ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব- ১)

লিখেছেন লিখেছেন আবদুস সবুর ০৪ জুন, ২০১৪, ০২:৩০:৪৩ দুপুর

আজকের আলোচ্য বিষয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ইনশাআল্লাহ আজ আমরা কথা বলব ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়, এর গোড়ার কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আমাদের দেশে এর প্রাসঙ্গিকতাসহ সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ে। শুধু সচেতন আলেমে দ্বীন হিসেবেই নয়, স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও এ বিষয়টি আমাদের বোঝা উচিত। কারণ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্রের মৌলিক চার নীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে এ নীতিটি বাদ দিয়ে তার স্থলে আনা হয়েছে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু তিন দশক পর আবারো বর্তমান সরকার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে এবং ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ‘‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’-এর নীতিটি।

সংবিধান জনগণকে প্রজাতন্ত্র তথা দেশের মালিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সে হিসেবে রাষ্ট্রের মালিক তথা নাগরিকদের জন্য দেশের সংবিধান জানার ও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের নামে জনপ্রতিনিধি তথা সংসদসদস্যগণ কী কী বিষয় সংবিধানে যোগ-বিয়োগ করছেন তার প্রতি নজর রাখা সচেতন নাগরিকদের কর্তব্যও বটে। আমরা মূল আলোচনায় চলে যাই।

ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা/পরিচয়

প্রথমেই বলা দরকার যে, কিছু জিনিস আছে যেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া লাগে না। এমনিই বুঝে আসে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিও এমন। কম পড়ুয়া লোকজনও এর অর্থ বুঝে নিতে পারবে। ইংরেজি Secularism শব্দের বাংলারূপ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, আরবীতে যাকে বলা হয় ‘আলআলমানিয়্যাহ’।

প্রথমেই দেখুন বাংলা একাডেমীর ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারী। ২০১২ সালের এ সংস্করণ ছেপেছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সম্পাদনায়। Secular-(অর্থ) পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জড়, জাগতিক।

Secular State ‘গীর্জার সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র’। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র।

Secularism নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়-এই মতবাদ। জাগতিকতা, ইহবাদ।

এ অর্থগুলো লিখেছে বাংলা একাডেমীর অভিধান। এটির সম্পাদনায় কোনো ডানপন্থী বা কোনো ‘হুজুর’ জড়িত ছিলেন না। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব ছিলেন এর সম্পাদক।

এটা এমন নয় যে, কোনো মতবাদ ওয়ালারা নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ ব্যাখ্যা লিখেছে; বরং দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত এবং বর্তমান সরকার নিয়ন্ত্রিত সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী, যারা সংবিধানে আবার সেকুলারিজমকে স্থান দিয়েছে তাদের কর্তৃক নিয়োজিত, নির্ভরযোগ্য, যোগ্য ব্যক্তিরাই সেকুলারিজমের এই অর্থ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আমার দেখে ভালো লেগেছে যে, ওনারাও ভালো মানুষ। রাখঢাক না করে সাফ সাফ কথাটাই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়’-এমন কথা লেখেননি। আমি বাইরের অভিধানেও খোঁজ করেছি। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা দেখেছি, উইকিপিডিয়া দেখেছি। একই ব্যাখ্যা পেয়েছি। অক্সফোর্ড ইংরেজী-উর্দু ডিকশনারী। সেখানে লেখা আছে, Secularism لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা)।

এগুলো মুসলমানদের ব্যাখ্যা নয়। সেকুলারিজম যে বাস্তবেই لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা) এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় না। বাংলা একাডেমীরটা তো দেখলেনই। উইকিপিডিয়াতে সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে Anti Islam দিয়ে।

তাই বলছিলাম অনেক কিছুই আছে যেগুলো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার হয় না। শব্দ দেখেই মতলব স্পষ্ট হয়ে উঠে।

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা

আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানের মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। জনগণ তখন জেনেছে এই রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য স্বাধীন হয়েছে। বিজয়ের এক বছর পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে সংবিধান প্রণয়ন সমাপ্ত হয়েছে। বস্ত্তত তখনই দেশের সাধারণ জনগণ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা জেনেছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক, অল্প ধার্মিক হোক বা বেশি ধার্মিক যুদ্ধের সময় তারা জানেনি যে, তারা সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করছেন। এটা জেনেছেন তারা ১৯৭২ এর শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আরো এক বছর পরে। কারণ সংবিধানে এই কথা লিখে দেওয়া হয়েছে যে, যে সব কারণে আমাদের দেশের আবাল, বৃদ্ধ, নওজোয়ানরা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা সংবিধানে লেখা আছে।

এর আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক দলিলে সেটা নেই। আপনি আমাদের দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইগুলো, পৌরনীতির বইগুলো পড়লে এর যথার্থতা খুঁজে পাবেন। এছাড়া স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ বহু আন্দোলন করেছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন হয়েছে। ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ হয়েছে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছে। এগুলোর কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার নাম-গন্ধও ছিল না। এমনকি আপনি বর্তমান সময়ের (যখন দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়) মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখুন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পাবেন না। সুতরাং অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আস্থার সাথে বলা যায় যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখিত নিম্নলিখিত বাক্যটি বাস্তবসম্মত নয়।

‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল ... ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’’

সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাকারী মতান্তরে ঘোষণা পাঠকারী জেডফোর্সের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রথম সুযোগেই এটিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এবং পরবর্তীতে অনেক সেক্টর কমান্ডারকেই জনগণ ধার্মিকরূপে পেয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম (পর্ব- 2)

বিষয়: বিবিধ

১৩০৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

230511
০৪ জুন ২০১৪ দুপুর ০৩:০২
নেহায়েৎ লিখেছেন : আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিলে, একজন মানুষ তারপরও কি করে নিজেকে মুসলিম পরিচয় দেয় আবার সালাত আদায় করে?!? এটা কোন ধরণের রসিকতা?!?
০৪ জুন ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৮
177279
আবদুস সবুর লিখেছেন : রসিকতার দেশে করিতেছি বসবাস Crying Waiting
230526
০৪ জুন ২০১৪ দুপুর ০৩:৩০
আমি মুসাফির লিখেছেন : ঈমান মানেই হলো আল্লাহর উপর পুর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা যার ঈমানই থাকেনা তাদের আবার কিসের ধর্ম ।
230580
০৪ জুন ২০১৪ বিকাল ০৫:৩৪
মোহাম্মদ রিগান লিখেছেন : আপনার কথা শুনে ভাল লাগলো সুন্দর এত সুন্দর লেখা লিখেন কিভাবে?????
০৪ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১০
177308
নোমান২৯ লিখেছেন :




রিগান(ভাইয়া)-পোলা(দুষ্টুমি)এক্কেবারে নাওয়কের লাহান!Happy Happy Happy
০৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৪০
177463
আবদুস সবুর লিখেছেন : আপনাদের দোয়ায় !!!
230603
০৪ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১০
নোমান২৯ লিখেছেন :






ধন্যবাদ ভাইয়া । আমার প্রস্তাব বুঝি গৃহিত হইলো ?
লেখাটা কিন্তু সত্যি চমৎকার হয়ছে ।
০৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৪০
177464
আবদুস সবুর লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ
230612
০৪ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২১
এম_আহমদ লিখেছেন :
‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল … ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’’
এটা হচ্ছে নাস্তিকদের কৌশল এবং ছোপা-ধর্মীদের মূর্খতার উপর তাদের কৃতিত্ব। আপনি ঠিক বলেছেন যে ‘স্বাধীনতা-যুদ্ধের’ পূর্বে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কোনো আন্দোলন ছিল না –এটা চোরা পথে এসেছে এবং নাস্তিকদের সংখ্যা কম হলেও তাদের পিছনের শক্তি অনেক বেশি। তাদের আরেকটি শক্তি হচ্ছে এই ছোপাধর্মীরা তাদের buffer zone হিসেবে কাজ করে থাকে। ওরা তাদের ধারণাকে গুছিয়ে আনে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে জড়িত করে “কারণ” ব্যাখ্যা করে এবং যারা এসবের এইসব ফাইজলামীর বিরোধিতা করে তাদের উপর চড়াও হয়। আবার ছোপাধর্মীদের একদল জিহ্বা বন্ধ করে ওদেরকে নীরব সমর্থন দেয়। আর এভাবে একটি দুটি নয় অসংখ্য অনৈসলামি ধ্যান-ধারনা, প্রথা ও অপকর্ম বিস্তৃত হয়ে আছে।
একটি অপূর্ব লেখা দিয়েছেন। খুব দ্রুত পড়েছি রাতের বেলায় অপর অপর অংশ পড়ব।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File