প্রবাসের স্মৃতিচারণ (দুই)

লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:০১:০৯ রাত

ট্রেন আসার সাথে সাথে সবাই ট্রেনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সবার ধৈর্যের বাঁধ যেন ট্রেন আসার সাথে সাথে নিমিষেই তাসের ঘরের মত ধসে গেল। ভিড় ঠেলে কোন রকম গিয়ে উঠলাম। সাথের লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিরব হাসি দিলেন। হাসিটার মধ্যে একটা ভরশার আভাষ ছিল। হাসিটা যেন বলছিল, ‘তুমি টেনশন করোনা আমি তোমার সাথে আছি’। এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাঁধে স্কুল ব্যাগ আর হাতে লাগেজ। সব মিলিয়ে বিশ-পঁচিশ কেজি মত হবে। আমার ঠিক বরাবর সামনের দিকে তাকাতেই বাইশ তেইশ বছরের একজন তরুণী চোখে পড়ল। মোবাইলের ভিতর ডুবে আছে মেয়েটি। মাঝে মাঝে মিটমিট করে হাসছে। মেয়েটির মাথার চুল গুলো ছিল সোনালী। কোন এক উপন্যাসে পড়েছিলাম কোন মেয়ের মাথার চুল সোনালীও হতে পারে। ঐ উপন্যাসের নায়িকার মাথার চুল ছিল সোনালী। ঐটা তখন উপন্যাসিকের অতিরঞ্জন মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন নিজ চোখে দেখে বুঝতে পারলাম না মানুষের মাথার চুল সোনালীও হতে পারে। আরও পরে জানতে পারলাম গ্রীস থেকে এসে তুরস্কে অবস্থানকারীদের ঔরসজাত সন্তানদের চুল সোনালী হয়ে থাকে। বাবা অথবা মায়ের প্রভাবে। তুরস্কের মূল ভূখণ্ডের লোকদের চুল সাধারণত সোনালী হয়না। বাবা-মায়ের যে কোন একজন যদি গ্রীসের হয়ে থাকেন তাহলে চুল সোনালী হয়ে থাকে। একটা শা-শা আওয়াজ তুলে ট্রেন খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল মাটির নিচ দিয়ে। এক ষ্টেশন থেকে আরেক ষ্টেশনে যেতে ২ মিনিটের মত লাগল। ৪-৫ ষ্টেশন যাওয়ার পরে আমার নেমে যাওয়ার সময় হল। সাথের লোকটি একজন বৃদ্ধকে আমার সম্পর্কে কি যেন বললেন। বৃদ্ধের বয়স ষাটের উপর হবে। উনি আমার লাগেজটা যেভাবে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন তাতে বয়স যে ষাট সেটা বুঝাই গেলনা। উনার অতি আন্তরিক আচরণ দেখে মনে মনে একটু খটকা লাগল। তখন সৈয়দ মুজতবা আলীর মত চিন্তা করতে লাগলাম, ‘‘লোকটার এ আচরণের কতটা আন্তরিক, কতটা লৌকিকতা?’’ মুজতবা আলী একবার পাঠান মুল্লুকে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর সাথে পাঠান লোকদের আচরণ দেখে এ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি তাঁর দেশে-বিদেশে নামক ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন, ‘খানিকটা কোলে-পিঠে, খানিকটা টেনে-হিঁচড়ে তিনি (এক পাঠান ভদ্রলোক) আমাকে স্টেশনের বাইরে এনে একটা টাঙ্গায় বসালেন। আমি তখন শুধু ভাবছি ভদ্রলোক আমাকে চেনেন না, জানেন না, আমি বাঙ্গালী তিনি পাঠান, তবে যে এত সম্বর্ধনা করছেন তার মানে কি? এর কতটা আন্তরিক, আর কতটা লৌকিকতা?’’

আমি বৃদ্ধকে অনুসরণ করে সামনে চললাম। ইটের রাস্তা। সুন্দর করে অতি যত্ন করে ইট বসিয়েছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। খুব পরিচ্ছন সবকিছু। সূর্য তখন আপন মনে ঐশ্বর্য বিকিরণ করা শুরু করেছে। গায়ের জ্যাকেটটা এখন অসহ্য লাগছে। খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। একটু সামনে যাওয়ার পর কিছু ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বৃদ্ধ ট্যাক্সির ড্রাইভারের সাথে আমার ব্যাপারে কথা বলে আমার লাগেজটা ট্যাক্সির পিছনের বক্সে তুলে দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন টাকা আছে কিনা। আমি হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিতেই উনি হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। আমি জবাব দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লাম।

ট্যাক্সি ড্রাইভারটা বেশ আমুদে লোক। একটু পর পর গলা ছেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় গান করে আবার মাঝে মাঝে আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করে আমি জবাবে শুধু হেসে দু-চারটা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করি। সে আমার কথা বুঝল বলে মনে হলনা। না বুঝলে আমার কি, আমি নিজেওতো বুঝিনা তার কথা। আমাদের ট্যাক্সি মিনিট বিশেক চলার পরে একটা সাগরের পাড়ে গিয়ে পৌঁছে। সাগরের পাড় ঘেঁষে সুন্দর দু'লেন বিশিষ্ট রাজপথ। পথের মাঝখানে খেজুর গাছের মত গাছ পথের সৌন্দর্যটা আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিছে। খেজুর গাছে কোন খেজুর ছিলনা। ত্রিশ-পয়ত্রিশ ফুট দীর্ঘ আর ২-৩ ফুট মত প্রস্থের গাছটিতে উঠার মত কোন খাঁজ কাটা দেখলাম না আমাদের দেশের মত। মনে মনে ভাবলাম যদি এ গাছগুলো রস দিত তাহলে পুরো ইজমির প্রভিন্সের সব লোক পান করে শেষ করতে পারতনা। পাশের এজিয়ন সাগরের নীল জলরাশি কূলে আঁচড়ে পড়ছে। সাগরের মৃদু হাওয়া গায়ে শিহরণ জাগায়। ট্যাক্সির পুরো কাঁচ খুলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম । তখন ঘড়ির কাটা এগারটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। সকাল থকে পেটে কোন দানা-পানি পড়েনি। এতক্ষণ সেটা বুঝতেই পারিনি। সাগরের মৃদু হাওয়া যেন আমার ক্ষুধার জ্বালাটা বাড়িয়ে দিল। এতক্ষণ ঝামেলার মধ্যে খেয়ালই ছিলনা। ক্ষুধার জ্বালা ভুলতে সাগরের বিশাল জলরাশির দিকে মনযোগ দিলাম। দূরে সুদূরে হারিয়ে গেলাম। কত কিছু মনে পড়ছে। কয়দিন আগে পত্রিকার পাতায় পড়েছিলাম ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরের ভেসে গেল শত প্রাণ। এ নিরব সাগরও এত হিংস্র, ভয়ংকর হতে পারে ভাবতেই শিউরে উঠি। এভাবে কত প্রাণ আর যাবে! আত্মীয় পরিজনের আবদার মিটিয়ে মুখে হাসি ফুটানোর জন্য স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে খেয়ে না খেয়ে সাগরের বুকে নিরবে ঝরে যাচ্ছে কত প্রাণ! মৃতদের কারো সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও ছিলনা তবু তাদের নিয়ে ভাবতেই চোখে ঝাপসা দেখি। যেন মানুষের প্রাণ নেয়ার আয়োজন চারিদিকে। গত শতাব্দীতে হয়ে গেল দুইটি মহাযুদ্ধ। নিয়ে গেল লক্ষ-কোটি তাজা প্রাণ। আবিষ্কৃত হল নিত্য নতুন মারণাস্ত্র। অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে যেন চারদিকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশ্ব পারমানবিক বোমার ভয়াবহতা দেখেছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির কথা কার না অজানা। এর পরে বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দু’ভাগ করে গঠন করা হল ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র! ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেল। মূল ভূখণ্ডের ৪৫% ফিলিস্তিনবাসীর কাছে রেখে বাকি ৫৫% দেয়া হল সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ইয়হুদিদের। তখন থেকে ইসরাইলের ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ব নিরবে প্রত্যক্ষ করেছ। ফিলিস্তিনের মানচিত্র দিন দিন ছোট হচ্ছে। প্রতিনিয়ত প্রাণ দিচ্ছে অসহায় ফিলিস্তিনবাসিরা। এখন ফিলিস্তিন পুরাটাই একটা ভয়ংকর কারাগার। বিশ্ব নিরব দর্শকের ভূমিকায়। এরপরে একবিংশ শতাব্দীটাই শুরু হল ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র দিয়ে। এ শতাব্দীর আবিষ্কার ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন তালেবান। আরও আগে তালেবান প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও দৃশ্যপটে আসে ১/১১/২০১১ এর টুইন টাওয়ার হামলা দিয়ে। বিমান চুরি করে হামলা চালায় তালেবানের চৌকস(!) একটি দল। আমেরিকার মত আধুনিক অস্ত্রশত্রে সজ্জিত এবং শক্তিশালী দেশের বিমান বাহিনীর বিমান চুরি করে সেদেশের সুউচ্চ ভবনে হামলা করে তিন হাজারের মত মানুষ মেরে ফেলার মত দুঃসাহসিক কাজ করায় তালেবানকে বাহবা দেয়ার বদলে এর পিছনে কি ষড়যন্ত্র থাকতে পারে সে কথা চিন্তা করে শিউরে উঠেছিল সেদিন অনেকেই। কিছুদিন পরে আমেরিকান সৈন্য বাহিনী তালেবানের উপর প্রতিশোধ নেয়ার নাম করে আফগানিস্তানে আসে। ন্যাটোভুক্ত দেশসমুহ চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকার সৈন্যদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ঝরে পড়ল লক্ষ নিরহ-নিরপরাধ প্রাণ। ধর্ষিতা হল অগণিত মা-বোন। এতিম হল লক্ষ লক্ষ শিশু। বন্ধ হয়ে গেল আফগানিস্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা। ধ্বসে পড়ল আফগানের ইকোনমি। বাস্তুহারা, স্বজন হারা মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি কেউ, জাতিসংঘ নিরব নিশ্চুপ। এরপরে শুরু হল ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসন। এবার আমেরিকা তাদের বহুদিনের মিত্র সাদ্দাম হোসেনকে শায়েস্তা করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে মনস্থির করল। বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। জানা যায়, ২০০৪ সালে ন্যাটোর একটি মাত্র বিমান হামলায় মারা যায় ২ মিলিয়ন ইরাকের সামরিক-বেসামরিক নাগরিক। আবারও বিশ্ব নিরব নিশ্চুপ। চোখের সামনে ভেসে উঠে অসহায় মুসলমানদের আকুতি। আর ভাবতে পারিনা। একজন নেতার শূন্যতা অনুভব করি। যার কাছে গেলে মন প্রশান্ত হয়ে উঠবে। যার দৃপ্ত আহবানে জেগে উঠবে আবার মুসলিম জাতি, অন্যায়ের নির্মূল সাধন করে শান্তি ফিরিয়ে আনবে সমাজে। কোথায় সে নেতা! হাহাকার করে উঠে হৃদয়। ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। একটা গেইটের সামনে আমাদের ট্যাক্সিটি থামল। গেইটের উপরের নামের সাথে আমার ঠিকানার নামটা মিলিয়ে দেখে বুঝলাম ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছলাম। ড্রাইভারকে তার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে লাগেজ সমেত গেইটের ভিতরে পা রাখলাম।

-- চলবে,,,

বিষয়: বিবিধ

১১২৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

343665
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৬:২৯
শেখের পোলা লিখেছেন : সুন্দর বর্ণনা৷ চলুক৷ ধন্যবাদ৷
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:৩৫
285113
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।। Good Luck
343695
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:০৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:৩৬
285114
মুহামমাদ সামি লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ ভাইয়া কষ্ট করে পড়ার জন্য Good Luck ।।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File