প্রবাসের স্মৃতিচারণ—দশ
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১১ নভেম্বর, ২০১৫, ০৫:১২:৪২ সকাল
১৪
ট্রে’তে খাবার নিয়ে বিল পরিশোধ করে কোনার একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম আমরা দু’জন। বিভিন্ন ধরনের নাম না জানা খাবারে ভর্তি, শুধু নিজের পছন্দমত সিলেক্ট করে নেয়া। রাইস পাওয়া যায়, কিন্তু ছোট্ট একটা প্লেটে করে চায়ের কাপের এক কাপের মত যা ১০০ গ্রামও হবেনা। এই রাইসের নাম হল ‘পিলাভ বা পিলাও’। তাই সাথে রুটি নিতে হয়। ভাতের উপরে একপ্রকার শিমের বিচির ঝোল দিল। যে সিমের বিচিকে তারা ‘ফাসুলিয়া’ বলে। স্বাদটা খারাপ বলা চলেনা। সাথে নিলাম আলোর চপের মত করে বানানো ‘কোফতে’, কোফতে না বলে ‘গরুর চপ’ও বলা যেতে পারে। আমাদের আজিমভও ট্রে ভর্তি খাবার নিয়েছে। বুঝতে পারলাম ইতিমধ্যেই সে টার্কিশ খাবারে বেশ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। খুব এক্সপার্টের মত সে তার কর্ম সমাধা করছে দেখে মনে পড়লো অন্য এক আজিমের কথা। যিনি আমাদের সিপাহী বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। যার পুরো নাম আজিমুল্লাহ খাঁ। কয়জনেই বা জানি এ বীর আজিমুল্লাহ খাঁ’র নাম। যাদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নটুকু দেখেছিল। যারা ভারতীয় নাগরিকের মনে আশার আলো জাগিয়েছিলেন। সত্যেন সেন বলেছেন, ‘তখনকার দিনে আমাদের দেশে প্রতিভা, কূটনৈতিক বুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টির দিক থেকে তাঁর সাথে তুলনা করবার মত দ্বিতীয় একজন লোক পাওয়া যাবেনা।‘ অথচ, সেই আজিমুল্লাহ খাঁ ছিলেন একজন বাবুর্চি। ব্রিটিশরা তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত। তাদের চোখে আজিমুল্লাহ খাঁ ছিলেন, ‘ধূর্ত, নৃশংস ও রক্তপিপাসু।
রূপকথার কাহিনীর মতই বিস্ময়কর তাঁর জীবন। নিতান্ত গরীব ঘরের ছেলে ছিলেন। দুবেলার দুমুঠো ভাত জুটবে এমন সঙ্গতি নেই। বয়স তখন খুবই কম, শিশু বলা চলে। আর সবাই যে বয়সে খেলাধুলা নিয়ে মত্ত থাকে, কঠিন জীবন সংগ্রামের জন্য তখন তাঁকে বাধ্য হয়ে এক ইংরেজ সাহেবের বাড়িতে ‘বয়ের’ কাজে ঢুকতে হল।
‘ছোটবেলা থেকে সাহেবদের বাড়িতে বয় ও খানসামার কাজ করবার ফলে বহু সাহেবের সংস্পর্শে তাঁকে আসতে হয়েছে। এ প্রিয় দর্শন তরুণ খানসামাটি অতি সহজেই সকলের মন জয় করতে পারত। আজিমুল্লাহ এ সুযোগ কাজে লাগাতে ছাড়লেন না। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি ইংরেজি ও ফারসি দুই ভাষাতেই দিব্যি কথা বলতে শিখলেন। শুধু কি কথা বলা, এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার ফলে তিনি সাহেবী চালচলন, আদবকায়দা বেশ ভালভাবেই রপ্ত করেন।
একদিন যাকে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে হবে খানসামা-বাবুর্চির কাজের মধ্যে তাঁকে আটকে থাকলে চলবে কি করে। তাই তিনি স্কুলে ভর্তি হলেন। পরে একই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করলেন। তাঁর সুখ্যাতি সবখানে ছড়িয়ে পড়ল। এ কান থেকে ও কান করতে করতে নানা সাহেবের কানে গিয়ে পৌঁছল তাঁর সুখ্যাতির খবর। একপর্যায়ে নানা সাহেবের মাধ্যমে ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ হয় তাঁর। ইউরোপ ভ্রমণের এক পর্যায়ে আসলেন কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তানবুলে। ইস্তানবুল তখন মুসলিম জাহানের রাজধানী। তুরস্কের সুলতান তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানেরা তুরস্কের প্রতি ধর্মীয় আনুগত্য বহন করে। কনস্টান্টিনোপল-এ গিয়ে তিনি জানতে পারলেন তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। তুরস্কের মিত্রশক্তি ইংরেজরা সেবাস্তোপলের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে দারুণ মার খেয়েছে। দুপক্ষের বলাবল নিজ চোখে দেখার জন্য তিনি রাশিয়া গমন করেন। রাশিয়া গমনের আরও একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ইংরেজদেরকে ভারতভূমি থেকে বিতাড়ন করা। রাশিয়া থেকে ইস্তানবুলে ফিরে কয়েকজন রুশ এজেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রুশ এজেন্টরা আশ্বাস দেন যে, ‘হিন্দুস্তানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জাগিয়ে তুলতে পারলে রাশিয়া বিদ্রোহীদের মুক্তহস্তে সাহায্য দেবেন।’ এটা ১৮৫৪ সালের ঘটনা। এর তিন বছর পরে পলাশীর যুদ্ধের ঠিক শতবর্ষ ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেন তাঁরা। ইতিহাসে যেটি সিপাহী বিপ্লব নামে পরিচিত।
আমাদের আজিমভ খাওয়া-দাওয়াতে বেশ এক্সপার্ট আর সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম নায়ক আজিমুল্লাহ খাঁ ছিলেন ভাল পাচক। আর একটা জায়গায় তাদের বেশ মিল। সুদর্শন আজিমুল্লাহ খাঁ যখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন তখন বেশ কিছু ব্রিটিশ তরুণী তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। হিন্দুস্তান ফিরে আসার পরও অনেক ব্রিটিশ তরুণী ডাকযোগে ‘ডার্লিং আজিমুল্লাহ’র ঠিকানায় চিঠি প্রেরণ করতেন। আর আমাদের সুদর্শন আজিমভও কম কিসে, ইতিমধ্যেই সে টার্কিশ ডার্লিং যোগাড় করে ফেলেছে।
আজিমভ কতক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকাই আছে জানিনা। আমার চোখের সামনে হাত নেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। বলে, কি হে! কোন দেশে হারিয়ে গেলে? আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে খাবারে মনযোগ দিলাম। অতক্ষনে আজিমভ সব খাবার প্রায় সাবাড় করে ফেলেছে। আমিও ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ‘মাংসের চপ’ গুলো কোন রকম গলধঃকরণ করে নিচে নেমে পড়লাম।
--চলবে
বিষয়: বিবিধ
১২৩০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজিমুল্লাহ খাঁ এর ইতিহাসটা আবারো রিভিউ হয়ে গেলো, ভুলেই গিয়েছিলাম। উনারাই প্রতিভা- সূর্যের আলোর মতোন বিকশিত হয়ে কিরণ রশ্নি দ্বারা সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে গেছেন।
চমৎকার পর্ব সাথে ইতিহাস -খুব চমৎকার লাগলো! শুকরিয়া।
গত বছরের প্রথম দিকে তুরস্ক আসছিলাম একটা প্রশিক্ষনের জন্য। কিন্তু আর্মির কঠিন রুলসের কারণে স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাই ওদের কালচার বুঝতে পারিনি। আপনার লেখাগুলো থেকে অনেক কিছুই জানতে পারছি।
আপনি কি এখনো টার্কিতে আছেন??
আগামী মাসে আসতে পারি।
আজিমুল্লাহ খান এর ইতিহাস স্মরন করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ ভাই।।
মন্তব্য করতে লগইন করুন