প্রবাসের স্মৃতিচারণ-চার

লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১০ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:১৫:০৬ সকাল

পুরো নামাজ জুড়ে চোখের সামনে দুইটা প্রতিচ্ছবি ভাসছিল। একটা আমার সামনের শ্বেত টুপির ঈমানদার ইমামের অন্যটা দু’ঘণ্টা আগের প্রেমিক ইমামের। মনকে শান্ত করার জন্য ধরে নিলাম ঐটা উনার বিবাহিত স্ত্রীই ছিল। উনার স্ত্রীকে উনি যা ইচ্ছে তা করতেই পারেন। কিন্তু পরক্ষণেই মন প্রতিবাদ করে উঠল, উনার লিগ্যাল স্ত্রী হলেও উনি সবার সামনে এরকম অশালীন আচরণ করলেন কেন? এরকম অদ্ভুত সব চিন্তা করতে করতে নামাজ শেষ হল। এ নামাজটা কবুল হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম তাই আবার পড়ে মনকে শান্ত করলাম। ইমাককে দুপুরের ঘটনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেলাম না। একদিকে আমি নতুন, ভাষা জানিনা, অপরদিকে সে লম্বা চওড়া মিলিয়ে আমার মত কমসে কম দেড়টার সমান হবে। সুতরাং বুঝে শুনে কথা বলা দরকার। তাই মনে প্রবল ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও এড়িয়ে গেলাম।

নামাজ শেষ করে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালাম। সকাল থেকে এক প্রকার উপবাসই আছি। পেটে পানি ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কিছু পড়েনি। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই আমার পঞ্চইন্দ্রিয় আপনা থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠল। এটা কি হোস্টেলের রেস্টুরেন্ট না কি কোন ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্টুরেন্ট! দ্বিধায় পড়লাম। এরকম হোস্টেলেতো আগে অনেক থেকেছি, দেখেছি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুদর্শন হল এসএম হলে ছিলাম বছর খানেক। এসএম হলের ডাইনিং সাথে এখানকার ডাইনিংকে মনে মনে মিলিয়ে নিলাম। এসএম হলের ডাইনিং এর টেবিলের উপর ময়লা পানি গড়িয়ে পড়ছে কোন খবর নাই, টেবিলের অনেক জায়গায় আবার ভাঙ্গা। পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। কাজের বেয়াড়াগুলো গায়ের ড্রেসের অনেকাংশে ময়লা স্তুপ হয়ে থাকতে দেখা যায়। থালা-বাসনের কোন কোনটা আবার ভাঙা। ডাল গুলো ডাল নয় যেন থালাবাসন ধোয়া পানি। আমিতো চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে ভাইয়ার কাছে গিয়ে একবার ঐ ডালের উপর হাত ধোয়া পানি ফেলে দিয়েছিলাম। ভাইয়া বলে কি করলি, কেউ দেখলে কি বলবে? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রেস্টুরেন্টেও খেয়েছিলাম ভর্তি পরিক্ষার সময়, সব অপরিচ্ছন্ন। থালা-বাটি গুলোর হাল তবিয়ত দেখলে মনে হয় যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হয়েছিল ওইদিনই কেনা হয়েছিল পরে আর চেইঞ্জ করা হয়নি। এরপরে গিয়েছিলাম দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খ্যাত তামিরুল মিল্লাতের মূল ক্যম্পাসের ডাইনিং এ। ডাইনিং টেবিলের উপর যত্রতত্র কাঁটা, টেবিল ক্লথের উপরের ময়লার আবরণ দেখে মনে হয় এ ক্লথগুলো কখন চেইঞ্জ করা হয়েছিল তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। টেবিলের নিচে পানি জমে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে মশা উৎপাদনের কারখানা হয়ে আছে। এখানে দেখলাম সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রেস্টুরেন্ট বা ডাইনিংটার সবখানে একটা রুচির চাপ। আমি খাওয়ার পরিবর্তে চিন্তা করতে লাগলাম আমার দেশ আর ওদের দেশের মাঝে রুচির কত ফারাক। টেবিল-চেয়ার গুলো সুন্দর করে সাজানো। টেবিল ক্লথটা বেশ রুচিশীল। আরও পরে খেয়াল করলাম এ ক্লথগুলো দিনের শেষে পরিবর্তন করে রাতের জন্য ভিন্ন ক্লথ ব্যবহার করে। যা রাতের জন্য মানাসই।

ছাত্র-ছাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দের খাবার ট্রেতে তুলছে। শৃঙ্খলার সাথে কেউ চুপচাপ কেউ বা পাশের জনের সাথে গল্প করতে করতে সামনে আগাচ্ছে। আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে ফলো করছি সামনের জনকে। যেন কোন ধরণের গলত না হয়। সে যেভাবে যা করছে আমিও ঠিক সেভাবে। বিল পেইড করে একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। খাওয়া সেরে রুমে গেলাম। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম আমাদের দেশের মানুষদের রুচির পরিবর্তন কবে আসবে! পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ সেটা শুধু হাদিসের কেতাবেই শোভা পায় আর হুজুররা পানের পিক যত্রতত্র ফেলতে ফেলতে পরিচ্ছনতার এসব হাদিস ছাত্রদের সামনে বর্ণনা করছেন। সুতরাং ছাত্রদের উপরও এর কোন প্রভাব পড়ছেনা। আমার মনে হয় হুজুররা পরিচ্ছন্নতা যে ঈমানের অংশ সেটা বিশ্বাসই করেননা। না হলে তামিরুল মিল্লাতের মত মাদরাসার ডাইনিং বা বাথরুমের ওরকম হাল থাকতনা। আসলে পরিচ্ছন হওয়ার জন্য হাদিস কোরআন পড়া লাগেনা রুচির একটু পরিবর্তনই দরকার। বাংলাদেশের মানুষদের রুচিতে মনে হয় মরচে ধরে গেছে।আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষক দেশের বাহির থেকে ডিগ্রি নিয়ে গিয়ে নিজের নামের আগে-পিছে বড় বড় টাইটেল যোগ করলেও আদতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন লাভ হয়না। যে লাউ সেই কদুই থেকে যায়।

এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির কথা মনে পড়ল। প্রিয়মুখগুলোর ভেসে আসতে লাগল চোখের সামনে। আম্মু-আব্বু, ভাই-বোন আরও...।। হঠাৎ করে মনে হল আমি যখন ইচ্ছা তখন চাইলেই বাড়িতে যেতে পারবনা। মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বুকে যেন পাথর জমে আছে। বেশ ভারি লাগছে। মোবাইলের সিম নেয়া হয়নি। ফোনও করা হয়নি এখনো। মায়ের মধুর ডাকটি খুব বেশী শুনতে ইচ্ছে করছে এ মুহূর্তে। বুকের পাথরটি অধিকতর ভারি হয়ে উঠল। খুব অসহায় মনে হল নিজেকে। রুমে কেউ নেই। কারো সাথে কথা বলতে না পারলে বুকের এ বোঝা হালকা হবেনা। মানিব্যাগে হাত রাখলাম। গুনে দেখলাম কত আছে। টিকেট করে ব্যাক করব...।।

--- চলবে

বিষয়: বিবিধ

১৩০১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

345334
১১ অক্টোবর ২০১৫ বিকাল ০৪:৩০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিন গুলির দুরাবস্থার পিছনে রুচির অভাব ছাড়া আর কিছু নাই।
১৮ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ০৩:০৪
287255
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : ঠিক বলেছেন ভাই।। রুচির এ পরিবর্তন যে কবে হবে।।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File