ইসলামে ‘সাহাবী’ ধারণার পূনর্গঠন (পর্যালোচনা পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ২৯ অক্টোবর, ২০১৬, ০৯:৫১:৪৩ রাত
‘মুহাজির ও আনসারদের যারা অগ্রগামী প্রথম দল এবং যারা তাদের নিষ্ঠাবান অনুসারী- আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও সন্তুষ্ট আল্লাহর প্রতি। আল্লাহ তাদের জন্য এমন জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন যার নিম্নদেশে প্রবাহিত-ঝরণাধারা আর তাঁরা সেখানে থাকবে চিরকাল৷ এটাই মহা সাফল্য(০৯:১০০)।
০২.
সাইয়েদ আবুল আ’লার প্রতি দেওবন্দীদের যে হীনমন্য-পরশ্রীকাতরতা, এবং তার বিপরীতে আবুল আ’লার সমর্থক গোষ্ঠীর লুকোচুরি(একদিকে সাহাবী-সমালোচক ‘অভিধা’ প্রাপ্তির ভয়, অন্যদিকে উম্মাহর ইতিহাস বোঝার ভার) বাদ দিয়ে, আসুন, আমরা সরাসরি কুরআন হাদীস থেকে সাহাবী প্রত্যয়টিকে বোঝার চেষ্টা করি। সাহাবী আজমাঈনদের নামের শেষে ‘রাদিয়াল্লাহু আনহু’ বলার প্রেরণা আমরা যে আয়াত থেকে পাই, সেখান থেকে শুরু করা যাক। শুরুতেই আমরা আয়াতটি তাই সেঁটে দিলাম-
উপরোক্ত আয়াতে আমরা সাহাবীদের দুটো ক্লিয়ার ক্যাটাগরি পাই-
এক. প্রথম অগ্রগামী দল (সাবিকুনাল আউয়্যালুনা-the foremost and the first to lead the way);
দুই. তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারি (who follow them in the way of righteousness).
লক্ষ্য করুন, প্রথম আগ্রবর্তী দল হলো স্ট্যান্ডার্ড। এবং কনস্ট্যান্ট মর্যাদার অধিকারী, আর পরবর্তীদের মর্যাদা ভ্যারিয়েবল। সেটা নির্ভর করেছে তাঁদেরকে অর্থাৎ, প্রথম অগ্রবর্তীদেরকে অনুসরণের নিষ্ঠার ওপর।
‘সাহাবী’ বোঝার জন্য এ আয়াতটি বলা যায় টপমোস্ট ফান্ডামেন্টাল। এটা ঠিকঠাক বুঝলে অন্য কথাগুলো আমাদের জন্য ইজি হয়ে যাবে।
০৩.
এখন প্রশ্ন হলো- মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ‘সাবিকুনাল আউয়্যালুনা’ কারা?...
এ নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
এক. যারা কিবলা পরিবর্তনের আগে হিজরত করেছেন এবং যারা একই সময় মদীনায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং সাপোর্ট দিয়েছেন;
দুই. যারা বদর যুদ্ধের আগে (ঐ)…
তিন. যারা বদরে অংশগ্রহণ করেছেন,
চার. যারা হুদাইবিয়ার সন্ধির আগে (ঐ)…
পাঁচ. যারা বাইয়াতে রিদওয়ানে উপস্থিত ছিলেন।
০৪.
প্রথম দুই ক্ষেত্রে অর্থাৎ, কিবলা পরিবর্তন(১৫শাবান) এবং বদর যুদ্ধের(১২/১৭রমজান, ২য় হি.) মধ্যকার সময়ের পার্থক্য এক মাস কিংবা তারও কম। সুতরাং, এ দু’টোকে একীভূত করা যায়।
অন্যদিকে, তিন নম্বরের ব্যাপারে কথা হলো- যুদ্ধে অংশগ্রহণের আলাদা ডিস্টিংশন বা মর্যাদা অবশ্যই আছে; কিন্তু লক্ষ করুন, কুরআন এখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণকে নির্দেশ করেছে না, বরং একটা সময় কাল(আউয়্যালুনা) এবং তাদের প্রাণবন্ত উদ্যোগ তথা সানন্দ অগ্রগামীতা(সাবিকুনা)’র কথাই বলছে।
বদরের অংশগ্রহণকারীরা তাতে আছেন, অবশ্যই আছেন, সন্দেহ নেই। কথা হলো- এবং আছেন এর বাইরের কেউকেউও। যেমন, হযরত উসমান রা., যিনি স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে রাসূলুল্লাহর অনুমতিক্রমেই বদরে অনুপস্থিত ছিলেন, তারপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম, আবু লুবাবা ইবনু আবদিল মুনযির’কে রাসূলুল্লাহ মদীনায় রেখেছিলেন; ইত্যাদি।
চার এবং পাঁচের ব্যাপারে কথা হলো- হুদাইবিয়ার সন্ধির আগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং যারা বাইয়াতে রিদওয়ানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রসঙ্গে আলাদা আলাদা আয়াত নাযিল হয়েছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তাঁরা স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী হলেও, এ ক্যাটাগরিতে তাঁদের না পড়াই স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ- প্রথমত, মদীনায় হিজরতের পর ততদিনে ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, যা রাসূলুল্লাহর মাদানী জীবনের অর্ধাংশেরও বেশী। সুতরাং, কালের বিচারে উনারা ‘আউয়াল ক্যাটাগরি’তে না পড়ারই কথা।
দ্বিতীয়ত, বদরে বিজয়ের ফলে অনেকে স্বভাবতই ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হন, ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার ওহুদের প্রাক-কালে বিজয়ের স্বাভাবিক সম্ভাবনা না দেখে তিনশো জনের বড় বাহিনী যেভাবে ছিটকে যান, সেক্ষেত্রে বদর-পরবর্তীদেরকে ‘এজ এ হোল’ সাবিকুন বা অগ্রগামী বলাটা কঠিনই বটে!
এই সমস্ত বিবেচনায় এটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয় যে, বদরযুদ্ধের পূর্বে যারা হিজরত করেছেন এবং আনসারদের মধ্যে যারা সে সময় ঈমান গ্রহণ করেছেন, সাপোর্ট দিয়েছেন তারাই আলোচ্য আয়াতের ‘সাবিকুনাল আউয়্যালুন’।
সুনির্দিষ্ট কোনো যুক্তি না দেখালেও, সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে এটাকেই সঠিক বলেছেন। আল্লাহই ভালো জানেন।
০৫. থ্রি ফ্যাক্টর
তাহলে সামগ্রিকভাবে সাহাবী বোঝার জন্য এই আয়াত থেকে আমরা তিনটা ফ্যাক্টর নিতে পারি।
এক. আউয়্যালুনা বা টাইম ফ্যাক্টর,
দুই. সাবিকুনা বা ফরমোস্ট ফ্যাক্টর,
তিন. ইত্তেবা বা ফলোয়িং ফ্যাক্টর।
আর যে বিষয়টা ক্লিয়ার, তা হলো- এই সাবিকুনাল আউয়্যালুন মুহাজির এবং আনসারগণ’ই আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ডিস্ট্রিংকশন প্রাপ্ত রাসূলুল্লাহর প্রথম শ্রেণীর সাহাবী। এরাই হলো- অন্যদেরকে তো বটেই, এবংকি রাসূলুল্লাহর অন্যসব সাহাবীকেও মাপার স্ট্যান্ডার্ড! এরাই আখেরি রসূলের দক্ষিণ হস্ত, তাঁর নয়ন যুগলের মণি, তাঁর আবেগ অনুভূতির পহেলা আশ্রয়! বিশ্বনবীর সে সময়ের সাথী, যে সময় ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর জমিনের এক বর্গমাইলও নিরাপদ ছিলো না। নিশ্চয়তা ছিলো না, একবেলা খাবারের পর কখন দ্বিতীয় বেলা খাওয়ার সুযোগ হবে!
(আল্লাহ এঁদের সাথে আমাদের প্রাণ বেঁধে দাও! দাজ্জালের জন্য প্রস্তুতিরত তোমার পৃথিবী তো আমাদের জন্যও অনিরাপদ হয়ে উঠছে, অনিশ্চিত হয়ে উঠছে তোমার সৃষ্ট রিজিকও!)
০৬.
উপরোক্ত আয়াতে(০৯:১০০) সাহাবীদের দ্বিতীয় যে ক্যাটেগরি আমরা পাই- যারা প্রথম ক্যাটেগরির নিষ্ঠাবান অনুসারি(those who follow them in the way of righteousness). লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু কোনো সময়কালের উল্লেখ নেই, বিশেষ কোনো অগ্রগামীতারও ব্যাপার নেই! অর্থাৎ, আর সবাই সেই সাবিকুনাল আউয়্যালুন স্ট্যান্ডার্ডের অধীন। সেই স্ট্যান্ডার্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট, বাকীরা নন। এবং সেই স্টান্ডার্ডের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু গ্রহণপযোগ্য হতে পারে না। কারণ আয়াত বলছে- আল্লাহর সন্তুষ্টি তাদের অনুসরণে, এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অতিক্রমে নয়।
আল্লাহ বাকীদের তাদের স্ট্যান্ডার্ডেই ডেকেছেন- লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে(০২:১৩)। উনারা সাহাবী যাছাইয়ের মানদন্ড, রাসূলুল্লাহকে অনুসরণেরও মানদন্ডও বলতে পারেন।
০৭.
‘তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করছো না? অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর উত্তরাধিকার তো তাঁরই৷ তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় ও জিহাদ করবে তারা কখনো তাদের সমকক্ষ হতে পারবে না, যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে৷ বিজয়ের পরে ব্যয়কারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা অনেক বেশী৷ যদিও আল্লাহ উভয়কে ভাল প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তোমরা যা করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত’(৫৭:১০)।
কারো কারো জন্য ইংরেজিটাই সহজ হবে মনে হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, মুহাম্মদ আসাদের অনুবাদ হচ্ছে- ‘…Not equal are those of you who spent and fought before the Victory [and those who did not do so]: they are of a higher rank than those who would spend and fight [only] after it-’
আগের আয়াতের(০৯:১০০) আলোচনায় আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধির কথা পড়েছিলাম। মূলত এটাই হচ্ছে- হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথে সম্পৃক্ত আয়াত। এখানে বিজয় বলতে কোনো কোনো মুফাসসির মক্কা বিজয় বললেও নানা কারণে সে মত দূর্বল হয়ে পড়ে।
প্রথমত, মক্কা বিজয়ের কথা সূরা নসরেই বলা হয়েছে, যেখানে সাহায্য ও বিজয় দু’টোই এক সাথে এসেছে, কিন্তু এখানে শুধু বিজয়ের কথা বলা হচ্ছে, যা হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথেই সম্পৃক্ত(৪৮:০১)। [তাছাড়া পরবর্তী দু’আয়াতে(৪৮:০২-০৩) আল্লাহ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মক্কা বিজয়ের মাধ্যমেই মোটা দাগে তার পূর্ণতা পেয়েছে।]
দ্বিতীয়ত, আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত একটি হাদীস- হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বললেনঃ অচিরেই এমন লোক জন আসবে যাদের আমল বা কাজকর্ম দেখে তোমরা নিজেদের কাজকর্মকে নগণ্য মনে করবে । কিন্তু ‘তাদের কারো কাছে যদি পাহাড় পরিমাণও স্বর্ণও থাকে আর সে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তবুও সে তোমাদের দুই রতল এমন কি এক রতল পরিমাণ ব্যয় করার সমকক্ষও হতে পারবে না’। (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে মারদুইয়া, আবু নুআইম ইসফাহানী) ।
তৃতীয়ত, হযরত আনাস থেকে বর্ণিত হাদিস- ‘একবার হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার মুহুর্তে হযরত খালেদ হযরত আবদুর রহমান কে বলেন- ‘তোমরা তোমাদের অতীত কাজ কর্মের কারণেই আমাদের কাছে গর্ব কর এবং বড় হতে চাও’। এ কথা রাসূলুল্লাহর কাছে পৌছলে, তিনি বললেন- ‘যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! যদি তোমরা উহুদের সমপরিমাণ বা পাহাড়গুলোর সমপরিমাণ স্বর্ণও খরচ করো তবুও এসব লোকের আমলের সমান হতে পারবে না’(আহমদ)।[এটি সাইয়েদ আবুল আ’লা, সাইয়েদ কুতুব, শহীদ আবদুল্লাহ আযযাম(তাফসীরে সূরা তাওবা) সবাই উল্লেখ করেছেন]
এ থেকেও বোঝা যায় যে, এখানে বিজয় অর্থ হুদাইবিয়ার সন্ধি। কারণ হযরত খালেদ হুদাইবিয়ার সন্ধির পরেই ঈমান এনেছিলেন এবং মক্কা বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
উভয় শ্রেণীর সাহাবীর মর্যাদাগত পার্থক্য লক্ষ্য করুন, প্রথম পক্ষের এক রতল পরিমাণ=অপর পক্ষের উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ!!
০৮.
তার মানে, বদর যুদ্ধের পরে কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এবং নিজ নিজ জায়গা থেকে যতদূর সম্ভব সেই ‘সাবিকুনাল আউইয়্যালিন’গণের উপমায় নিজেদের পেশ করেছেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তারা সেকেন্ড ডিস্টিংকশন প্রাপ্ত সাহাবী।
তাদের ডিস্টিংকশনের কারণ হলো, মুসলমানরা তখনও সংখ্যায় স্বল্পই ছিলো- ইসলাম একটা শক্তিশালী ভিত্তিমূলে দাঁড়ালেও, আপাত দৃষ্টিতে বিজয় ও নিরাপত্তা তখনও নিশ্চিত হয়নি। তখনও আশংকা ছিলো যে, আল্লাহর পথে ব্যয় করা ও জিহাদ করা আদৌ কোনো ফল আনে কী না?...
‘যদিও আল্লাহ উভয়কে ভাল প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’৷ কারণ, স্বাভাবিকভাবেই স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষ আল্লাহর পথে জান ও মালের কুরবানী পেশ করা সর্বাবস্থায়ই সম্মানজনক কাজ। কিন্তু মর্যাদার যে পার্থক্য কুরআন ঘোষণা করছে সেটা নিয়ে যাতে অর্থহীন বিতর্ক তৈরী না হয়, তাই সে সাথে এও বলে দিয়েছে- ‘তোমরা যা করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত’(৫৭:১০)।
তাহলে কুরআন ও হাদীসের পর্যালোচনায় এ পর্যন্ত আমরা সাহাবীদের তিনটি স্তর সম্পর্কে ধারণা পেলাম। যথা-
এক. অগ্রগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার দল(ফার্স্ট ডিস্টিংকশন);
দুই. তাদের নিষ্ঠাবান অনুসারি, যারা বিজয় তথা হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন(সেকেন্ড ডিস্টিংকশন), এঁদের মধ্যে অবশ্য বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের স্পেশাল ডিস্টিংকশন রয়েছে(৪৮:১৮);
তিন. হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত যারা ঈমান এনেছেন এবং সাবিকুনাল আউয়্যালীনদের সততাপূর্ণ অনুসরণ করেছেন, তাঁরাও উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি প্রাপ্ত, বাট-(উইদাউট ডিস্টিংকশন)।
০৯.
আর বাকী থাকলো মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কিংবা পরে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের কথা। তাদের কথা বলা হচ্ছে সূরা নাসরে। ইতোপূর্বে সূরা ফাতহে আমরা দেখেছি হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা’লা বলেছেন-
‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি। যাতে আল্লাহ তোমার আগের ও পরের তাবৎ ক্রটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেন, তোমার প্রতি তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণ করেন, তোমাকে সরল সহজ পথ দেখিয়ে দেন। এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সাহায্য করেন’(৪৮:১-৩)।
আর সূরা নাসর বলছে- যখন আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় এসে যায়; তুমি দেখবে মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে(১১০:১-২)।
অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের ভেতর দিয়ে এই ‘সাহায্য ও বিজয়’ অর্থাৎ, চূড়ান্ত বিজয়ের সূচনা হয়, এবং তার প্রেক্ষিতে পরবর্তী মাত্র দু’বছরে মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণকারী দশ হাজার সাহাবী উন্নীত হয় প্রায় সোয়া লক্ষে(১২৪,০০০), মতান্তরে আরো বেশী(১৪৪,০০০); যেখানে প্রথম তিন বছরে এ সংখ্যা ছিলো মাত্র পঞ্চাশের মতো! হযরত খাদীজা, আলী এবং যায়েদকেসহ গণনা করলে দাঁড়ায় পঞ্চান্ন জন মাত্র!
কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তি এখান থেকে কী শেখে! তিন বছরে একশোও পূর্ণ হয় না, আর দু’বছরে সোয়া লক্ষ!! সো, বুঝতে হবে সবই বৃক্ষ বটে কিন্তু সেখানে বট বৃক্ষও আছে! সবই সামুদ্রিক প্রাণী বটে, কিন্তু সেখানে নীল তিমিও আছে! আর্থোপোড়া পর্বের প্রাণী যেমন আছে, আছে কর্ডেটও! আরো শত কথা বলা যায়। আপাতত দরকার নেই। শুধু লক্ষ্য করুন, কুরআন এখানে কাউকে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করছে না। এবংকি কারো আলাদা কোনো অস্তিত্বও নেই, সবাই দলের সাথে লীন! দলে দলে লোক(ওয়ারা-আইতান-নাসা)!
যখন ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই, যখন ইসলাম গ্রহণ করলেই স্বার্থ হাসিলের কারবার সবচেয়ে সহজ হয়ে যায়, ইসলাম গ্রহণেই যখন নেতৃত্বের চাবিকাঠি নিহিত- তখন শুধু ইসলাম গ্রহণের ভেতরে কী এমন মাহাত্ম থাকতে পারে! আসলে নেইও! কোথাও নেই! না কুরআনে, না হাদীসে! আছে ইসলাম থেকে স্বার্থ-হাসিলকারী সেই শ্রেণীর উত্তরসূরীদের মন-মগজে! তাদের অপাঠ যোগ্য বই-পুস্তকে! রাজ-দরবারে ভর্তি করা উদর হতে বমন করা ফতোয়ায়!
কিভাবে তাদের আলাদা মর্যাদা থাকতে পারে, যেখানে তাদের চেয়ে অগ্রগামীদেরই কোনো ডিস্টিংকশন নেই! কিভাবে থাকতে পারে যারা ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফসলের কোনো ক্ষতিতে পরীক্ষিত হয়নি(০২:১৫৫)?
তাহলে কী হবে? আমরা তাদের গ্রহণ করতে পারি কিভাবে, কোন ফর্মূলায়?...
হ্যাঁ, ফর্মূলা আছে। আছে লিখার একেবারে কপালে সাঁটানো আয়াতে(০৯:১০০)। সেই ফলোয়িং ফ্যাক্টরে!...
অর্থাৎ, প্রথমত, সাবিকুনাল আউয়্যালীন মুহাজির ও আনসারদের আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করতে পারি! শুধু গ্রহণ নয়, সত্যকে সুন্দরকে গোটা দুনিয়ার প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে কিভাবে সেলিব্রেট করতে হয়, কিভাবে বরণ করে নিতে হয় বিনির্মাণের পথ দেখানোর বিরহ-যন্ত্রণা, কিভাবে অনুসরণ করতে হয় আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলকে, সেই পথ-নির্দেশক হিসেবে তাঁদের অবস্থান পৃথিবীর প্রলয়দিন পর্যন্ত ধ্রুবতারার মতো দেদীপ্যমান থাকবে! রাসূলুল্লাহকে অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরাই আমাদের একচ্ছত্র স্ট্যান্ডার্ড!
তারপর সেকেন্ড ডিস্টিংকশনে থাকা সাহাবীদেরও আমরা অনায়েসে গ্রহণ করতে পা্রি, প্রথম শ্রেণী তথা স্ট্যান্ডার্ডের সাথে মিলিয়ে নিয়ে(০৯:১০০)।
ডিস্টিংকশন ছাড়া যারা আছেন, তাদেরকে আমরা স্ট্যান্ডার্ডের নিরিখে কিছুটা যাছাই-বাছাই করে গ্রহণ করবো।
কিন্তু মক্কা বিজয়ের ভেতর দিয়ে যারা নিরুপায় পরিস্থিতিতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, কিংবা তারপরে- যখন ইসলাম গ্রহণ না করাই বরং বৈষয়িক দিক থেকেই ক্ষতির কারণ ছিলো, তাদেরকে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই! কারণ তাদের মধ্য নির্ভেজাল কপটচারী যেমন আছে, নির্জলা স্বার্থপরও আছে। আছে সাংঘাতিক বিদ্বিষ্ট পরশ্রীকাতরবৃন্দ, এবংকি প্রতিশোধপরায়ণ জাহেলিয়াতের প্রতিবিপ্লবীরা!...
শুধু এখানে নয়, সব বিপ্লবেই এরা থাকে! এরা সারাজীবন রাজাকার থেকে যুদ্ধ শেষে গুরুতর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়! নয় মাস ধরে এরা হানাদারের লাঠিয়াল থাকে আর ষোলই ডিসেম্বর থেকে হয়ে ওঠে ‘চেতনা’র রুপকার!
এদের চেনা কারো কারো জন্য কঠিন বটে! আবার চিনলেও সহজে কিছু করা যায় না! এরা সাধারণত পুরানা সমাজ-কাঠামোর প্রভাবশালী অংশ থেকেই বেড়ে ওঠে! জাহেলী সমাজের সদস্যদের কাছে তাদের মর্যাদারও অভাব হয় না। কিন্তু বিপ্লব ও নয়া বিনির্মাণের সাথীদের পদে পদে এদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হয়!
আমাদেরও প্রত্যাশা শুধু- অন্যরা যেভাবে নিচ্ছে নিক, উম্মাহর আগামী দিনের ইতিহাস বিনর্মাণের সৈনিকরা, খিলাফাত আ’লা মিন হাজিন নবুয়াহ’র নিশান-বরদারগণ যেনো কোনো অবস্থায় ‘মানুষ’ চিনতে ভুল না করে! রাজ-দরবারের শয়তানি ফতোয়ায় যেন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়!
এবং নিজেরা নিজেদের পূর্বসূরীদের ব্যাপারে সর্বাধিক ক্লিয়ার হয়েই যেনো, মোকাবিলা করতে সমর্থ হয় জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জ…
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একটানে পড়ে ফেললাম, আলহামদুলিল্লাহ..
জাযাকাল্লাহ, খুব ভালো লিখেছেন,
আপনার কলম আরো আরো বরকতময় হোক
.
আলহামদুলিল্লাহ!
অনেক ধন্যবাদ, প্রেরণাদায়ক কমেন্টের জন্য!
যাজাকাল্লাহ!...
জাযাকাল্লাহ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!...
মন্তব্য করতে লগইন করুন