প্রবাসের স্মৃতিচারণ -সাত
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ২৫ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:২২:৪০ বিকাল
১১
একটু বেলা করে ঘুম ভাঙল। সূর্য তার আপন তেজ বিকিরণ করা শুরু করেছে হিম শীতল ইজমিরের উপর। রাতভর গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলি চিক চিক করে ঝরে পড়ছে ঘাসের ডগার উপর। শিশির বিন্দুগুলির জন্য বেশ খারাপ লাগল। এখন মুক্তোর মত চকচক করে তার সৌন্দর্য বিকিরণ করলেও একটু পরেই হারিয়ে যাবে কালের অতল গহ্বরে। তার খোঁজ কেউ রাখবে না। মানুষের জীবনের সাথে শিশির বিন্দুর জীবনের বেশ মিল। শিশির বিন্দু যেমন একটা সময়ের জন্য আবির্ভূত হয় মানুষও ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আবির্ভূত হয়। যে শিশির বিন্দুটি ভোরবেলা তার সৌন্দর্যে সবাইকে মোহিত করেছিল, কবির কবিতায় ছন্দের যোগান দিয়েছিল, দুপুরবেলা এসে সেই শিশির বিন্দুর কথা কেউ আর মনে রাখেনা। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এখানে ভিন্নতা হল, সে যদি তার নির্দিষ্ট সময়টা মানব কল্যাণে অতিবাহিত করে যেতে পারে তাহলে যুগ যুগ ধরে তাঁর কথা স্মরণ করবে বিশ্ববাসী।
ঘুমটা বেশ ভালই হয়েছে। নতুন জায়গায় আমার ঘুম একটু কমই হয়ে থাকে, কখনো কখনো ঘুম একটু হলেও দুঃস্বপ্নে ভরে থাকে পুরোটা সময়। কিন্তু এখানে ঘুম হওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হল দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি আর মাঝখানে সেই ঘুম ভাঙ্গানিয়ার মিষ্টি পরশ। ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই করছে। জানালার বাহির থেকে চোখ ভিতরে ফেরাতেই সেই দীর্ঘকায় বিদেশীর মিষ্টি হাসির অভ্যর্থনা পেলাম। সে আমার আগেই উঠে পড়েছে। চেহারার অবস্থা দেখে বুঝলাম বেশ আগেই জেগেছে সে। সে যেমন সুদর্শন হাসিটাও ঠিক তেমনি দেখার মত। যে কেউ এক নিমিষেই আপন হতে বাধ্য। সুন্দর স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল ‘গুড মর্নিং’। আমিও হেসে জবাব দিলাম। নাম তার করিমভ। রাশিয়া অধ্যুষিত ‘তাতার’ অঞ্চলের লোক। সে নিজে ইস্তানবুলে পড়াশুনা করে। তার চাচাতো বোনকে নিয়ে এ হোস্টেলে এসেছে। চাচাতো বোন আমার মত নতুন এসছে তুর্কি দেশে। প্রাথমিক পরিচয়ের পর সে এক সাথে নাস্তা করার অফার করল। উঠে ফ্রেস হয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে রওয়ানা দিলাম।
তার চাচাতো বোন আগে থেকেই আমাদের জন্য রেস্টুরেন্টের বাইরে অপেক্ষারত ছিল। করিমভ তার চাচাতো বোনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। নামটা বেশ কঠিন ছিল তাই সাথে সাথেই ভুলে গিয়েছিলাম। বয়স আঠার-উনিশ হবে। সকালের রোদ খেলা করছিল তার মাথার চুলে। চুল সামনের দিকে ছোট আর পিছনে কাঁধ বরাবর লম্বা। গায়ে ইয়োরোপীয় ড্রেস। এ শীতের মধ্যেও গায়ে তেমন কাপড় চোপড়ের বালাই দেখলাম না। সম্ভবত আমার কাছেই বেশী শীত মনে হচ্ছে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের লোক কিনা! সে রাশিয়ান ল্যাংগুয়েজ ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানেননা। আমার 'হ্যালো'র উত্তরে মাথা নেড়ে তাই শুধু একটা হাসি দিল। 'এ হাসি বিধাতা যাকে দিয়েছেন তার আর কথা বলার দরকার হয় না।'
রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকলাম আমরা তিনজন। এবার নাস্তা সিলেকশনের পালা। টেবিলের উপর পনীর, জয়তুন, মধু আরও কত কি সাজানো। একটাকেও মনে ধরলনা। আমার চোখ পরটা বা নান রুটি জাতীয় কিছু একটা খুঁজছিল। নাহ! কোথাও এর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। অগত্যা পনীর, মধু আর রুটি নিয়ে ফিরলাম। রুটিটা বেশ শক্ত। এটা তুরস্কের জাতীয় খাদ্য। বাঙ্গালীর যেমন ভাত না হলে চলেনা, ঠিক তেমনি তুর্কিদেরও রুটি না হলে চলেনা। প্রত্যেক খাবারের সাথে তাঁদের রুটি চাইই। আরও পরে খেয়াল করলাম তারা রাইসের সাথেও রুটি খায়। রুটিকে তারা 'একমেক' বলে। রুটিটা কোনমতেই নান রুটির মত না। তিন চার ইঞ্চি প্রস্থ আর আট-দশ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একমেক। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গমই যার কাঁচামাল। ওরা বলে গরম গরম খেতে বেশ লাগে।
পড়াশুনার জন্য যেদিন থেকে ঘর ছেড়ে আসি সেদিন থেকে খাবার দাবার নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিলনা আমার মাঝে। একটা কিছু হলেই হল। আমার অনেক ফ্রেন্ডকে দেখেছি খাবার টেবিলে বসে মায়ের হাতের রান্নার কথা মনে করে চোখের পানি ঝরাতে। আমারও মনে পড়তনা তা না। বাস্তবতা মেনে নেয়ার প্রবল ইচ্ছাটা আমাকে অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগ দিতনা। যে জিনিসটা পাব না সেটা নিয়ে দূঃখ করতে আমার মন কোনদিন সায় দেয়নি। কিন্তু আজকে নাস্তার টেবিলে বসে দেশের তেলেভাজা পরটাকে খুব মিস করেছি। কোন রকম কষ্ট করে ৬০ গ্রাম ওজনের রুটির চার ভাগের এক ভাগ গলাধঃকরণ করে উঠে পড়লাম।।
-- চলবে
বিষয়: বিবিধ
৯৮৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তুর্কি হেসফিবল কোম্পানি এবং টার্কিস হোপ স্কুল এর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের জন্য অনেক তুর্কি খাবার খাওয়ার সেীভাগ্য হয়েছে। ওদের বাকলাভা মানে বাকরখানির মত রুটিটা খুব ভাল লাগে।
বাকলাভাটাতো মিষ্টি ভাই।
এবারের বর্ণনাটাও চমৎকার লাগলো বিশেষত এই অংশটুকু-
মানুষের জীবনের সাথে শিশির বিন্দুর জীবনের বেশ মিল। শিশির বিন্দু যেমন একটা সময়ের জন্য আবির্ভূত হয় মানুষও ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আবির্ভূত হয়।
শুরকিয়া।
মন্তব্য করতে লগইন করুন