প্রবাসের স্মৃতিচার--পাঁচ
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:০২:৪৩ দুপুর
বুকের পাথর একসময় নিরব অশ্রুতে রূপ নিয়ে ঝড়ে পড়ল। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। মিষ্টি একটি স্বপ্নে ঘুম ভাঙল। সে এসেছিল আমাকে সান্ত্বনা জানাতে। যে আমাকে বিদেশে আসার আগের দিন ফোন করেছিল। মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে চলে গেল সে। মনটা শান্তিতে পূর্ণ হয়ে গেল। জার্নির কোন ক্লান্তি নেই এখন।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘণ্টার কাঁটা সাতটার ঘরে। এটা বাংলাদেশি সময়, এখনো চেইঞ্জ করা হয়ে উঠেনি। এখানে রাত তিনটা এখন। আমার ছোট বোনের দেয়া উপহার এ ঘড়িটা। বিদেশ পাড়ি দেয়ার কয়েকদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম হোস্টেলে, তখন সে দিয়েছিল। তার ছোট্ট অথচ অমূল্য এ উপহারটি সেদিন আমাকে বেশ আপ্লুত করেছিল। ঘড়িতে পরম মমতায় হাত বুলালাম।
আমার ঠিক পিছনে কাঁচের জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত আকাশ, কমলালেবু বাগান। সমান দূরত্বে সারি সারি সাজানো গাছ-গাছালি। দক্ষ আর রুচিশীল শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া পড়েছে তা প্রথম দেখে যে কেউ বুঝবে। ধন্যবাদ জানালাম সেই ঘুম ভাঙ্গানিয়াকে, এমন একটি মুহূর্তে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য। তার মিষ্টি হাসির পরশটা এখনো আমার সামনে জীবন্ত। আচ্ছা সে কেন এসেছিল? আমার দুখের সময়ে এসে শান্তিময় করে দিয়ে গেল সবকিছু। সে স্বপ্নে জানান দিল আমি তোমার পাশে আছি তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকোনা কেন। এসব কি ভাবছি আমি! তার সাথেতো এরকম কোন কথাই হয়নি কোন দিন। সে হয়তো জানেইনা আমি এখন তাকে ভাবছি। হয়ত সব আমার অবচেতন মনের কল্পনা।
জ্যোৎস্নার সাথে কথা বলি। রাতের নিরবতা ভেঙে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকটা বেশ লাগছে। ইশার নামাজটা না পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন পড়ে নেয়া দরকার কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। আলস্যেরা সব যেন ঝেঁকে বসছে আমার উপর। বাইরে ঠাণ্ডা পড়লেও রুমের ভিতের হিটার দিয়ে বেশ উষ্ণ করে রাখা হয়েছে। মাগরিবের নামাজের ওযুর সময় ট্যাবের পানি গুলো ঠাণ্ডা ছিল। হয়ত অন্য কোথাও গরম পানির ব্যবস্থা আছে, আমি জানিনা। নতুনতো! ঐ পানির কথা মনে পড়তেই হাত পা যেন অবশ হওয়ার অবস্থা। নাফসে মুৎমায়িন্না তখন আমাকে ইন্সপায়ার করার সকল চেষ্টা করছিল অযু করে নামাজ পড়ার প্রতি। মনে একটা ভয় ঝেঁকে বসল আগুনের!! আগুনকে বড় ভয় হয় আমার সেই ছোট বেলা থেকে। নাফসে মুৎমায়িন্নাও আমাকে আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করল। নামাজ না পড়লে নিশ্চিত আগুনে পুড়তে হবে। তাই সকল আলস্যের ছোবলকে হটিয়ে ওযু করতে গেলাম। গরম পানিও পেয়ে গিয়েছিলাম। সব স্রষ্টার সাহায্য। স্রষ্টার দিকে বান্দা নাকি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেলে স্রষ্টা বান্দার দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসেন। তারমানে যখন স্রষ্টাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা হয় তাহলে স্রষ্টাও তাঁর বান্দাকে সুখি করার সব বন্দোবস্ত করে রাখেন। হাত-মুখ ভালো করে তোয়ালে মুছে নামাজে দাঁড়ালাম।।
নামাজ শেষে আবার ঘুম পেয়ে বসল। ফজরের আজানের সময় জানা নেই। সাথে কোন ইন্টারনেট সংযোগও ছিলনা তাই দেখাও সম্ভব হলনা। ঘুমের মাত্রা অধিক থেকে অধিকতর হয়ে একসময় সীমা অতিক্রম করার উপক্রম হওয়ায় ঝটপট ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। লাইট অফ করে বিছানার দিকে যাব, চাঁদের আলো জানালার কাঁচ গলে রুমের ভিতরে এসে পড়ল। আলোর একটা অংশ আমার উপর এসে পড়ে। আমার প্রতিবিম্ব তখন মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। ঝাপসা আলোয় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কোনদিন ওভাবে খেয়াল করে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা হয়ে উঠেনি। বাইরে তাকাতেই কমলেবুর গাছগুলোকে চাঁদের আলোয় একেকটা অশরীরীর মত দেখাচ্ছিল। কি অদ্ভুত মানুষের অনুভূতি! একটু আগে জ্যোৎস্নায় যে গাছগুলোর ছায়া আমার মনকে প্রশান্ত করেছিল ঠিক মুহূর্ত কয়েকের ব্যবধানে তা আমার কাছে অশরীরীর মত মনে হল। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার মন আমাকে জানান দিল ১৫-১৬ জনের এ গেস্ট রুমে আমি ছাড়া অন্য কোন প্রাণী নেই, মানে আমি একা। এতক্ষণ যে কথাটা মনে পড়েনি ঐটা মনে পড়ার আর টাইম পেলনা। রুমে আটটা সিট। আবার প্রত্যেকটা সিট দ্বিতল বিশিষ্ট। নিচে একজন উপরে একজন। সব মিলিয়ে ১৬ জন গেস্ট এক সাথে অবস্থান করতে পারবেন এখানে। প্রত্যেকটা বিছানা সাদা চাদরে ঢাকা। বিছানার সাদা চাদরগুলোকে মনে হল কাফনের কাপড়ে ঢাকা এক একটা মড়া লাশ। ভূত-টুতের অস্তিত্বে কোন দিন আস্থা ছিলনা আমার, তাও কিন্তু নিজের প্রয়োজনে। কারণ অনেক সময় রাত-বিরাতে অন্ধকারে চলা ফেরা করতে হত, ভুতের অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখলে নিজেরই লস। জীবনে যে জিনিসটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলাম সেই জিনিসটাই আমার উপর এভাবে ভর করবে ভাবিনি কখনো। বাইরে তাকাতে সাহসে কুলোচ্ছেনা। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও যেন অশরীরীর সাথে মিশে গিয়ে আমার সাথে উপহাস করছে। জীবনে যত ‘হরর মুভি’ দেখেছি, রাত জেগে যত ‘ভূত এফএম’ শুনেছি, সবগুলোর ভয়ংকর দৃশ্য আর ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত লাগছে একটু আগে ঘুমের জন্য ঠিকমত নামাজ পড়তে পারছিলাম না সেখানে এখন দেখি ঘুম উধাও। শেষ পর্যন্ত বিপদের মুহূর্তে ঘুমটাও আমার সাথে বেঈমানি করল। কম্বলের ভিতরে মুখ গোঁজে রাখলাম। এভাবে কতক্ষণ কাটল জানিনা। ভয় এখনো কাটেনি। ঘড়ির কাঁটা অনেক শ্লথ হয়ে গেছে যেন। ঠাণ্ডার মধ্যেও শরীর ঘেমে একাকার। মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম কোন মিনার থেকে ভেসে আসুক আজানের ধ্বনি। এমনি সময় প্রকট আওয়াজ তোলে রুমের দরজা খুলে গেল।।
---চলবে
বিষয়: বিবিধ
১১৭৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন