প্রবাসের স্মৃতিচারণ --বারো
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১৬ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:১৬:১৮ সকাল
১৬
ঘুম ভাঙল ভোর তিনটার আশপাশে। ভোর না বলে একে শেষরাত্রিও বলা চলে। কারণ, আজান হতে এখনো বাকী তিন ঘণ্টার বেশী। আবার ঘুমাবো ভাবছি। কিন্তু কি মনে করে উঠে চেয়ার টেনে জানলা খুলে দিয়ে বসলাম। প্রভাতের সমীরণ উপভোগ করছিনা অনেক দিন। জানলা খুলতেই সুন্দর ফুরফুরে হাওয়ারা এসে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। আঃ, গা’ টা একেবারে জুড়িয়ে গেল। শুয়ে পড়লে চমৎকার ঘুম হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘুমানোই হবে, এমন সুন্দর বাতাস তো আর উপভোগ করা হবে না। আজ না হয় একটু কমই ঘুমালাম। আমার পাশের এক সিট বাদে পরের সিটে করিমভ গভীর ঘুমে অচেতন। আলো আধারিতে আবছা দেখা যাচ্ছে তার ফর্সা মুখখানা। সে ঘুমোক, আমি জেগে থাকব। অন্ধকার রাত্রির হৃদয় ভেদ করে আমি তোরণদ্বারে গিয়ে পৌঁছাব।
বাইরে তাকিয়ে আছি। এভাবে কতক্ষন কাটল জানিনা। মনে পড়ল শৈশবের একটা সময়ের কথা। যখন আব্বুর সাথে মসজিদে যেতাম প্রতিদিন। তখন আজানের সাথে সাথেই উঠা হত। কিন্তু আমরা যখন আধুনিক(!) হয়ে গেলাম তখন আর ভোর রাত্রিতে উঠা হয়না। সূর্য উঠার আগ মুহূর্তে কোনরকম উঠে আবার বিছানায় চলে যাই। মসজিদে যাওয়ার পথে একটা কুকুর খুব ডিস্টার্ব করত। বাজারের অদূরে বাড়ি হওয়াতে বাজারের একমাত্র জামে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। মসজিদটির নাম মোক্তার শাহ বাইতুল ইজ্জত জামে মসজিদ। মসজিদ আর বাজারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোক্তার শাহ নামের একজন আল্লাহওয়ালা মানুষ। তিনি সম্পর্কে আমার দূরসম্পর্কের নানু হন। মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাজার। বাজারের নামটা বেশ রোমান্টিক। নাম তার ‘প্রেম বাজার’। এ নাম কেন দিলেন জিজ্ঞেস করা হলে উনি বলেন এখানে 'প্রেম' শব্দটির দ্বারা মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের কথা বোঝানো হয়নি। বরং এটা ‘প্রেমে-ই-ইলাহি’ তথা স্রষ্টার প্রতি প্রেম বা ভালোবাসা। এ মানুষটির স্রস্টার প্রতি ভালবাসার বিভিন্ন নমুনা আমরা দেখতে পাই। এর মধ্যে একটা হল উনি প্রায় এগারটার মত মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বিভিন্ন জায়গায়। নিজে এত বড়লোক না হলেও তাঁর স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এ এগারো মসজিদ। জীবনের শেষ বয়সে তিনি এ মসজিদকে আকড়ে ধরেছিলেন। মসজিদটিকে পরম মমতায় যত্ন করতেন। গত বছর দেশে গিয়ে উনার সাথে দেখা হয়। কিন্তু উনি সেই আগের মত নেই। অনেকটা শুকিয়ে গেছেন। বিভিন্ন ধরনের রোগে শয্যা নিয়েছেন বেশ কিছুদিন ধরে। এরমাঝেও একটু ভাল লাগলে মসজিদে এসেই নামাজ আদায় করতেন। এ মসজিদ যেন উনার সব। কিন্তু কিছুদিন আগে আম্মু ফোন করে জানালেন মোক্তার শাহ আর নেই। আত্মীয়পরিজন এমনকি তাঁর ভালোবাসার মসজিদটিকেও ছেড়ে মহাজাগতিক সফরে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। দোয়া করি আল্লাহ যেন উনাকে কবুল করেন, আমিন।।
মানুষ এই ভাবেই যায়, যাচ্ছে, যাবেই। নতুন কোন কথা নয়। আমি থাকবনা। এখন যারা আমার পৃথিবীর সহবাসী তারা কেউ থাকবেনা। যারা আসবে তারাও থাকবেনা তাও জানি। কিন্তু ‘আমি আছি, তুমি নাই ‘ এ কথাটাতো কোনদিন ভেবে দেখি নি।।
বাজারের প্রবেশ পথে একটা স’মিল ছিল। মিলের নিরাপত্তার জন্য একটা কুকুর পোষতেন মিলের মালিক। কুকুরটা বেশ শিকারি ছিল বলা যায়। মানুষতো দূরে থাক অন্য কোন চতুষ্পদ জন্তুকেই সে বাজারের পথ মাড়ানোর সুযোগ দিতনা। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল শৈশবের মসজিদে যাওয়ার সেই ছবি। বাজারে প্রবেশের বিশ-ত্রিশ মিটার দূর থেকেই কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠত। তখন বুঝতে পারলাম কুকুরের চোখ অনেক সার্প আমাদের চেয়ে। আবছা অন্ধকারে আমরা না দেখলেও আমাদেরকে দূর থেকে ঠিকই দেখে ফেলত কুকুরটা। কুকুরের কাছ থেকে আগলে রেখে আব্বু আমাকে কিভাবে মসজিদে নিয়ে যেতেন সে কথা মনে পড়ল। কত চেষ্টাই না করতেন আব্বু তখন আমাকে কুকুরের হাত থেকে রক্ষা করতে। জানতে পারছিলাম কুকুরটা শুধু ঘেউ ঘেউ করেই ক্ষ্যান্ত দেয়না কামড়ও বসিয়ে দেয় অনেক সময়। তবে আমাদের ওরকম কিছু করেনি কোন দিন। সম্ভবত কুকুরও ভাল-খারাপের ব্যবধান বুঝে। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমাদের পক্ষ থেকে কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না দেখে কুকুরটা আমাদের দেখলে আর ঘেউ ঘেউ করে না। কাছে গেলেই লেজ নাড়তে নাড়তে পিছু পিছু চলে মসজিদ পর্যন্ত। এ যেন তার প্রতিদিনকার কর্ম হয়ে দাঁড়ালো।। লেজ নাড়ার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল সে আমাদেরকে দিব্যি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই আব্বু বিশেষ এক কাজে ঢাকা গেলেন। আমি এরপরদিন একাই সাহস নিয়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলাম। কুকুরটার কাছে যেতেই যেন সে কিছু বলতে চাচ্ছিল। সে আমার কাপড়-চোপড় শুঁকতে লাগল। তার বোবা চোখদ্বয় যেন বলতে চাচ্ছিল তুমি আজ একা কেন? এখন এ দূর দেশ থেকে ভাবছি না জানি আব্বু এখন কি করছেন? মসজিদে যাওয়ার সময় উনারও বুঝি আমার কথা মনে পড়ে? তখন উনি খুব কষ্ট পান তাই না? কিন্তু, আমি কি করতে পারি? আমার নাকি অনেক বড় হতে হবে যে...।।
---চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৫৩২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার স্মৃতিচারণ হলো! উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত স্মৃতির ভান্ডার হাতড়ে সুন্দর পোস্টটি লিখা রজন্য আন্তরিক শুকরিয়া!
মন্তব্য করতে লগইন করুন