‘ডাবের পানি খাই না,খেতে ইচ্ছা করে না,স্বাদ পাই না’ (রক্তদান বিষয়ে লেখকের নিজের স্মৃতিআলেখ্য)
লিখেছেন লিখেছেন ওমরী সাদাত ০২ জুলাই, ২০১৩, ১২:০৫:২৮ দুপুর
একটি ডাবের চেয়ে চোখের নুন্তা পানি আমার কাছে অনেক মূল্যবান। কেউ ডাব খেতে দিলে চোখ আর মানতে চায় না, মনের অজান্তেই অশ্রূ চলে আসে জানি না অশ্রূর সাথে ডাবের কি এত বিরাগ! ডাবের পানিতে আমাদের দেহের জন্য কি কি উপকারী উপাদান আছে জানি না। তবে এতটুকু বুঝি যে, এটা মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী, যা প্রশান্তি দেয়, অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে। যখন পলিটেকনিক্যাল কলেজে পড়ি, তখন আমি যে পাড়ার মেসে থাকতাম, সে পাড়ায় মাঝে মধ্যে এক অখ্যাত সেলুনে বসতাম। মাঝে মধ্যে একটু পত্রিকা পড়তাম, চুল-টুল আছড়াতাম, আর সময়ে চুল কাঁটাতাম। ছোট বেলা থেকেই আমি কিছুটা সেলুন মুখি ছিলাম।
অসীম’দা সেলুনের পুরাতন কর্মচারী, দৈনিক এক-দেড়’শ ইনকাম। আমার সাথে খুব-ই ভাব। আমার মাথার সাইজ বুঝে উনি চুল কাঁটতেন ফ্যাশন করে। একদিন অসীম’দাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছিল। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি, কি হলো অসীম’দা এতো মন খারাপ কেন? উত্তরে উনি বললেন, বউদি কে নাকি গতকাল ক্লিনিকে চেকআপ করে জানতে পারলেন যে উনার সন্তান প্রসবের আর মাত্র ২১ দিন বাকি। এটা খুশির খবর হলেও চিন্তার কারণ হলো উনার স্ত্রীর অপারেশন হতে পারে। তার চেয়ে অধিক চিন্তার বিষয় হলো উনার স্ত্রীর ব্লাড গ্রূপটা নেগেটিভ। যা পাওয়া অত্যন্ত দুস্কর। তিন চার দিন পরেও দেখলাম উনার উদাসীন চাহুনী আর ভাবনার বিশাল পাহাড়। যা ঐ পথে আসতে যেতে চোখে পড়লো। একে তো নিম্ন আয়ের অতি দরিদ্র , তার উপর অপারেশন যদি হয় তবে রক্ত যোগাড় করা এক বিশাল চিন্তা। বললাম চিন্তা কইরেন না, আমিই দেব বউদির অপারেশনের জন্য রক্ত। আপনি শুধু বউদির প্রতি একটু নজর দেন বেশি করে। আমার মতো এত ক্ষুদ্র মানুষ, দেখি কতটুকু কি করতে পারি।
এদিকে আমার কাজে আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম। টেকনিক্যাল কলেজে পড়ালেখা একটু ঝামেলার হয় এটা অনেকেই জানেন। সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন ক্লান্ত শরীর-শুয়ে ছিলাম, আছরের আযানের সাথে সাথে পাশের রূমের মোবারক ভাইয়ের মোবাইলে রিং। আমাকে ডেকে বললেন, মনি তোমার ফোন। অসীম না কে যেন মেডিক্যাল থেকে …। ওপাশ থেকেঃ “মনি ভাই নাকি! নমস্কার। বললাম দাদা আসল কথা বলেন, কি খবর বউদির। মিনিট কিন্তু ৭ টাকা। কান্নার স্বরে দাদা বললেনঃ আপনি আমার আপন ভাই। বললামঃ কি হয়েছে বলেন? আপনার বউদিকে তো গত রাতে মেডিক্যালে ভর্তি করালাম। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললঃ বাচ্চার পজিশন ভালো না!
অপারেশন লাগবে ৯০ ভাগ নিশ্চিত। দাদা, আপনি কি সত্যিই রক্ত দিবেন? অবশ্য ডাক্তার এও বলেছেন যে, রক্ত ছাড়া চেষ্টা করবেন। তবে রক্তদাতা প্রস্তুত থাকতে হবে। এরি মধ্যে আমি যত জায়গায় খবর নিলাম কেউ এই গ্রূপের রক্তের খবর দিতে পারল না। এখন ভরসা শুধু আপনিই।” আমি বললামঃ আচ্ছা দাদা এটা একটা কথা বললেন! সমস্যা নাই কখন অপারেশন হবে বলেন, অসীম’দা বললেনঃ আগামী কাল আনুমানিক দুপুরের দিকে হতে পারে। বললাম সমস্যা নাই আমাকে একটা কল করবেন মোবারক ভাই অথবা সোহাগ ভাইয়ের নম্বরে রিং দিয়ে। চিন্তার কারণ নাই ভেঙ্গে পড়বেন না। অন্যদিকগুলো সামলান। আক্ষেপ করে বললামঃ আমার তো আছে শুধু রক্তগুলাই আর তো কিছুই নাই আপনাকে দেওয়ার মত। পরদিন ভর দুপুরে টেকনিক্যাল থেকে আসলাম। হেঁটে এসেছি, তার উপরে রোঁদের তাপ, বাসায় বিদ্যুৎ নাই! ডাবলিং করে থাকি। বালিশের পাশে এক টুকরা কাগজ। মোবারক ভাই লিখেছেনঃ মনি, অসীম’দা ফোন করেছিলেন। বিকাল দুইটায় মেডিক্যালে উনার স্ত্রীর অপারেশন, প্রসূতি ওয়ার্ড। তোমাকে অবশ্যই যেতে বললোঃ চার বার ফোন করেছেন। তরকারী আছে পারলে ভাত রেধে খেও! দুপুরে আমার এক গেস্ট ছিল, তাই ভাত শেষ। কাগজটা পকেটে নিয়ে মনে মনে মোবারক ভাইকে
গালি দিচ্ছি … হায়রে এই পেটটা যদি না থাকতো। ভাত আর খাওয়া হলো না। বুঝতে পারছি ইদানিং মেস মেম্বাররা আমাকে খুবই অবহেলা করছে। কারণ সিডিউল অনুযায়ী বাজার করতে পারছি না কিন্তু খেতে হচ্ছে। এক পরিচিত ভাইয়ের বদলি টিউশনিটাও গত মাসে সে আবার ফিরে আসায় বন্ধ হয়ে গেল। তাতে কত সুন্দর বিকেলের নাস্তাটা ও কিছু হাত খরচ হতো। মা চিটিতে বললো বাবা এই মাসে তোর জন্য টাকাটা পাঠাতে মনে হয় দেরি হবে। মনে মনে আল্লাহকে বলি, তুমি কেন এই অসময়ে আমার বাবাকে তুলে নিলে। যাই হোক এক গ্ল্যাস পানি খেয়ে বাসা থেকে বের হলাম। পেট তো ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি তিনটা খুচরা এক টাকার পয়সা। এ দিয়ে তো মেডিক্যালে আসা-যাওয়া হবে না, মেডিক্যালের দূরত্ব বাসা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার। সামনের গলিতে আমাদের বুয়ার ছেলে মিন্টুর গ্যারেজ। গ্যারেজ গিয়ে মিন্টুকে বললাম, একটা সাইকেল দাওতো ভাই মিন্টু, এই যে একটু সামনে যাবো আর আসবো। বিসমিল্লাহ বলে সাইকেলে উঠে দিলাম টান। মেডিক্যালে গিয়ে প্রসূতি ওয়ার্ড খোঁজে বের করলাম। অসীম’দা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।
বললেনঃ দাদা রক্তের ব্যাগ ও আপনার বউদির রক্তের নমুনা নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। বললাম তা-দেরি কেন চলেন। বললেনঃ আপনার বউদিকে ডাক্তার প্রিপারেশনে রেখেছে। রক্ত হাতে পেলেই অপারেশন শুরূ করবেন। মেডিক্যালের দ্বিতীয় তলা, রক্ত সঞ্চালন বিভাগ। যা যা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা দরকার তা দ্রূত শেষ করে রক্ত নেওয়া শুরূ করলেন ওয়ার্ড কর্মী। অসীম’দা আমার মাথায় আলতোভাবে হাত বোলাচ্ছেন। আমি বললাম
অসীম’দা চিন্তা করবেন না, আমার রক্ত দেওয়ার অভ্যাস আছে। রক্ত নেওয়া শেষ হলে ব্যাগটা অসীম’দার হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটারে যেতে বললাম। পাশে এক ভদ্র লোক সবে মাত্র রক্ত দিয়ে এসে একটি কচি ডাব খাচ্ছে। অসীম’দাকে দেখে মনে হচ্ছে উনারও খুবই ইচ্ছা করছে আমাকে একটা কচি ডাব খাওয়াতে। বুঝতে পারলাম উনার পকেটের অবস্থা খুবই খারাপ। বললাম, অসীম’দা আমি যাই। কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। সামনে পানের দোকান সমেত ডাব ওয়ালার সামনে যাই। ডাবগুলোর দিকে এক নজর দেখে নেই। চিন্তা করলাম এর চেয়ে অনেক বড় বড় ডাব তো আমাদের গ্রামের বাড়িতে আছে। এগুলো এত ছোট কেন! ডাব দোকানীকে ধন্যবাদ দিলাম কারণ তাঁর নিকট আমার বাই সাইকেলটি জমা রেখেছিলাম।
সাইকেলেটা নিয়ে না উঠে, ধরে হাটতে লাগলাম। ভাব যেন রাজপুত্র! এই মাত্র একরাজ্য জয় করলাম। আর সাথে ভয় পাচ্ছিলাম সাইকেল থেকে যেন পড়ে না যাই। যদিও আগে কোন সময় রক্ত দিয়ে কখনো তেমন দুর্বল হইনি। হাটছি আর ভাবছি, হায়রে রক্ত তুই কি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছিস এই দেহে। তোকে শরীরে জমাইতে যে কতো দিন লেগেছে, খেতে পারি বা না পারি।
যাক দুঃখ নাই, কাল যখন অসীম’দা হাসি মুখে বলবে, মনি ভাই সু-খবর হলো আপনার বউদি-বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছেন। মনে মনে ভাবছি খোদার এই পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কি সুখ হতে পারে যে, আমার রক্ত শরীরে নিয়ে দুটি জীবন পৃথিবীতে বাঁচবে, হাসবে, আর ভালোবাসবে মা তার সন্তানকে; সন্তান তাঁর মাকে। হাঁটতে হাঁটতে সাইকেলটা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার পথ শেষ। এবার খানিকটা সাইকেলে উঠে মেসের দিকে ছুটলাম। সাইকেলটা মিন্টুকে দিয়ে বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই আছরের আযান।মোয়াজ্জেন যেন বলছে তোমরা এসো, মানুষ মানুষের জন্য এসো। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি! আজ তেমন খাওয়া-দাওয়া চলা ফেরাতে অসুবিধা হয় না। এখন অনেকটা সচ্ছল। কিনে খেতে পারি অনেক ডাব। ভুরি ভুরি, কিন্তু খাই না।বারবার মনে পড়ে সেদিনের কথা। আমি চাইনা চোখ গুলো অবাধ্য হোক। চাই শুধু মানুষ ভাবুক তাঁর যে রক্তটা আজ একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাবে, সেটা যেন তারও প্রয়োজন হতে পারে, হয়ত বা স্নেহের সন্তানের জন্য, বৃদ্ধা মায়ের জন্য অথবা পরম ভালোবাসার মানুষটির জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২২৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন