গ্যালিপলির যুদ্ধ ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান। (২য় কিস্তি)
লিখেছেন লিখেছেন মুহামমাদ সামি ১৯ মার্চ, ২০১৫, ০২:৫৩:৩২ রাত
গ্যালিপলি যুদ্ধের শত বর্ষে আছি আমরা। প্রতিটা যুদ্ধই আমাদেরকে কাছে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির সাথে আগমন করে। কোন যুদ্ধই শান্তি বয়ে না আনলেও এক একটা পরিবর্তন নিয়েই আসে। রক্তের বন্যা মাড়িয়ে একপক্ষ বিজয়ী হয় অন্যপক্ষ হয় বিজিত। শক্তির লড়াইয়ে মত্ত পুরো বিশ্ব। তেমনিভাবে গ্যালিপলি প্যানিন্সুলায় সংগঠিত যুদ্ধটিও ছিল একটি শক্তির লড়াই এবং এ যুদ্ধের মাধ্যমে ওসমানী খেলাফাতের পতনের পথ উম্মুক্ত হয়। কারণ, এ যুদ্ধেই নতুন এক যুদ্ধার আবির্ভাব হয় যে পরবর্তীতে ওসমানী খেলাফাতের পতন ঘটায়। তার নাম হল কামাল পাশা। আতাতুরক তথা জাতির পিতা নামে যে সমধিক পরিচিত। আতাতুরক খেলাফাতের পতন ঘটানোর মাধ্যমে শুধু ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষতি করেনি, ক্ষতি করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা প্রিয় লোকদেরও। এ ব্যাপারের পরবর্তীতে আলোচনা করছি।
ভারতের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শুধু প্রস্তুতি নয় কার্যত ইংরেজদের সাহায্যে অর্থবল ও ধনবল জুগিয়ে চলেছিল হিন্দু মুসলিমরা। ঠিক ঐ মুহূর্তে ওসমানী খেলাফাত যুদ্ধে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে জার্মানদের মিত্র শক্তি হয়ে। তখন মুসলমানদের অবস্থা কি হয়েছিল এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সত্যেন সেন বলেছেন, ''ওসমানী খেলাফাত যখন যুদ্ধে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিল, ঠিক তখনই ভারতের মুসলমানদের মধ্যে গভীর দ্বিধা ও সংশয় দেখা দিল-- মুসলমান হয়ে তারা তুরস্কের মুসলমান ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে! বিশেষ করে তুরস্কের খলিফা সারা মুসলিম জগতের ধর্মীয় নেতা, এ প্রশ্নটা ভারতের মুসলমানদের মনে দারুণ বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।''
ধূর্ত ইংরেজরা মুসলমানদের মনের অবস্থা সম্পর্কে অচেতন ছিলনা। তাই সাথে সাথেই তারা এর প্রতিকারের চেষ্টায় এগিয়ে এল। ভারতে দায়িত্বরত ব্রিটিশ অফিসাররা মুসলমান আলেমদের কাছে এ প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, ''যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক না কেন, আরব ও মেসোপোটমিয়ায় মুসলমানদের যেসব ধর্মস্থান এবং ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে সেগুলো অক্ষত রাখা হবে। ইংরেজদের মিত্র পক্ষের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোও এ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দান করে ঘোষণা দিল। ডেভিড লয়েড জর্জ তুরস্কের মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এ আশ্বাস পেয়েই ভারতের মুসলমানরা মেসোপোটমিয়া, গ্যালিপলি ও অন্যান্য অঞ্চলে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে গিয়েছিল।
কিন্তু ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা আরবে তুরস্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের ষড়যন্ত্রে ওসমানী খেলাফাতের হেজাজ প্রদেশের গভর্নর শরীফ হোসেন ওসমানী খেলাফাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা দিয়ে ইংরেজদের পক্ষে যোগ দিয়ে তুর্কিদেরকে মেসোপোটমিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়। শরীফ হোসেনকে আরবের বাদশাহ বানানোর প্রতিশ্রুতি এবং ৭ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়া হয়েছিল ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য। মুসলানদের বিরুদ্ধে আরব বাদশাহদের মুনাফিকি তখন থেকেই শুরু হয়ছিল।
অপরদিকে ভারতেও ব্রিটিশ বিরুধিদেরকে ব্যাপক হারে ধর পাকড় শুরু হয়। সরকারী নির্দেশে মুসলমানের তৎকালীন নেতাদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত 'আল-হেলাল' পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এবং মাওলানা কালামকে যতদিন যুদ্ধ চলেছিল ততদিন করাচীতে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল।
শওকত আলীর ভাই মাওলানা মুহাম্মদ আলী তুরস্কের জার্মানির পক্ষে যোগ দেয়াকে সমর্থন করে তাঁর 'কমরেড' পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার দায়ে 'কমরেড' পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তাঁকে ও তাঁর ভাই শওকত আলীকে অন্তরীণ করে রাখা হয়।
১৯১৮ সালে জার্মানি এবং তুরস্কের চূড়ান্ত পতন ঘটে। ফলে বিজয়ী পক্ষের বিধান অনুযায়ী সমগ্র আরব সাম্রাজ্য তুরস্কের হাতছাড়া হয়ে গেল, এমনকি এখানকার ধর্মীয় পবিত্র স্থানগুলোর উপরও তার কোন অধিকার রইল না।
এ বিষয়ে ইংরেজরা চরম বিশ্বাস ঘাতকতার পরিচয় দেয়। তাদের দেয়া কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ডেভিড লয়েড জর্জ ৫ জানুয়ারি ১৯১৮ সালে তার দেয়া এক বক্তব্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, ''তুরস্ককে তার রাজধানি ও এশিয়া মাইনরের অন্যান্য অঞ্চলগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অভিপ্রায় আমাদের নেই, কারণ, ঐ অঞ্চলের লোকেরা তুর্কিদের স্বজাতি।'' কিন্তু ইংরেজদরই ইঙ্গিতে উৎসাহিত হয়ে গ্রীস পরবর্তীতে স্পারটা অধিকার করে নেয় এবং অ্যাজিয়ান সাগরের দীপগুলোকে গ্রাস করার জন্য সমুদ্র-উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে।
এ সমস্ত কারণে এবং বিশেষ করে ওসমানী খেলাফাতের পতনের ফলে ভারতের মুসলমানদের মনে দারুণ উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ সমস্যার প্রতিকারের জন্য ১৯১৯ সালে ভারতের মুসলিম নেতাদের নিয়ে খেলাফাত কমিটি গঠন করা হয়। বোম্বাইয়ের শেঠ সোহানি এ কমিটির সভাপতি ও সদ্য অন্তরীণ-বাস মুক্ত শওকত আলী সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২৩ ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে দিল্লীতে খেলাফাত কমিটির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধীজী, মতিলাল নেহেরু ও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে সভাপতিত্ব করেন মৌলভি ফজলুল হক এবং দ্বিতীয় দিনে গান্ধীজীকে সভাপতির আসনে বসানো হয়েছিল। গান্ধীজী সভাপতির বক্তব্যে মুসলমানদেরকে এ সমস্যার প্রতিকারের জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগের পন্থা অবলম্বন করতে বললেন।
পরবর্তীতে খেলাফাত কমিটি ও কংগ্রেস এ ব্যাপারে একত্রে কাজ করে। ভারতের বড়লাট এবং ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাদের বক্তব্য প্রকাশের জন্য একটি ডেপুটেশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এ দু’দল। তবে সরকারের কাছে পাঠানো ডেপুটেশন নিষ্ফল বলে প্রতিপন্ন হল। তখন খেলাফাত সম্মেলনের পক্ষ থেকে সরকারকে জানিয়ে দেয়া হল যে, তাদের দাবি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এ আন্দোলনকে সার্থক করে তোলার জন্য খেলাফাত কমিটি ও কংগ্রেস একত্রে আন্দোলনে নামার প্রয়োজন অনুভব করল। এবং কংগ্রেসের ১৯২০ সালের ২০ মে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় এ প্রস্তাব পেশ করা হয়। এবং সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়, তবে স্বরাজ লাভের উদ্দেশ্যটাকেও এ প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
১৯২১ সালে করাচীতে খেলাফাত কমিটির সম্মেলনে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম চারটি ছিল তুরস্ক ও মুসলিম জগত সম্পর্কিত। শেষ ও পঞ্চম বিষয়টি ছিল ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের সংকল্প।
১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রতিটা স্থানে খেলাফাত মুভমেন্ট এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়ে মাঠে নামে। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিটিশরা খেলাফাতকে ধ্বংস করার মাধ্যমেই একমাত্র এ আন্দোলনকে দমানো যাবে বলে মনে করে এবং মোস্তফা কামালকে, গ্যালিপলি যুদ্ধের মাধ্যমেই যার উত্থান হয়, খেলাফাত বিলোপের আদেশ দেয়। এবং খেলাফাতের বিলুপ্তির মাধ্যমে ভারতের সর্বস্থরের মানুষের আন্দোলন নিমিষেই বন্ধ হয়ে যায়। এবং ভারতের মানুষের স্বাধীনতার পথও দীর্ঘ হয়ে যায়।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাতির পিতা না ছাই! জাতির হন্তারকরাই জাতির পিতা! হাস্যকর বটে! এমন বৈপরিত্য সত্ত্বেও পিতা! আজব বটে।
এই শরীফরা যুগ যুগ ধরে ছিল এবং থাকবে, তবু ইসলাম তার সমহীমায় অগ্রসর হতেই থাকবে।
আপনার মাধ্যমে আজ অনেক কিছু জানতে
পারলাম। ইতিহাস নির্ভর এমন লিখা ব্লগে আজ খুব দরকার।
আপনি আপনার লিখার উৎস উল্লেখ করলে ভাল হত। ধন্যবাদ।
কলামটির কিছু অংশ নেয়া হয়েছে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সত্যেন সেনের ''ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা'' বই থেকে বাকি অংশ ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার কি শিক্ষকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন