ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব-৪)

লিখেছেন লিখেছেন আবদুস সবুর ০৬ জুন, ২০১৪, ১০:০৫:১৭ রাত

ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব- ১)

ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব- ২)

ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব- ৩)

স্বদেশ পরিস্থিতি

এদেশের কিছু লোক আগেও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, এখনো আছে। কিন্তু তারা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। বিশাল ধর্মপ্রাণ মানুষের তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই কম। অথচ এ সংখ্যালঘুদের মতবাদই এখন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো দেশের উপর। সময় কম। আমি সেক্যুলারিজমের প্রভাবে ঘটে যাওয়া শুধু দু’একটি নযীর পেশ করব।

আমাদের শিক্ষা কমিশন

প্রথমে বলে রাখি, একটা শিক্ষা কমিশন গঠন থেকে শুরু হয়ে কমিশনের রিপোর্ট হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। কমিশনের সদস্য ও সহযোগীরা পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেন। তারা ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষানীতি স্বচক্ষে দেখে সে অনুযায়ী এদেশের শিক্ষানীতি তৈরি করেন। এভাবেই কাজ করেছে এ দেশের সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন।

প্রত্যেক শিক্ষানীতিরই কতগুলো উপাদান থাকে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের শিক্ষানীতির মূল আদর্শ বানানো হয়েছে সেক্যুলারিজমকে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে মাথায় নিয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে তা উল্লেখও করা হয়েছে। অবশ্য ওটা যদি শব্দে ব্যবহার না করত তবুও তা স্পষ্ট ছিল।

আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তিন জায়গাতেই পাকাপোক্ত কড়া বাম ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব ভদ্র লোক। তিনি সমাজতান্ত্রিক দলের বড় নেতা ছিলেন। বেশি বছর হয়নি আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, যৌবনের পুরো অংশই পার হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে।

শিক্ষা কমিশনের প্রধান ছিলেন কবীর চৌধুরী সাহেব। পরলোকগত হয়ে গেছেন। এ লোক আযানকে কিসের সাথে তুলনা করেছিলেন আপনারা হয়তো জানেন। এসব কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান রাশেদ খান মেনন সাহেব। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা কারো অজানা নয়। যে দেশের শিক্ষা খাতের তিনটি স্তম্ভে এমন ব্যক্তিরা থাকবেন সে দেশে কেমন শিক্ষানীতি ও শিক্ষা চলবে তা সহজেই অনুমেয়। আগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মুসলমান শিক্ষার্থীদের অনেকে এ বলে অনুযোগ করত, দুঃখ করত যে, তাদের কোনো কোনো স্যার প্রকাশ্যেই ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে বিদ্রূপ, কটাক্ষ করেন। তা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বুঝমান শিক্ষার্থীদের সমস্যা। কিন্তু এখন আর ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ শোনার জন্য আপনাকে কলেজ-ইউনিভার্সিটি যেতে হবে না। বর্তমান শিক্ষানীতি শিশু শ্রেণী থেকেই মুসলিম ছেলেমেয়ের সেক্যুলার আদর্শে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়েছে। সেভাবেই তৈরি হয়েছে বইপত্র। গত বছর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষা কারিকুলাম ঠিক করতে গিয়ে জেনারেল বিষয়গুলো সরকারি বোর্ডের বই থেকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যালয়ের শিক্ষা-বিভাগের নেগরান সাহেব দেখতে পান বর্তমান সময়ের প্রাথমিক বই ও পূর্বেকার বইগুলোর পার্থক্য। কোমলমতি শিশুদের অঙ্কুর থেকেই শিরকী ভাবধারায় গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট উপাদান এই বইগুলোতে রয়েছে।

প্রসঙ্গ বোরকা

কয়েক মাস আগের কথা। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী হয়ে সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপিত হয়েছেমাত্র। কিছু দিনের মধ্যে উচ্চ আদালত ‘সুয়োমটো’ (কারো আপিলের অপেক্ষা না করে স্বপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন। বিচারক সাহেব বললেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী উচ্চআদালত যা বলবেন তা-ই আইন। ভালো যে, পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্রের মতো এখানে বোরকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে বিজ্ঞ বিচারক যে যুক্তি দিয়েছেন তা লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র হল ধর্মনিরপেক্ষ তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝতে কারো অসুবিধা হলে এ ধরনের দু চারটা নজির মনে রাখলেই হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষতিটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, এই শব্দটাকে গলদভাবে ব্যবহার করে আরো কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তা দেখার জন্য হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি শুধু চোখ-কান খোলা রাখুন, কয়েক দশকের ইতিহাস দেখুন, স্বদেশী লোকজনের হাতে নিরীহ ধর্মপ্রাণ লোকদের হতাহতের চিত্র দেখুন এবং সেক্যুলার গণতন্ত্রবাদী, মানবতাবাদী, স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করুন। তারা কোন খবরটা কীভাবে ছাপছে, কোন বিষয়টা কীভাবে বিশ্লেষণ করছে তা খেয়াল করুন। এভাবেই একটি দেশের প্রতিরক্ষা, আইন-আদালত, শিক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো পাকাপোক্ত সেক্যুলার হয়ে উঠে এবং পরের কাজগুলো স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকে। তখন মুরসী, এরদোগান, আবদুল্লাহ গুলদের দেশের অধিকাংশ লোক ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও তারা হয়তো ক্ষমতায় বসতেই পারেন না, না হয় ক্ষমতাচ্যুত হন। স্বদেশের ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের ব্যাপারে মন্তব্য করার দরকার আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আপনি এর পরের অবস্থার প্রতি নজর দিন। দেখুন নির্বাচিত (!) ব্যক্তিগণ বেশি খুশি নাকি তাদের সমর্থক শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা বেশি আনন্দিত। কারণ এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার-গণতন্ত্র সবই নস্যি। নিজেদের মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করার মোক্ষম সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চান না।

তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আমাদের এখানে কেউ লিখেছেন কি না জানি না, তবে আরব বিশ্বের কোনো কোনো ডক্টর-প্রফেসর ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে বইপত্রও লিখে ফেলেছেন। তারা নিজেদেরকে আলেমও মনে করে থাকেন এবং নিজেদের বক্তব্যের সপক্ষে কুরআন-হাদীসের দলিল দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন যে, ইসলাম নামায, রোযা, ইবাদত-বন্দেগী কীভাবে আদায় করবে তা শিক্ষা দেয়, কিন্তু রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে তা ইসলাম বলেনি। সুতরাং ইসলামে রাজনীতি নেই। (এ কথাটাই আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এভাবে বলে যে, ধর্ম পবিত্র জিনিস। রাজনীতি থেকে এটাকে আলাদা রাখতে হবে।) যা হোক, ঐ আরব সেক্যুলার আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে ইসলাম ইবাদত বন্দেগীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার প্রক্রিয়া, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনার কথা ইসলামে নেই।

(চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১১৭৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

231517
০৬ জুন ২০১৪ রাত ১০:১৮
চোরাবালি লিখেছেন : ভাল লাগল
231615
০৭ জুন ২০১৪ রাত ০২:১৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File