প্রবাসের স্মৃতিচারণ-- আট
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ০৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৫:৪৯ রাত
- ১২
সকালে নাস্তার পর বিচ্ছিন্নভাবে আলাপ চলছিল আমার আর করিমভের মাঝে। মেয়েটি একবার আমার দিকে একবার তার চাচাতো ভাইয়ের দিকে প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে। মনে হল সে কিছু বলতে চায়। ইংরেজি না জানার কারণে সে আমাদের সাথে আলাপে যোগ দিতে পারছিলনা। অগত্যা আমি তারা দু’ভাইবোনকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে উঠে রেস্টুরেন্টের বাইরের একটা চেয়ারে বসলাম। সকালের রোদ আমার উপর এসে পড়েছে। ছোট বেলায় আব্বু বলেছিলেন, "সকাল দশটা পর্যন্ত যে রোদ পড়ে সেটা শরীরের জন্য ভাল।" সেটা নাকি মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি’ সরবরাহ করে। রোদটুকু নিয়ে খেলা করতে বেশ লাগছে। প্রায় বাতাসের মতোই চোখ-মুখ এসে ছোঁয় শীতের-সকালের রোদ। অতি কোমল শিশুর মত সে স্পর্শ। হালকা বাতাসটা জানান দিচ্ছে কাছে কোথাও সাগরের অস্তিত্ব আছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম হোস্টেলের গেইট পেরিয়ে রাস্তা, রাস্তার ওপারে খেলার মাঠ, মাঠের পরেই সমুদ্রের সবুজ জলরাশি খেলা করছে। অ্যাজিয়ান সাগরের একটা অংশ ইজমিরকে দু’ভাগ করে দিয়ে ইজমিরের মূল কেন্দ্রকে যেন এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে পরম মমতায়। সবুজ জলরাশি আস্তে আস্তে উপচে পড়ছে সমুদ্র পাড়স্থ পাথর খণ্ডের উপর। ঢেউগুলো উম্মাদ নয় বরং বেশ শান্ত; আস্তে আস্তে আনমনে কূলে উপচে পড়ছে একের পর এক।
হাওয়া নামের সেই সিকিউরিটি মহিলাটি দশ-পনের মিনিট ধরে কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করে অব্যহতি দিয়েছে এমন সময় একটা মেয়ে উপযাচকের মত আমার বিষয়টা দেখতে এগিয়ে এল। বয়স আঠার-উনিশ হবে, গায়ের টিশার্টে লিখা আছে 'নো ওয়ান কেয়ারস।' নিচে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা স্পোর্টস প্যান্ট। পায়ে টিশার্টের রংয়ের সাথে ম্যাচ করা ক্যাটস। উচ্চতায় 5 ফুটের কিছু বেশী হবে। মাথার চুলগুলো ইশত কালো, বাঙালি মেয়েদের মত কুচকুচে কালো নয়। তবে বাঙালি মেয়েদের মত সামনের দিকে ছোট করে কাটানো, পিছনের গুলো বেশ লম্বা। চুলের স্টাইলে আভিজাত্য নেই তবে আকর্ষণীয়। সেও নাস্তা করে বেরিয়েছে মাত্র। সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিল আজ শনিবার হওয়াতে অফিস বন্ধ। সোমবারে যোগাযোগ করতে বলল। কারণ, এখানে শনি, রবি নাকি সাপ্তাহিক ছুটি। আমাকে আরও দুইদিন মুসাফিরখানায় থাকতে হবে জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মনে ফিরার সময় রাশিয়ান আর একটা ছেলের সাথে দেখা হল নামটা স্মৃতির পাতা অসংখ্যবার হাতড়েও খুঁজে পেলাম না। সে তাতারের করিমভের মত দুই মিটার লম্বা না হলেও গায়ের রং আর চুলের কালারে অনেকটা করিমভরই প্রতিচ্ছবি বলা চলে। সে এখানে এসেছে দু'মাস আগে। প্রাথমিক পরিচয়ের পরে আমাকে বাড়ির সাথে কথা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল, আমি না সূচক ইঙ্গিত দিতেই সে বাইরের দোকান থেকে ইন্টারন্যাশনাল কলিং কার্ড কিনে দিয়ে পাবলিক ফোন থেকে কল করার সিস্টেমটা দেখিয়ে দিল। দেশে ফোন করে আশ্বাস দিলাম যে আমি ভালো আছি। কথা শেষ করা পর্যন্ত সে আমার অপেক্ষায় ছিল। আমাকে সিম কিনতে সাহায্য করবে সে নিজে থেকেই বলল। পাশের দোকান থেকে পাবলিক বাসের একটা কার্ড কিনে নিয়ে বাসে উঠলাম আমরা দু’জন। পাবলিক বাসের এ কার্ড না থাকলে পকেটে হাজার ডলার থাকলেও গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার আগে নিজ দায়িত্বে নেমে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের এ হোস্টেলটির আশে পাশে তেমন কোন লোকালয় চোখে পড়লনা। মাইল কয়েক দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর সুন্দর দালান। ঐখানেই মানুষের বাস।
হোস্টেলের একপাশে সমুদ্রের শান্ত বারিরাশি অপর প্রান্তে পাহাড়। উচ্চতায় এদেরকে পর্বত বলা যায়না। তবে কিছু কিছু পাহাড় বেশ উঁচু, এসব পাহাড়ের শীর্ষে আস্তানা গেড়েছে সাদা মেঘরাশি।। হোস্টেল পার হয়েই চোখে পড়বে সুদর্শন একটা পাঁচতারা হোটেল। হোটেলটি গোলাকার এবং বেশ উঁচু। দূর থেকে দেখে মনে হবে কোন বাতিঘর। হোটেলের পাশে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টের সারি। রেস্টুরেন্টগুলো লোকে লোকারণ্য। এখানে প্রধানত মদ আর মাছ সাপ্লাই দেয়া হয়। 'মাছের জন্য বিখ্যাত এসব রেস্টুরেন্ট' আমার রাশিয়ান বন্ধু বলল। একদম অ্যাজিয়ান সাগরের টাটকা মাছ। ছুটির দিন হওয়ায় প্রত্যেকটা রেস্টুরেন্টে লোকজনের উপচে পড়া ভিড়। রেস্টুরেন্টের ভিতরে বাসের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল শেল্পজুড়ে হরেক রকমের মদ সাজানো।। আর টেবিল জুড়ে বসে আছে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী, কয়েকটা ফ্যামিলিও চোখে পড়ল।
রেস্টুরেন্টের ভিতর থেকে চোখ ফিরালাম রাস্তার উপর। এদিক ওদিক মানুষের ব্যস্ত ছুটাছুটি। ছোট বেলা থেকে শিখে আসছি ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মুল্য অনেক বেশী' কিন্তু এখানকার মানুষদের দীর্ঘশ্বাসে ছুটাছুটি দেখে মনে হচ্ছে এ প্রবাদটা আংশিক না পুরাই ভুল। বরং ‘জীবনের চেয়ে সময়ের মুল্য অনেক বেশী’।
মিনিট বিশেক পরে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে বিশাল এক শপিং মলের ভিতরে পা রাখলাম।।
--চলবে
বিষয়: বিবিধ
৯৬৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চলুক-শুভকামনা!
পরের পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।।
মন্তব্য করতে লগইন করুন