প্রবাসের স্মৃতিচারণ ,,, এক
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:১৬:৪১ রাত
পিছন থেকে অচেনা এক ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখি ইস্তানবুল-ইজমর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে আমার পাশের সিটে বসা লোকটি আমাকে ডাকছেন। কি নামে বা কি বলে ডাকলেন তা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড়াতে বলে 'ইজমির বিমানবন্দর' সংলগ্ন মদের দোকানে ঢুকলেন মদ-টদ কিনবেন বলে, মনের মধ্যে একটা খটকা লাগলো, যে মদ পান করে সে আর যাই হোক ভালো মানুষ হতে পারেনা। কারণ, সদ্য বাংলাদেশ ফেরৎ একজন মানুষ হিসেবে আমার এর চেয়ে ভালো ধারণা হতে পারে না। তবে একটা পার্থক্য খেয়াল করলাম, বাংলাদেশের মদখোরদের চেহারা দেখে মোটেও ভাল মানুষ বলে মনে হয়না, কি রকম একটা হিংস্রতা বিরাজ করে চেহারাময়। চোখ দেখলে ছোট বাচ্চারা দৌড়ে পালাবে ভয়ে। তবে এদেরকে খারাপ মানুষ বলে মনে হয়না, চেহারার সুরতহাল ও বেশ সভ্য, প্রথম দেখাতেই ভালো মানুষ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়না। চেহারার সুসভ্য হাল দেখে ভরসা পেলাম। প্রথমে ভাবলাম লোকটা মদ কিনতে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমি পালিয়ে যাব। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলালাম, কপালে যা আছে 'আয়াতুল কুরসী' পড়ে সর্বাঙ্গে 'ফু' দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অচেনা অপরিচিত জায়গা, কাউকে চিনিনা, ভাষা জানি না তাই এরচেয়ে ভালো কোন অপশন আমার কাছে ছিল না।
এর আগে তুরস্কের বাণিজ্যিক রাজধানী কনস্টান্টিনোপল খ্যাত ইস্তানবুলের আতাতুরক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে 2011 সালের ডিসেম্বর মাসের 10 তারিখ সকাল সাড়ে সাতটার আশেপাশের কোন একটা সময়ে অবতরণ করল আমাদের বহন করা 'তারকিশ এয়ারলাইন্স' এর বিমানটি। বিমানের দরজা খুলতেই শীতের সকালের ঠান্ডা বাতাস তার কোমল হাতের স্পর্শ বিলিয়ে দিল শরীরময়। এ স্পর্শ প্রথমে ভাল লাগলেও একটু পরেই তার তীব্রতায় প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। বুঝলাম এটা কোনক্রমেই প্রেয়সীর হাতের স্পর্শের মত হতে
পারেনা। কোনরকমে হাতমোজা আর আব্বুর কিনে দেয়া জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে একরকম দৌড়েই উঠে গেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ত্রিশ-চল্লিশ মিটার দীর্ঘ বাসটিতে। একটা বিমানের তিন-চারশ যাত্রীকে নিমিষেই গলাধঃকরণ করে এয়ারপোর্টের ভিতরে নিয়ে চলল আমাদের।
ইস্তানবুল আতাতুরক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বিমানবন্দর হওয়ায় এটার সাইজটিও বেশ প্রকাণ্ড। তখন আমার হাত ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারটার আশেপাশে ঘুরছিল। তবে বিমানবন্দরের ঘড়িতে তখন সবে সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। তখন শীতকাল হওয়াতে বাংলাদেশ-তুর্কীর সময়ের পার্থক্য ছিল ৪ ঘণ্টার। সামারে যেটা তিন ঘণ্টায় নেমে আসে। ইস্তনাবুল তুরস্কের বাণিজ্যিক রাজধানী। ওসমানীয়দের সময়ে প্রায় ৫০০ বছর এটি ওসমানী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তারও বহু আগে বাইজান্টাইন তথা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ইস্তানবুল। তখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ শহরটির নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। এখানে রোমানরা খ্রিষ্টীয় ৩৩০ থেকে ১৪৫৩ সালে মুসলিম সেনাপতি ২১ বছরের তরুণ ওসমানী সুলতান, মেহমেদের দ্বারা বিজিত হওয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে এগারশ বছর শাসন করেছিল। ইসলামের ইতিহাসে কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তানবুল গুরুত্ববহ একটি শহর। এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশের বিস্তৃত এবং মাঝখানে প্রবহমান বসফরাস প্রণালীর এ শহরটি মুসলমানদের দ্বারা অবশ্যই বিজিত হবে এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ এর একটি পবিত্র হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি। যে হাদিসটি ইমাম বোখারি রহঃ এর আত-তারিখুল কাবির, ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল এর মুসনাদে আহমদ’এ এবং তাবারি রহঃ এর আল-মুজমাউল কাবিরসহ বিভিন্ন বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে। হাদিসটির বাংলা তরজমা এরকম,
“কনস্টান্টিনোপল অবশ্যই বিজিত হবে( মুসলমানদের দ্বারা), এ বিজয়ের সেনাপতি কতইনা সৌভাগ্যবান সেনাপতি এবং এ বিজয়ের সেনাদল কতইনা সৌভাগ্যবান সেনাদল!’’
রসুলুল্লাহ সাঃ এর ভবিষ্যৎ বাণীর কথা শুনে বিখ্যাত সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারি রাঃ ইস্তানবুলে বিজয় করতে অগ্রসর হয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ বয়সে। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি দুশমান বাহিনী কতৃক শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। পরে উনার মাজার মূল ইস্তানবুলের প্রাণকেন্দ্রে গোল্ডেন হর্নের পাশে স্থানান্তর করা হয়। যে স্থানটা উনার সম্মানে ‘আইয়ুব’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন বহনকারী সুন্দর সুন্দর মসজিদ দ্বারা বিস্তৃত শহর ইস্তানবুল। শীতকালে এখানকার আবহাওয়া অন্যান্য অঞ্চলের মত ঠাণ্ডা নয়। পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য অঞ্চলের মত সবসময় বরফ পড়েনা। পড়লেও পুরো শীতকাল জুড়ে দুই একবার পড়ে। তবে বাতাসটা অনেক বেশীই মনে হয়েছে আমার কাছে। নাকি বাংলাদেশের মত নাতিশীতোষ্ণ দেশ থেকে আসাতে এরকম মনে হয়েছে কে জানে। এরপর সামনে একচেঞ্জ অফিস পেয়ে কিছু ডলার টার্কিশ লিরায় পরিবর্তন করলাম। এসব কাজ করতে করতে আমি খেয়লই করিনি আমার পরবর্তী ফ্লাইট টার্কিশ সময় সকাল ৮ টায়। তখন ৮ টা বাজতে মাত্র ১২ কি ১৩ মিনিট বাকি। না জানি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে কোত্থেকে উঠতে হয়। আগেই বলেছিলাম এ বিমানবন্দরটির সাইজটি প্রকাণ্ড। অনেকটা নাটোরের চলন বিলের মত এ পাশ থেকে ওপাশ দেখা যায়না। এবার আমাকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের অবস্থান খুঁজতে হবে। এটা খুঁজতে গিয়ে একটা ব্যাপার আমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেল সেটা হল তারকিশরা ইংরেজিতে একটু কাঁচা। আরও পরে বুঝতে পারলাম তুরস্কের বেশীরভাগ মানুষই ‘তারকিশ ল্যাংগুয়েজ’ ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানেননা। ওদের অধিকাংশেরই ইংরেজি ভাষার দক্ষতা শুধু ‘হাউ আর ইউ’/'আই এম ফাইন' পর্যন্তই। এবার আমি বুঝে গেলাম ওদের সাথে মুখে কথা বলার চেয়ে ইশারা ইংগিতে কথা বলাই সংগত। তাই এবার যেখানে সিকিউরিটি মতন যাকে দেখি তাঁকে প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে ‘ইজমির’ শব্দটি উচ্চারণ করে হাতে ইশারা করে বুঝাতে চেষ্টা করলাম আমি ওখানে যেতে চাই। এবার কাজ হল বলে মনে হল, সবাই আমাকে দেখাই দিতে লাগল। সামনে-বামে গিয়ে ডানে, আবার ডানে গিয়ে বামে...।! আমি ওদের কথার উপর আস্থা রেখে কিছুটা শংকা নিয়ে হাঁঠা শুরু করি। আস্থা রাখা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিলনা আমার কাছে। তারপরও কনফার্ম হওয়ার জন্য প্রতিটা মোড়ে জিজ্ঞেস করছি একেক জনকে। আমি এক প্রকার দৌড়েই চলছি। উৎকন্ঠা কাজ করছিল আমার মাঝে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবতো? সম্ভবত এটি মানব মনের সাধারণ প্রকৃতি অচেনা-অজানা জায়গায় এরকম উৎকন্ঠা কাজ করা। এদিকে বিমান ছাড়তে মাত্র ৩-৪ মিনিটের মত বাকি। আরও এক মিনিট মত পরে আমি পৌঁছলাম চেক পোষ্ট। এখানকার চেকপোষ্ট গুলো খুব বিব্রতকর মনে হল আমার কাছে। কোমরের বেল্ট পর্যন্ত খুলে ফেলতে হয়। আর এদিকে আমার টাইমও নেই। এক দেড় মিনিটের মত লাগল এখানে। এরপর গেলাম যেখানে টিকিট চেক করে ঐখানে। ঐখানে গিয়ে টিকিট দেখাতেই ওখানকার কর্তব্যরত কর্মকর্তা আমার টিকিট দেখে একরকম ছুড়েই মারলেন টেবিলের উপর। বিরক্তি জড়ানো চেহারা। এরপর ওয়াকি-টকিতে কার সাথে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বললেন। এর এক মুহূর্ত পরেই আমাদেরকে বিমান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার বাসটি এসে থামল। বুঝতে পারলাম ওয়াকি-টকিতে বাসের ড্রাইবারের সাথেই কথা বলেছেন লোকটি। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে এক লাফে উঠে গেলাম বাসে। আমি বাসে উঠতেই আমার কাছে মনে হল সবাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছেন। কেউ কেউ মনে মনে হয়তো বলছে ছোকরা তোর জন্য আমাদের আবার ফিরতে হল। আমি কোনদিকে দৃকপাত না করে আমার গন্তব্যের ঠিকানাযুক্ত কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছি। যেখানে তারকিশ ভাষায় আমার হোস্টেলের ঠিকানাটা লিখা ছিল। এখন যে এ ঠিকানাটাই আমাকে খুঁজে বার করতে হবে। এক মুহূর্ত পরেই বাস থামল, বিমানে উঠলাম। এখন অবশ্যই বাসের এ সিস্টেমটা উঠে গেছে। যাত্রীদের বিমান পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বাসের দারস্ত হতে হয়না। সরাসরি বিমানে উঠা যায়।
বিমানের সিটে বসলাম। তিনজনের সিটে জানালার পাশেই আমার সিট। আব্বুকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম জানালার পাশের সিটটা বুকিং দেয়ার জন্য। আসলে আব্বুটা না হলে কত কিছুই অধরা থেকে যেত, আমার তুরস্কেই আসা সম্ভব হতনা। সবসময় পাশে থেকে সাপোর্ট দিয়েছেন আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন সকলেই। এ দূরদেশ থেকে জানাই তোমাদের প্রতি অনেক ভালবাসা। আমার পাশের অর্থাৎ মাঝখানের সিটে বসা লোকটিকে দেখেই আমার কাছে প্রথম কোন বিদেশীর সাক্ষাৎ পেলাম বলে মনে হল। এতক্ষন যেসব টার্কিশদের দেখলাম তাদের কাউকেই কেমন যেন বিদেশী বলেই মনে হয়নি। দেখতে শুনতে আমাদের মতই শুধু গায়ের রঙটা একটু বেশীই ফর্সা। কিন্তু এই লোকটা বেশ ভিন্ন। বিশাল দীর্ঘকায় শরীর লম্বা চওড়া মিলিয়ে যা সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আর চেহারার আকৃতিটা বেলজিয়ামের মুভি “দ্যা এইটথ ডে’’ এর নায়ক ‘ফাসকাল দকুন্নে’র মত। ২০১০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিএসটি’তে এ মুভিটা দেখেছিলাম। ঐ মুভির নায়ককে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মুভির পরিচালক। তবে আমার পাশে বসা লোকটিকে ওরকম কিছু মনে হচ্ছেনা। বিমান আকাশে উড্ডয়ন করল। খোলা জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলাম আমাদের বিমান মেঘেদের দেশে চলে এসছে। মেঘের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হল আমরা বিশাল কোন সমুদ্র ক্ষুদ্র জাহাজ দিয়ে অতিক্রম করছি। বিশাল মেঘের সাগর দেখতে বেশ ভাল লাগছিল। সৃষ্টিকর্তার অপার মমতায় গড়া এ সৃষ্টি দেখে মহান রবের দরবারে সম্মানে মাথা নুয়ে আসে। সাথে সাথে চোখের কোনা ভিজে আসে তাঁকে চিনার তাওফিক দিয়েছেন বলে। সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে জন্মভূমির কথা। হঠাৎ মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। সব প্রিয়মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে । চোখে ঝাপসা দেখি। ঠিক তখনি অন্য একজনের কথা মনে পড়ে যে আমাকে আগেরদিন রাতে ফোন করেছিল। সালাম বিনিময়, কুশল জিজ্ঞাসার পরে আমি কালকে বিদেশ চলে যাচ্ছি সে কথা বলাতেই ১০-১৫ সেকেন্ড নিরব ছিল। কণ্ঠ মনে হল ভিজা। আচ্ছা সে কি কান্না করছিল! কান্না করল কেন! সে কি আমায় ভালবাসত?
পাশের সিটের সেই বিদেশীকে হোস্টেলের ঠিকানা সমেত কাগজটা দেখালাম। মুখে কোন কথা বলিনি কারণ ততক্ষণে বুঝে গেছি মুখে কথা বলে লাভ নেই। ভদ্রলোক আমার হোস্টেলের ঠিকানাটা দেখে ভ্রু কুচকালেন মুখে কিছু বললেননা। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে বাইরের দিকে নজর দিলাম। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে আবার হারিয়ে গেলাম শৈশবে। আমার নানু সেই ১৯৯৭ সালের দিকে হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। উনি হয়ত আমাদের ফ্যামেলির বিমানে আরোহণ করা প্রথম ব্যক্তি। উনি হজ্ব থেকে ফেরার পরে আমাদেরকে গল্প বলছিলেন, বিমানের গল্প। আমরা খুব ছোট কত আর বয়স হবে। উনি বললেন ঐ যে মেঘ দেখছনা ঐ গুলো ভেদ করে বিমান চলাচল করে। আর মেঘ কাটার ‘কচ-কচ’ শব্দ শুনা যায় বিমানের ভিতর থেকে। আমার শিশুমনে সেটা ভালই ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। যদিও অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম কথাটা নানু দুষ্টামি করে বলেছিলেন। আজকে নানুর সেই কথাটা মনে পড়তেই মনের অজান্তে দু’কানকে সক্রিয় করে মেঘ কাটার শব্দ শুনার চেষ্টা করলাম। কই বিমানের মেশিনের বুমবুম নাকি কিরকম একটা কর্কশ শব্দ ছাড়া কিছুইতো শুনা যায়না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রায় 500 কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলাম বুঝতেই পারিনি। একটু পরেই ইজমির বিমান বন্দরে আমাদের বিমানটি ল্যান্ড করল।
লোকটি মদ নিয়ে ফিরলেন মিনিট পাঁচেক পরে। উনি হাতে ইশারা করলেন সাথে চলতে আমিও সুবোধ বালকের মত উনাকে অনুসরণ করলাম। সবেমাত্র সূর্যের আলো তার কোমল স্পর্শ বিলিয়ে দেয়া শুরু করছে। শীতের দিনে সূর্য্যিমামাকে বেশ আপন মনে হয়। বেশ ভালই লাগছিল হাঁটতে। ইজমিরের ঠাণ্ডাটা ইস্তানবুলের চেয়ে একটু হালকা বলে মনে হল। চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, বেশ পরিপাটি মনে হচ্ছে সবকিছু। সামনে কিছু দূর গিয়ে দেখলাম লোকজন কোথায় যেন ঢুকছে, আবার কেউ কেউ বের হচ্ছে। প্রথম দেখাতেই আমার কাছে এটা একটা ভূগর্ভস্থ ঘরের মত মনে হল। দরজার উপরে টার্কিশ ভাষায় কি যেন একটা লিখা। বুঝিনা কিছু, শুধু একটা শব্দ বুঝতে পারলাম ‘মেট্রো’। বাংলাদেশে প্রত্যেকটা গাড়ির পিছনে যে অঞ্চলে গাড়িটা রেজিস্ট্রেশন করা হয় ঐ অঞ্ছলের বা শহরের নামের সাথে ‘মেট্রো’ শব্দটি যুক্ত থাকে। এটা কি কিছু বুঝতেছিনা এখনো। একটু সামনে গিয়েই প্রবেশ পথের পাশের সিকিউরিটি মতন লোকটার সাথে কিছু আলাপ সারলেন আমার সাথের লোকটি। সিকিউরিটি কাগজে কি যেন একটা লিখে দিলেন। লিখা সমেত কাগজটা আমার হাতে দিলেন। হাতের লিখা তেমন ভাল ছিলনা তাই পড়তে পারিনি। তবে বুঝতে পারলাম আমার গন্তব্যে কিভাবে পৌঁছতে হবে তার একটা ব্রিফ সাজেশন্স দেয়া আছে কাগজে। পাশের লোকটার সাথে আমিও প্রবেশ করলাম ঐ ভূগর্ভস্থ ঘরটিতে। প্রবেশ করার সময় একটা কার্ড প্রেস করলেন প্রবেশ পথের একটা বক্সের উপর। আসলে ঠিক প্রেস না বক্সের ১ ইঞ্চি মত উপর থেকে ধরলেন। বক্সকে কার্ড দেখাতেই সামনের লোহার আবরণটি দেয়ালের ভিতর ঢুকে গেল। আমার কাছে আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেল। ঐখানে ‘চিচিংফাঁক’ বলতেই দরজা খুলে যেত। আমার কাছে ঐ কার্ডটিকেও ‘চিচিংফাঁকে’র একটা সঙ্কেতের মত মনে হল। ভিতরে গিয়ে চলন্ত সিঁড়িতে উঠলাম। সিঁড়িটি আমাদের নিয়ে এক-দু’তলা মত নিচে নেমে গেল। গিয়ে দেখলাম ট্রেনের রাস্তা। বুঝতে বাকি রইলনা এটা একটা পাতাল ট্রেন ষ্টেশন। যাত্রীরা একটা হলুদ লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। হলুদ লাইনের উপর ইংরেজিতে লিখা আছে ‘প্লীজ ডোন্ট ক্রস দ্যা ইয়োলো লাইন।’ আমরাও লাইনের পিছনে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিনিট কয়েক পরে ট্রেনের হেড লাইট চোখে পড়ল।
ছবি-১: হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাঃ এর মাজার।
ছবি-২: 17 শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নির্মিত 'সুলতান আহমেদ মসজিদ'। যেটি ব্লু মস্ক তথা নীল মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত।।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন