প্রবাসের স্মৃতিচারণ-- ছয়
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ২০ অক্টোবর, ২০১৫, ০৭:২১:০৮ সন্ধ্যা
৯
নামাজ শেষে আবার ঘুম পেয়ে বসল। ফজরের আজানের সময় জানা নেই। সাথে কোন ইন্টারনেট সংযোগও ছিলনা তাই দেখাও সম্ভব হলনা। ঘুমের মাত্রা অধিক থেকে অধিকতর হয়ে একসময় সীমা অতিক্রম করার উপক্রম হওয়ায় ঝটপট ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। লাইট অফ করে বিছানার দিকে যাব, চাঁদের আলো জানালার কাঁচ গলে রুমের ভিতরে এসে পড়ল। আলোর একটা অংশ আমার উপর এসে পড়ে। আমার প্রতিবিম্ব তখন মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। ঝাপসা আলোয় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কোনদিন ওভাবে খেয়াল করে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা হয়ে উঠেনি। বাইরে তাকাতেই কমলেবুর গাছগুলোকে চাঁদের আলোয় একেকটা অশরীরীর মত দেখাচ্ছিল। কি অদ্ভুত মানুষের অনুভূতি! একটু আগে জ্যোৎস্নায় যে গাছগুলোর ছায়া আমার মনকে প্রশান্ত করেছিল ঠিক মুহূর্ত কয়েকের ব্যবধানে তা আমার কাছে অশরীরীর মত মনে হল। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার মন আমাকে জানান দিল ১৫-১৬ জনের এ গেস্ট রুমে আমি ছাড়া অন্য কোন প্রাণী নেই, মানে আমি একা। এতক্ষণ যে কথাটা মনে পড়েনি ঐটা মনে পড়ার আর টাইম পেলনা। রুমে আটটা সিট। আবার প্রত্যেকটা সিট দ্বিতল বিশিষ্ট। নিচে একজন উপরে একজন। সব মিলিয়ে ১৬ জন গেস্ট এক সাথে অবস্থান করতে পারবেন এখানে। প্রত্যেকটা বিছানা সাদা চাদরে ঢাকা। বিছানার সাদা চাদরগুলোকে মনে হল কাফনের কাপড়ে ঢাকা এক একটা মড়া লাশ। ভূত-টুতের অস্তিত্বে কোন দিন আস্থা ছিলনা আমার, তাও কিন্তু নিজের প্রয়োজনে। কারণ অনেক সময় রাত-বিরাতে অন্ধকারে চলা ফেরা করতে হত, ভুতের অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখলে নিজেরই লস। জীবনে যে জিনিসটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলাম সেই জিনিসটাই আমার উপর এভাবে ভর করবে ভাবিনি কখনো। বাইরে তাকাতে সাহসে কুলোচ্ছেনা। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও যেন অশরীরীর সাথে মিশে গিয়ে আমার সাথে উপহাস করছে। জীবনে যত ‘হরর মুভি’ দেখেছি, রাত জেগে যত ‘ভূত এফএম’ শুনেছি, সবগুলোর ভয়ংকর দৃশ্য আর ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত লাগছে একটু আগে ঘুমের জন্য ঠিকমত নামাজ পড়তে পারছিলাম না সেখানে এখন দেখি ঘুম উধাও। শেষ পর্যন্ত বিপদের মুহূর্তে ঘুমটাও আমার সাথে বেঈমানি করল। কম্বলের ভিতরে মুখ গোঁজে রাখলাম। এভাবে কতক্ষণ কাটল জানিনা। ভয় এখনো কাটেনি। ঘড়ির কাঁটা অনেক শ্লথ হয়ে গেছে যেন। ঠাণ্ডার মধ্যেও শরীর ঘেমে একাকার। মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম কোন মিনার থেকে ভেসে আসুক আজানের ধ্বনি। এমনি সময় প্রকট আওয়াজ তোলে রুমের দরজা খুলে গেল।।
10
আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। রুমে আগন্তুকদের বুঝতে দিলাম না আমি যে ভয় পেয়েছি। দুটি গলা কথা বলছে। একটি আমাদের ব্লকের সিকিউরিটির গলার মতন, অন্যটা অপরিচিত। কম্বল একটু ফাঁক করে দেখলাম একজন দুই মিটার লম্বা জওয়ান, গায়ের রংটা ইশৎ লাল। চুল গুলোতেও সোনালী আর লালের মিশ্রণ। চওড়া কাঁধে বিশাল এক ব্যাগ। কাঁধের প্রকাণ্ড ব্যাগ আর জ্যাকেটে ঢাকা পড়ায় গায়ের শার্টের কালারটি অনুমান করা গেলনা। কোন দেশ থেকে আসল তাও বুঝতে পারলাম না। টার্কিশদের মত দেখতে, কিন্তু গায়ের রঙ্গটা একটু বেশীই লালচে। ঠিক ফর্সা লোকেরা গরমের পুড়লে যে কালার ধারণ করে তার চেয়েও ঢের লাল। সম্ভবত রাতের ফ্লাইটে তার আগমন। সিকিউরিটি লোকটির গায়ে সাদা শার্টের উপরে জ্যাকেট আর কাল প্যান্ট। এটা সিকিউরিটির ফর্মাল ড্রেস এখানে। সিকিউরিটির পোশাক না পড়লে বড় কোন অফিসের অফিসার বলে চালিয়ে দেয়া যাবে অনায়েসেই। দু’জনের কথা শুনে বুঝলাম আগন্তুক যে দেশিই হোকনা কেন টার্কিশ ল্যঙ্গুয়েজে ভালই পারদর্শী। তার স্বতস্ফূর্ত কথা শুনে অন্তত আমার কাছে তাই মনে হল। একটা শব্দও বুঝার সাধ্য আমার হয় নাই। দুর্বেধ্য! অগত্যা আমি কম্বলের ভিতরে আশ্রিত হলাম। দরজায় কপাট পড়ার শব্দ পেলাম, বুঝলাম সিকিউরিটি লোকটি বের হয়ে গেছেন। রুমের দরজাটি স্বাভাবিকভাবে খুললেও আমার কাছে মনে হয়েছে প্রকট আওয়াজ তুলে হিংস্রতার সাথে কেউ খুলছে। ভয়ে আচ্ছন্ন ছিলাম বিধায় ওরকম মনে হয়েছে হয়ত। এভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ভয় পাওয়াতে খুব লজ্জা পেলাম। কারণ, জানতাম খারাপ জিন-ভূতগুলো থাকে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। এ কথাটা এতক্ষণে মনে আসল। খুব লজ্জা পেলাম, বুঝতে পারলাম লজ্জায় চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে সাত পাঁচ ভেবে চলেছি। আগন্তুকের সাথে কথা বলব কিনা ভাবছি। আবার চিন্তা করলাম বেচারা অনেক দূর থেকে এসেছে তাকে ডিস্টার্ব করাটা ঠিক হবেনা। এমনি সময় দূরের কোন মিনার থেকে ভেসে আসল মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আজানের সুমুধুর ধ্বনি,
‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান,
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই,
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুল.........।।’
আমার কল্পনা এভাবে নিয়ে গেল আমাকে ১৪ শত বছর আগের মক্কার মরু প্রান্তরে। পথভ্রষ্ট জাহেলি সমাজের মানুষদের মুক্তির জন্য একজন যুবক চিন্তারত। যুবকের বয়স ২৫ এর কোটায়। মক্কার অদূরে সমতল থেকে বেশ উঁচুতে দুর্গম পাহাড় ‘গারে হেরা’ তথা হেরা পর্বতের গুহায় গিয়ে তৎকালীন পৌত্তলিক আরব সমাজের মানুষদের মুক্তির জন্য পরমাত্মার ধ্যানে মশগুল। প্রতিদিন শ্বাপদসঙ্কুল পথ মাড়িয়ে হেরা গুহায় আসা যাওয়া করতেন সেই যুবকটি। যিনি তৎকালীন জাহেলি সমাজের লোকদের মাঝে হানাহানি-মারামারির বদলে কেমনে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিবেন, কেমন করে শত্রুকে বন্ধুতে রূপান্তর করবেন, কেমন করে নারীর মর্যাদা দেয়া যায় এসব আরও বহু চিন্তায় উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। নারীরা তখন ছিল অবহেলিত, নির্যাতিত। জন্মের পরেই জীবন্ত পুঁতে ফেলা হত নবজাতিকাকে নিজ বাবা কতৃক। এভাবে চিন্তা করতে করতে দীর্ঘ ১৫ বছর পরে একদিন সিদ্ধি লাভ করলেন সেই যুবক। যুবক তখন পূর্ণ একজন মানুষ, বয়স তাঁর চল্লিশ। স্বর্গীয় দূত তাঁর কাছে এসে বললেন ‘ইক্বরা’ তথা পড়ো। স্বর্গীয় দূত আবার বললেন,
‘পড়ো! সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিষিক্ত ডিম্ব থেকে।’
মহান রব প্রথম ঐশীবাণীর মাধ্যমে এভাবে মানুষকে জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝতে শিখে। তবে সে জ্ঞান অর্জন যেন হয় মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য সেটাও স্মরণ করে দিয়েছেন। সাথে সাথে এও স্মরণ করে দিয়েছেন, জ্ঞান অর্জন যেন কাউকে অহংকারী করে না দেয়। যার সৃষ্টি একফোঁটা নিষিক্ত ডিম্ব থেকে তার আবার কিসের অহংকার!!
সেই স্বর্গীয় দূত হলেন হযরত জিব্রাইল আঃ যিনি সকল প্রেরিত রাসুলের কাছে আল্লাহ্র বাণী নিয়ে আগমন করতেন, আর সেই যুবক হলেন হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ, যাকে আল্লাহ তামাম দুনিয়ার জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। ♡☪
-->চলবে
বিষয়: বিবিধ
১২১৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার লিখা! কৌতুহল বাড়লো........
শুকরিয়া
মন্তব্য করতে লগইন করুন