খারেজি-ওয়াহাবী (তাকফিরি,সালাফি,আহলে-হাদীস) বেদা’আতিদের জন্ম,বিকাশ ও বিস্তার;পর্ব-১

লিখেছেন লিখেছেন সত্যবাক১৯৭৯ ২৯ জুন, ২০১৩, ০৮:৪৩:৫৪ রাত

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সৃষ্ট (দেখুন: wahhabism:A critical Essay by Hamid Algar; University of California) এবং সৌদি পেট্রো- ডলারে বিস্তার লাভ করা ওয়াহাবী( নব্য-খারেজী) মতবাদ মুসলিম সমাজে বিষবাষ্পের মত ছড়িয়ে পড়ছে । যা থেকে বাঙলাদেশের কওমী মাদ্রাসাসমূহও মুক্ত নয় ।ওয়াহাবী(নব্য-খারেজী) মতবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে বাঙলা–আফগান-পাক-ইন্দো তালিবান জঙ্গি সমাজ । আর এদের কুকর্মের ঘানি টানতে হচ্ছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে । তদুপরি এই নব্য খারেজীরা দেশে দেশে মাজহাবী সঙঘাত সৃষ্টি করছে ।

বাংলাদেশে এই ইয়াজীদের বংশধররা লুকিয়ে আছে । এবং সাস্প্রদায়িকতা ও মাজহাবী ফিতনা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে । দাড়ি–টুপি,কোট-প্যান্ট এর আড়াল হতে এদেরকে টেনে বের করা আমাদের দায়িত্ব ।সৌদি এ্র্যাম্বাসীর পেট্রো-ডলার খাওয়া এই সকল ছদ্দবেশী জঙ্গিদের কে চিনতে হলে আমাদের জানতে হবে ওয়াহাবী (নব্য খারেজী) দের ইতিহাস ও তাদের অসার মতবাদ সম্পর্কে । আর এটা জরুরি । কারন আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক , জঙ্গিমুক্ত সুন্দর ও নিরাপদ বাংলাদেশ চাই ।

বর্তমানে দেশে একশ্রেনীর আলেম দেখা যাচ্ছে যারা কুরআন-হাদীস না জানলেও জানে ইবনে তাঈমিয়ার নিকৃষ্ট,ভ্রাতৃঘাতি,অসভ্য ও পাগলাটে ফতওয়াসমূহ সম্বন্ধে আর জানে বেদায়াত- বেদায়াত বলে জিগির তুলতে । জানে শিয়া কাফের, শিয়া কাফের বলতে ।আর এদেরকে কিছু বললে এদের উত্তর হল “ ইবনে তাঈমিয়া তার ফতওয়ায় বলেছেন ---------------''

আর ওয়াহাবী (নব্য খারেজী) মতবাদের ৭৫% কনসেপ্ট এসেছে এই ইবনে তা্ঈমিয়ার চিন্তাধারা থেকে । তাই এই লোকটি কে??? তা সম্পর্কে জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি । আসলেই কি এই ব্যক্তি ''বড়" আলেম; তা জানা জরুরি ।এই পর্বে আমি ইবনে তাঈমিয়া সম্পর্কে পাঠককে একটি স্পষ্ট ধারনা দিতে চাই ।

ইবনে তা্ঈমিয়ার পুরো নাম আাহমদ ঈবনে আব্দুল সালাম ইবনে আবদুল্লাহ আবু আল আব্বাস তাকি- আল –দ্বীন ইবনে তাইমিয়া আল হাররানী । তিনি ৬৬১ হিজরী সনে তথা ১২৬৩ খৃষ্টাব্দে দামেস্কের হার্রান অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেন্ । তার পিতা ছিলেন এ অঞ্চলের হাম্বলী মাজহাবের ফকীহ যিনি “শাইখুল বালাদ” নামে পরিচিত ছিলেন । ইবনে তা্ঈমিয়া হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি এই মাযহাবের প্রতি খুব কমই অনুগত ছিলেন । ইবনে তা্ঈমিয়া নিজে ছিলেন তার প্রবর্তিত মতবাদের একজন মুফাস্সির ও হাদীস বিশারদ । তার ছিল বিশেষ ধরনের লিখন কৌশল ও তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি । যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন,“ আমি তার মত এমন আর কাউকে দেখিনি যিনি এত দ্রুত বিষয়ভিত্তিকভাবে কুরআনের আয়াতসমূহ স্মরনে আনতে পারেন ” ।

বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবনে কাসির লিখেছেন “ হিজরি ৬৬৭ সালে ইবনে তা্ঈমিয়ার বয়স যখন ৬ বছরের বেশী ছিল না , তখন হাররান শহরের উপরে মোঙ্গলদের চাপ এতো ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তাদের হামলার ভয়ে হাররানবাসীরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ইবনে তা্ঈমিয়াও সপরিবারে সেসময় হাররান থেকে দামেস্কে চলে গিয়েছিল ” ।

