শিরকের বেড়াজালে সমাজ-পর্ব ১ (বড় শিরক-১)
লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ান আহমেদ তরফদার ১৪ জুন, ২০১৩, ০৭:৪৮:৫৭ সন্ধ্যা
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য(সুরা ফাতিহা-১) .আল্লাহর রহমতে নতুন একটি লেখা লিখলাম। হে আল্লাহ আমার লেখায় যদি কোন ভুল থাকে তাহলে আপনি তা ক্ষমা করে দিন। বন্ধুগন, আপনারা যদি কেউ কোন ভুল ধরতে পারেন তাহলে তা বিনা সঙ্কচে জানাবেন।
[কৃতজ্ঞতা-
১.শাইখ মুস্তাফিজুর রাহমান মাদানি,
২. যে সকল ভাইয়েরা এই নোটে ব্যবহৃত ছবিগুলো তৈরি করেছেন।]
ভুমিকা-
বর্তমানে আমাদের সমাজে শিরক অত্যন্ত গভীরভাবে বসে গিয়েছে। অনেকেই শুধু মূর্তি পুজা বা মাজার পুজাকেই শিরক মনে করলেও শিরক বলতে প্রকৃত পক্ষে আর অনেক কিছুই বুঝায়। অনেকেই মনে করেন মুসলিম সমাজে শিরক থাকতে পারে না। অথচ আল্লাহ বলেন, “অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি ইমান আনার পরেও মুশরিক” (ইউসুফ-১০৬)
শিরক কি??
সোজা কথায় আল্লাহতাআলার সাথে অন্য কোন বস্তুর অংশীদার স্থাপন করাই শিরক। এই অংশীদার ইবাদাতে, গুনে, ক্ষমতায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে হতে পারে। রাসুল(সা) বলেন,”যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহর সাথে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করেছে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে” (বুখারি-১২৩৮,৪৪৯৭,৬৬৮৩, মুস্লিম-৯২). তিনি আরো বলেন, “আর যে ব্যক্তি এরুপ অবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহর সাথে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করেনি তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহর সাথে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করেছে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে”(মুসলিম-৯৩)
রাসুল(সা) বলেন, “আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে জমিন ভর্তি গুনাহ নিয়ে সাক্ষাত করবে অথচ সে কখনও আমার সাথে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করেনি তাহলে আমি ততটুকু ক্ষমা নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করব”(মুসলিম- ২৬৮৭, আবু দাউদ-৩৫৪০, ইবনু মাজাহ-৩৮৮৯) তিনি বলেন,”তুমি আল্লাহর সাথে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করনা যদি তোমাকে হত্যা করে জালিয়ে দেয়া হয়।”(তাবরানি/ কাবির- ৪৭৯, বায়হাকি- ১৪৫৫৪)
বড় শিরক-
এই শিরক কোন ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি হতে সম্পুরন বের করে দেয়। আল্লাহ তাওবা ছাড়া এই ধরনের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন না। নিচে বিস্তারিত আলচোনা করা হল...
১. আহ্বানের শিরকঃ আহ্বানের শিরক বলতে মানুষের ক্ষমতার বাইরে এমন কোন পারথিব লাভের আশায় অথবা কোন পার্থিব ক্ষতি হতে রক্ষা পাবার উদ্দেশে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আহবান করা বুঝায়।
(আল কুরআন-- জিন—১৮, মুমিন-৬০, রাদ-১৪, আহকাফ-৫, মারিয়াম-৪৮, ইউনুস-১০৬-১০৭, সাবা-২২-২৩, ফাতির-১৩-১৪) (হাদিস—তিরমিজি-২৫১৬, বুখারি-১১৪৫, মুসলিম- ৭৫৮, ইবনু মাজাহ-৩৮৯৫)
২. ফরিয়াদের শিরকঃ ফরিয়াদের শিরক বলতে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাহাজ্জের জন্য ডাকাকে বুঝায়। রোগ নিরাময়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা।
(আল কুরআন-- আনফাল-৯, আনকাবুত-৬৫, বানি ইসরাইল-৫৬,৬৭, নাহল-৫৩-৫৪, জুমার-৮, নামল-৬২,) (হাদিস- মুস্লিম-২৫৭৭)
৩. আশ্রয়ের শিরক- কোন অনিষ্টকর বস্তু বা ব্যক্তি হতে বাঁচার জন্য আলাহ ব্যতিত অন্য কারো কাছে আশ্রয় নেয়া বা সরনাপন্ন হওয়া।
(আল কুরআন— ফুসসিলাত/ হা মিম আসসাজদাহ-৩৬, মুমিনুন-৯৭-৯৮, মুমিন-৫৬, ফালাক-১-৫, নাস-১-৬, জিন-৬, আনআম-১২৮) (হাদিছ- মুসলিম-২৭০৮, তিরমিজি-৩৪০৭)
৪. আশা বা বাসনার শিরক- মানুষের অসাধ্য কোন বস্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কামনা করা। যেমন, কোন পিরের কাছে সন্তান কামনা করা। (আল কুরআন- বাকারাহ-২১৮)
৫. নামাজের শিরক- রুকু, সিজদাহ, সওয়াবের আশায় কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সামনে বিনম্রভাবে দাঁড়ানো বা নামাজের শিরক বলতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতগুলো ব্যয় করাকে বুঝান হয়।
(হাজ্জ-৭৭,ফুসসিলাত/ হা মিম আসসাজদাহ-৩৭, আনআম-১৬২-১৬৩, কাউসার-২) (আবু দাউদ- ২১৪০)
৬. তাওয়াফের শিরক- কাবা শারিফ ব্যতিত অন্য কোন বস্তুর তাওয়াফ করা।
(হাজ্জ-২৯, বাকারাহ- ১২৫) (বুখরি-৭১১৬, মুসলিম-৪২৮৫, ইবনু হিব্বান- ৬৭১৪, আব্দুর রাজ্জাক- ২০৭৯৫)
৭. তাওবার শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে তাওবা করা। (নুর-৩১, আল ইমরান-১৩৫)
৮. জবাইয়ের শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই করা। চাই তা আল্লাহর নামেই করা হোক বা অন্য কারো নামে বা নবি বা জিনের নামে। (আনআম- ১২১, ১৬২-১৬৩, বাকারাহ- ১৭৩) (মুসলিম-১৯৭৮, আহমাদ- ১৫, আবু দাউদ- ৩৩১৩, ইবনু মাজাহ- ২১৬১)
৯.মানতের শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জন্য মানত করা। রাসুল(সা) মানত করতে নিষেধ করেছেন, তিনি বলেন, তোমরা মানত করনা। কারন মানত কারোর ভাগ্যলিপিকে এতটুকুও পরিবরতন করতে পারেনা। বরং মানতের মাধ্যমে কৃপণের পকেট হতে কিছু বের করে নেয়া হয়। (যা সে এমনিতেই আদায় করত না), মুসলিম-১৬৪০। (আল কুরআন- ইনসান-৭, হাজ্জ-২৯, বাকারাহ-২৭০, আনআম-১৩৬) (হাদিছ- আহমাদ-২/২৪২, বায়হাকি- ১০/৭২)
১০. আনুগত্যের শিরক- বিনা ভাবনায় শরিয়তের গ্রহণযোগ্য কোন প্রমান ছাড়াই হালাল হারাম জায়েজ নাজায়েজের ব্যপারে আলেম বুজুর্গ বা উপরস্থ কারো সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া।
(তাওবা-৩১, আনআম- ১২১, আরাফ- ৩,৫৪, নিসা- ৫৯,৬১, সুরা-২১, বাকারাহ- ২৫৬, নুর-৫৪, তা হা- ১২৪-১২৭ এবং আরও অসংখ্য)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্ধভাবে চার মাঝহাবের চার জন মহামতি ইমামের অন্ধ অনুসরণ করাও শিরক। উপরন্তু এই চার জন মহান ব্যক্তি কখনই নিজেকে অন্ধভাবে অনুসরন করতে বলেনি। যদি কোন ব্যক্তি মনে করে বর্তমান যুগে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা অচল এবং গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ধরমনিরপেক্ষ মতবাদ ইত্যাদিই হল আধুনিক পদ্ধতি তাহলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। খ্রিস্টানরা তাদের আলেমদের উপাসনা করত না তবে তারা হালাল হারামের ব্যপারে বিনা প্রমানে তাদের আলেমদের সিদ্ধান্ত মেনে নিত। আর এটিই হচ্ছে শিরক। (তিরমিজি-৩০৯৫)
[বি. দ্র. ইন শা আল্লাহতাআলা democracy, communism, secularism, nationalism, monarchy ইত্যাদি নিয়ে লিখা হবে]
১১. ভালবাসার শিরক- দুনিয়ার কাউকে এমন ভাবে ভালবাসা যাতে তাঁর আদেশ নিশেধ কে আল্লাহ তাআলার আদেশ নিশেধের উপর প্রাধান্য দেয়া অথবা সমপর্যায়ের মনে করা। প্রকৃতিগত ভালবাসা(খাবার), স্নেহ জাতীয় ভালবাসা(সন্তানের জন্য পিতার), আসক্তিগত ভালবাসা(স্বামীর জন্য স্ত্রীর) ইত্যাদির কোনটাকেই আল্লাহ তাআলার ভালবাসার উপর স্থান দেয়া যাবে না,
(বাকারাহ-১৬৫, তাওবা-২৪, ইমরান- ৩১, শু আরা- ২১৫, মায়িদাহ-৫৪)
১২. ভয়ের শিরক- একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ পক্ষে প্রকাশ্যভাবে দুনিয়া বা আখিরাত সংক্রান্ত যে কোন ক্ষতি সংঘটন করতে পারে বলে অন্ধ বিশ্বাস করে তাকে ভয় পাওয়াকে বুঝানো হয়। মানুষ, মূর্তি, জিন ইত্যাদির অনিষ্টটা থেকে ভয় পাওয়া শিরক। প্রভাবশালি শাসকের ভয়ে ভাল কাজ বা জিহাদ হতে দূরে থাকা ছোট শিরক। তবে শত্রুর ভয়, বাঘের ভয় ইত্যাদি স্বাভাবিক ভয় শিরকের অন্তরভুক্ত নয়।
(আনাআম- ৮০-৮১, হুদ-৫৪-৫৫, জুমার-৩৬, তাওবাহ-১৩,১৮, ইমরান- ১৭৩,১৭৫, মায়িদাহ-৩, বাকারাহ- ৪০, আহজাব-৩৯, রাহমান-৪৬, ইব্রাহিম- ১৪, দাহর- ৭, মুমিনুন-৫৭,৬১) ( তিরমিজি-৩১৭৫, ইবনু মাজাহ- ৪০৭৯,৪০৮৯)
১৩. ভরসার শিরক- মানুষের অসাধ্য ব্যপারসমুহের ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি ভরসা করা। কারো সমস্যা দূরীকরণ, চাকরি লাভ, রোগমুক্তি ইত্যাদি ব্যপারে আল্লাহর উপরেই ভরসা রাখতে হবে। দান, সাদাকার ব্যপারে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তির উপর ভরসা ছোট শিরক। তবে কোন প্রতিস্তানের মালিক তাঁর কর্মচারীদের উপর মালামাল উৎপাদন বা কোন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভরসা করতে পারে। তবে সম্পূর্ণরূপে ভরসা করা শরিয়াতে জায়েজ নয়।
(মায়িদাহ-২৩, ইউনুস-৮৪, হুদ-১২৩, আনফাল-২,৬০, নিসা-৭১) (মুসলিম-২৬৬৪)
১৪. সুপারিশের শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে পরকালের মুক্তির জন্য সুপারিশ কামনা করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
(জুমার-৪৪, সাজদাহ-৪, আনাআম- ৫১, বাকারাহ-২৫৫, হুদ- ১০৫, নাবা- ৩৮) (বুখারি- ৪৪৭৬, ৬৫৬৫, ৭৪১০, ৭৪৪০)
১৫.হিদায়াতের শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কাউকে হিদায়াত করতে পারে এমন বিশ্বাস করা অথবা কারো নিকট হিদায়াত কামনা করা।
(বাকারাহ-২৭২, ইউসুফ-১০৩, কাসাস-৫৬) (মুসলিম- ২৪, ২৫৭৭, বুখারি- ১৩৬০, ৩৮৮৪, ৪৬৭৫)
১৬.সাহায্য প্রার্থনার শিরক- মানুষের সাধের বাইরে কোন কাজ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট কামনা করা। (ফাতিহা-৫) ( তিরমিজি- ২৫১৬)
১৭. কবরের শিরক- কবরে শায়িত কারো জন্য ইবাদাত ব্যয় করা। অর্থাৎ সেখানে সালাত আদায় করা, সিজদাহ করা শিরক(মুসলিম-৯৭২, ইবনু হিব্বান- ৩৪৫, বাযযার-৪৪১,৪৪২). তাঁর নিকট কিছু চাওয়া। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে কিছু চাওয়া। সেখানে মসজিদ নির্মাণসহ আরও অসংখ্য শিরক বিদ্যমান।
(মায়িদাহ-৭৭, নুহ-২৩, ) (বুখারি- ৪২৭,৪৩৪, ৪৩৫, ৪৩৬, ১১৯৭, ১৯৯৫, ১৩৪১, ৩৮৭৩, ৪৯২০, ৩৪৪৫, ইবনু মাজাহ-৩০৮৫, মুসলিম- ৫২৮, ৫৩১, ৫৩২, ৮২৭, ২৬৭০, আবু দাউদ- ১০৪৭, ৪৬০৮, ইবনু খুজাইমা- ৭৮৯,৭৯০, তাব্রানি- ১০৪১৩) এছাড়া আরও অসংখ্য হাদিস বিদ্যমান। ইন শা আল্লাহতাআলা কবর পুজা নিয়ে আলাদা একটি নোট লিখব।
১৮. মাসজিদ ছাড়া অন্য কোন জায়গায় অবস্থান করা/ খাদেম হওয়া- মাজারে খাদেম হওয়া শিরক। (বাকারাহ- ১২৫) (মুসলিম- ৯৭১)
১৯. আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কিত শিরক- আল্লাহ মুমিনের অন্তরে বিরাজমান মনে করা। আল্লাহ সবার অন্তরে বিররাজমান মনে করা। আল্লাহ সকল বস্তুর মাঝে লুকায়িত মনে করা। আল্লাহ সম্পর্কে সহিহ আকিদা হল, তিনি আরশের উপর অবস্থান করছেন। তাঁর আকার আছে কিন্তু তিনি তাঁর মত।
(মূলক- ১৬-১৭, ফাতির- ১০, ইমরান- ৫৫, আরাফ- ৫৪, ইউনুস-৩, রাদ- ২, ফুরকান- ৫৯, সাজদাহ-৪, হাদিদ- ৪) (বুখারি- ১১৪৫ ১৬৩৬, ৭৪২০, মুসলিম- ৫৩৭, ৭৫৮, আবু দাউদ- ১৩১৫)
২০. দেখা ও শোনার শিরক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মানুষ হোক নবি বা রাসুল সব শুনতে বা দেখতে পান এমন মনে করা শিরক। (ইউনুস- ৬১, সাবা- ৩, আ’লা-৭, তাহা-৪৬) (বুখারি- ২৯৯২, ৪২০২, মুসলিম- ২৭০৪)
বি. দ্র. এই লেখাটি সবার জন্য উন্মুক্ত, যে যেভাবে পারুন, কপি-পেস্ট/ শেয়ারের মাধ্যমে সবাইকে সত্য জানিয়ে দিন। আল্লাহর রহমতে একই বিষয়ে আরও ৩ টি নোট আসছে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন