চে, বিপ্লবের প্রতিশব্দ

লিখেছেন লিখেছেন নতুন বার্তা ডটকম ১৪ জুন, ২০১৩, ০২:৪০:১৪ দুপুর



কিউবা বিপ্লবের মহানায়ক চে গুয়েভারার ৮৪তম জন্মবার্ষিকী আজ। বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ হিসেবে, গেরিলা নেতা হিসাবে বিশ্বজুড়ে তারই নাম ধ্বনিত হয়। এই মহান বিপ্লবীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার সান্তা ফে শহরে। কিউবায় ফিদেল কাস্ট্রোর সঙ্গে সফল বিপ্লবে অংশ নেয়ার পর চে বলিভিয়ায় গিয়েছিলেন আরেকটি বিপ্লবের প্রত্যয় নিয়ে। বলিভিয়াতে থাকার সময় তিনি সিআইএ’র (যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা শহরে দেশটির সেনাবাহিনী তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

চে গুয়েভারা ছিলেন, একাধারে মার্কসবাদী বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, কূটনীতিক, গেরিলা নেতা ও সমর বিশেষজ্ঞ। তার পুরো নাম ‘এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা’। জন্মসূত্রে আর্জেন্টিনার নাগরিক। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর দলে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তিনি সমাজতন্ত্র অনুসারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম। এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন বিপ্লবের মুখচ্ছবি হিসাবে বিশ্বপ্রতীকে (আইকন) পরিণত হয়।

চে গুয়েভারা ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তিনি ঠাঁই পেয়েছেন। আবার গেরিলা যোদ্ধার পোশাকে ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ ‘গেরিলেরো হেরোইকো নামে’ আলবের্তো কোর্দার তোলা চে’র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি চে’র ছিল গভীর মমত্মবোধ। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন চে। তাদের বাড়িতে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই। যা চে’কে করে তোলে সমাজ সচেতন। সে সময়ই তিনি কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন, রবার্ট ফ্রস্টের বই পড়েছেন। কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না হয়ে কালক্রমে নিজেকে একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন।

যুবক বয়সে মেডিসিন বিষয়ে পড়ার সময় চে মোটর সাইকেলে চড়ে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। পরে এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দি মোটর সাইকেল ডায়েরি’ নামে তার একটি বই প্রকাশিত হয়। এসময় চে বুঝতে পারেন ধনী-গরিবের ব্যবধান ধ্বংস করে দেবার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন থেকেই তিনি মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং সচক্ষে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখার জন্য গুয়াতেমালা ভ্রমণ করেন। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে’র বৈপ্লবিক আদর্শ ও চেতনা আরো বদ্ধমূল হয়।

পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। প্রথম যদিও রাউলের সঙ্গে তার পরিচয় হয় কারক্রমে দোস্তি জমে ওঠে কাস্ত্রোর। চে তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উত্খাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। খুব অল্পদিনেই চে ফিদেলের বিপ্লবী সংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে তার পদোন্নতি হয়। এরপর টানা দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের মাধ্যমে বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসাবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন। তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। এর ফলে এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ ও বই রচনা করেন। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি ম্যানুয়েল রচনা করেছেন।

১৯৬৫ সালে চে কিউবা ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছা ছিল কঙ্গো-কিনশাসা ও বলিভিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বলিভিয়াতে তিনি সিআইএ মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট বলিভিয়ার তত্কালীন সামরিক জান্তা বারিয়েন্তোসের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চে সহযোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। সামরিক জান্তার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় চে গুরুতর আহত হয়ে ধরা পড়েন। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর, বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১৩৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File