দামেস্কে ‘দারুল হাদীস’ এর দায়িত্ব নেন ইবনে তা্ঈমিয়ার পিতা । এখানে ইবনে তা্ঈমিয়া কৈশোর ও যৌবনে পড়ালেখা সম্পন্ন করে কালক্রমে হাম্বলী মাজহাবের ‘ইজতিহাদ’ এর যোগ্যতা অর্জন করেন । তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কুরআন তাফসীর পড়ানোর কাজে নিয়োজিত থাকেন । ৬৯৮ হিজরি পর্যন্ত ইবনে তা্ঈমিয়ার চিন্তাধারা সম্পর্কে তেমন কিছু শোনা যায় নি ।

মুসলমানদের সুপ্রতিষ্টিত ধারনা- বিশ্বাসের সাথে ইবনে তা্ঈমিয়ার মতবাদের ব্যাপক দ্বন্ধের ফলশ্রুতিতে সিরিয়ার জনগন ও আলেম সমাজে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । যার প্রেক্ষিতে সিরিয়ার আদালত তার বিরুদ্ধে ৭০৫ হিজরি সনে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয় । সাজা ভোগের পর ৭০৭ হিজরি সনে তিনি মুক্ত হন এবং পরবর্তিতে সিরিয়ায় ফিরে এসে তার মতামতের অনুকূলে পুনরায় লেখা শুরু করেন । তাই, ৭২১ হিজরি সনে তিনি আবারো কারাবরন করেন । এবং এ অবস্থাতেই ৭২৮ হিজরির জিলক্বদ মাসে দামেস্কের কারাগারে মারা যান । ইবনে তা্ঈমিয়া তার জীবনের অধিকাংশ সময় কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া এবং দামেস্কের জেলে আটকে ছিলেন । তার উদ্ভট, বিভ্রান্তিকর এবঙ কুরআন, সুন্নাহ পরিপন্থি লেখার জন্যই তাকে এ শাস্তিবরন করতে হয় । বিশেষত তিনি তার “ আল আকিদা আল হামাভিয়্যা” এবং “ আল ওয়াসিসিয়্যা” গ্রন্থে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহ তাআ’লার হাত,পা,মুখমন্ডল থাকার উদ্ভট মতবাদ প্রকাশ করেন এবং তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে মহান আল্লাহ তাআ’লা উধ্বাকাশে তার সিংহাসনে বসে আছেন, আল্লাহ সিড়ি বেয়ে আকাশ থেকে নেমে আসেন । এই যে কুরআনের আয়াতের হাস্যকর সম্পূর্ন আক্ষরিক অর্থ করা, ছিল ইবনে তা্ঈমিয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য । ইবনে তা্ঈমিয়ার পূর্বে আল্লাহ তাআ’লার অবয়ব সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসসমূহের আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার একেবারেই প্রচলিত ছিল না এবং এ অর্থে তার এই মতবাদ সম্পূর্ন বিদআত’ই মতবাদ ।

ইবনে তা্ঈমিয়া নবী- রাসূল,ওলী- আউলিয়াদের মাজার মেরামত,মাজারের নিকটে মসজিদ নির্মানের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তিনি এগুলোকে শির্ক আক্ষায়িত করেন ।তার এই ধৃষ্টতায় ত্দকালীন আলেম সমাজ প্রতিবাদের ঝড় তোলেন ।

ইবনে তা্ঈমিয়া ইসলামী ইরফান/সূফী শাস্ত্রের সর্বসম্মত জনক মুহিউদ্দিন আল-আরাবীর শক্তিশালী মতবাদকে মেনে নিতে পারেন নি । এবং নিজ মতবাদের প্রচারের পথে অন্তরায় মনে করতেন । তাই তিনি, মুহিউদ্দিন আরাবীর লেখা “ফুসুসুল হিকাম’’ গ্রন্থটিকে কটাক্ষ করে পাল্টা একটি গ্রন্থ ‘ আন্নুসুস আলালফুসুস’ রচনা করেন । যেখানে তিনি আকল-বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে যুক্তি খন্ডন না করে বরং মুহিউদ্দিন আরাবীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অশোভন মন্তব্য করেন । আর ইবনে তা্ঈমিয়া তার মতবাদের বিরোধীদের এভাবে অশোভনভাবে অপদস্ত করতে পছন্দ করতেন ।

ইবনে তা্ঈমিয়ার বিরাট সংখ্যক ফতওয়া সুন্নী চার মাজহাব ও শীয়া মুসলমানদের ধর্মীয় আহকাম ও আকিদার পরিপন্থি ছিল । এবং তিনি মাযহাব সমূহের মধ্যে বিদ্বেষ এবং ঝগড়া ছড়ানোর চেষ্টা করতেন ।

তিনি নিজেকে সালাফী বলে আখ্যায়িত করতেন । সালাফীদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা ইজতেহাদ ও ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যার বিরোধী এবং কুরআন ও হাদীস এর আক্ষরিক অর্থই যথেষ্ট বলে মনে করত এরা । উল্লেখ্য,আফগান তালিবান,বর্তমান দেওবন্দী এবং বাংলাদেশী কওমী মাদ্রাসাসমূহের ছাত্ররা বহুলাংশে সালাফী মনোভাবাপন্ন ।

এ সকল কারনেই তাকিউদ্দিন সুবকী,ইবনে হাযার হাইসামী,আল- ইজ্জ ইবনে জামা’আ প্রমুখ শাফেয়ী মাজহাবের প্রসিদ্ধ ঈমামগন ইবনে তাঈমিয়ার বিরুদ্ধে আনুস্ঠানিক ফতওয়া দেন যে,''ইবনে তাঈমিয়া বিচ্যুত ও সে দ্বীনের মৌলিক বিশ্বাস সমূহ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে । আলেম সমাজ জনগনকে ইবনে তাঈমিয়ার মতবাদ থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দেন । হানাফি মাজহাবের ঈমাম জাহিদ-আল-কাওসারী,ইবনে তাঈমিয়ার বিরুদ্ধে ফতওয়ার সমর্থন দেন এবং তাকে নসিহত করেন ।

ইবনে তাঈমিয়া তার জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটান । এটি এজন্য নয় যে, সে সময়ের শাসক সমাজ অত্যাচারী – অবিচারী ছিল বরং প্রসিদ্ধ আলেমগন ও জনসাধারন এর অভিযোগেই তাকে আটক রাখা হত ।ইবনে বতুতা তার “রিহলাত” গ্রন্থে একটি ঘটনা উল্লেখ করেন । ঘটনাটি এরকম “ একবার ইবনে তাঈমিয়া জুম্মার খুতবায় বলছিলেন আল্লাহ আসমান থেকে সিড়ি বেয়ে নেমে আসেন । এবং তিনি নিজে মিম্বার থেকে দুইধাপ নেমে দেখালেন এবং বললেন “ আল্লাহ আমার মত করেই এভাবে আসমান থেকে নেমে আসেন ।” তার কথার পর লোকেরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে । এভাবে জনসাধারন তার অদ্ভুত অদ্ভুত কথায় রাগান্বিত হত ।

বহু বিখ্যাত আলেম ইবনে তাঈমিয়াকে “দ্বীনচ্যুতী” এর ফতওয়া দেন ।

যেমন-

1. আসসুবকি তার “আর্ রাসাইল আসসুবকিয়্যা ফিয়্যাদ আলা ইবনে তাঈমিয়া ।

2. ইবনে হাযার হাইসামী তার “ আল ফাতওয়া আল হাদিসিয়্যা” গ্রন্থে ।

3. আবু হাইয়্যান আল আন্দালুসী তার “ আননাহর আল মাদ্দ” গ্রন্থে

4. ইবনে হাজার আসক্বালানী তার “ ফাত-উল বারী” গ্রন্থে ।

5. শেখ আহমদ ইবনে যাইনী তার “ফিনাত আল ওয়াহাবীয়্যা” গ্রন্থে ।

6. শেখ মুহম্মদ ওয়াইস (আল আজহারের শেখ) তার “ইবনে তাঈমিয়া লাইসা সালাফিয়্যা” গ্রন্থে।

উল্লেখ্য ঈমাম আশহারি তার কিতাব আন- নাওয়াযের ( Kitab An-Nawader) গ্রন্থে বলেন “ যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআ’লার শরীরী কাঠামোয় বিশ্বাস করল সে আল্লাহকে অবজ্ঞা করল এবং তাই সে কাফির বলে গন্য হবে । ” এই ফতওয়া অনুযায়ী ইবনে তাঈমিয়া ছিলেন কাফির ।

তদুপরি তাঈমিয়ার সমসাময়িক বিখ্যাত আলেমগন তাঈমিয়ার বিরুদ্ধে “ইসলামচ্যুতির” অভিযোগ আনেন এবং সর্বসম্মতভাবে(ইজমা) তার ফতওয়া ত্যাগ করেন ।

ইবনে তাঈমিয়ার বিরুদ্ধে বিশিষ্ট আলেমদের ফতওয়াকে ভিত্তিহীন বলার উপায় নেই । কারন তার রচিত গ্রন্থই তার বিরুদ্ধে কথা বলে । এরকম একজন বিতর্কিত,বিভ্রান্ত,পথভ্রষ্ট ব্যক্তির ফতওয়া কেন এবং কিভাবে আমাদের নিকট গ্রহনযোগ্য হবে পাঠকের কাছে এ প্রশ্ন থাকল ।

ইবনে তাঈমিয়ার যুক্তিসমূহ আমি উপযুক্ত সময়ে খন্ডন করব ।পরবর্তি পর্বে তাঈমিয়ার মতবাদের বাহক ও ওয়াহাবী মতবাদের স্রষ্টা আব্দুল ওয়াহাব নয্দী সম্পর্কে আমরা জানব । ততদিন ভাল থাকুন ।

বিষয়: বিবিধ

৩৪৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File