"ইচ্ছা পূরনের গল্প"
লিখেছেন লিখেছেন সোহেল মাহামুদ০অতি ক্ষুদ্র একজন০ ৩০ জুন, ২০১৩, ১২:০৩:৪৪ রাত
----------------------------------------------------------------------------------
উৎসর্গঃ
সেই সব স্বপ্নবাজ মানুষদেরকে, অদম্য ইচ্ছার বলে যারা নিজেদের “ইচ্ছা পূরনের গল্প” রচনা করে যাচ্ছে...।
-----------------------------------------------------------------------------------
মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিশাতের।বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে ডিম লাইটটা জ্বালালো ও।বিছানায় অঘোরে ঘুমুচ্ছে জাহিদ। আবছা আলোয় ওর মুখের দিকে তাকাল নিশাত।মুখ হা করে ঘুমানোর অভ্যাসটা আর গেল না জাহিদের। এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। মাঝে মাঝে এটা নিয়ে জাহিদকে খোচাঁয় ও।নিশাত জাহিদের মুখে দিকে তাকিয়ে থাকে।কি মায়াময় মুখ।
নিশাত ভাবতে থাকে।জাহিদ আর ওর বিয়ের কথা যখন চলছিল তখন প্রথমবার জাহিদের ছবি দেখে মোটেও ভাল লাগেনি ওর ।সবাই বলেছিল ছেলেকে দেখতে নাকি বেকুব বেকুব লাগে।কিন্তু সরাসরি যখন দেখল,ছবি আর বাস্তবের মধ্যে মিলই খুজে পাওয়া গেল না।
দিনটি এখনও মনে গড়ে।সকালবেলা নিশাতের বাবা-মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল।নিশাতের মা প্রথম থেকেই জাহিদের সাথে ওর বিয়ের ব্যাপারে রাজি হচ্ছিল না।ছেলের উপার্জন কম।বিয়ের পরে মেয়েকে খাওয়াবে কি? কিন্তু নিশাতের বাবার এক কথা, যৌতুক ছাড়া এর চেয়ে ভাল ছেলে আর পাওয়া যাবে না।শেষ পর্যন্ত নিশাতের মাকে রাজি হতে হল।
রাত আটটায় জাহিদ তার মামার সাথে ওকে দেখতে আসল।নিশাতের মা ইচ্ছে করেই নিশাতকে খুবই সাদামাটা ভাবে সাজিয়ে দিলেন।যাতে ছেলে পক্ষ মেয়েকে দেখে পছন্দ না করে।নিশাতের খুবই মন খারাপ হয়েছিল এজন্য। কিন্তু যখন আয়নায় নিজেকে দেখল তখন আর মায়ের উপর রাগ থাকলো না ওর।কেননা সাদামাটা সাজেও অপূর্ব লাগছিল নিশাতকে।
প্রথম দেখাতেই জাহিদ নিশাতকে মুগ্ধ করেছিল।ছোট বোন নিলুর সাথে যখন ও বসার ঘরে ঢুকল,সঙ্গে সঙ্গে জাহিদ উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো।তখনই প্রথম দুজনের মাঝে চোখাচোখি হল।এরপর আর একটিবারের জন্যও জাহিদ মাথা তুলে নিশাতকে দেখেনি।তখনই মনে মনে আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করছিল যেন এই ছেলের সাথেই ওর বিয়ে হয়।আল্লাহ সেদিন ওর প্রার্থনা কবুল করলেন।বেকুব বেকুব চেহারার এই বিনয়ী ছেলেটার সাথেই ওর বিয়ে হল।
প্রত্যেকটি মেয়েই দাদি-নানীদের কাছে শোনা রূপকথার গল্পগুলো শুনতে শুনতে একদম ছোটবেলা থেকে তার জীবন সঙ্গীর স্বপ্ন দেখে।গল্পের অচিনপুরের রাজপুত্রটি তার শিশু মনের সবটুকু স্থান দখল করে নেয়।সেই রাজপুগত্রকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতে থাকে।
আর অপেক্ষায় থাকে সেই সময়টির, যখন সেই রাজপুত্রের এসে তাকে ঘোড়ায় করে দূর দেশে নিয়ে যাবে।পুতুল খেলতে খেলতে তার মনে ইচ্ছা জাগে সংসার জীবনের।এক সময় মেয়েটি বড় হয়।সেই সাথে বড় হয় তার চিন্তাধারা গুলোও।কিন্তু তার শৈশবের সেই স্বপ্নগুলো আগের মতই রঙ্গীন থেকে যায়।
নিশাতের সকল ইচ্ছা, আকাক্ষা, স্বপ্ন তার এই রাজকুমারকে নিয়েই।ঠিক যেমনটা চেয়েছিল।বরং তার স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু সে পেয়েছে।আর এই রাজপুত্রটিকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন, ইচ্ছা আকাক্ষা।
নিশাত কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়।ছোট্ট একটি সংসার।ছিমছাম, সাজানো গোছানো।বিশাল ব্যালকনিতে ওর পছন্দের ফুল গুলোর যত্ন নিতে নিতে ওর দিন পার হয়ে যাবে। দিনের শেষে তার রাজপুত্র যখন ঘরে ফিরবে, ভালবাসায় বরন করে নিবে তাকে।
কখনো মাঝরাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়, তবে দুজনে মিলে গল্প করে কাটিয়ে দেবে সারা রাত।ভোরের আলো ফুটবে, রাতের সমাপ্তি ঘটবে।তাদের গল্পের থেমে যাবে কিন্তু এর সমাপ্তি হবে না। অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি ঘটাতে আর একটা র্নিঘুম রাতের প্রতিক্ষায় থাকবে ওরা।কিন্তু সেই গল্প আর সমাপ্ত হবে না।র্নিঘুম রাত্রিগুলোতে সেই ভালবাসার গল্প চলতে থাকবে।
কখনো খোলা বারান্দায় বসে দুজনে একসাথে চনন্দ্রোৎসব পালন করবে।চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় পরস্পর চোখের ভাষায় কথা বলবে।সেই মুহুর্তে জগতের সকল ভাষা তাদের দুজনের কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে।তখন শুধু একটিই ভাষা, ‘ভালবাসা’।
বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে।নিশাত ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।নতুন অতিথির কারনে হাটতে একটু কষ্ট হয়।তবুও ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করার উপায় আছে? নিশাত উঠানের দিকে তাকাল।পুরো উঠোন বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ ।বাতাসের বেগ মনে হচ্ছে একটু বেশিই।সোঁ সোঁ করে শব্দ হচ্ছে।ঠান্ডা বাতাস হালকা কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।ভালই লাগল।সেই সাথে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ পরিবেশটা আরও মনোমুগ্ধকর করেছে।নিশাত হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোটা স্পর্শ করলো। বৃষ্টির ঠান্ডা ফোটা হাতে লাগায় ওর শরীরে একধরনের শিহরন বয়ে গেল।
এসময় জাহিদ যদি ওর পাশে থাকতো, তাহলে কতই না ভাল হত।দুজনে একসাথে বর্ষা-উৎসব পালন করতো।কিন্তু জাহিদ এখন ঘুমের রাজ্যে বিচরন করছে।সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শুধু রাতেই একটু বিশ্রামের সুযোগ পায় বেচারা।ওকে এখন ডেকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।অবশ্য এখন যদি নিশাত জাহিদকে ডাকে তবে জাহিদ একটুও রাগ করবে না।মাঝে মাঝে নিশাত এ কাজটি করি।এইতো কিছুদিন আগেও এমনটি করেছিল।মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিশাতের।কি হল? নিশাত নিজের পেটে হাত রাখল।হ্যাঁ! তাই তো! ওর ছোট্ট সোনামনি পেটের ভেতর নড়াচড়া করছে!! একবার! দুইবার!! তিন বার!!!
নিশাত জাহিদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল।
-“এই জাহিদ ওঠ।দেখ কি হচ্ছে।”
-“হুম। ঘুমের ঘোরেই বলল জাহিদ।”
-“এই জাহিদ, ওঠ না বাবা।”
জাহিদ বিছানায় উঠে বসল।চোখ ডলতে ডলতে বলল,
-“কি ব্যাপার ঘুম আসছে না?”
-“না।এই দেখ, আমাদের সোনামনি নড়াচড়া করছে।”
সঙ্গে সঙ্গে জাহিদের ঘুম চলে গেল।তাড়াতাড়ি নিশাতের পেটে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল।
-“কই কোন নড়াচড়া করছে না তো।”
-“এতক্ষন করেছিল তো।ওর নড়াচড়াতেই তো ঘুম ভাঙ্গল আমার।এই যে আবার নড়ছে!” খুশিতে নিশাতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জাহিদ আবারও কান পাতল।কিন্তু এবারও সে কিছু শুনতে পেল না।
-“কই, এবারও তো নড়াচড়া করল না।”
নিশাত নিজের পেটে হাত রেখে ওর সোনামনিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
-“দুষ্টু বাবু! বাপির সাথে মজা করা হয়? নাকি বাপিকে ভয় পাও??”
-“আমাকে বাবু ভয় পেতে যাবে কেন?” জাহিদ ক্ষেপে যায়।
হু তোমাকে ভয় পায়। হি হি।” এই বলে নিশাত হাসতে থাকে।জাহিদ অপলক চোখে নিজের স্ত্রীর হাসি দেখতে থাকে।
-“এই বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চল দুজনে মিলে বৃষ্টি দেখি।” হুট করে বলে উঠল নিশাত।
-“এত রাতে বৃষ্টি দেখব?”
-“মাত্র তো একটা বাজে।”দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল নিশাত।
-“তুমি কি পাগল নাকি?”
-“পাগল হব কেন, আমি হচ্ছি পাগলি। কেন জাননা বুঝি? এখন কথা রাখো উঠো তো,চল বাইরে চল।”
জাহিদ আর কিছু না বলে উঠে পড়ল।চোখ ডলতে ডলতে নিশাতের সাথে বারান্দায় এসে বসল।নিশাত ওর কাধে মাথা রেখে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম।
-“জাহিদ।”
-“হুম।”
-“একটা গান শোনাবে? প্লিজ!”
-“কোন গান শুনবে?”
-“ওই যে বৃষ্টির গানটা।”
জাহিদ কিছু বলল না।বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকল। তারপর গলা খাকারি দিয়ে মৃদু স্বরে গান শুরু করল।
“পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে
চেনাশোনার কোন বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে
ঘরের মুখে আর কি রে …......”
বৃষ্টির শব্দের মাঝেও নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল নিশাত।স্বপ্নের রাজকুমারকে সে পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাকে নিয়ে তার ইচ্ছা-“আকাক্ষাগুলো এখনও অপূর্নই রয়ে গেছে।অভাব তার ইচ্ছাগুলোকে দমিয়ে রেখেছে।কিন্তু নিশাত বিশ্বাস করে, তার ইচ্ছাগুলো একদিন পূরন হবেই।সে কল্পনা করতে থাকে।
নিজের ডেস্কে বসে একমনে কাজ করছে জাহিদ।এই অফিসের এ্যাসিসটেন্ট ক্যাশিয়ার সে।অত্যন্ত বিনয়ী ছেলে বলে সবাই ওকে পছন্দ করে।বিশেষ করে জিএম সাহেব ওকে খুবই স্নেহ করেন।তবে দু-“একজন ওর বিনয়ের ফায়দাও নিয়ে নেয়।বিশেষ করে ক্যাশিয়ার সাহেব।বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সব কাজ জাহিদকে দিয়েই করিয়ে নেয়।জাহিদ সেটা বুঝতে পারে।কিন্তু কিছু না বলে একমনে কাজ করে যায়।ওর কথা হচ্ছে, কাজকে ফাঁকি দেয়া মানে নিজেকে ফাঁকি দেয়া।কাজ থাকলে তা করতে হবে।ফল একসময় আসবেই।
অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু বেশিই ব্যস্ততা ওর।আজ মাসের শেষ তারিখ।এ মাসের ক্যাশ টাকার হিসাব কমপ্লিট করে রাখতে হবে।কাজটা খুবই মনোযোগ দিয়ে করছে জাহিদ।কারন যা করার ওকেই করতে হবে।ক্যাশিয়ার সাহেবের ওপরও ভরাসা রাখা যাবে না।উনি একাউন্ট ভালমত চেক না করেই জমা দিয়ে দেবেন।তাই একটু ভুল হলেই সর্বনাশ।ঠিক এমন এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। জাহিদ কাজ রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল ওর শ্বশুরের নাম্বার। তাড়াতাড়ি রিসিভ করল ও।
-“স্লামালিকুম আব্বাজান। কেমন আছেন?”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি তোমার আম্মাজান বলছি।” ফোন করেছে ওর শ্বাশুড়ি।
-“জ্বী আম্মা, স্লামালিকুম।আপনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন? আব্বাজান কেমন আছেন??”
-“সবাই ভালই আছে। তা বাবাজি আমার মেয়ে কেমন আছে শুনি।”
-“জ্বী আম্মাজান। নিশাত ভালই আছে।”
-“তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করবো?? আমি আমার মেয়ের সাথে তো আমি একা ফোনে কথা বলতে পারি না।নিশাতের কাছে তো ফোন নেই।তুমি ওকে এখন পর্যন্ত একটা ফোনও কিনে দিতে পারলে না।আর আমি দিতে চাইলেও আমার মেয়ে নেবে না জানি।”
শ্বাশুড়ির অপমানটা নিরবে সহ্য করলো জাহিদ।
-“তা ডাক্তার কি বলেছে??” ডেলিভারী ডেট দিয়েছে ?
-“না আম্মা।এখনও দেয়নি।তবে ডাক্তার বলেছে আগামী মাসের শেষের দিকেই ডেলিভারী হবার সম্ভাবনা আছে।”
-“সম্ভাবনা মানে কি? এ্যা? বল ইনশাল্লাহ! বল বল, ইনশাল্লাহ বল এখনই।”
-“ইনশাল্লাহ আম্মা।” জাহিদের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ওকি ঘর জামাই নাকি যে ওর সাথে উনি এমন ব্যাবহার করেন??
-“তা এ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে গিয়েছো কয়বার??”
-“জ্বী, সাত বার।”
-“মাত্র সাত বার?? কেন আমার মেয়েকে ডাক্তার দেখাবার পয়সাও কি নেই নাকি??”
এবার আর জাহিদের সহ্য হল না। কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় ওপাশে শ্বশুররের গলার আওয়াজ শোনা গেল।তিনি মনে হয় জোর করে ফোনটা নিশাতের আম্মার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন।
-“কেমন আছেন বাবাজি?”
-“স্লামালিকুম আব্বাজান।জ্বী, আপনাদের দোয়ায় ভালই আছি।”
-“তা বাবাজি যে কারনে আপনাকে ফোন করা হল।নিশাতের মা কয়েকদিন ধরে খুবই অস্থির হয়ে আছে নিশাতকে দেখবে বলে।তার ওপর ঘরে নতুন অতিথি আসতেছে।তাই নিশাতকে দেখতে আপনাদের ওখানে আসছে ওরা।সব গোছগাছ শেষ।একটু পরই ঢাকা রওনা হচ্ছে।ওরা মানে নিশাতের মা আর নিশাতের ছোটটা। নিলা তো বোনকে দেখবে বলে উতলা হয়ে আছে।আমারও মেয়েকে দেখার খুব ইচ্ছা। কিন্তু এখানে একটা কাজে আটকে আছি বলে আসতে পারছি না।”
-“ও আচ্ছা। তবে আপনি আসতে পারলে আরও ভাল হত।”
-“সেটা আর পারছি না। নিশাতের মা আর নিলু যাক।আমি না হয় পরে একসময় আসবো।”
-“তাহলে তো খুবই ভাল হয়। এসময় নিশাত আম্মাকে পাশে পেলে সাহস পাবে।”
-“তা ঠিক বলেছো।আর হ্যাঁ, নিশাতের আম্মার কথায় কিছু মনে করবেন না বাবাজি।মেয়েকে নিয়ে একটু বেশী চিন্তা করে তো তাই এমন করে।”
-“না না। আমি কিছুই মনে করি নি। আমি তো আপনাদের ছেলের মতই।” বিনয়ী কন্ঠে বলল জাহিদ।
-“তা বাবাজি, এখন রাখি।পরে কথা হবে।”
-“জ্বী, স্লামালি....।” কথা শেষ হবার আগেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেল।
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন আসায় খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। সাথে মেজাজটাও খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতে ঢাকা আসবে অথচ কথাটা এখন বলছে।এরকম আগেও দুবার করেছেন।গতবার তো না বলে হুট করেই চলে এসেছিলেন।এর কারন নিশাতের মায়ের সন্দেহ।উনি হুট করেই বাসায় এসে দেখতে চান মেয়ে কেমন আছে।এবার ভাল যে বলে কয়ে আসছেন।কিন্তু এখন সমস্যা একটাই। অতিথীদের জন্য বাজার করা।ওরা হয়তো রাত আটটার মধ্যেই চলে আসবে।কিন্তু যে কাজের চাপ,অফিস থেকে বের হতে হতে সাতটা বেজে যাবে।এরপর আবার দুটো টিউশনি করিয়ে বাসায় ফিরতে হবে।কিছুক্ষন চিন্তা করে দুটো টিউশনিই বাদ দেয়ার চিন্তা করল জাহিদ।কিন্তু বিকাল দিকে ক্যাশিয়ার সাহেব ওর সমস্যাটা মিটিয়ে দিলেন।
-“কি ব্যাপার, জাহিদ সাহেব? কাজের চাপ কি খুব বেশি?” পাশের ডেস্ক থেকে বললেন ক্যাশিয়ার আবুল হোসেন।
-“না স্যার, তেমন একটা না।তবে একটু টেনশনে আছি।”
-“কেন বলুন তো?”
-“আটটার দিকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসবে।কিন্তু আজ যে কাজের চাপ দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে সাতটার আগে শেষই করবে পারবো না।”
-“ঠিক আছে। আপনি এ নিয়ে কোন চিন্তাই করবেন না।ফাইলগুলো আমাকে দিয়ে যান, আমি করে রাখছি।”
আবুল সাহেবের কথায় জাহিদ খুবই আশ্চর্য হল।যে মানুষকে দিয়ে সহজে কোন কাজ করানো যায় না, আজ তিনিই কি না নিজে থেকে কাজ চাইছেন?
-“আপনি পারবেন শেষ করতে?” ইতস্তত করে বলল জাহিদ।
-“পারবো না কেন? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে আমি আপনার সিনিয়র।আপনার চেয়ে কাজ ভালই বুঝি।আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সময় মতই ফাইল রেডি করে জমা দিয়ে দেব।আপনি বাড়িতে যান।”
-“কি বলে যে ধন্যবাদ দেব আপনাকে।” বিগলিত কন্ঠে বলল জাহিদ।
-“প্রয়োজন নেই। আপনি বাড়িতে যান।” হাসিমুখে বললেন আবুল সাহেব।
জাহিদ ফাইলগুলো ক্যাশিয়ার সাহেবের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে এল।
এলাকায় ঢুকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল জাহিদের।বৃষ্টিতে রাস্তা কাদাকাদা হয়ে আছে।প্যাচপ্যাচে কাদায় হাটতে ওর খুবই অসস্তি লাগে।তার ওপর রাস্তার এখানে ওখানে গর্ত হয়ে পানি জমে আছে।এলাকার সবগুলো স্ট্রিট লাইটই ভাঙ্গা।অন্ধকারে একটু অসাবধান হলেই গর্তে পরে যেতে হবে।পুরো রাস্তা খালি,কোন রিক্সা নেই।অবশ্য পকেটে বেশি টাকাও নেই যে রিক্সা নেবে।সকালবেলা সাতশ টাকা মানিব্যাগে নিয়ে বের হয়েছিল।অফিসের যাওয়া-“আসার বাস ভাড়া মিলে ৫০ টাকা খরচ হয়েছে।আর বাকি সবটাই বাজারের পেছনে গেছে।মানিব্যাগে এখন খুচরো দুই টাকার ছয়টা নোট আছে।
জাহিদ হাবিব কাকার দোকানের দিকে তাকালো।প্রতিদিনই বাড়ি ফেরার সময় এ দোকানটায় চোখ বুলিয়ে বুঝে নেয় এলাকায় কারেন্ট আছে কি না।দোকানের লাইট জ্বলছে,তার মানে কারেন্ট আছে।আজকালতো একটৃ বৃষ্টি হলেই কারেন্ট চলে যায়।
বাসার সামনে জাহিদের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল।হাটু পানি জমে আছে গলিতে।পারাপারের জন্য কোন ইট দেয়া হয়নি এখনো।জুতা হাতে নিয়েই কাদা পানিতে নেমে গেল ও।পানি থেকে বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে।ওর একহাতে বাজারের ব্যাগ,আর একহাতে জুতা।নাক চেপে ধরতে গিয়েও পারলো না।জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে দম আটকে ফেলল ও।তারপর তাড়াতাড়ি বাসার গেইটের কাছে এসে পৌছল।
গেইট খুলে ভেতরে ঢুকতেই পাশের বাসার বাসার হাকিম চাচাকে দেখলো তার তিন ছেলেকে বারান্দায় বসিয়ে আরবী পড়াচ্ছেন।হাকিম চাচা এলাকার মসজিদের ইমাম।খুবই ধার্মিক লোক।বেশিরভাগ সময় মসজিদে সময় কাটান।লম্বা,স্বাস্থবান লোকটাকে সমীহ করে চলে জাহিদ।রোজ সন্ধায় মাগরিবের নামাজ শেষে তার তিন শিশু বাচ্চাকে নিয়ে পড়তে বসেন।ওনার হাতে লম্বা চিকন একটা বেত।ছেলেরা মাথা ঝুলিয়ে জোরে জোরে পড়ছে ….।
জাহিদ বাজারের ব্যাগটা চৌকির একপাশে রেখে বাথরুমে ঢুকে গেল।ওর বাড়িতে বাথরুম একটাই।তাও আবার বাইরে।বাথরুমটাকে পাবলিক টয়লেট বললেই চলে।মাঝে মাঝে পাশের বাসার বাচ্চারা এসে এখানে পায়খানা করে নোংরা করে যেত।পা দুটো সাবান দিয়ে ভাল করে ধুতে লাগলো জাহিদ।কিন্তু বিশ্রী গন্ধটা কিছুতেই কাটছে না বলে মনে হচ্ছে ওর।
বাথরুম থেকে বের হতেই জাহিদ নিশাতের মায়ের সামনে পড়ে গেল সামনে পড়ে গেল।
-“স্লামালিকুম আম্মাজান, কেমন আছেন?”
-“এই ছেলে, এখনো সালাম দেয়া শেখ নি? স্লামালিকুম এর মানে কি হ্যাঁ? বলবে আস সালা মু আলাইকুম।”
-“জ্বী, আস সালামু আলাইকুম।”
-“ওয়ালাইকুম আস সালাম।”
-“কি বাড়িতে থাক হ্যাঁ? বাথরুমও তালা্ মেরে রাখো? আমি এসে বাথরুমে যাবো, ওমা! দেখি তালা মারা।এদিকে নিশাতও চাবি খুজেঁ পাচ্ছিল না।পাক্কা বিশ মিনিট খুজেঁ চাবি পেল ও।তারপর বাথরুমে ঢুকতে পেরেছি।আমি ডায়বেটিসের রোগী।বাথরুম আটকে রাখা কত কষ্টের জানো??”
-“না মানে।” প্রচন্ড লজ্জা পেল জাহিদ।
-“আসলে বাথরুমটাতো বাইরে।খোলা থাকলে যে কেউ এসে বাথরুম নোংরা করে রেখে যায়।তাই সব সময় তালা দিয়ে রাখি।”
-“ইমার্জেন্সির সময় চাবি খোজাঁর কথা মনে থাকে তোমাদের?”
জাহিদ কিছুই বলতে পারলো না।
-“তা এত রাত করে বাড়ি ফিরলে যে?প্রতিদিন কি এমন দেরি করেই বাড়ি ফের?”
-“জ্বী না আম্মা।প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী নেমেছিল রাস্তায়।ফার্মগেটের ওই দিকে জ্যামে আটকে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষন।”
-“আজই এসব হয়েছে তাই না? আমি আসবো বলে?”
-“আমি না মা, বল আমরা।” ঘরের ভেতর থেকে নিশাতের ছোট বোন নিলা বের হয়ে এল।
-“কেমন আছেন দুলা ভাই?” হাসিমুখে বলল নিলা।
-“এই কি বেয়াদব মেয়ে। দুলাভাইকে দেখে সালাম দিবি না??” নিলাকে ধমক দিয়ে বললেন মা।
-“আসসালা মু আলাইকুম দুলাভাই। কি এবার হয়েছে?” মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল নিলা।
মা কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।নিলা মায়ের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করল।
-“তা দুলা ভাই, আপনার হাতে এসব কি? আমার জন্য কি কি এসেছেন??” এই বলে জাহিদের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিল নিলা।
-“তেমন কিছু না। একটু বাজার সদাই করলাম।”
-“আমারা এসেছি বলে?? দেখাতে চাও আমার মেয়েকে ভাল ভাল খাওয়াও??”
-“না সেটা না।” অপ্রস্তুত হয়ে গেল জাহিদ।
-“আসলে আপনারা এতদিন পর এসেছেন, তাই...।”
-“তাই এত এত বাজার করতে হবে?? এত বাজার করার কোন দরকার ছিল না।আমি কাল সকালেই চলে যাচ্ছি।ডেলিভারী ডেট পড়লে আসবো।তবে নিশাতের ডেলিভারী না হওয়া পর্যন্ত নিলা এখানেই থাকবে।”
-“তাহলে তো খুব ভাল হয়।নিলাকে পেলে নিশাতেরও ভাল লাগবে।”
-“হ্যাঁ, এখন চল।দাড়িয়ে দাড়িয়ে কতক্ষন কথা বলবে?”
রাতের খাবারের পর নিশাতের মা পান খেতে চাওয়ার কথা বলে কৌশল করে জাহিদকে বাইরে পাঠিয়ে দিল।উদেশ্য, মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলা।জাহিদ বেরিয়ে যাবার পর নিজের মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিলেন তিনি।
-“নিশাত, আমার কাছে আয়।” নিশাতের মা খাটের ওপর বসে নিশাতকে ডাকল।
-“বল মা।”
-“আমার কাছে এসে বস না।” আদুরে গলায় বললেন তিনি।
-“নিশাত মায়ের কাছে গিয়ে বসল।
-“আচ্ছা বলত, তুই কি সত্যিই সুখে আছিস?? আমার মন রক্ষার জন্য বলিস না। সত্যিটা বল।”
-“হ্যাঁ, মা।আমি সত্যিই সুখে আছি।” হাসি মুখে বলল নিশাত।
-“জাহিদ তোর সাথে কখনো খারাপ ব্যাবহার করেছে?”
-“কক্ষনো না।ওকে আমি যাই বলি না কেন, ও কিছুই বলে না।চুপচপ শুনে যায়।”
-“তোদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে কয়বার?”
-“এটাই তো আফসোস! বিয়ের পর এ পর্যন্ত ওর সাথে একবারও ঝগড়া হয়নি।মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে ঝগড়া করতে চেয়েছি।কিন্তু ও শুধু চুপচাপ শুনে গেছে।ওর সাথে ঝগড়া করে মজা নেই।তাই এখন আর ঝগড়া করার চেষ্টাও করি না।”
-“ইস্! আমার ভাগ্যেও যেন জাহিদ ভাইয়ার মত ছেলেই জোটে।” আফসোসের সুরে বলল নিলা।
-“খবরদার এমন দোয়া করেছিস তো।আমার এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শিক্ষা হয়েছে। তোকে বিয়ে দিলে দেখে শুনে বড় ঘরে বিয়ে দেব।তোর বোনের মত অভাবের সংসারে নয়।” নিলাকে ধমক দিয়ে বললেন মা।
-“মা তুমি এভাবে বলছ কেন? আমি তো অনেক সুখেই আছি।”
-“তুই এই অভাবের মাঝে সুখে থাকিস কি করে? এত অল্প টাকার বেতনে চলে?”
-“চলে যায় মা।আর সবই চলে ভালবাসার উপর।”
-“ভালবাসা না ছাই।একটা কথা আছে, অভাব যখন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।”
মায়ের এমন কথা শুনে নিশাত কোন রকম হাসি চেপে রাখল।মা তাহলে আগে থেকেই এসব বলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।
-“কিন্তু মা। আমাদের এই ছোট্ট বাসাটিতে ভালবাসা ঢুকলেও তা পালাবার পথ নেই। কারনে এই বাসায় কোন জানালা নেই।থাকলেও তা খোলা যায় না।আগে খোলা যেত।কিন্তু পাশে নতুন দালান ওঠায় জানালাটি সবসময় বন্ধ করেই রাখতে হয়। এই যে দেখ জানালা বন্ধ।” রুমের জানালাটা দেখিয়ে বলল নিশাত।
-“তুই কি আমার সাথে মজা করছিস?”
-“না মা। আমি সত্যিই বলছি।এই অভাবের মাঝেও আমাদের ভালবাসার এতটুকু কমতি হয়নি। বরং যত দিন যাচ্ছে, আমাদের মাঝে ভালবাসা ততই বেড়ে চলেছে।”
নিশাতের মা কিছু বলতে যাবে এমন সময় জাহিদ আসায় তিনি থেমে গেলেন।
ডাক্তার নিশাতের ডেলিভারি ডেট দিয়ে দিয়েছে আগষ্টের দশ তারিখ।সবকিছু ঠিক মতই এগোচ্ছিল।কিন্তু তিন তারিখ হঠাৎ করে জাহিদের অফিসে একটা ঝামেলার কারনে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল।অফিসে ঢুকতেই জাহিদ বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। সবাই ওর দিকে কেমন চোখে যেন তাকাচ্ছে।নিজের ডেস্কে গিয়ে বসতেই পিয়ন এসে বলল,
-“স্যার, জিএম স্যার আফনেরে সালাম দিছে।এক্ষুনি যাইতে কইছে।”
পিয়নের কথায় জাহিদ চিন্তিত হয়ে পড়ল।দ্রুত জিএম স্যারের রুমে গেলও ।
-“স্লামালিকুম স্যার।”
-“ওয়ালাইকুম।ভেতরে আসো জাহিদ।”
জাহিদ ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢোকে।জিএম স্যারকে খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছে।উনি এমনিতেও গম্ভীর থাকেন।কিন্তু আজকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে ওনাকে।জাহিদ রুমে ঢুকে দেখল ভেতরে চীফ একাউন্টেন্ট আর ক্যাশিয়ার সাহেবও বসে আছে।নিশ্চই কোন ঝামেলা হয়েছে।
ইশারায় জাহিদকে বসতে বললেন তিনি।জাহিদ ক্যাশিয়ার সাহেবের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল।
জিএম স্যার কিছুক্ষন কার সাথে যেন ফোনে কথা বললেন।জাহিদ ইশারায় ক্যাশিয়ার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপার কি? উনি কিছুই বললেন না।
-“তো জাহিদ।অফিসে একটা বিরাট ঝামেলা হয়েছে তা কি জানো??” ফোন রেখেই বলতে শুরু করলেন জিএম স্যার।
-“না তো স্যার।কেন কি হয়েছে?” অবাক হয়ে বলল জাহিদ।
-“সত্যিই জানো না?” ভ্রু কুচকে বললেন তিনি।
-“না স্যার, সত্যিই।”
-“না স্যার। জাহিদ মিথ্যা বলছে। ও সবই জানে।এখন না জানার ভান করছে।” জোর গলায় প্রতিবাদ জানালেন চীফ একাউন্টেন্ট।
-“আমি কিভাবে জানবো কি হয়েছে?” জাহিদ অবাক হয়ে গেল।
-“নিজে করেছেন আর এখন বলছেন জানেন না কিছু?” রেগে গিয়ে বললেন চীফ একাউন্টেন্ট।
-“আরে বলবেন তো কি হয়েছে?” জাহিদ কিছুই বুঝতে পারলনা।
-“আমি বলছি,শুনুন।এ মাসের পঞ্চাশ হাজার টাকার হিসাব গায়েব।গায়েব মানে হিসাব অনুযায়ী ক্যাশে দেড় লাখ টাকা কম পাওয়া গেছে।” বললেন জিএম সাহেব।
-“বলেন কি স্যার।কিভাবে হল?”
-“কিভাবে হল সেটাই তো প্রশ্ন।খুবই চালাকি করে এই টাকা গায়েব করে দেয়ার প্লান করা হয়েছিল।চীফ একাউন্টেন্ট সাহেবই প্রথম বিষয়টা ধরতে পারেন।উনি প্রথমে আমাকে ইনর্ফম করেন।আমি ওনাকে বিষয়টা তদন্ত করতে বলি।তাতে আপনি দোষী সাবস্ত হয়েছেন।”
-“কি বলছেন স্যার! আমি দোষী হলাম কি করে??” একদম আকাশ থেকে পড়ল জাহিদ।
-“অফিসের সবাই জানে ক্যাশ এর হিসাব সব আপনিই দেখেন।আবুল সাহেব শুধু চেক করে দেন।মাঝে মাঝে ভাল মত চেক করেন না।এটা ওনার ফাকিঁবাজি।এর শাস্তি উনি পাবেন।কিন্তু জাহিদ সাহেব, আপনি ওনার এই ফাকিঁবাজির সুযোগ নিয়ে বড় রকমের দুর্নীতি করতে যাচ্ছিলে।এমনভাবে হিসাবের প্যাচঁ তৈরী করেছেন যাতে কেউ বুঝতেই না পারে।ভাগ্যিস আমি ভালভাবে চেক করায় বিষয়টা ধরতে পেরেছি।” গর্বিত কন্ঠে বললেন চীফ একাউন্টেন্ট সাহেব।
-“কি বলছেন আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।” হতবাক হয়ে গেল জাহিদ।
-“তোমাকে আর কিছু বুঝতে হবে না জাহিদ।তুমি যা করার করেছো।তোমাকে স্নেহ করতাম।কিন্তু তুমি এমন হবে ভাবতেও পারিনি।” আফসোসের সুরে বললন জিএম স্যার।
-“কিন্তু স্যার, আমিতো এরকম কিছুই করিনি।”
-“সেটা পড়ে দেখা যাবে।আপাতত তোমাকে বিনা নোটিশে সাসপেন্ড করা হল।যতদিন এ বিষয়ের কোন সমাধান না হচ্ছে, ততদিন তুমি অফিসে না আসলেও চলবে।”
-“কিন্তু স্যার...।”
-“নো টক। এখন তুমি আসতে পারো।আর মিটিং এখানেই শেষ।” জাহিদকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না তিনি।
মাথা কোন কিছু না বলে চুপচাপ অফিস থেকে বের হয়ে এল জাহিদ।সর্ব শরীর ঠান্ডায় জমে গেছে।রাস্তায় হাটতে গিয়ে কয়েকবার পথচারীদের সাথে ধাক্কাও লেগেছে ওর।জাহিদ কিছুই ভাবতে পারছে না।কি হল এটা? ওর তো কোন দোষই ছিল না।তবে কেন ওর সাথে এমন হল? এ কেমন ষড়যন্ত্র হল ওর সাথে? জিএম স্যারও ওকে অবিশ্বাস করলেন।এমন কি একটা কথা পর্যন্ত শুনলেন না।সোজা অফিস থেকে বের করে দিলেন।কেন উনি কি জানতেন না যে ওর স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা?খবরটা শুনে তো উনি বেশ খুশি হয়েছিলেন।বলেছিলেন,
-“জাহিদ।আমি বলে রাখছি,তোমার ছেলে হবে।ফুটফুটে একটা ছেলে।তা ছেলের নাম ঠিক করেছো?”
-“জাহিদ বলেছিল, না স্যার।এখনো ঠিক করিনি।”
-“কি বলছ? এখনো ঠিকই করনি? তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেল।”
কিন্তু এখন এসব বড় অর্থহীন লাগছে।নিশাতকে কি বলবে ও? কিভাবে বলবে যে ওর চাকরী চলে গেছে?জাহিদ কিছুই ভাবতে পারে না।সন্ধা পর্যন্ত এদিন ওদিক ঘোরাঘুরি করে ওভার ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়াল।ওপর থেকে চলন্ত গাড়ি গুলোকে দেখতে দেখতে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল।হুট করে ওর জীবনটা কঠিন হয়ে গেল।কিন্তু কেন?? ভাবতে গিয়ে জাহিদের চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে নিচে পড়ল।
আটটার দিকে বাড়ি ফিরল ও জাহিদ।বাড়িতে এসেই দেখল দরজায় তালা মারা।পাশের বাড়ির হাকিম চাচার স্ত্রী ওকে দেখেই বলল,
-“এখন আইছো তুমি?? এই দিকে তোমার স্ত্রীর তো প্রচন্ড ব্যাদনা উঠছিল।ওর চিৎকার শুইনা আমি গিয়া দেহি অবস্থা খুবই খারাপ।হাসপাতালে নেওন লাগব।এই দিকে তুমি বাড়িত নাই।তোমার চাচায় তোমাকে কতবার ফোন করল।কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ পাইছেন তিনি।ফোন বন্ধ রাখছিলা কেন??”
জাহিদ হতবিহব্বল হয়ে পড়ে।দ্রুত পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে আসলেই ফোনটা বন্ধ।কখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে ও টেরই পায় নি।
-“এখন ও কোথায় আছে??” বিচলিত হয়ে বলল জাহিদ।
-“তোমার চাচায় এ্যাম্বুলেন্স ডাকাইয়া ওরে হাসপাতালে লইয়া গেল।লগে তোমার শালীও গেছে।ওই যে মোড়ের ক্লিনিকটা আছে না? ওইটায় নিয়া গেছে শুনছি।তুমি জলদি যাও।আর এই লও তোমার চাচার ফোন নাম্বার।” জাহিদের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন তিনি।
কাগজটা ওনার হাত থেকে নিয়ে দ্রুত ক্লিনিকের দিকে রওনা হল ও।নিশাতকে এলাকার একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন হাকিম চাচা।ক্লিনিকে ঢুকেই হাকিম চাচাকে ফোন দিল।উনি ওকে দোতলায় আসতে বললেন।দোতলায় উঠে করিডোরে দেখল হাকিম সাহেব পায়চারী করছেন।নিলা একটা বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে।ওকে দেখেই দুজন একসাথে ওর দিকে এগিয়ে এল।
-“কি ব্যাপার দুলাভাই! আপনার ফোন বন্ধ ছিল কেন?এদিকে আপুর..।” বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নিলু।
জাহিদ কিছুই বলতে পারল না।হাকিম চাচাকে বলল,
-“চাচা, ডাক্তার কি বলেছে?”
-“নিশাত মামনি অপারেশন রুমে আছে।এখনও ডেলিভারী হয়নি।এই ডাক্তার আপা এসেছেন। ওনার সাথে কথা বল।” সাদা এপ্রোন পরা মধ্যবয়স্ক একজনদে দেখিয়ে বললেন তিনি।
-“জ্বী, আমার স্ত্রীর অবস্থা এখন কেমন?”
-“আপনি এখন এসেছেন?? কেমন স্বামী আপনি? স্ত্রীর ডেলিভারী হচ্ছে, অথচ আপনার দেখা নেই।” ধমক দিয়ে বললেন ডাক্তার।
-“জ্বী, একটু সমস্যা হয়েছিল।তাই...।”
-“আপনারা পুরুষা শুধু সমস্যাতেই পরে থাকেন।আর তার ফল ভোগ করতে হয় আমাদেরকে।তেমন কোন সমস্যা হবে না আপনার স্ত্রীর।আপনি আসুন আমার সাথে, কিছু কাগজপত্রে সাইন করতে হবে।”
জাহিদ ওনার সাথে গিয়ে কাগজপত্রের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলল।কিন্তু এখন সমস্যা বিল নিয়ে।ক্লিনিক থেকে বিল নিয়ে চিন্তা করতে মানা করল।বিল পরে দিলেও হবে।কিন্তু বিলটা দিবে কি করে ও? এমাসের বেতন পাওয়ার আগেই অফিস থেকে সাসপেন্ড হয়েছে ও।আর এ মুহুর্তে হাতে টাকাও নেই।সমস্যা যখন আসে চারদিক থেকেই আসে।কি করবে কিছুই বুঝতে পারলনা জাহিদ।অফিসের কয়েকজন কলিগকে ফোন করল টাকা ধার চেয়ে।বেশিরভাগই নিজেদের সমস্যার কথাই বলল।কিন্তু একজন বিষয়টা দেখবে বলে আশ্বাস দিল।দেখবে মানে কি? এখন কি দেখার সময়?? শ্বশুরবাড়িতে ফোন করেও জানাতো হল।কিন্তু টাকার বিষয়টা এড়িয়ে গেল ও।কি বলবে ওনাদেরকে? ওর চাকরী চলে গেছে? হাতে কোন টাকা নেই?
এক ঘন্টা পর সুখবর পেল জাহিদ।নিশাতের ডেলিভারী ভালভাবেই হয়েছে।নার্স এসে বলল ছেলে হয়েছে।খবরটা পেয়েই দ্রুত কেবিনের ভেতর ঢুকে গেল ও।নিশাত বেডে শুয়ে আছে।আর ওর পাশে ফুটফুটে একটি শিশু,যার দেহে ওর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।নিলা প্রথমেই দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটার কাছে গেল।কিন্তু জাহিদ আগে নিশাতের কাছে গেল।
-“কেমন আছো তুমি?”
নিশাত অভিমানে মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।
-“রাগ করেছো? করাটাই স্বাভাবিক।কিভাবে এমন হয়ে গেল।আর তোমার ডেলিভারী ডেটের আগেই যে এমন হবে জানতো কে? কে জানতো আমাদের সোনামনি সময়ের আগেই আমাদের কাছে পৌছে যাবে?”
নিশাত এবার জাহিদের দিকে তাকাল।
-“তুমি কেন আমার পাশে ছিলে না বল তো? আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল জানো?”
নিশাতের কথা শুনে জাহিদ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
-“কি ব্যাপার কাদঁছো কেন? নিশাত অবাক হয়ে গেল।”
জাহিদ নিশাতকে বলতে গিয়েও বলতে পারল না।সন্তানকে আদর না করেই কেবিনের বাইরে বের হয়ে এল।ওর মত বাবার নিজের ছেলেকে আদর করার কোন অধিকার নেই।
কেবিনের বাইরে এসেই আশ্চর্য হয়ে গেল জাহিদ।করিডোর ধরে ও কাকে আসতে দেখছে? জিএম স্যার এখানে? সাথে অফিসের দুজন কলিগও আছে দেখছি।
-“কি ব্যাপার জাহিদ? তোমার সন্তান হচ্ছে, অথচ আমাকে খবটা দেবার প্রয়োজন মনে করলে না? আমি কি এতই দোষ করে ফেলেছি?”
-“না মানে...।রাগে কষ্টে জাহিদ কিছুই বলতে পারল না।”
-“আমার ওপর রাগ করাটাই স্বাভাবিক।তোমাকে এভাবে কোন রকম সুযোগ না দিয়েই সাসপেন্ড করে দিলাম আজ।কিন্তু পরে আজই আমি চার্টাড একাউন্টেন্ট ডেকে এনে হিসাবটা আবারও ভালভাবে চেক করাই।তাতে ধরা পড়েছে যে ঘাপলা হয়েছে তা তোমার দ্বারা হয়নি।ক্যাশিয়ার আবুল হোসেন এ কাজ করেছে।”
জিএম স্যারের কথায় জাহিদ অবাক হয়ে গেল।
-“ক্যাশিয়ার সাহেব একাজ কেন করতে যাবেন? আমাকে ইচ্ছে করে ফাঁসাতে যাবেন কেন উনি?”
-“উনি একা হয়, সাথে চীফ একাউন্টেন্টও এর সাথে জড়িত।আর এটি করা হয়েছে তোমাকে অফিস থেকে বের করে দেবার জন্য।তোমার কাজে শুধু আমি নই, হেড অফিসও সন্তুষ্ট।তোমাকে হেড অফিসে ট্রান্সফারের চিন্তা করা হচ্ছিল ওপর থেকে।কিন্তু অনেকেই ব্যাপারটা ভাল চোখে নেয়নি।তাই তোমার পোষ্টিং আটকানোর জন্যই তারা এ কাজ করেছে।”
-“কি বলেন স্যার! শুধুমাত্র আমার পোষ্টিং আটকানোর জন্য ওনারা আমার সাথে এমন কাজ করতে পারলেন?” অভিমানের সুরে বলল জাহিদ।
-“হ্যাঁ।করেছে।খারাপ মানুষের স্বভাবই হয় এমন।কিন্তু জানই তো, শেষ পর্যন্ত সত্যের জয়ই হয়।বিশ্বাস হয় না?” হেসে বললেন তিনি।
-“তোমাকে আজ সকালে যেমন করে মৌখিকভাবে বিনা নোটিশে সাসপেন্ড করেছি, তেমনি এখন তোমাকে বিনা নোটিশে তোমার প্রমোশন ঘোষনা করছি।তোমাকে হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হবে না।কারন, দুর্নীতির জন্য অফিসের চীফ একাউন্টেন্ট এর পদটা খালি হয়ে যাচ্ছে।সেটা এখন তোমার।”
জাহিদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ আজ কি হচ্ছে? ওকি স্বপ্ন দেখেছে?? নাকি সত্যি? প্রচন্ড আনন্দ সে ধরে রাখতে পারে না।এক দৌড়ে সে তার সন্তানের কাছে চলে যায়।এবার সে তার সন্তানকে আদর করবে।প্রাণ ভরে আদর করবে।
-“এখানে বসে আছো কেন নিশু?” হঠাৎ জাহিদের ডাকে কল্পনার জগত থেকে ফিরে আসে নিশাত।ও কি তবে এতক্ষন এ সবকিছু কল্পনাই করছিল?? হ্যাঁ তাইতো!! সেই কখন থেকে বারান্দায় বসে বসে ভাবছিল ও।কল্পনায় নিজের ইচ্ছা পূরন হতে দেখেছে।কিন্তু নিশাত জানে, জীবন কল্পনার মত নয়।এখানে সবকিছু এত সহজেই হয়ে যায় না।কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জন করে নিতে হয়।এখন তাদের সামনে কঠিন দিনগুলো রয়েছে।সেই দিনগুলো পাড়ি দিতে পারলে তবেই হবে ওর ইচ্ছা পূরনের গল্প।
-“জানো এখানে বসে বসে কি ঘটে গেছে??” আনন্দিত কন্ঠে বলল নিশাত।
-“আগে ভেতরে চল, তারপর শুনছি।”
জাহিদের সাথে নিশাত সাথে রুমের ভেতরে চলে যায়।ওর চোখে এখন ইচ্ছা পূরনের দৃঢ় সংকল্প।শুধু নিশাত নয়, আমারা সকলেই কল্পনা দেখি।ইচ্ছা পূরনের কল্পনা।আর যাদের মাঝে থাকে নিশাতের মত দৃঢ় সংকল্প, তারাই রচনা করে- ‘ ইচ্ছা পূরনের গল্প’।
বিষয়: সাহিত্য
২০৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন