ইসলামী রাষ্ট্র নাকি গণরাষ্ট্র: তারিক রামাদান
লিখেছেন লিখেছেন দার্শনিক ১৯ জুন, ২০১৩, ১০:০৬:৫০ সকাল
অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম
বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান ছিল রাজনৈতিক ইসলামের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যদিও কাজের ধরন ও কৌশলে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের মধ্যে ফারাক ছিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের কৌশল ছিল তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন হওয়া। আর অন্যদের নীতি ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে উপর থেকে নীচের দিকে আসা। এভাবেই ইরানের বিপ্লব সংঘটিত হয়। তবে কৌশল যাই হোক মোটামুটিভাবে তাদের সবার লক্ষ্যই ছিল এক। আর তা হচ্ছে রাষ্ট্র গঠন করা।
এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী বিশ্বাসের মূলনীতির আলোকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণা দাঁড় করানো হয় এবং তা করা হয় সুপ্রাচীন শিয়া ও সুন্নি ঐতিহ্যের আলোকেই। এর সাথে ইসলামী আইন যা সাধারণ অর্থে শরিয়াহ বলে পরিচিত তার সমন্বয় করা হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইসলামী সংগঠনগুলো ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশী ছিল। তারা চেয়েছিল সুস্পষ্টভাবেই এবং এটা কোন দৈব ঘটনা ছিল না।
সেই সময়ে ওসমানি সাম্রাজ্য ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। এদের ওপর পশ্চিমা উপনিবেশি শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। তখন এদের মুক্তির পথ ও উপায় বাতলে দেয়াটা খুব জরুরি ছিল। বিশেষ করে অদূর ভবিষ্যতে উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ পুনর্জাগরণের জন্য এর দরকার ছিল। এই সময়ে মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের একটা রাজনৈতিক পরিচয়ের দরকার অনুভব করে। তারা ওসমানি সাম্রাজ্যকেই তাদের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। যদিও আদর্শিক অর্থে তা ছিল ত্রুটিযুক্ত।
ইসলামকে আত্মপরিচয় হিসেবে গ্রহণ করা যে কোনো আন্দোলনের জন্য এটাই স্বাভাবিক যে তারা তাদের কর্মপন্থাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলে সংগঠিত করবে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। তারা দুইটি লক্ষ্য স্থির করে এগোতে থাকে।
প্রথমত, তারা ১৮৮৫ সালে বার্লিন কংগ্রেস কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া জাতীয় ও রাষ্ট্রিয় কাঠামোর স্বরূপ অনুসন্ধান করে। দ্বিতীয়ত, জাতিগত আন্দোলনের গতিশীলতা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে থাকে। বাস্তবিক অর্থে এটা মূলত জামাল আল দ্বীন আল আফগানির প্যান-ইসলামিজম মতবাদেরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন যা পরবর্তিতে হাসান আল বান্নার সময়ে এসে মুসলিম ব্রাদারহুডের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রূপ গ্রহণ করে।
ইসলামপন্থীদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা তখন পশ্চিমা তরিকা মোকাবেলার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। তারা ইসলামী রাষ্ট্র বলতে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক হিসেবেই বুঝে থাকে এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এই তিন উপায়ে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পণাকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিপরীতে উপনিবেশি শক্তি একে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই বিবেচনা করে। তাদের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার- তারা উপনিবেশি রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরতাকে একীভূত করে ফেলার পক্ষপাতী। তারা এদের ওপর ইহজাগতিকতাবাদ চাপিয়ে দিতে চায়। ইসলাম বিশেষ করে ইসলামের প্রতিরোধী শক্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নতুন লড়াই শুরু করতে চায়।
ইসলামপন্থীদের মতে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশদ ও বহুমাত্রিক হুমকি মোকাবেলায় ইসলামই একমাত্র রক্ষাকবজ। ইসলামী আদর্শে পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমেই উপনিবেশবাদের ত্রিমুখী হামলাকে প্রতিহত করা সম্ভব। দুনিয়ার সব ইসলামী আন্দোলনই এই মত পোষণ করে।
তাদের মতে, একটি রাষ্ট্র তখনই ইসলামী বলে গণ্য হবে যখন তা রাজনৈতিক মুক্তি, ধর্মীয় আত্মপরিচয় ও জাতিগত আরব রাষ্ট্রসমূহের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে নিশ্চিত করবে। ধর্মীয় আত্মপরিচয় বলতে তারা ইহজাগতিকতাবাদের বিরুদ্ধাচরণকেই বুঝে। কারণ তাতে আসলে ইসলাম বিরোধী আচরণই নিহিত। এটা হচ্ছে তাদের আদর্শের প্রতিফলন যা সাধারণত সমসাময়িক ঘটনা পরম্পরার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়।
ইরানি বিপ্লবও এই একই রীতি অনুসরণ করেছিল। ইরানি বিপ্লবকে বলা যায় এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক ইসলামের সর্বশেষ বৈপ্লবিক বহিঃপ্রকাশ। এতে জাতিরাষ্ট্রের শক্ত কাঠামোর মধ্য থেকেই পশ্চিমাপন্থী স্বৈরাচারী শাসনের মোকাবেলা করা হয়েছিল। তবে বিপ্লবের ইরানি অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই বলা চলে। কারণ তা ইসলামপন্থীদের বড় একটা অংশের আদর্শিক আশা-আকাংখা পূরণ করতে পারে নাই। এমনকি শিয়া-সুন্নি উভয় পক্ষের আন্দোলন ও সংগঠনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেও তা ব্যর্থ হয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে ইসলামপন্থীদের বোঝার ধরন ও বিভিন্ন শব্দের ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রক্রিয়া বদলেছে। এমনকি তাদের লক্ষ্যও নতুন রূপ ধারণ করেছে। বিশ্বায়নের মত নিত্য-নতুন উপায়-উপাদান, প্রকৃত ইসলামপন্থী আন্দোলনের অভাব ও নতুন সম্ভাবনাময় শক্তির উদ্ভবই এর পিছনে মূল কারণ।
কিছু কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুসলিম নেতা এখন নির্দ্বিধায় গণতান্ত্রিক মূলনীতি সমর্থন করছেন। শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি ও রশিদ ঘানুসি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের মতে রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে এর সাথে ইসলামের কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু আলজেরিয়ার হামাস পার্টির ইসলামপন্থী নেতা মাহফুদ নাহনাহ-এর বক্তব্য আরেক ধাপ উপরে। এখন পর্যন্ত তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী রাষ্ট্রের বদলে গণরাষ্ট্রের কথা বলেছেন।
বেশিদিন আগের কথা না। বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থী আন্দোলন ইসলামী দল না বলে গণমানুষের আন্দোলন হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিত। তবে তারা ইহজাগতিকীকরণ, ইহজাগতিকতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার মত পরিভাষা এড়িয়ে যেত। এর কারণ হচ্ছে- বৃহত্তর আরব ও মুসলিম মানসে এগুলো নেতিবাচক ধারণা হিসেবেই পরিগণিত হয়। এটা তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগান এর মতামত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মিশর সফরে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। তবে মুসলিম ব্রাদারহুড ও সাধারণ ইসলামপন্থীরা তার এই মতামতকে ভালোভাবে নেয়নি।
মিশরের বামপন্থী বুদ্ধিজীবি মুহাম্মদ ইমারাকে ইসলামপন্থীদের কাছের লোক বলে মনে করা হয়। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি সম্পর্কে তিনি খুবই আশাবাদী মত ব্যক্ত করেন। মিশরের জাগরণ সম্পর্কে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি স্বীকার করেন যে ইসলামী রাষ্ট্রকে আসলে একধরনের গণরাষ্ট্রই বলা চলে। তবে একে অবশ্যই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শের ভিত্তিতে (শুরার মাধ্যমে) পরিচালিত হতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সচল ও সক্রিয় রাখতে হবে। আর এজন্য এই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব গণমানুষের হাতেই থাকতে হবে।
তার মতে, গণরাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাস কিম্বা তার প্রত্যাখান বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ঠিক না বেঠিক তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তার বিরোধগুলোকে মেনে নিতে হবে। এদের পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হবে।
রশিদ ঘানুসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের বেশ কিছু নেতা ইতিমধ্যেই গণতন্ত্রকে পুরোপুরি গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মিশরের আবদুল মুনেম আবুল ফুতুহ তার মধ্যে অন্যতম। মরক্কোর আন্দোলন আল আদল ওয়াল ইহসান-এর কণ্ঠেও একই সুর শোনা যাচ্ছে। তারা ক্ষমতার জন্য কোনো প্রকার আপসের ঘোর বিরোধী। গণতন্ত্রের পক্ষে শায়খ ইয়াসিনের মেয়ে নাদিয়া ইয়াসিনের ব্যাখ্যা হচ্ছে এটা রাজতন্ত্রের বিরোধী। আর একারণেই তারা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
গণরাষ্ট্র গঠনই এখন এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। দলের মুখপাত্র ফাতাল্লাহ আরসালান এমনটাই জানালেন। এক বিবৃতিতে তিনি নিশ্চিত করে জানান, ইসলামপন্থী নেতারা ইহজাগতিকতাবাদ থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। কারণ আরব দুনিয়ায় একে পশ্চিমাকরণের সাঁটে বাধা পদ্ধতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা প্রচারের সময় তারা পশ্চিমাকরণের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেন। এর কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলো মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন।
ইরানের অভিজ্ঞতা একটা ব্যাপক বিস্তৃত ধারণা তৈরি করেছে। আর তা হচ্ছে- ইসলামী রাষ্ট্রও এক ধরনের ধর্মরাষ্ট্র যা ইরানি শিয়াদের ইমামিয়া পরম্পরার মতই পুরোহিততান্ত্রিক। তবে সবাই এটাও উপলব্ধি করছে যে ইসলামপন্থীরা তাদের পরিভাষাগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস ও ধারণাগুলোকে আরো সুস্পষ্ট করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।
ইসলামপন্থীরা যখনই সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাগুলোর আলোকে চিন্তা করে তখন তারা নাদিয়ার মত করেই ভাবে। তারা প্রায় সবাই ইরানি কায়দায় বিপ্লবের পর তুরস্কের তরিকায় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে।
বিষয়: বিবিধ
১৯৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন