প্রবাসের স্মৃতিচারণ - তিন।।

লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ০৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:৫৪:৩১ সন্ধ্যা

হোস্টেলের প্রবেশ মুখে দেখলাম প্রত্যকে ছাত্র-ছাত্রী ‘ফিঙ্গার প্রেস’ করে ভিতরে প্রবেশ করছে। একটা ছোট্ট রুমের ভিতরের দু’জন সিকিউরিটি দুইটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফিঙ্গার প্রেসের ব্যবস্থা থাকায় বহিরাগত কেউ হোস্টেলের চার দেয়ালের ভিতর প্রবেশ করতে পারেননা শুধু রেজিস্টার্ড ছাত্ররাই প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু হোস্টেল সুপারের অনুমতিক্রমে অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্রদের কয়েকদিনের জন্য মুসাফির হিসেবে কবুল করে মুসাফির খানা তথা গেস্ট হাউসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি আস্তে আস্তে গেইটের ভিতরে প্রবেশ করতেই এক মহিলা সিকিউরিটির মুখোমুখি হলাম। গায়ের ইউনিফর্মের উপরে শীতের জামা চড়িয়েছেন। চুল গুলো পিছনে সুন্দর করে আঁচড়ানো। দেখে মনে হচ্ছে চুলের পিছনে বেশ সময় ব্যয় করেন। উনি এক গাল হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। হাসিটা শীতের সকালের মত শুষ্ক। বিব্রতবোধ করলাম একটু। পরে বুঝতে পারলাম উনার হাসিটা ন্যাচারালি ওরকমই, আন্তরিকতায় কোন খাদ নেই। একদম নিখাদ আন্তরিকতা তার। উনার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে বহু আগেই তবু যৌবনের সৌন্দর্যটা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখলাম শরীরময়। উনি কিছু বলার আগেই আমি আমার হাতের প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রের ফাইলটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি দেখে হাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। তারপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা। সামনের বেঞ্চিতে কিছু মেয়ে-ছেলে এক সাথে বসে আয়েশ করে সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছেন। মেয়েকে ধূমপান করতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। একটু পরে দেখলাম একটা কাপল দু’দিক থেকে এসে এতগুলো মানুষের সামনে দুজন-দুজনাকে জড়িয়ে ধরে চুমোর সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। আমি লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিমাল।

সিকিউরিটি মহিলাটি একটু পরপর দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বলে হাসছেন। একটা ব্যাপার মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। উনি নিজের দিকে ইশারা করে টার্কিশ ভাষায় বলেছিলেন ‘’বেনিম আদিম হাওয়া’’ যার অর্থ দাঁড়ায় ‘আমার নাম হাওয়া’। আমার কানে ‘আ...দিম’ শব্দটা ‘আদম’ এর মত লেগেছে। কারণ আমার মনের ডিকশনারিতে তখন ঘুর ঘুর করছিল উনি হয়ত আমাদের আদি মানব আদম আঃ ও হাওয়া আঃ এর কথা বলছেন। হয়ত বলছেন আমরা সবাই আদম-হাওয়ার সন্তান। সে ‘বেনিম আদিম হাওয়া’ বলার পরে আমার দিকে প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে ইশারা করতেই আমি ইংরেজিতে বললাম ‘আপনি ঠিকই বলেছেন আমরা আদম-হাওয়ারই সন্তান, কোন ভেদাভেদ নেই আমাদের মাঝে’। সে আমার নাতিদীর্ঘ বক্তব্যটা শুনে বোকার মত আমার দিকে চেয়ে থাকল, তার ওরকম বোবা চাহনিটার মানে আমার কাছে তখনো অস্পষ্ট ছিল। কয়দিন পরে যথার্থ মিনিংটা যখন জানলাম তখন বুঝতে পারলাম উনার চাহনিটার মানেটা। বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব মানুষগুলোর ইংরেজিতে চালিয়ে যাওয়ার মত অল্প বিস্তর দখল থাকবে সে ধারণা ছিল আমার মধ্যে। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে ওরা আবারও প্রমাণ করল ওরা ন্যশনালিস্ট, ঘোর ন্যশনালিস্ট একটা জাতি তারা। বিমান থেকে আজ পর্যন্ত যাদের সাথে পরিচিত হলাম তারা সবাই নাম জিজ্ঞাসার পরে দ্বিতীয় একটা কথা জিজ্ঞেস করেছেন সেটা হল ‘তোমাদের দেশ সুন্দর নাকি আমাদের দেশ সুন্দর?’ প্রশ্নটা আমার কাছে অবান্তর মনে হয়েছে সবসময়। তাই আজ পর্যন্ত সবসময় জোর গলায় জবাব দিয়েছি আমার দেশই সুন্দর। তোমার কাছে তোমার দেশকে যেমন সুন্দর লাগে ঠিক তেমনিভাবে আমার কাছে আমার দেশ অনন্যা।

মহিলাটার আগডুম- বাগডুম দুর্বোধ্য সব কথার সাথে সাথে সময়ের কাঁটাও আপন গতিতে এগিয়ে চলছিল। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আকাশে গিয়ে সূর্য্যি মামা আপন তেজ হারানো শুরু করেছে। পুরো ইজমির শহরটিকে শীত তার হিমশীতল চাদরে জড়িয়ে ধরা শুরু করেছে। জ্যাকেট চড়ালাম গায়ে। মহিলাটি অফিসে আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে তিন কি পাঁচ দিন মুসাফির হিসেবে থাকার ব্যবস্থাপত্র হোস্টেল প্রভোস্টের স্বাক্ষর সমেত আমার হাতে দিয়ে আমার ব্যাগ টানতে টানতে একটা ৫ তলা বিল্ডিং এর সামনে নিয়ে আসলেন। এ হোস্টেলে এরকম ১০ টি বিল্ডিং আছে। ৫ টি মেয়েদের জন্য আর বাকি ৫ টি ছেলেদের। বিল্ডিং গুলোকে কেন্দ্র করে প্রকাণ্ড একটা দ্বিতল বিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট। যার নিচতলায় ফাস্টফুড ও উপরের তলায় ভারি খাবারের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটা বিল্ডিং সুন্দর বাগান দিয়ে সাজানো। হরেক রকমের গাছ। সব গাছের ডাল-পালাগুলো সুন্দর করে কাটা। নিয়মিত পরিচর্যা চলে সেটাই বুঝা গেল। কিছু গাছে কমলালেবু শোভা পাচ্ছে। দেখে জিবে পানি এসে যাবে যে কারো। যদিও অনেকদিন পরে এ কমলার স্বাদ পেয়েছিলাম। যিনি একবার এর স্বাদ পেয়েছেন তিনি দ্বিতীয়বার স্বাদগ্রহণের দুঃসাহস দেখাবেননা। একপাশে ছোট্ট একতলা বিশিষ্ট মসজিদ। এতগুলো ছাত্রের জন্য এ মসজিদের আকারটা কিছুই না হলেও ভালই লাগছিল ওটা দেখে। মুসাফিরখানায় সব মাল-পত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে মাগরিবের নামাজের জন্য মসজিদে গেলাম মনের দুঃখটা একটু হালকা করতে। আমি মসজিদে প্রবেশ করার আগেই ইকামাতের ধ্বনি শোনা গেল। ইমামের কাতারে যাকে দেখলাম তাঁকে দেখে খুব চেনা চেনা মনে হল। মনকে জোর দিলাম কোথায় দেখেছি তা বুঝার জন্য। এতক্ষণে মনে পড়ল। ঐ যে ঘণ্টা-দুয়েক আগে সবার সামনে প্রেমিকাকে চুম্বন করতে যাকে দেখলাম সেই আমাদের মাগরিবের নামাজের ইমাম। নামাজ ওর পিছনে পড়ব কি পড়ব না ভাবতে ভাবতে ইমাম রুকুতে চলে গেলেন আমিও আল্লাহু আকবার বলে শামিল হলাম...।।

--চলবে

বিষয়: বিবিধ

১০৪২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

345065
০৮ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৪২
শেখের পোলা লিখেছেন : বর্ণনা আমার কাছে নিখুঁত লাগল। তবে ইমাম সাহেবকে নিয়ে বড় বিপাকে পড়লাম৷ অপেক্ষায় রইলাম৷
০৮ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১০:০৯
286321
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আমিও উনার পিছনে পড়ব কি পড়বনা করতে করতে পড়েই ফেললাম।।। Happy ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।~:>
345074
০৮ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:৪১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : তুরুস্কের অধিবাসিদের নিয়ে ব্লগার আবু মাহফুজ ভাই এরও এমন একটি অভিজ্ঞতার কথা পড়েছিলাম তার আগে এক ম্যাগাজিন এর লিখায়্।
০৮ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১০:১১
286322
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আবু মাহফুজ ভাই কি তুরস্কেই থাকেন ভাই ?
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য Happy
০৮ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১১:৩৭
286333
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : না তিনি ইউএস এ থাকেন। ঘটনাটিও তুরুস্কের নয় সম্ভবত মালয়শিয়াতে ঘটেছিল।
345189
০৯ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৮:৪৬
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : ধন্যবাদ সবুজ ভাই

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File