহুদিদের দুর্দশা ও দুর্ভোগের দিকটা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রবক্তা ছিল। তাদের ভাষায় তাওরাত ও তেলমুদ গ্রন্থের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ইহুদিরা ভবঘুরে অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে এবং দুধ ও মধু’র দেশে পদার্পণ করবে। এভাবে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো হয়।
মার্টিন লুথার ছিলেন প্রোটেস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। এ সম্প্রদায়কে ‘যায়নাবাদী খ্রিস্টবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বলে রাখা দরকার যে, ইহুদিদের জন্য একটি ইহুদি রাষ্ট্রের আবশ্যকতা এবং তা প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি সম্পর্কে যাঁরাই লেখালেখি করতেন তাঁরা সকলেই যে ইহুদি ছিলেন তা নয়; বরং এমন অনেকেই ছিলেন যাঁদের ‘যায়নবাদী খ্রিস্টান’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, এতে তাঁরা ইহুদিদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারবেন। একারণে ঐ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদেরকে সেখানে স্থানান্তরিত করতে হবে। যায়নবাদী খ্রিস্টান মূলত তারাই যারা প্রোটেস্টান সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিল এবং বিশ্বাস করত যে, হযরত ঈসা মসীহ্র যায়ন পাহাড় থেকে আবির্ভাবের তিনটি শর্ত রয়েছে :
১. বৃহত্তর ইসরাইল (নীল থেকে ফোরাত) প্রতিষ্ঠা করা। যা ইসরাইলের পতাকায়ও প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ, ইসরাইলের পতাকায় যে দুটি নীল দাগ রয়েছে তা আসলে নীল ও ফোরাত এ দুই নদীর প্রতীক। আর মাঝখানে ইহুদিদের পতীক হিসাবে একটি স্টার অঙ্কিত। অর্থাৎ এ দুই নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় কেবল ইহুদিরা থাকবে।
২. বাইতুল মুকাদ্দাসকে ধ্বংস করা এবং সুলায়মানের ইবাদতখানা পুননির্মাণ করা।
৩. আরমাজদুন যুদ্ধ সংঘটিত করা।
তবে বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার নাম তালিকাবদ্ধ করা হলেও তালিকার শীর্ষে স্থান পায় দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, আফ্রিকা মহাদেশের কোন এক এলাকা আর মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। কিন্তু ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি ও সমৃদ্ধ ধর্মীয় চেতনা বিদ্যমান না থাকায় আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার নাম কাটা যায় এবং তিনটি কারণে ফিলিস্তিনকেই বেছে নেওয়া হয়। যথা :
১. ধর্মীয় চেতনার বিবেচনায় : তাওরাতের আসফারে ‘দুধ’ ও ‘মধুর’ ভূখণ্ড নামে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে।
২. ঐতিহাসিক ভিত্তির বিবেচনায় : এটা তাওরাতের অনুসারী ইহুদিদের ঐতিহাসিক ভূমি ছিল। কারণ, হযরত মূসা (আ.) তাদের এই ভূখণ্ডেরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বনি ইসরাইলের নবি হযরত দাউদ ও হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ৮০ বছরের শাসনামল এ অঞ্চলেই কায়েম ছিল।
৩. তিন মহাদেশের সম্মিলনস্থল : ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভৌগোলিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে অতীব কৌশলগত স্থানে অবস্থিত। যে কেউ এ অঞ্চলে ভিত গড়বে সে তিন মহাদেশের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠাকারী ভূণ্ডমধ্যসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া এ অঞ্চল ছিল ইংরেজ উপনিবেশের অধীনে। কাজেই ইংরেজদের মাধ্যমে এখানকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করা সহজতর ছিল।
মূসা মন্টিফিওর (Moses Montefiore) তাঁর একাধিকবার সফরকালে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন যাতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে কোন একভাবে ইহুদিদের মালিকানাধীন করে ফেলতে সক্ষম হন। তিনি ইহুদি ও ইংরেজদের জাতীয় পরিষদের প্রধান ছিলেন। তিনি তাঁর মূল কর্মতৎপরতাকে কেন্দ্রিভূত করেন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি দেশ গড়ে তুলতে। এভাবে অন্যান্য স্থানে উপনিবেশ গড়ে তোলার কাজ বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিন অভিমুখি কার্যক্রম পরিচালিত করা হলো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জোর পদক্ষেপে চলতে থাকল ইহুদিদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তর এবং সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তোলার কাজ।
অবশ্য এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটে তা ছিল যায়নবাদ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক রূপ পরিগ্রহ করার আগের পর্যায়। তারপর যখন ইহুদিদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তর করার কাজ শুরু হলো তখনই বিভিন্ন যায়নবাদী ইহুদি সংস্থা ও সংগঠনেরও আত্মপ্রকাশ শুরু হলো। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে জড়ো হওয়ার জন্য প্ররোচিত করাই তাদের প্রধান কাজ ছিল।
যায়নবাদের শেষ লক্ষ্য বিশ্বের গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাদের এ প্রয়াস অবশ্য আরো আগে থেকেই শুরু হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জাতির চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাগের খাখাম হাশুরুন ঘোষণা করেন : ‘যদি বিশ্বের ওপর আমাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রথম হাতিয়ার হয় স্বর্ণ, তাহলে প্রচারমাধ্যম হবে আমাদের দ্বিতীয় হাতিয়ার!’ স্বর্ণ যদি ইহুদিদের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক, বিভিন্ন জাতির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার অস্ত্র, ইহুদিদের বিত্তশালী করার উপায় এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উসিলা হয় তাহলে প্রচারমাধ্যমও নিশ্চয় ইহুদিদের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাকে পাল্টে দিতে সক্ষম হবে এবং ক্রমে ক্রমে বিশ্ব জনমতের ওপর ইহুদিদের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
এভাবে একের পর এক যখন যায়নবাদের ভূমিকা প্রস্তুতকরণের পর্যায়গুলো অতিক্রান্ত হয় তখন থিওডর হার্জল যায়নবাদের সুসংগঠিত প্রয়াস আরম্ভ করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ডের বেসলে শহরে তিনি যে যায়নবাদী ইহুদি শীর্ষ নেতাদের যোগদানে সম্মেলনের আয়োজন করেন সেখানে তাঁর আহ্বান ছিল দুটি :
১. বিশ্বের সকল ইহুদিবিরোধী রাষ্ট্র তথা সরকারকে উৎখাত করা।
২. তিন মহাদেশের সম্মিলনস্থলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এমর্মে তিনি Protocols of Jews নামে প্রচারমাধ্যম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করে গভীর ও সর্বব্যাপী এক যায়নবাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং বাস্তবায়ন করতে থাকেন। বেসলে সম্মেলনের কয়েক মাস পরে যায়নবাদী সংস্থার প্রধান হার্জল ঘোষণা করেন : ‘আমরা যদি বিশ্ববাসীকে বলি ইসরাইল রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করে ফেলেছি, তাহলে হয়ত তারা আমাদের কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিতে পারে। পাঁচ বছর পরেও হয়ত একই কথা। কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে অবশ্যই তারা এ রাষ্ট্রকে দেখতে পাবে।’ আর ঠিক এর পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসে অর্থাৎ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে যায়নবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, হার্জল নিজেও ইহুদি মহারথিদের হাতের নিছক একটি ঘুটিবিশেষ। কারণ, এর আরো পঞ্চাশ বছর পূর্বে ব্যারন রুশিল্ড (Baron Rothschild) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। ইহুদিদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হতো কেবল ফিলিস্তিনে ইহুদি বাসিন্দাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়।
১১৭১ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনে মাত্র ১৪৪০ জন বসবাস করত। আর ১২৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাইতুল মুকাদ্দাসে মাত্র দুটি পরিবার ছিল। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৪৫ জন। আর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এগার হাজার জন এবং ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কুড়ি হাজার জন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর এবং ইংরেজ নেতৃবৃন্দ ধনাঢ্য ইহুদি রুশিল্ডকে যায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ইংল্যান্ড ও ইহুদিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে ইংল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদিদের কাছে অর্পণ করবে। এরূপে ইংরেজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর কর্তৃক ইহুদিদের জাতীয় স্বদেশ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। আর এসময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা হওয়ার ১০ বছর পরে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লক্ষ। আর ১৭ বছর পরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষে। যখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে তখন তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৬ হাজার। আর যখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে বের হয়ে যায় ততদিনে ত্রিশ বছর ধরে প্রায় সাত লাখ ইহুদিকে সেখানে বসতি স্থাপন করানো হয়, যা তৎকালীন ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অতঃপর যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে ইহুদিদের সংখ্যা পঁচিশ লাখে পৌঁছায় এবং বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৬০ লক্ষাধিক।
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা গঠিত হওয়ার পর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত ওসমানি সম্রাট আবদুল হামিদের সাথে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হস্তগত করার জন্য দর কষাকষি করা। বিনিময়ে তারা অঙ্গীকার করে যে, ওসমানি সাম্রাজ্যের সকল দেনা পরিশোধ করে দেওয়া হবে। সম্রাট তা গ্রহণ করেননি। এরপর তারা জার্মানির মধ্যস্থতা চায়। কিন্তু ইহুদি সমাজের যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সাথে জার্মানির পরিচয় ছিল সে কারণে তারা এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয় নি। ইতিমধ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার কারণে বিশ্ব যায়নবাদী ফ্রন্ট নতুন এক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে যোগদান করে এবং পর্যায়ক্রমে ফ্রন্টের সদস্যরা Hibbat Zion এর ন্যায় বিভিন্ন গ্রুপভুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরূপে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এরাই সশস্ত্র বাহিনী রূপে ফিলিস্তিনে আসে। প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রথম যারা ইহুদি মুহাজির রূপে ফিলিস্তিনে পদার্পণ করে তারা ঐ সকল ইহুদি ছিল না যারা রাশিয়া কিম্বা পূর্ব ইউরোপের নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে বেঁচে গিয়েছিল। বরং তারা ছিল একদল যুদ্ধবাজ, যাদের লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের এই অঞ্চলে স্থানান্তরিত ও বসতি স্থাপনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তারা প্রথম থেকেই ‘হাগানা’ (Haganah) ও ‘হাশুমির’ (Hashumir) নামে দুটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। পরবর্তী ফ্রন্টগুলো স্ট্রেন (Stern) ও ইরগুন (Irgun) নামে গঠিত হয়। এ কয়টি যায়নবাদী ফ্রন্টের কাজ ছিল ইহুদি এজিন্সির আর্থিক সহায়তায় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করা। ফ্রন্টগুলো গঠন হওয়ার পর ইহুদি এজেন্সি এদের কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং এদের পরিকল্পনা ও আর্থিক মদদ যোগান দিতে থাকে। ইহুদিদের এ ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করা হতে থাকে। কিন্তু যে বিষয়টি ফিরে দেখার দাবি রাখে তা হলো ইহুদিরা কি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি খরিদ করেছিল, নাকি করে নি?
ইহুদিরা বিভিন্ন ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড খরিদ করার জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা যেহেতু জানত, এ কারণে বলত, ‘তারা ইহুদি, তাদের কাছে জমি বিক্রয় কর না।’ ফলে বিভিন্ন যোগাযোগ ও মাধ্যম প্রয়োগ করে তারা কেবল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ১ থেকে ৩ শতাংশ জমি ক্রয় করতে পেরেছিল। তারপর যখন ইসরাইলের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায় তখন সমগ্র ফিলিস্তিন জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নির্দেশ জারি করে : যদি কেউ ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রয় করে তাহলে তার রক্ত (অর্থাৎ তাকে হত্যা করা) বৈধ হয়ে যাবে।’ এ কারণে আর কোন জমি বিক্রয়ের ঘটনা ঘটেনি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যখন ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল তখন সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মাত্র আড়াই শতাংশ যায়নবাদীদের মালিকানায় ছিল। আর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা এ এলাকা ছেড়ে চলে যায় তখন যায়নবাদীরা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৬ শতাংশ ক্রয় করেছিল। অবশিষ্ট ৯৪ শতাংশ ভূখণ্ড ফিলিস্তিনিদেরই মালিকানাধীন ছিল। যায়নবাদীদের একটি কৌশল ছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর পাশাপাশি যায়নবাদীদের একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ইংরেজরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সমর্থনে নানা স্টেটমেন্ট জারি করা এবং গ্রন্থ রচনার কাজ জোরেশোরে চালায়। এসব তৎপরতার বেশিরভাগই ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি সরকারের আমলে সম্পন্ন হয় এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। পরে ইহুদি ও ব্রিটিশদের যোগসাজশে তা আরও সুসংগঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের এসব পদক্ষেপের মধ্যে একটি হলো ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত শ্বেতপত্র যা ব্রিটেনের আইন সভা কর্তৃক ডিজাইনকৃত। আর ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ মারফত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভাগাভাগির প্রস্তাব পাশ করানো হয় যা ১৮১ নং প্রস্তাব নামে খ্যাত। ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের চাপেই জাতিসংঘ এ প্রস্তাব পাশ করতে বাধ্য হয়। উক্ত প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিভাজিত হয়ে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রায় ৫৬ শতাংশ ভূখণ্ডবিশিষ্ট। আরেকটি ফিলিস্তিনি আরব রাষ্ট্র প্রায় ৪৪ শতাংশ ভূখণ্ডবিশিষ্ট। আর বাইতুল মুকাদ্দাস ঘোষিত হলো নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক এলাকারূপে। অথচ এ সময়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মাত্র ৬ শতাংশ ইহুদিদের হাতে ছিল। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ কি তার ১৮১ নং প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারত, নাকি এতে অনেক আইনগত বিতর্ক চলে আসে?
নিঃসন্দেহে আইনগত দিকে দিয়ে জাতিসংঘ কখনোই এরূপ প্রস্তাব পাশ করতে পারত না। কারণ, নির্দিষ্ট সীমারেখাবিশিষ্ট একটি দেশকে সেখানকার অধিবাসীদের ইচ্ছার বিপরীতে অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করার কোন আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি নেই। তাই ঐ সময় থেকেই ইহুদিদের মুখেই ফিলিস্তিন ভাগাভাগির গুঞ্জন শুরু হয় এবং ব্রিটিশদের সহযোগিতায় তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। ১৮১ নং প্রস্তাব পাশ হওয়ার সাথে সাথে ইংরেজদের মাধ্যমে এমন দমন নিপীড়ন চালানো হয় যে, কোন ফিলিস্তিনির হাতে একটি চাকু থাকার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। অথচ খোদ ইংরেজরাই ইহুদিদের প্রকাশ্যে সমরাস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করত। অতঃপর যখন স্থির হলো যে, ইহুদিরা আরবদের বসত এলাকা থেকে অপসারিত হবে তখন তারা চুক্তি ভঙ্গ করল এবং উক্ত এলাকা থেকে সরে গেল না। কিন্তু ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানরা ইহুদি বসতি এলাকা থেকে সরে এল। এভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এ এলাকায় জন্ম হলো একটি অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্রের যার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম ডেভিড বেন-গুরিয়ান (David Ben-Gurion)।
[b]ভূমিকা[/b]
ফিলিস্তিন ইস্যুটি বর্তমান মানব বিশ্বের অন্যতম একটি বিষাদঘন ইস্যু। মানব ও মানবাধিকার সম্পর্কে যার সামান্যতম অনুভূতি রয়েছে এবং নিজেকে নিপীড়িত মানুষদের পক্ষে বলে মনে করে, এ ইস্যুতে তার নির্লিপ্ত থাকার অবকাশ নেই; বরং এর সাথে নিজের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করা উচিত। কেননা, ফিলিস্তিনের দুঃখ-দুর্দশা ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া দুরূহ, যেখানে একটি জাতি এভাবে প্রায় অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল যাবৎ বিশ্ববাসীর চোখের সামনে নিদারুণভাবে নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়ে চলেছে। অথচ নিপীড়ক জাতি বিশ্বের সমর্থন ও মদদপুষ্ট হয়েছে, আর নিপীড়িত জাতি চিহ্নিত হয়েছে সন্ত্রাসী হিসাবে! হেন অত্যাচার, নিপীড়ন ও নৃশংসতা বাকি নেই যা ফিলিস্তিন জাতির ওপর চালানো হয়নি- নিরীহ-নিরপরাধ জনগণকে হত্যা, নিজের ঘরবাড়ি ও বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করে চিরকালের জন্য উদ্বাস্তু করে দেওয়া, নির্যাতন, বন্দি, নির্বাসন, শিশু ও নারী হত্যা, লুণ্ঠন, অবরোধ, মৌলিক অধিকার হরণ, সহায় সম্পদ বিনাশ, কণ্ঠরোধ, অবাধ চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি ইত্যাদি। অবর্ণনীয় ও চরম অমানবিক নৃশংসতা যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক। অথচ এগুলোর কোন একটি নৃশংসতার ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ক্ষেত্রে একবার সংঘটিত হলেই তা বিশ্বকে প্রকম্পিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজ ষাট বছরেরও অধিক কাল ধরে ফিলিস্তিন জাতির ওপর এ ধরনের নৃশংসতা অবলীলায় ঘটে চলেছে, অথচ এজন্য কোন দুঃখ নেই, নেই কোন প্রতিক্রিয়া। তবে কি ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ও ফিলিস্তিনি জাতির অপরাধ একটাই? আর তা হচ্ছে ভৌগোলিক বিচারে তারা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে- যা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের গ্রাস করা চাই-ই চাই, যে কোন মূল্যে ও যে কোন নৃশংসতায়? তাহলে প্রশ্ন হলো এ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের স্বরূপ কী?
যায়নবাদ হচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ সক্রিয় চক্রের নাম যারা বিগত শতকে তাদের কার্যক্রমের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা অনুসারে প্রতিদিন বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের চিন্তা-চেতনা, এমনকি অনেক বিজ্ঞ লোকেরও এ চক্রের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে যথাযথ পরিচয় না থাকার কারণে প্রায়শই এ বিষয়টি ইসরাইল ইস্যুর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ ইসরাইল প্রসঙ্গটি হচ্ছে যায়নবাদের ব্যাপকভিত্তিক মহাপরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। তাই এ প্রবন্ধে বিশ্ব যায়নবাদের উৎপত্তির প্রেক্ষিত এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ইতিহাসভিত্তিক একটি পর্যালোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
ইহুদিদের ইউরোপে আগমন
ইউরোপ হচ্ছে যায়নবাদের উৎপত্তি স্থল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর আবির্ভাবের পরে এবং ইহুদিগণ কর্তৃক তাঁর ঐশী মর্যাদার প্রতি অবমাননা করার পর রোমান সম্রাট ফিলিস্তিনে আক্রমণ করেন। তিনি আক্রমণ চালিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে নেন এবং অসংখ্য ইহুদিকে হত্যা ও বন্দি করেন। বিজয়ী সৈন্যরা বন্দিদেরকে নিজেদের সঙ্গে রোমে নিয়ে যায়। আর এ ঘটনাই সর্বপ্রথম ইউরোপে ইহুদি জনগোষ্ঠীর পদার্পণের পথ খোলার কারণ হয়। পরবর্তীকালে তাদের বংশবৃদ্ধি ও এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরের ফলে সমগ্র ইউরোপে ইহুদি জাতি ছড়িয়ে পড়ে।
খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকে কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী (অর্থাৎ সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ রাশিয়া) অঞ্চলের জনগণ ইহুদি হয়ে যায়। এরা ‘তুর্কী-কাস্পিয়ান’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা ও অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনগোষ্ঠীই এদেরই বংশধর। ইহুদিরা প্রথম থেকেই বিভিন্ন পেশা, যেমন কারিগরি, বাণিজ্য (বিশেষ করে বয়নকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে), জুয়েলারি এবং আরো পরে এসে মুদ্রা বিনিময় ও ব্যাংকিং এর ন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। ইউরোপে বসবাসকালে ইহুদিরা সবসময় এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিক ও সম্পূর্ণরূপে রক্ষণশীল এক পরিবেশে জীবনযাপন করত। এটাই তাদের অন্য কোন জাতির সাথে মিশে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয় এবং তাদের স্বতন্ত্র একটি জাতিসত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
ইহুদিদের সম্পর্কে ইউরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাসের পাতা উল্টালে প্রমাণ মেলে যে, ইউরোপীয় জাতিগুলো কখনোই ইহুদিদের প্রতি ইতিবাচক দষ্টিভঙ্গি পোষণ করত না; বরং কতিপয় কারণে ইহুদি সম্প্রদায় সেখানে বরাবরই কোণঠাসা ও উপেক্ষিত ছিল। এসব কারণের অন্যতম হলো ইউরোপীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা ইহুদিদের এমন এক সম্প্রদায় বলে বিশ্বাস করত যারা তাদের নবী হযরত ঈসা মসীহকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে এবং এ ঐশী নবীর মর্যাদার প্রতি অবমাননা করেছে। তাই তাদের চোখে ইহুদি সম্প্রদায় হলো একটি বিশ্বাসঘাতক ও পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়। অপরদিকে ইহুদিদের মাঝে এমন কিছু বিশ্বাস প্রচলিত থাকা (যেমন তারা নিজেদের আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত জাতি হিসাবে গণ্য করে, অথচ তাদের মধ্যে অনেক নিকৃষ্ট ও জঘন্য কার্যকলাপ বিদ্যমান), অন্যান্য জাতিকে হীন বলে গণ্য করা, ফিতান-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, বিশ্বাসঘাতকতা করা, সুদ খাওয়া, স্বর্ণরোপ্য জমা করা ইত্যাদি কারণে তাদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আরো তীব্র আকার ধারণ করে ইহুদিদের কিছু অপকর্মের সূত্র ধরে। যেমন নগরীর পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া (যার উদাহরণ ইংল্যান্ড ও জার্মানে বিদ্যমান), অথবা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য খ্রিস্টান শিশুদের জবাই করে রক্ত সংগ্রহ ইত্যাদি। ইউরোপে আঁকাবাকা নাক ও রক্তস্নাত থাবাবিশিষ্ট বিগত শতাব্দীসমূহের ইহুদিদের ছবির উপস্থিতি সেই ইতিহাসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইহুদিদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের এহেন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি তাদের সম্পর্কেও ইহুদিদের অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি উৎপত্তি লাভ করে। যা কিছুই ইহুদিদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তার সবই খ্রিস্টানদের চোখে অসৎ ও বিশৃঙ্খল প্রতীয়মান হয়। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদিদের পক্ষ থেকে খ্রিস্টানদের প্রতিও জন্ম লাভ করে। এ বিষয়টি ক্রমে ক্রমে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাতে রূপ নিতে থাকে। কিছু কিছু ইউরোপীয় সরকার খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতক থেকে ইহুদিদেরকে তাদের পোশাকে বিশেষ এক চিহ্ন ব্যবহার করার নির্দেশ জারি করে, যাতে তাদেরকে অন্যদের মধ্য থেকে চেনা যায়। বিভিন্ন সময়ে ইহুদিদের ওপর নানা আক্রমণের ঘটনা ঘটত। এসব আক্রমণের কোন কোনটা সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে সংঘটিত হত, আবার কোন কোন আক্রমণ সরকারের পক্ষ থেকে এবং তাদের আচরণের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হতো। এসব আক্রমণ কখনো কখনো তাদের হতাহত করা, কখনো বা বিশেষ কোন স্থানে অবরুদ্ধ করে রাখা, আবার কখনো দেশ থেকে বিতাড়ন ও নির্বাসনে প্রেরণের মাধ্যমে পরিণতি লাভ করত।
ইংল্যান্ডের সরকার ছিল তৎকালীন ইহুদিদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এরূপ অন্যতম ইউরোপীয় সরকার। তারা খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে যখন ক্রুসেডের যুদ্ধ শেষ হয়, তখন ইহুদিবিরোধী মনোভাব তীব্ররূপ ধারণ করার প্রেক্ষাপটে সেদেশ থেকে সকল ইহুদিকে বিতাড়িত করে। একই ভাবে ফ্রান্সের সরকারের নামও উল্লেখ করা যায়। তারা খ্রিস্টীয় ১৩০৬ সাল থেকে ১৩৪৯ সালের ব্যবধানে তিন দফায় ইহুদিদের বহিষ্কার করে। স্পেনেও ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের ক্ষমতাসীন হওয়ার মাধ্যমে ইহুদিদের বহিষ্কারাদেশ জারি করা হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, তৎকালীন সরকারগুলো ও তাদের জনগণ ইহুদিদের কর্মকাণ্ডের কারণে এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল যে, তারা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকে ইহুদিনিধন নয়; বরং ফিতনা-ফ্যাসাদ অপসারণ বলে মনে করত।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় কিছু ডকুমেন্ট প্রকাশিত হয়, যাতে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে ইহুদিদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিরোনামে পর্দার অন্তরালে বিপজ্জনক সব পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। ‘Protocols of Jews’ নামে খ্যাত এসব পরিকল্পনায় বিভিন্ন জাতিকে বোকা বানানো এবং তাদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদের নীতিকৌশল সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়। এসব কৌশলের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেপরোয়াবৃত্তির অবাধ প্রচলন, গণমাধ্যমসমূহ হস্তগত করা, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এসব ডকুমেন্ট প্রকাশিত হওয়া আসলে ইহুদি স্কার লুই এর সেই কথাটিই স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলে। তিনি কয়েক বছর পূর্বে বলেছিলেন : ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ফিতনা- ফ্যাসাদের জন্মদাতা আর মূর্খ জল্লাদদের রাজা আমরাই’। ফলে রুশ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধের উদ্রেক হয় এবং তারা ইহুদিদের ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে কিছুসংখ্যক ইহুদি নিহত হয়, যা পরবর্তীকালে সুবিধা হাসিলের উসিলা হিসাবে ইহুদিদের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে একটি ইস্যুতে পরিণত করা হয়।
উপরের আলোচনায় ইউরোপে ইহুদিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি ও তাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তাছাড়াও ইহুদি পণ্ডিতরাও এধরনের ইহুদিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি বা উস্কে দেওয়ার পেছনে স্বয়ং ইহুদি জনগোষ্ঠীর সন্দেহাতীত ভূমিকা ছিল বলে জোরালো মতামত দিয়ে থাকেন। বার্নার্ড লজার একজন শীর্ষস্থানীয় ইহুদি চিন্তাবিদ। তাঁর নামেই আজ একটি ইহুদি সোসাইটি ফ্রান্সে ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি ইহুদিবিরোধী চিন্তা ও মনোভাবের কারণ সম্পর্কে বলেন : ‘ইতিহাসে প্রথম থেকে অদ্যাবধি ইহুদিবিরোধী মনোভাবের কারণ ছিল এটা যে, ইহুদিরা ছিল একটি অসামাজিক শ্রেণি। ইহুদিনিধন চিন্তা প্রকাশ পাওয়ার পেছনে ধর্মীয়, জাতীয় ও অর্থনৈতিক কারণ নিহিত। ইহুদিরা সর্বত্র এবং সবসময় নিজেদের অন্যান্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।’
যদিও বর্তমানে ইহুদিরা তাদের এই ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে এবং এ কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে, তথাপি এতকাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও ইউরোপীয়দের মাঝে এখনো এ দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। আর অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রতিদিন পৈশাচিকতা পরিচালনাকারী যায়নবাদী জান্তাকে অনেক ইহুদি সমর্থন করার কারণে এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধিও পাচ্ছে। এ মর্মে ২০০১ সালে মার্কিন ইহুদি কমিটি কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল প্রণিধানযোগ্য। এ জরিপে ইউরোপের জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় যে : সে কি একজন ইহুদিকে প্রতিবেশী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি আছে? ইতালিতে ৩১ শতাংশ, অস্ট্রিয়ায় ২৬ শতাংশ, রাশিয়ায় ২৪ শতাংশ এবং জার্মানিতে ২২ শতাংশ জনগণ ‘না’বোধক উত্তর প্রদান করে। তাদের কামনা ছিল একজন ইহুদি যেন তাদের প্রতিবেশী না হয়।
যদি মনে করা হয় যে, যায়নবাদ স্বল্প সময়ের মধ্যে এবং কতিপয় ইহুদি কর্মী ও চিন্তাবিদের সংকল্প থেকেই গড়ে উঠেছে, তাহলে এটি একটি অবাস্তব ধারণা মাত্র। তদ্রূপ যদি মনে করা হয় যে, যায়নবাদীদের সমস্ত প্রচেষ্টা একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তা বাস্তবায়িত হওয়ার পর তারা ক্ষান্ত হয়েছে, তাহলে সেটাও যায়নবাদের স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকারই পরিচয় বহন করবে। বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থার একজন উদ্যোক্তা ও ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান এর যায়নবাদের স্বরূপ সম্পর্কিত উক্তিটি তুলে ধরার পর আমরা যায়নবাদী চিন্তা গঠিত হওয়ার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং এর কতিপয় সাংগঠনিক দিক ও ধারা সম্পর্কে আলোকপাত করব। তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি হলো : ‘যায়নবাদী সংস্থা ইসরাইলের সক্ষমতা ও সামর্থ্যে যা রয়েছে তার বহির্ভূত অনেক জিনিস অর্জন করতে সক্ষম। আর এটি হল যায়নবাদী সংস্থার এ রাস্ট্রটির প্রতি একটি বাড়তি অনুদান।’
যায়নবাদী চিন্তা গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতসমূহ
ইহুদি শীর্ষ নেতারা যদিও সবসময় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন তথা তাদের ভাষায় ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-তে প্রত্যাবর্তনের আবশ্যকতা সম্পর্কে নিজেদের সমাজের মাঝে প্রচারনা চালিয়ে এসেছে, কিন্তু খ্রিস্টীয় সতের শতক পর্যন্ত এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের সুনির্দিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য কোন সুসংগঠিত পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা প্রস্তুত হওয়ার সূত্র ধরে বিক্ষিপ্তভাবে এ মর্মে কানাঘুষা শোনা যেত। সম্ভবত নেপোলিয়ান বোনাপার্টের নির্দেশক্রমে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ‘ইহুদিদের উচ্চ পরিষদ’ নামক একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠাকরণ ছিল সাম্প্রতিক শতকগুলোতে ইউরোপে ইহুদিদের সর্বপ্রথম সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। The Grand Sanhedrin খ্যাত এ পরিষদ সুনির্দিষ্ট সংগঠন ও কর্মসূচিসমৃদ্ধ ছিল এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করত।
উনিশ শতকের বিখ্যাত ইহুদি চিন্তাবিদ ও সক্রিয় কর্মী Dr. Leon Pinsker তাঁর Auto-Emancipation শীর্ষক গ্রন্থে সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্টভাবে ‘যায়নবাদ’ পরিভিাষাটির প্রতি ইশারা করেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, ইহুদিদের ফিলিস্তিনে রওয়ানা হওয়ার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থেকে খ্রিস্টের অপেক্ষায় থাকা উচিত হবে না; বরং দুর্দশা লাঘবের জন্য তাদের নিজেদেরই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইহুদিদের এ মনস্কামনা বাস্তবায়ন করা এবং একটি একক ভূখণ্ডে বসবাসের ব্যবস্থা করার নিমিত্তে বিভিন্ন ইহুদি গ্রুপ গঠিত হল। Hibbat Zion তথা ‘যায়নের প্রেমিকগণ’ নামের গ্রুপটি ছিল এ ধরনের অন্যতম ও প্রসিদ্ধতম গ্রুপ। তারা ‘যায়নের অভিমুখে’ স্লোগান তুলে রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ডসহ পরবর্তীকালে আরো কতিপয় দেশে তৎপরতা চালাতে থাকে। Blau-Weiss মুভমেন্ট হলো আরেকটি ইহুদি যুব সংগঠন যারা Hibbat Zion গ্রুপের পরে উৎপত্তি লাভ করে। তারা ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফিলিস্তিনে সর্বপ্রথম ইহুদি জনপদ গড়ে তোলে। কতিপয় ইহুদি ব্যক্তি যায়নবাদী চিন্তা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Benjamin Disraeli ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন মূলত একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি। শৈশবে তাঁর পিতার ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু আজীবন তিনি যায়নবাদী চিন্তা-চেতনা লালন করতেন। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘যায়নবাদী খ্রিস্টান’ বলে আখ্যায়িত করত। তিনি ব্রিটেনের রাষ্ট্রনায়কদের অধুনা ইহুদি চিন্তাধারার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানের জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর নৈতিকতার স্বরূপ সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর এ বিখ্যাত উক্তিটিই যথেষ্ট। তিনি বলতেন : ‘বিজয় লাভের জন্য প্রতারণা, মিথ্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতা কোন পাপ নয়।’
এছাড়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ইহুদি ও ইহুদিদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব Moses Montefiore ও Asher Ginzberg প্রমুখের ন্যায় কর্মীরাও নিজেদের যায়নবাদী বিশ্বাসকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ করেন। আর এ ব্যাপারে বিখ্যাত ধনাঢ্য Rothschild পরিবারের ভূমিকাও ছিল অপরিসীম। এ পরিবারের James de Rothschild এর বিখ্যাত ইহুদি পুঁজিপতি পুত্র Edmond Rothschild যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানের কয়েক বছর পূর্বে জমি ক্রয় এবং নবাগত ইহুদিদের জন্য বসতি গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালান। তিনি এ কাজে ৭০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক স্বর্ণ বিনিয়োগ করেন এবং ফিলিস্তিনে ইদীদের জীবন যাপনের ধারণাকে বাস্তবে সম্ভব বলে তাদের চিন্তাজগতে প্রতিষ্ঠা করেন। উপরিউক্ত আলোচনায় যায়নবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে যেসব প্রেক্ষিত ভূমিকা পালন করে সেগুলোকে একত্র করে এভাবে তালিকাবদ্ধ করা যেতে পারে :
১. ফিলিস্তিন ইহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত মর্মে ইহুদি নেতাদের অবিরাম প্রচারণা।
২. ইহুদি সংস্কৃতিতে তাদের নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করার প্রবণতা- যারা অন্যদের চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং তাদের ওপর শাসন করার অধিকার রাখে। আর এ মর্মে ইহুদি কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় জোরালোভাবে গুরুত্ব আরোপ।
৩. ইতিপূর্বে উল্লিখিত কারণসমূহের ভিত্তিতে ইউরোপীয় দেশসমূহে ইহুদিদের ওপর আক্রমণ সংঘটিত হওয়া এবং এর ফলে তাদের হতাহত হওয়া ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া- যা কোন কোন ক্ষেত্রে যায়নবাদীদের সংগঠিত করে তোলে।
৪. খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে কতিপয় যায়নবাদী হোতার পক্ষ থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে অসহায় ও নিরাশ্রয় জাতি হিসাবে প্রচারনা চালানো এবং এ বিষয়টিকে অসীম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত করে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি ইহুদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহকে বাস্তবায়িত করার নিমিত্তে সংগঠিত হওয়া এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাস গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে তৎপরতা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ।
৫. ইউরোপের কিছু কিছু রাজ-দরবারে, বিশেষ করে ব্রিটেনে প্রভাবশালী ইহুদি লবি নিযুক্ত করা এবং একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ঐসকল দেশের সরকারের ইতিবাচক সাড়া আদায়।
Zionist Organization এর আনুষ্ঠানিক তৎপরতা
যায়নবাদী চিন্তা জন্মের পেছনে যেসব কারণ ও প্রেক্ষিত উল্লেখ করা হলো সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতকের শেষ বছরগুলোতে Zionist Organization উৎপত্তি লাভ করে। এ বছরগুলোতে যায়নবাদী চিন্তাধারকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাড় করা হয়েছিল। শুধু যা প্রয়োজন ছিল তা হলো এ প্রবাহকে সংগঠিত করার জন্য একটি ক্যারিশমেটিক ও কর্মতৎপর নেতৃত্ব। অস্ট্রিয়ায় একটি পত্রিকার সম্পাদক থিওডর হার্জল হলেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রীধারী থিওডর হার্জল বিশ্বাস করতেন ইহুদিরা পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করুক না কেন তারা সকলেই একই সম্প্রদায় তথা জাতির অধিভুক্ত; তারা কোনক্রমেই তাদের পাশ্ববর্তী জাতিসমূহের সাথে মিলেমিশে যেতে পারে না। হার্জল তাঁর সমচিন্তার কতিপয় ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রতিভাবান ইহুদিদের খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হন যারা দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে তাঁর নিকটবর্তী হবে। বিভিন্ন ইহুদি চিন্তাবিদের চিন্তা ও বিশ্বাস সম্পর্কে বলতে হয় যে, যায়নবাদীদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী কিছুসংখ্যক ইহুদি যায়নবাদকে (তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যামতে) ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত। আর যে সমস্ত রেওয়ায়াত ইয়াহুদ পরিত্রাতার আবির্ভাবকে ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে ইহুদিদের একত্র হওয়ার শর্ত বলে মনে করত তারা সেগুলোর প্রতিই ইশারা করত। এ দলটি ‘ধর্মীয় যায়নবাদী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আরেক দল যাদের তত্ত্বদাতা ছিলেন Asher Ginzberg যিনি - Ahad Ha'am - নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি যায়নবাদের সাংস্কৃতিক দিকের ওপরেই বেশি জোর দিতেন। এ দলটি বিশ্বাস করত যে, সকল ইহুদির ফিলিস্তিনে সমবেত হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। শুধু কতিপয় বিশিষ্ট ইহুদি নির্যাসস্বরূপ ইহুদি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়ের জন্য সুসংহতকারী হিসাবে এ ভূখণ্ডে আবাস গড়ে তুললেই চলবে। তারাই এ ভূমিকে গোটা বিশ্বের ইহুদিদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করবে। ‘সাংস্কৃতিক যায়নবাদী’ নামে খ্যাত এ দলটি তাদের এ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ইউরোপের কাছ থেকে এবং অ-ইহুদিদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের বিরোধী ছিল। তাদেরকে তারা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করত না। এতদসত্ত্বেও যে ধারাটি যায়নবাদকে নেতৃত্ব প্রদান করত এবং এর নীতিমালা নির্ধারণ করত সেটা ধর্মীয় যায়নবাদও ছিল না, আবার সাংস্কৃতিক যায়নবাদও ছিল না; বরং এর নেতৃত্ব ছিল থিওডর হার্জল এর হাতে। তিনি ও তাঁর সমমনা লোকেরা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উভয় যায়নবাদী ধারাকে হাতিয়ার হিসাবে মূল্যায়ন করতেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে নয়। আর আদতেই তাঁরা ধর্মের মূল ভিত্তি সম্পর্কে এবং ইহুদি সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন অবগতও ছিলেন না।
স্বয়ং থিওডর হার্জল যায়নবাদীদের একটি সভায় স্পষ্টতই ঘোষণা করেন যে, তিনি জানেন না ইহুদি কালচার (সংস্কৃতি) বলতে কি বোঝায়? American Jews Organization এর তৎকালীন নেতা ইয়াকুব শিফও যায়নবাদী সংস্থা প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে এ আন্দোলনের অগ্রপথিকদের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন : ‘যদি বলি যে, যারা জাতীয়তাবাদী ইহুদি নামে প্রসিদ্ধ তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোকই বে-দ্বীন ও নাস্তিক এবং ইহুদী জাতীয় আন্দোলন তথা যায়নবাদের অধিকাংশ নেতাই দ্বীন ও ধর্মের প্রতি কোন মনোযোগ ও আগ্রহ পোষণ করেন না তাহলে মনে হয় ভুল বলা হবে না।’
যাহোক প্রত্যেক ইহুদি গোষ্ঠীই তাদের নিজ নিজ ধারণা থেকে থিওডর হার্জল ও তাঁর ধারার লোকদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তিনিও তাঁর স্বতন্ত্র পরিচালনা দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ইহুদি চিন্তাবিদ ও কর্মীদলের বিক্ষিপ্ত মতামত যাতে মূল যায়নবাদী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে থিওডর হার্জল বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে ২০৪ জন শীর্ষ ইহুদি নেতাকে সুইজারলাণ্ডের বেসলে (Basle) শহরে একত্র করতে এবং প্রথম আন্তর্জাতিক যায়নবাদী সম্মেলন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হন। উক্ত সম্মেলনে তিনি একটি ইহুদি ভূখণ্ড ও রাষ্ট্র গঠনে আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আর এ কাজে যেসব ইহুদি মহল শৈথিল্য প্রদর্শন করছিল তাদের তীব্র নিন্দা জানান। বেসলে সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ছিল নিম্নরূপ :
যায়নবাদের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করা এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুন দ্বারা এর নিশ্চয়তা বিধান করা। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা আবশ্যক :
ক. ফিলিস্তিনে অভিবাসী কৃষক ও শ্রমিকদের মাধ্যমে ইহুদি বসতিসমূহের বিস্তার ঘটাতে হবে।
খ. স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিভিন্ন দেশের নিয়মকানুন অনুসারে সকল ইহুদির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে ও তাদের সংগঠিত করতে হবে।
গ. ইহুদিদের আবেগ ও জাতীয়তাবোধকে লালন পালন ও শক্তিশালী করতে হবে।
ঘ. যায়নবাদের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন সরকারের সম্মতি ও সমর্থন আদায়ের প্রাথমিক পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে।
থিওডর হার্জল এ আন্দোলনের অন্য অনেক নেতার মতের বিপরীতে গিয়ে অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সমাবেশ ও সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপের প্রভাবশালী সরকার ও মহলসমূহের সাথে লবিং করেন এবং বেসলে সম্মেলনে অনুমোদিত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। হার্জল তাঁর যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেসব রাষ্ট্রনায়কের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের মধ্যে ওসমানি শাসক আব্দুল হামিদ, ইংল্যাণ্ডের যোসেফ চেম্বারলিন ও জার্মানির ২য় উইলহাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯০৪ সালে হার্জল মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক ও প্রভাবশালী মহলের সাথে তাঁর আলোচনা যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্রিটিশদের সহযোগিতা আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। যার ফলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বেলফোর ঘোষণা’ সম্ভব হয় এবং ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন প্রদান করা হয়।
ইউরোপে যায়নবাদীদের সুবিধা পাওয়া
বেলফোর ঘোষণার পর প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, যায়নবাদীদের সমস্ত চেষ্টা কেন্দ্রিভূত হবে ইহুদিদের স্থানান্তরিত করে ফিলিস্তিনে এনে পুনর্বাসন করার মধ্যে। কারণ, ইহুদিদের জাতীয় তহবিল ও এজেন্সি এবং অন্যান্য যায়নবাদী সংস্থাও এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নেপথ্যের মূল খেলোয়াড়রা আরো উচ্চতর কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ অনুসন্ধান করতে লাগল। ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের দেশে ইহুদিদের উপস্থিতির কারণে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা এ পরিস্থিতিকে মোক্ষম সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে ইহুদিদের ইউরোপ মহাদেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজটি সেরে ফেললেন। যায়নবাদীরা পূর্ব থেকেই বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে ইহুদিদের ইউরোপ ত্যাগে সাহায্য করার জন্য ইউরোপীয় সরকারগুলোর মধ্যে নিজেদের জন্য একটি পা রাখার জায়গা বের করার পদক্ষেপ নেয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, যদি ইহুদিদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুদীর্ঘ ইতিহাস না থাকত এবং তারা যে সময় থেকে ইউরোপে উপস্থিত হয়েছিল তখন থেকেই এসব দেশের সরকারগুলোর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য চেষ্টা না চালাত তাহলে ইউরোপীয় সরকারগুলোর কাছে সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে তাদের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গের কয়েক বছরের প্রয়াস নির্ঘাৎ বিফলে পর্যবসিত হতো।
যায়নবাদী সংস্থার আনুষ্ঠানিক কর্মতৎপরতার আগে কোন কোন চিন্তাবিদ ও লেখক ইহুদিদের একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীল নকশার পেছনে তাঁদের যে বিপজ্জনক মতলব গুপ্ত ছিল সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতেন। কিন্তু প্রভাবশালী ইহুদিরা এ বিষয়টিকে ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর একটি স্নায়ু যুদ্ধ বলে অভিহিত করত। ইহুদিদের তৎপরতা যখন আরো ব্যাপক আকার ধারণ করল এবং বড় বড় সরকারি পদে তাদের লোকদের অধিষ্ঠিত করা হলো তখন তারা এ বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিল। তখন প্রমাণিত হলো যে, বেসলে সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহই সব নয়- যা যায়নবাদীরা অনুসরণ করছে। এ সম্পর্কিত একটি উদাহরণ হলো Herzl এর বিক্ষিপ্ত ডায়েরিসমূহ যা তাঁর মৃত্যুর ২৬ বছর পরে প্রকাশ হয়। প্রকাশিত এসব লেখা থেকে জানা যায় যে, বেসলে সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে Herzl এর কিছু ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, যেগুলো তিনি কখনোই যায়নবাদীদের আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা-বিবৃতি ও সভা-সমাবেশে উত্থাপন করতেন না। তাঁর নিগূঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আরবদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে, পত্রপত্রিকা এবং সরকারসমূহের অর্থনৈতিক খাতের ওপর গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তীব্রতর করতে হবে যাতে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়।
সুতরাং যখন Herzl এর ন্যায় দুঃসাহসী ব্যক্তি যায়নবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বীয় পন্থাগুলো কৌশলে এড়িয়ে যান তখন এটাই স্বাভাবিক যে, অন্য ইহুদি কর্মীরা এ পন্থাই অনুসরণ করে চলবে। বিখ্যাত মার্কিন শিল্পপতি ও ‘ফোর্ড’ গাড়ি নির্মাণ কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ড ১৯২১ সালে অর্থাৎ বেলফোর ঘোষণার ঠিক ৪০ বছর পরে যায়নবাদীদের প্রোটকলগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেন। অতঃপর এ ব্যাপারে তাঁর অধ্যয়নের ফলাফল তাঁরই কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত একটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। উক্ত গবেষণার একটি স্থানে তিনি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে যায়নবাদীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :
‘যায়নবাদীদের তৎপরতা দুই দিকে কেন্দ্রিভূত হয়েছে : একদিক থেকে তাদের চেষ্টা হলো সকল অ-ইহুদি রাষ্ট্র (অর্থাৎ যেসব রাষ্ট্র তাদের আধিপত্যের অধীনে নেই)-কে উৎখাত করবে। অপরদিকে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। তারা অনেক হৈচৈ শুরু করে। কিন্তু এ সবকিছুই ছিল সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশা বাস্তবায়নের একটি অজুহাত মাত্র। ইহুদি রাষ্ট্রের তত্ত্ব একটি আবরণ মাত্র। এতে আরো অনেক অভিসন্ধি নিহিত রয়েছে। খনিজ সম্পদ এবং বিশেষ করে তেল সম্পদকে হস্তগত করা সেসকল অভিসন্ধির অন্যতম। আর গোপন অভিযান পরিচালনার জন্য শক্তি সঞ্চয় করাও আরেকটি অভিসন্ধি। ইয়াহুদ ইকোনমিক্স ও পলিটিক্স দুটিই তাদের হাতে চায়।’
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা গঠনের পর অসংখ্য ইহুদি সংস্থা ও সংগঠন নানাবিধ কার্যক্রম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এসব সংস্থা ও সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ধরনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং নতুন নতুন যায়নবাদী সংস্থার উৎপত্তি লাভের কারণ হয়। তবে যায়নবাদী সংস্থাসমূহের কর্মকাণ্ডের স্বরূপ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে, যায়নবাদীরা যেহেতু সর্বদা তাদের কার্যক্রমে ইহুদি সমাজের ভিতকে মজবুত করার এবং ঐ সকল লোক তৈরি করার উদ্দেশ্যটি গোপন রাখত যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় শক্তিবর্গের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে, অপরদিকে ইসরাইল বিষয়ে তাদের সংস্থাসমূহের আচরণগত দিকটিই ফলাও করে প্রকাশ করত যা পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথে একই ধারার ছিল, তাই এ ধারার গোপন দিকটি সর্বদা অজ্ঞাত ও অজানাই থেকে যায়। নিম্নে এরূপ কিছু যায়নবাদী সংস্থা ও সংগঠনের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা World Zionist Organization (WZO) প্রথমে Zionist Organization নামে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত যায়নবাদীদের প্রথম সম্মেলনে গঠিত হয়। তখন এটি যায়নবাদী সংস্থাসমূহের একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের পরিকাঠামো রূপে ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য একটি বাহ্যিক ইহুদি সোসাইটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। ইহুদিদের মধ্যে যারা যায়নবাদী কর্মসূচিকে গ্রহণ করত তারা সকলেই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হত। Zionist Organization প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই যায়নবাদ একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক, অভিবাসন ও গবেষণা তৎপরতা পরিচালনার উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। এসব উপকরণ তথা মাধ্যমসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেগুলো থিওডর হার্জল-এর এই সংস্থার নেতৃত্বে থাকাকালে (১৮৯৭-১৯০৪ খ্রি.) উৎপত্তি লাভ করে। সেগুলো হলো :
১. ইহুদি ঔপনবেশিক ট্রাস্ট (JEWISH COLONIAL TRUST) : যায়নবাদীদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করত।
২. ইহুদি জাতীয় তহবিল (The Jewish National Fund) : ভূমি ক্রয় করার নিমিত্তে এ তহবিল গঠন করা হয়, যে ভূমি ইহুদি জাতির চিরকালীন সম্পদ হিসাবে থেকে যাবে।
৩. ডিভোল্ট : সংস্থার অফিসিয়াল বডি।
পর্যালোচনা
বিশ্বের অনেক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় তা অতীতের হোক, কিম্বা বর্তমান ও ভবিষ্যতেরই হোক, কোন একভাবে যায়নবাদীদদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণেই বিশ্ব যায়নবাদকে জানা কেবল আবশ্যকই নয়; বরং যায়নবাদী শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য তা প্রাথমিক প্রস্তুতিস্বরূপ। যায়নবাদ হচ্ছে এমন এক আবিষ্কার যার সাথে বিশ্ব কমপক্ষে এক শতককাল ধরে পরিচিত। যে যায়নবাদ অর্ধশতক কাল ধরে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের চেহারা ধারণ করে বিশ্বের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরেছে। যায়নবাদ প্রতিষ্ঠার একেকটি বছর উদ্যাপিত হচ্ছে আর বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে মুসলিম জাহানের জন্য এর কুফল ফুটে উঠছে। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ্বে প্রথম বারের মতো যায়নবাদী ধারণা উত্থাপন করা হয়, প্রতিশ্রুত মসীহ্’র প্রতি বিশ্বাসের সূত্র ধরে। কারণ, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের উপকণ্ঠে অবস্থিত যায়ন (Zion) পাহাড় থেকে আবির্ভূত হবেন। আর প্রতিশ্রুত মসীহ্’র আবির্ভাবের জন্য যথোপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিবেশ প্রস্তুত করা অপরিহার্য ছিল। এর ফল দাঁড়ায়, এ অঞ্চলে ইহুদিদের একটি স্বদেশ গড়ে তোলা। আর ইহুদিরা যে ঐতিহাসিক ধারণা পোষণ করে হযরত দাউদ ও সুলায়মান আলাইহিমাস সালামের আমলে এ অঞ্চলে তাদের একটি রাষ্ট্র ছিল, এ কারণে তাদের পূর্বের চিন্তায় এ অভিযাত্রা জ্বলে ওঠে। এ গতি আরো বেগবান হয়ে ওঠে যখন ইহুদি সাহিত্যিকরা লিখিতভাবে বিশ্বের ইহুদিদের ওপর আপতিত নিদারুণ নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁরা পরিত্রাণের একটি মাত্র উপায় নির্দেশ করেন। তা হলো ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস আরো পুরাতন। কোন কোন ঐতিহাসিক একে হযরত মূসা (আ.)-এর আমল থেকেই বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ হযরত সুলায়মান (আ.)-এর শাসনামল ও ফিলিস্তিনে ইবরানি (ইহুদি) রাষ্ট্রের পতনের পরের সময় থেকে বলে মনে করেন, যখন ইহুদিরা ১২ আসবাতে বিভক্ত হয়ে এ ভুমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব যায়নবাদী আন্দোলন ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎপত্তি লাভ করে কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বর্ণনার মাধ্যমে। সাহিত্যভিত্তিক যায়নবাদ ইহুদি ও প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। তারা সমগ্র বিশ্বে ইহুদিদের দুর্দশা ও দুর্ভোগের দিকটা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রবক্তা ছিল। তাদের ভাষায় তাওরাত ও তেলমুদ গ্রন্থের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ইহুদিরা ভবঘুরে অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে এবং দুধ ও মধু’র দেশে পদার্পণ করবে। এভাবে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো হয়।
মার্টিন লুথার ছিলেন প্রোটেস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। এ সম্প্রদায়কে ‘যায়নাবাদী খ্রিস্টবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বলে রাখা দরকার যে, ইহুদিদের জন্য একটি ইহুদি রাষ্ট্রের আবশ্যকতা এবং তা প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি সম্পর্কে যাঁরাই লেখালেখি করতেন তাঁরা সকলেই যে ইহুদি ছিলেন তা নয়; বরং এমন অনেকেই ছিলেন যাঁদের ‘যায়নবাদী খ্রিস্টান’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, এতে তাঁরা ইহুদিদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারবেন। একারণে ঐ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদেরকে সেখানে স্থানান্তরিত করতে হবে। যায়নবাদী খ্রিস্টান মূলত তারাই যারা প্রোটেস্টান সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিল এবং বিশ্বাস করত যে, হযরত ঈসা মসীহ্র যায়ন পাহাড় থেকে আবির্ভাবের তিনটি শর্ত রয়েছে :
১. বৃহত্তর ইসরাইল (নীল থেকে ফোরাত) প্রতিষ্ঠা করা। যা ইসরাইলের পতাকায়ও প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ, ইসরাইলের পতাকায় যে দুটি নীল দাগ রয়েছে তা আসলে নীল ও ফোরাত এ দুই নদীর প্রতীক। আর মাঝখানে ইহুদিদের পতীক হিসাবে একটি স্টার অঙ্কিত। অর্থাৎ এ দুই নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় কেবল ইহুদিরা থাকবে।
২. বাইতুল মুকাদ্দাসকে ধ্বংস করা এবং সুলায়মানের ইবাদতখানা পুননির্মাণ করা।
৩. আরমাজদুন যুদ্ধ সংঘটিত করা।
তবে বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার নাম তালিকাবদ্ধ করা হলেও তালিকার শীর্ষে স্থান পায় দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, আফ্রিকা মহাদেশের কোন এক এলাকা আর মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। কিন্তু ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি ও সমৃদ্ধ ধর্মীয় চেতনা বিদ্যমান না থাকায় আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার নাম কাটা যায় এবং তিনটি কারণে ফিলিস্তিনকেই বেছে নেওয়া হয়। যথা :
১. ধর্মীয় চেতনার বিবেচনায় : তাওরাতের আসফারে ‘দুধ’ ও ‘মধুর’ ভূখণ্ড নামে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে।
২. ঐতিহাসিক ভিত্তির বিবেচনায় : এটা তাওরাতের অনুসারী ইহুদিদের ঐতিহাসিক ভূমি ছিল। কারণ, হযরত মূসা (আ.) তাদের এই ভূখণ্ডেরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বনি ইসরাইলের নবি হযরত দাউদ ও হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ৮০ বছরের শাসনামল এ অঞ্চলেই কায়েম ছিল।
৩. তিন মহাদেশের সম্মিলনস্থল : ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভৌগোলিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে অতীব কৌশলগত স্থানে অবস্থিত। যে কেউ এ অঞ্চলে ভিত গড়বে সে তিন মহাদেশের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠাকারী ভূণ্ডমধ্যসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া এ অঞ্চল ছিল ইংরেজ উপনিবেশের অধীনে। কাজেই ইংরেজদের মাধ্যমে এখানকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করা সহজতর ছিল।
মূসা মন্টিফিওর (Moses Montefiore) তাঁর একাধিকবার সফরকালে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন যাতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে কোন একভাবে ইহুদিদের মালিকানাধীন করে ফেলতে সক্ষম হন। তিনি ইহুদি ও ইংরেজদের জাতীয় পরিষদের প্রধান ছিলেন। তিনি তাঁর মূল কর্মতৎপরতাকে কেন্দ্রিভূত করেন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি দেশ গড়ে তুলতে। এভাবে অন্যান্য স্থানে উপনিবেশ গড়ে তোলার কাজ বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিন অভিমুখি কার্যক্রম পরিচালিত করা হলো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জোর পদক্ষেপে চলতে থাকল ইহুদিদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তর এবং সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তোলার কাজ।
অবশ্য এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটে তা ছিল যায়নবাদ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক রূপ পরিগ্রহ করার আগের পর্যায়। তারপর যখন ইহুদিদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তর করার কাজ শুরু হলো তখনই বিভিন্ন যায়নবাদী ইহুদি সংস্থা ও সংগঠনেরও আত্মপ্রকাশ শুরু হলো। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে জড়ো হওয়ার জন্য প্ররোচিত করাই তাদের প্রধান কাজ ছিল।
যায়নবাদের শেষ লক্ষ্য বিশ্বের গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাদের এ প্রয়াস অবশ্য আরো আগে থেকেই শুরু হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জাতির চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাগের খাখাম হাশুরুন ঘোষণা করেন : ‘যদি বিশ্বের ওপর আমাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রথম হাতিয়ার হয় স্বর্ণ, তাহলে প্রচারমাধ্যম হবে আমাদের দ্বিতীয় হাতিয়ার!’ স্বর্ণ যদি ইহুদিদের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক, বিভিন্ন জাতির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার অস্ত্র, ইহুদিদের বিত্তশালী করার উপায় এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উসিলা হয় তাহলে প্রচারমাধ্যমও নিশ্চয় ইহুদিদের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাকে পাল্টে দিতে সক্ষম হবে এবং ক্রমে ক্রমে বিশ্ব জনমতের ওপর ইহুদিদের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
এভাবে একের পর এক যখন যায়নবাদের ভূমিকা প্রস্তুতকরণের পর্যায়গুলো অতিক্রান্ত হয় তখন থিওডর হার্জল যায়নবাদের সুসংগঠিত প্রয়াস আরম্ভ করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ডের বেসলে শহরে তিনি যে যায়নবাদী ইহুদি শীর্ষ নেতাদের যোগদানে সম্মেলনের আয়োজন করেন সেখানে তাঁর আহ্বান ছিল দুটি :
১. বিশ্বের সকল ইহুদিবিরোধী রাষ্ট্র তথা সরকারকে উৎখাত করা।
২. তিন মহাদেশের সম্মিলনস্থলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এমর্মে তিনি Protocols of Jews নামে প্রচারমাধ্যম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করে গভীর ও সর্বব্যাপী এক যায়নবাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং বাস্তবায়ন করতে থাকেন। বেসলে সম্মেলনের কয়েক মাস পরে যায়নবাদী সংস্থার প্রধান হার্জল ঘোষণা করেন : ‘আমরা যদি বিশ্ববাসীকে বলি ইসরাইল রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করে ফেলেছি, তাহলে হয়ত তারা আমাদের কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিতে পারে। পাঁচ বছর পরেও হয়ত একই কথা। কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে অবশ্যই তারা এ রাষ্ট্রকে দেখতে পাবে।’ আর ঠিক এর পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসে অর্থাৎ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে যায়নবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, হার্জল নিজেও ইহুদি মহারথিদের হাতের নিছক একটি ঘুটিবিশেষ। কারণ, এর আরো পঞ্চাশ বছর পূর্বে ব্যারন রুশিল্ড (Baron Rothschild) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। ইহুদিদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হতো কেবল ফিলিস্তিনে ইহুদি বাসিন্দাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়।
১১৭১ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনে মাত্র ১৪৪০ জন বসবাস করত। আর ১২৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাইতুল মুকাদ্দাসে মাত্র দুটি পরিবার ছিল। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৪৫ জন। আর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এগার হাজার জন এবং ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কুড়ি হাজার জন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর এবং ইংরেজ নেতৃবৃন্দ ধনাঢ্য ইহুদি রুশিল্ডকে যায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ইংল্যান্ড ও ইহুদিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে ইংল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদিদের কাছে অর্পণ করবে। এরূপে ইংরেজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর কর্তৃক ইহুদিদের জাতীয় স্বদেশ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। আর এসময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা হওয়ার ১০ বছর পরে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লক্ষ। আর ১৭ বছর পরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষে। যখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে তখন তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৬ হাজার। আর যখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে বের হয়ে যায় ততদিনে ত্রিশ বছর ধরে প্রায় সাত লাখ ইহুদিকে সেখানে বসতি স্থাপন করানো হয়, যা তৎকালীন ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অতঃপর যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে ইহুদিদের সংখ্যা পঁচিশ লাখে পৌঁছায় এবং বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৬০ লক্ষাধিক।
বিশ্ব যায়নবাদী সংস্থা গঠিত হওয়ার পর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত ওসমানি সম্রাট আবদুল হামিদের সাথে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হস্তগত করার জন্য দর কষাকষি করা। বিনিময়ে তারা অঙ্গীকার করে যে, ওসমানি সাম্রাজ্যের সকল দেনা পরিশোধ করে দেওয়া হবে। সম্রাট তা গ্রহণ করেননি। এরপর তারা জার্মানির মধ্যস্থতা চায়। কিন্তু ইহুদি সমাজের যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সাথে জার্মানির পরিচয় ছিল সে কারণে তারা এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয় নি। ইতিমধ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার কারণে বিশ্ব যায়নবাদী ফ্রন্ট নতুন এক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে যোগদান করে এবং পর্যায়ক্রমে ফ্রন্টের সদস্যরা Hibbat Zion এর ন্যায় বিভিন্ন গ্রুপভুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরূপে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এরাই সশস্ত্র বাহিনী রূপে ফিলিস্তিনে আসে। প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রথম যারা ইহুদি মুহাজির রূপে ফিলিস্তিনে পদার্পণ করে তারা ঐ সকল ইহুদি ছিল না যারা রাশিয়া কিম্বা পূর্ব ইউরোপের নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে বেঁচে গিয়েছিল। বরং তারা ছিল একদল যুদ্ধবাজ, যাদের লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের এই অঞ্চলে স্থানান্তরিত ও বসতি স্থাপনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তারা প্রথম থেকেই ‘হাগানা’ (Haganah) ও ‘হাশুমির’ (Hashumir) নামে দুটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। পরবর্তী ফ্রন্টগুলো স্ট্রেন (Stern) ও ইরগুন (Irgun) নামে গঠিত হয়। এ কয়টি যায়নবাদী ফ্রন্টের কাজ ছিল ইহুদি এজিন্সির আর্থিক সহায়তায় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করা। ফ্রন্টগুলো গঠন হওয়ার পর ইহুদি এজেন্সি এদের কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং এদের পরিকল্পনা ও আর্থিক মদদ যোগান দিতে থাকে। ইহুদিদের এ ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করা হতে থাকে। কিন্তু যে বিষয়টি ফিরে দেখার দাবি রাখে তা হলো ইহুদিরা কি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি খরিদ করেছিল, নাকি করে নি?
ইহুদিরা বিভিন্ন ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড খরিদ করার জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা যেহেতু জানত, এ কারণে বলত, ‘তারা ইহুদি, তাদের কাছে জমি বিক্রয় কর না।’ ফলে বিভিন্ন যোগাযোগ ও মাধ্যম প্রয়োগ করে তারা কেবল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ১ থেকে ৩ শতাংশ জমি ক্রয় করতে পেরেছিল। তারপর যখন ইসরাইলের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায় তখন সমগ্র ফিলিস্তিন জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নির্দেশ জারি করে : যদি কেউ ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রয় করে তাহলে তার রক্ত (অর্থাৎ তাকে হত্যা করা) বৈধ হয়ে যাবে।’ এ কারণে আর কোন জমি বিক্রয়ের ঘটনা ঘটেনি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যখন ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল তখন সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মাত্র আড়াই শতাংশ যায়নবাদীদের মালিকানায় ছিল। আর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা এ এলাকা ছেড়ে চলে যায় তখন যায়নবাদীরা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৬ শতাংশ ক্রয় করেছিল। অবশিষ্ট ৯৪ শতাংশ ভূখণ্ড ফিলিস্তিনিদেরই মালিকানাধীন ছিল। যায়নবাদীদের একটি কৌশল ছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর পাশাপাশি যায়নবাদীদের একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ইংরেজরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সমর্থনে নানা স্টেটমেন্ট জারি করা এবং গ্রন্থ রচনার কাজ জোরেশোরে চালায়। এসব তৎপরতার বেশিরভাগই ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি সরকারের আমলে সম্পন্ন হয় এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। পরে ইহুদি ও ব্রিটিশদের যোগসাজশে তা আরও সুসংগঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের এসব পদক্ষেপের মধ্যে একটি হলো ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত শ্বেতপত্র যা ব্রিটেনের আইন সভা কর্তৃক ডিজাইনকৃত। আর ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ মারফত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভাগাভাগির প্রস্তাব পাশ করানো হয় যা ১৮১ নং প্রস্তাব নামে খ্যাত। ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের চাপেই জাতিসংঘ এ প্রস্তাব পাশ করতে বাধ্য হয়। উক্ত প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিভাজিত হয়ে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রায় ৫৬ শতাংশ ভূখণ্ডবিশিষ্ট। আরেকটি ফিলিস্তিনি আরব রাষ্ট্র প্রায় ৪৪ শতাংশ ভূখণ্ডবিশিষ্ট। আর বাইতুল মুকাদ্দাস ঘোষিত হলো নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক এলাকারূপে। অথচ এ সময়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মাত্র ৬ শতাংশ ইহুদিদের হাতে ছিল। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ কি তার ১৮১ নং প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারত, নাকি এতে অনেক আইনগত বিতর্ক চলে আসে?
নিঃসন্দেহে আইনগত দিকে দিয়ে জাতিসংঘ কখনোই এরূপ প্রস্তাব পাশ করতে পারত না। কারণ, নির্দিষ্ট সীমারেখাবিশিষ্ট একটি দেশকে সেখানকার অধিবাসীদের ইচ্ছার বিপরীতে অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করার কোন আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি নেই। তাই ঐ সময় থেকেই ইহুদিদের মুখেই ফিলিস্তিন ভাগাভাগির গুঞ্জন শুরু হয় এবং ব্রিটিশদের সহযোগিতায় তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। ১৮১ নং প্রস্তাব পাশ হওয়ার সাথে সাথে ইংরেজদের মাধ্যমে এমন দমন নিপীড়ন চালানো হয় যে, কোন ফিলিস্তিনির হাতে একটি চাকু থাকার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। অথচ খোদ ইংরেজরাই ইহুদিদের প্রকাশ্যে সমরাস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করত। অতঃপর যখন স্থির হলো যে, ইহুদিরা আরবদের বসত এলাকা থেকে অপসারিত হবে তখন তারা চুক্তি ভঙ্গ করল এবং উক্ত এলাকা থেকে সরে গেল না। কিন্তু ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানরা ইহুদি বসতি এলাকা থেকে সরে এল। এভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এ এলাকায় জন্ম হলো একটি অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্রের যার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম ডেভিড বেন-গুরিয়ান (David Ben-Gurion)।
(সৌজন্যেঃপ্রত্যাশা লেখকঃআব্দুল কুদ্দুশ বাদশা)
(https://www.facebook.com/itmmovement)
বিষয়: বিবিধ
১৮২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন