প্রবাসের স্মৃতিচারণ - নয়

লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ০৬ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৬:১৬ রাত

১৩

সিম অপারেটর আমার পাসপোর্ট নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণার পরে আবিষ্কার করলেন আমার বয়স এখনো আঠারো হতে ২০ দিন বাকী। আঠারো না হলে সিম দেয়া যাবেনা বলে জানালেন তিনি। মনটা খারাপ হল রাশিয়ান বন্ধুটির জন্য। মনে হল আমার বয়স আঠারো না হওয়াতে সে ভীষণ ব্যথিত। অগত্যা এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করলাম কিছুক্ষণ। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। কোথাও কোন চকলেটের খোসা পর্যন্ত দেখলাম না। হালকা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিলাম বিশুদ্ধ হাওয়ায়। এজিয়ান সাগরের ওপারে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠছে একেরপর এক। ওপারের নাম ‘কারশিয়াকা’। মুহূর্তের মধ্যে যেন হাজার হাজার নক্ষত্রে ছেয়ে গেছে সাগরের ওপার। সাগরের নীল পানিতে নক্ষত্র সদৃশ লাইটের প্রতিচ্ছবিকে বেশ লাগছে। ওপার থেকে এপারকেও হয়ত এরকম সুন্দর লাগবে। কিন্তু, আমার কাছে ‘নদীর এ পার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস; ওপারেতে স্বর্গসুখ আমার বিশ্বাস’ প্রবাদটির মত মনে হচ্ছে ওপারটাই না জানি কত সুন্দর! হোস্টেলটা ওপারে হলে বেশ হত। রাশিয়ান বন্ধুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সে বলল, চল এবার যাওয়া যাক।

আমার এ বন্ধুটির আচরণের সাথে মানানসই একটা নাম হওয়া দরকার। এভাবে আর চলেনা। ওর নাম রাখলাম আজিম তথা মহান। তার হৃদয়টি যে মহান সে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছে। তাই তার নামটা আজিমই রাখা যায়। তবে সে রাশিয়া অঞ্চলের মানুষ হওয়াতে তার নামটা আজিম হলে অপূর্ণ থেকে যায়, তাই তার নাম ‘আজিমভ’ হওয়া দরকার। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন সেন্ট্রাল এশিয়া ব্লকটাকে শোষণ করে চলে যাওয়ার পরে নারী-মদ এসবের সাথে সাথে ঐসব অঞ্চলের মানুষদের নামের পিছনে ‘ভ’ যুক্ত করে দিয়ে গেছে। তাই তাঁর নামটা আজিমভ হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।।

আজিমভ আমাকে বলল এত চিন্তা কর কি? আমি বললাম সবেইতো আসলাম মানিয়ে নিতে একটু সময়তো লাগবেই। এখানে যা দেখি তা শুধু আমার দেশের সাথে মিলিয়ে নিই। এখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন রাস্তাঘাট আর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া সব আমাকে আমার দেশে নিয়ে যায়। আমার দেশের মানুষদেরও তো অধিকার আছে সুন্দর আবহাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ার। তুর্কিরা যেমন মানুষ আমার বাঙ্গালীরাওতো তেমন মানুষ। বিদ্যা-বুদ্ধিতেতো পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে বাঙ্গালীরা। প্রখ্যাত দার্শনিক গোখলে বলেছিলেন, ‘’What Bengal thinks today, the rest of India thinks it tomorrow.’’

চিন্তা চেতনায় অগ্রগামী ছিল বলে বিখ্যাত দার্শনিক গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এ উক্তিটি করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বদেশী আন্দোলন, সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে বাঙ্গালী।। সব কিছু ছিল আমাদের, কোন কিছুর অভাবতো ছিলনা। কিন্তু, কেন আমরা এত পিছিয়ে আজও? শুধু কি আমাদের রুচির দোষে? নাকি অন্তর্দন্দ্ব আর পরশ্রীকাতরতা? বুঝিনা, ভাল লাগেনা, বিষণ্ণ লাগে সব কিছু, স্বাধীনতার এতদিন পরে এসেও আমার দেশের মানুষদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা দেশের সরকার। সবাইকে মরতে একদিন হবেই, তবে 'স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়ত সবার 'অধিকার'। পত্রিকার পাতা জুড়ে শুধু রক্ত আর রক্ত।। লাশের ভারে ন্যুহ দেশ...।।

ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন দেওবন্দের প্রখ্যাত আলেম সমাজসহ উপমহাদেশের তৎকালীন বিখ্যাত আলেমরা । শাইখুল হিন্দ মাহমুদ আল হাসান, মৌলভী বরকত উল্লাহ্‌, ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর মত দেওবন্দের বিখ্যাত আলেমরা দখলাদার ইংরেজদের থেকে স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য স্বশস্ত্র আন্দোলন করেছিলেন। কোনদিন তারা জালিমের কাছে মাথা নত করেননি। এ স্বল্প পরিসরে তাঁদের নিয়ে লিখা সম্ভব না। ভাবতে অবাক লাগে তাঁদের উত্তরসূরি বর্তমান যুগের তথাকথিত কিছু আলেমের জালেমি দেখলে। সরকারের অন্যায় কাজের বিরোধিতার পরিবর্তে যারা ফতোয়ার মারপ্যাঁচে তা ন্যায়ে পরিণত করতে ব্যস্ত। ধিক্কার জানাই তাদের। দেশের প্রতিটা কোনায় সংগঠিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমান অপরাধী কথিত এসব আলেম।।

আমি তাকে বাঙ্গালি জাতির একটা ব্রিফ হিস্টোরি বললাম ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। তাকে বললাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে ওসমানী সাম্রাজ্য যখন তাদের রাজ্যের বিশাল একটা অংশ হারিয়ে টালমাটাল অবস্থা তখন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা খেলাফতের পতন ঠেকানোর জন্য সুদূর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে হুংকার দিয়ে উঠে। ১৯১৯ সালে ভারতের বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল 'খেলাফাত মুভমেন্ট'। সে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য্য হয় খেলাফাত মুভমেন্টের মত মুসলিম রিলেটেড মুভমেন্টে হিন্দু নেতাদের সাপোর্ট ছিল সে কথা জেনে। আমি তাকে বললাম, এমনকি খেলাফাত মুভমেন্টের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সভাপতিত্ব করেন কংগ্রেস নেতা মোহনদাশ করমচাঁদ গান্ধী। হিন্দু-মুসলিমদের যৌথ এ আন্দোলনের গোঁড়ায় করাত চালিয়ে ধ্বংস করে দেন মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক তার প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দিয়ে খেলাফত বাতিল করার মাধ্যমে। পরে ইংরেজরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে হিন্দু-মুসলিমের যৌথ এ আন্দোলনে। তাই ধূর্ত ইংরেজরা আমাদের সুবিধাবাদী নেতাদের ব্যবহার করে ভারতের মাঝখানে লোহার ধারালো শিকল দ্বারা চৌচির করে দু’ভাগ করে দিয়ে ভারত থেকে পলায়ন করে ১৯৪৭ সালে।

গাড়ি থেকে নেমে হুড়মুড় করে রেস্টুরেন্টের দু’তলায় উঠে পড়লাম আমরা দু’জন। আর একটু লেট হলে ডিনার মিস করতাম আমরা। এখানে ডিনারের টাইম শুরু হয় বিকেল চারটায় আর চলে রাত সাতটা পর্যন্ত। খুব সম্ভবত এটাই ডিনারের স্বাস্থ্যকর সময়। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে আমাদের মত ভার্সিটি পড়ুয়াদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে লেট নাইট ডিনার করাটা। তাইতো নানা ধরণের নাম না জানা ব্যামো পিছু ছাড়ছেনা কারোই।।

রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলাটা প্রথমদিন ভাল করে খেয়াল করে দেখা হয়নি। এখন দেখলাম উজ্জ্বল আলোর পরিবর্তে মৃদু নম্র আলো, যাতে চোখ পীড়িত না হয়। চেয়ারগুলো খুব মূল্যবান। কিন্তু মূল্যটা উঁচু গলায় প্রকাশ করেনা- বসবার আরামে তার পরিচয়। জানালার পর্দার রঙও আগন্তুককে স্মিতহাস্যে অভ্যর্থনা জানায়, বর্ণের রূঢ়তায় পিছু হটিয়ে দেয় না। তাছাড়া টেবিলের উপর সুন্দর টেবিল ক্লথ, গেলাস, পানি, ফুলদানি সবই যথাস্থানে স্বচ্ছন্দ নাগালের মধ্যে রাখা। ফ্লোর জুড়ে সুন্দর কার্পেট। রুমের ঠিক পিছন বরাবর কোনায় দশ-পনের ফুট জায়গা জুড়ে সুন্দর এক ঝরনা। শ্বেত পাথরের গা বেয়ে মৃদু শব্দ তুলে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার পানি...।।

--চলবে

বিষয়: বিবিধ

১৩৬১ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348662
০৬ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ০৬:২৪
শেখের পোলা লিখেছেন : সুন্দর বর্ণনা ভালই লাগল৷ধন্যবাদ৷
০৬ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৪:০৫
289416
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।।
348674
০৬ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : যে রুচির দৈন্য আমরা ডাইনিং হলে দেখাই সেই দৈন্যই আমাদের জিবনে সৃষ্টি করেছে এত সমস্যার।
আজিমভ কিন্ত ইংরেজি এস দিয়ে লিখা হয়!! বিখ্যাত সাহিত্যিক আইজ্যাক আজিমভ এর একটি গল্পই আছে "স্পেল মাই নেম উইথ এস" নামে। উচ্চারন যদিও আজিমভ!!
০৬ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
289417
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : সম্ভবত সেটা j অথবা Z এর স্থলে এস দিয়ে লিখতে বলেছিলেন, তাই কি??
ধন্যবাদ ভাই Good Luck Good Luck
348687
০৬ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৩
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : অসাধারণ।
০৬ নভেম্বর ২০১৫ রাত ১১:০৩
289449
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া Good Luck
349177
১০ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৩:০৩
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম।

ভালো লাগলো এ পর্বটিও। আমাদের এখানে ডিনার টাইম সাড়ে ছয়টার পর হতে রাত আটটার মধ্যে তবে রেস্টুরেন্ট এ লেট নাইট ডিনার চলে!

শুকরিয়া।
১০ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৪৬
289878
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুস সালাম।। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।। Good Luck
আপনি কোথায় থাকেন। বাংলাদেশেতো মনে হয় 9 টার পর শুরু হয় ডিনার টাইম।।
১১ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০২:০১
289909
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : ইতালিতেGood Luck
১১ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ০৫:১২
289936
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আচ্ছা।। খুব ভালো। তাইলেতো ইস্তানবুলে অবশ্যই আসা হয়েছে আপনার।।
১১ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:৫৪
289980
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : ট্রানজিটে অবশ্য এয়ারপোর্টের ভিতর Happy
১১ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:২১
289992
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আচ্ছা, সুযোগ পেলে ইস্তাম্বুল ঘুরে যাইয়েন,,, দাওয়াত রইলো Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File