তবু ইসলামের কথাই বলতে হবে… খসড়া-০৫(এপ্রোচের মামলা)
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১০:২৯:১০ রাত
ফরহাদ মজহার ইসলাম জানেন না কিংবা ভালো বোঝেন না- এমন কথা বলা দুস্কর। অন্তত এভাবে বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আবার, তার ইসলাম শেখায় ঘাটতি আছে কিংবা তাকে ইসলামের আরো গভীরে যেতে হবে ইত্যাদি বলেও যে আপনি পার পাবেন, সে অবকাশও তিনি রাখেননি। ইসলাম সংশ্লিষ্ট তার বিভিন্ন লিখা-জোখা কিংবা বক্তব্য শুনলে ক্ষেত্রবিশেষে আপনি বরং তাজ্জবও বনে যেতে পারেন। তাহলে?...
মামলাটা আসলে বস্তুগতঅর্থে জানা-বোঝার নয়।
কোনো বিষয়কে বোঝার জন্য পাশ্চাত্যের যে এপ্রোচ, কমিউনিজমের এপ্রোচ তার থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। দু’টোই একই রেনেসাঁ-সঞ্জাত। বস্তুবাদী-বুদ্ধিবৃত্তির উত্তরসূরি। ফলে ফরহাদ মজহার বা অন্যান্য বাম বা সেকিউলারপন্থিরা ধর্ম সম্পর্কে যখন কোনো কথা বলেন, সেটি তাদের সেই বদ্ধমূল ইউরোপীয় এপ্রোচ এবং বস্তুগত জানা-শোনার ভিত্তিমূল থেকেই উৎসারিত হয়। সে প্রক্রিয়ায় যে ইসলামে পৌঁছা অসম্ভব, এবং তা এপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গীগত সীমাবদ্ধতার কারণেই, উনারা হয়তো সচেতনভাবেই তা এড়িয়ে যান। অবশ্য ইসলামে পৌঁছা নয় বরং পঁচানোই উনাদের লক্ষ্য, বলা যায় মজ্জাগতভাবেই।
তবে বিষয়টা যে ফরহাদ ভাই একদমই বোঝেন না, তা না। বোঝেন। এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরুতেও চান মনে হয়। এজন্যই হয়তো তিনি ‘আরও অগ্রসর পর্যালোচনার দরকার’ মনে করেন। মার্কস যেভাবে ‘'মানুষ'কে তার সমাজ ও ইতিহাসের সারাৎসার হিসাবে ভাবতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাকে নিছকই অর্থনৈতিক এজেন্টে পর্যবসিত করেছিলেন,... সেই ভুলের বোঝা মাথায় নিয়ে’ তিনি চলতে চান না। একইভাবে চান ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ থেকেও মুক্ত থাকতে। এসবই সাহসী এবং অগ্রসর চিন্তা, সন্দেহ নেই। তারপর কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাইদেরও নসিহত করলেন-
‘এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বদ্ধমূল ধারণাকে নাকচ করতে’। কি সেইসব বদ্ধমূল ধারণা? তিনি বলছেন- ‘যেমন, ধর্মকে চিন্তার পশ্চাত্পদতা,অর্ধচেতন বা অসম্পূর্ণ অবস্থা মনে করা’। সেই সাথে বলে দিলেন- ধর্মচিন্তা যুক্তিবর্জিত, কুসংস্কার বা সোজা কথায় চিন্তাহীন কিম্বা দেশকালপাত্র নির্বিশেষে প্রতিক্রিয়াশীল এই সকল মুখস্তবিদ্যা বাদ দিতে হবে’। চমৎকার কথা-বার্তা! কমিউনিস্ট ভাই-বোনেরা এর কিঞ্চিত পরিমাণও আমলে নিয়েছেন নাকি তাদের ধর্মবিদ্বেষ আঞ্চলিক আধিপত্যের ছায়ায় আরো মহীরুহ হয়ে উঠছে- তা খতিয়ে দেখার বিষয়। তবে এসবই সাধুবাদ জানানোর মতো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য পরামর্শ। পতিত অবস্থা হতে বাম রাজনীতির উত্তরণ-চিন্তায় অপরিহার্যও বলা যেতে পারে।
তারমানে কী হলো, কী দাঁড়ালো?... একদিকে তিনি ইসলামকে দেখছেন বস্তুবাদী জায়গা থেকে। লক্ষ্য করুন, তিনি যতই দারুন সব বাক্য রচনা করুন না কেনো, ইসলামকে কিন্তু ইসলামের দিক থেকে দেখছেন না একবারও, দেখছেন কমিউনিস্টের অবস্থান থেকে। বস্তুবাদী জায়গা থেকে। আবার বলছেন যে, ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ থেকে মুক্ত থাকতে! বলছেন- ‘বদ্ধমূল ধারণাকে নাকচ করার জন্য’?... এর হেতু কী? কেন এই বৈপরীত্য?... ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ কিংবা ‘বদ্ধমূল ধারণা’ বলতে উনিই-বা কি বোঝেন? সে বোঝার গোপন কোনো তাৎপর্য আছে কি না?... এ বিষয়গুলো ভালোভাবে না বুঝলে আমরা আসলে কিছুই বুঝবো না?...
০২.
মানুষকে, মানুষের ইতিহাস এবং আগামীকে দেখার যতগুলো এপ্রোচ, সবগুলোই শেষ পর্যন্ত দুটোতে গিয়ে ঠেকে যায়। না, বস্তুবাদ আর ভাববাদ নয়। ধর্ম এবং দর্শনও নয়। সে দুটো হলো ইসলাম এবং পুঁজিবাদ। বিষয়টাকে আরো স্পেসিফাই করার জন্য আমরা কুরআনের একটি আয়াত সম্মুখে রাখতে পারি-
‘স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন, আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করেছি, অতঃপর অন্য একজন রসূল যদি এই শিক্ষার সত্যতা ঘোষণা করে তোমাদের কাছে আসেন, যা আগে থেকেই তোমাদের কাছে আছে, তাহলে তার প্রতি তোমাদের ঈমান আনতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে …’০৩:৮১)
এই হলো রিসালাতের ধারা। ঈমানদার এই ধারা হতে কোনো নবীকে পৃথক করেন না, করতে পারেন না(০২:২৮৫)। আর আমাদের এ যুগে, আখেরি রাসূলকে মেনে নেয়া মানে সম্পূর্ণ ধারাকেই মেনে নেয়া। 'শেষ ইস্টক'টিসহ নবুয়তের পুরো প্রাসাদকে গ্রহণ করা। এটা হলো ইসলামের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহনে আপনার এসিড টেস্ট! এখানে পাশ না করতে পারলে আপনার তাওহীদ এবং আখিরাত স্বীকৃতির গুমরও কুরআন ফাঁস করে দেবে- ‘কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়’(০২:০৮)।
তারমানে হয়তো আখেরি রাসূলের ওপর ঈমান এনে, রিসালাতের সম্পূর্ণ ধারাকে গভীর সচেতনতা সহকারে গ্রহণ করবেন। তাদের জীবন, শিক্ষা ও সংগ্রামের ইতিহাসকে আত্মস্থ করে আপনার দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বদৃষ্টি তৈয়ার করবেন। অথবা পুঁজিবাদী জাহেলিয়াতের বর্ণচোরা দৃষ্টিভঙ্গীতে আছাড় খেয়ে বেড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। জাহেলিয়াতে সব দানব আজ পুঁজিবাদে একাকার। হোক সেটি বস্তুবাদী জাহেলিয়াত, অংশীবাদী, ভাববাদী কিংবা বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত। মার্ক্স যেমন বলেছিলেন- 'পুঁজি সব কিছুকেই তার লাঠিয়াল হিসেবে তৈয়ার করে নেয়'। হ্যাঁ, সব জাহেলিয়াতকেই তৈয়ার করে নেয়, মজুদও করে রাখে, যাকে যেখানে দরকার সেখানে সময়মত খাটায়ও!...
০৩.
উপরের আলোচনাটুকু যদি আমরা মোটামুটি বুঝে থাকি, তাহলে আসুন দেখা যাক, ইসলামের প্রতি ফরহাদ মজহারের এপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গীটা ক্যামোন।
উনি, জানা-বোঝার ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ থেকে মুক্ত হতে চান। বেরিয়ে আসতে চান। ধর্ম নিয়ে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের যে ‘বদ্ধমূল ধারণা’ তা নাকচ করতে চান। এরচেয়ে ইতিবাচক বৈপ্লবিক আর কী হতে পারে?... কিন্তু প্রশ্ন হলো- নাকচ করে, বেরিয়ে এসে যেতে চান কোথায়? কোন জায়গা থেকে দেখতে চান দুনিয়াকে, কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে বুঝতে চান?... রিসালাতের ধারা থেকে? উনার লিখায় তো ‘আখেরি রসূল’ শব্দদ্বয়ের খুব প্রাণবন্ত বিচরণ পরিলক্ষিত হয়, তবে কী আখেরি রসূলকে আত্মস্থ করার ভেতর দিয়ে দুনিয়াকে দেখবেন এবার?...
সমস্যা কী? সেই লিখায় মার্ক্সের একটি উক্তি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উনিই টেনেছেন-
‘শেষমেষ এটা তো পরিষ্কার যে মানুষ নতুন কোনো কাজ ধরবে না, বরং সচেতনভাবে তার পুরানা কাজটাই সম্পূর্ণ করবার দিকে নিয়ে যাবে’(Early Writings by Marx).
দেখুন কী সুন্দর কথা! ফরহাদ ভাই নিজেই বলছেন- ‘দুনিয়াতে মানুষের কর্তব্য বা ভূমিকা কি সেটা তো আদি কাল থেকেই নানাভাবে মানুষের চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা হাজির হয়েছে নানান রহস্যে মোড়ক পরে, ধোঁয়াশার মধ্যে আলো হয়ে। সেই আদি কাজ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাই কমিউনিস্টদের কাজ। সেই কাজের হদিস ধর্মের মধ্যেও আছে’।
লক্ষ্য করুন- ‘সেই আদি কাজ’। কোন আদি কাজ?... ‘দুনিয়াতে মানুষের কর্তব্য বা ভূমিকা’ যা ‘আদি কাল থেকেই নানাভাবে মানুষের চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে’। এই আদি কাজ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাই কমিউনিস্টদের কাজ? বলেন কী?... এতো ঈমানদারেরও কাজ! আল্লাহর নবীরা তো এ কাজই করেছেন-
‘আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি...(১৬:৩৬), এবং ‘...একজন রাসূলও এ ওহী ছাড়া পাঠাইনি যে, 'আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই কাজেই তোমরা আমারই বন্দেগী করো'(২১:২৫)। এ কথাগুলো কুরআনের আরো বেশ কিছু জায়গায় নানাভাবে এসেছে। তার মানে তো নবীরাও কেউ আলাদা কোনো কাজে হাত দেয়নি। সবাই সেই আদি বা মৌল কাজটিরই আঞ্জাম দিয়েছেন।
তবে ফরহাদ মজহার যে বললেন- ‘সেটা(সেই আদি কাজ) হাজির হয়েছে নানান রহস্যে মোড়ক পরে, ধোঁয়াশার মধ্যে আলো হয়ে’, নবীরা এ থেকে মুক্ত ছিলেন। তাঁরা জানতেন আদি কাজটা কী(২১:২৫)। এবং আরো মজার ব্যাপার হলো- তাঁরা প্রত্যেকেই তাদের পূর্বসূরীকে প্রত্যয়ন করেই কাজ শুরু করতেন। অর্থাৎ, ‘নানান রহস্যে মোড়ক’ আর ‘ধোঁয়াশার মধ্যে আলো’ নবীদের বিভ্রান্ত করতে পারেনা। সেই ধারায় আখেরি রাসূলকে পূর্ণ-চৈতন্য সহকারে গ্রহণ করে যারা তাদের এপ্রোচ বিনির্মাণ করে, দৃষ্টিপাত করে মানবজাতির ইতিহাসের দিকে তারাও রক্ষা পায় সমূহ বিভ্রান্তির কানাগলি থেকে!
০৪.
কিন্তু ফরহাদ ভাই?... ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ থেকে 'মুক্ত' হলেন। ধর্ম নিয়ে তাদের ‘বদ্ধমূল ধারণা’ও 'নাকচ' করলেন। এবংকি যে ‘আদি কাজ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাই কমিউনিস্টদের কাজ’- ‘সেই কাজের হদিস' যে 'ধর্মের মধ্যেও আছে’- তাও বুঝলেন। তারপরও কী রিসালাতের এপ্রোচ নিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারলেন? কিংবা ইসলামের দিকে?... তাকালে কী হতো কমিউনিজম ছুটে যেতো?... তাহলে এতো 'মুক্ত হওয়া' 'নাকচ করা'র শ্লোগান কি বাগাড়ম্বরই সার!...
আচ্ছা, যদি নাই-বা তাকাবেন তাহলে এতো কথা তুললেনই-বা কেন?... এটাও ভালোভাবে জানতে হবে আমাদের।
তুলেছেন- ‘বদ্ধ, সংকীর্ণ ও ইসলামী আতংকের রুগী হয়ে বাংলাদেশে হাজির’ থাকা কমিউনিজমের ভার হালকা করার জন্য। ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব হতে আমদানি করা সামাজিক বিবর্তনের মুখাস্ত থিওরী কপচিয়ে তারা যে খাদে নিপতিত হয়েছে সেখান থেকে উদ্ধারের 'মহৎ' উদ্দেশ্যে।
এবং তুলেছেন- এদেশের গণমানুষের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বিশ্বাস ইসলামের প্রতি ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভেতর দিয়ে তারা নিজেদের জন্য নিজেরা যে জগদ্দল পাথর তৈরী করেছে তা থেকে উত্তরণের প্রয়োজনেই।
কারণ- ‘আমাদের দেশে আগামী দিনে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী আদর্শগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে ইসলাম প্রশ্নের একটা মীমাংসা দরকার’। এবং সে জন্য ‘কমিউনিজমের দিক থেকে ধর্মকে বিচার করবার সঠিক নীতি ও কৌশল' প্রণয়ন, এবং ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম নিয়ে আলোচনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই’।
এসব আমার কথা নয়, তার লিখা থেকেই কপি-পেস্ট করা।
লক্ষ করুন, ইউরোপ থেকে 'মুক্ত হয়ে', তাদের বদ্ধমূল ধারণাসমূহ 'নাকচ করে' তিনি এবার রাজনীতির উপর সোয়ার হয়েছেন। ইসলামটা তার কাছে মোটেই কোনো অখন্ড ধর্ম বা মতাদর্শ নয়, অন্তত সে লেখায়। রাজনীতির দিক থেকে বিবেচনার বিষয়, বাংলাদেশের রাজনীতি...! এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট রাজনীতির দিক থেকে স্রেফ মোকাবিলার বস্তু!
ফলে তার ইসলাম বা ধর্মালোচনা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, কমিউনিজমের দিক থেকে ইসলামের সাথে একটা কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরীর প্রয়াস ভিন্ন বিশেষ কোনো মূল্য বহন করেনা।
কৌতুকের বিষয় হলো- তাও কমিউনিজমের স্বার্থেই!!...
০৫.
কেউ আবার ভাববেন না, আমরা রাজনীতির নিন্দা করছি। রাজনীতি খারাপ জিনিষ না। কমিউনিজমও না। অন্তত আগাম খারাপ ধরে নিয়ে আমরা এগুতে চাই না। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ধর্ম ইসলাম হওয়ায়, এবং কমপক্ষে বিশ্বাসের দিক থেকে তারা ধর্মপ্রাণ হওয়ায়- রাজনীতির দিক থেকে ইসলামকে মোকাবিলা কম বেশি সবাইকেই করতে হয়, সবাই করেও। কেউ আন্তরিকভাবে করেন, কেউ আইওয়াশের জন্য হলেও করেন। কখনও কখনও আমরা দেখি সেকিউলারিজমকেও কিভাবে কালেমা পড়িয়ে ‘ঈমানদারে’র আলখেল্লায় হাজির করা হয়।
তো কমিউনিজমের দিক থেকেও আপনি ইসলামকে মোকাবিলা করতে চান, করুন। এতোদিন মোকাবিলা করেছেন না?... অবশ্যই করেছেন। ধর্ম নামের সবকিছুই ছিল আপনাদের কাছে ‘ফেলে আসা’ পুরান জামার মতো। তত্ত্ব ছেড়ছেন- ধর্ম হলো মানব ইতিহাসের থিওলজিক্যাল স্টেজের অজ্ঞতা। তার পরের ধাপ ম্যাটাপিজিক্যাল স্টেজও আমাদের ঠ্যাংয়ের নিচে, ধর্ম তো আর কথা। আমরা এখন পজেটিভ স্টেজে খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি!(অগাস্ট কোতের বিখ্যাত থিওরী) ধর্ম-টর্ম ইসলাম-টিসলাম এগুলো আবার কি?...
আবার মার্ক্সও ধর্মের পর্যালোচনা শেষ হয়ে গেছে বলেই তার পথ নির্মাণ করেছেন। উৎপাদন-প্রণালী(mode of production)কে ভিত্তি ধরেই দেখেছেন মানব জাতির ইতিহাস। মার্ক্সের বঙ্গীয় 'উম্মত' হিসেবে- কখনও কখনও তার চেয়েও বেশী মার্ক্সীস্ট হয়ে, ধর্মের কোনো বিবেচনা ছাড়াই আপনারাও মানুষকে বলে বেড়িয়েছেন কিভাবে সামন্তবাদ থেকে কানে হেটে পুঁজিবাদ অতিক্রম করে মানুষের ইতিহাস সমাজতন্ত্রে বিশ্রাম নেবে।
সেকিউলারিজম কিংবা কমিউনিজম তো এভাবেই ইসলামকে মোকাবিলা করেছে। এখনও ওভাবেই মোকাবিলা করতে মরিয়া। কিন্তু আপনি, ফরহাদ মজহার, কমিউনিজমের সেই বঙ্গীয় 'মুজাদ্দিদ' হিসেবে সহসা দেখছেন যে, সর্বনাশ!… ইসলামকে এভাবে 'ইউরোপীয় মূর্খতায়' মোকাবিলা কমিউনিজমের করুণ অধ:পতন ছাড়া এ পর্যন্ত আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি। এ তাদের জন্য ‘আত্মঘাতি’ হয়েছে। তাদেরকে ‘জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন' করে ফেলেছে। সো, ট্রায়াল এন্ড এরোর মেথডে, অথবা ভিন্ন কোনো উপলব্ধিতে ভিন্ন ফর্মূলায় এগুতে চাচ্ছেন। সে আপনি চাইতেই পারেন।
বিকল্প বাছাইয়ের যে স্বাধীনতা স্রষ্টা আপনাকে দিয়েছে, অথবা আপনি নিজ গুণে পেয়েছেন, তা থেকে মাহরুম করার কোনো অধিকার কারো নেই। আপনি চাইলে সর্বান্তকরণে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের ভেতর থেকে আপনার আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেন। যদি মনে করেন, ইসলাম আপনার জন্য গ্রহণযোগ্য আদর্শ না, আপনার বৈচিত্রপূর্ণ খায়েস মেটানোর সামর্থ তার নেই, তাতেও সমস্যা নেই। বাইরে মুসলিম সেজে অন্যান্য নানা আদর্শের ছায়ায় থেকেও আপনি ইসলাম মোকাবিলা করতে পারেন। সেটাকে বলা যেতে পারে চুক্তি বা আপোসমূলক সম্পর্ক! কিংবা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের গোলাম হয়ে ইসলামের সাথে বৈরী সম্পর্কে ফ্যাসিস্টও হয়ে উঠতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা নেই মানে ইহকালের মানবিক ইচ্ছার স্বাধীনতার দিক থেকে সমস্যা নেই। যে কোনোটাই আপনি করতে পারেন।
এখন আপনি কোনটা করবেন, কেন করবেন, আর কিভাবে করবেন্ সেটা আপনার জানা-বোঝা, আপনার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ফায়সালা, আপনার বিবিধ-প্রকার স্বার্থচিন্তা ইত্যাদি থেকেই নির্ধারিত হবে। এখানে, ‘আমার কাছে ইসলামের সঙ্গে এই মোকাবিলা নিছকই কৌশলের প্রশ্ন নয়, নীতিগত প্রশ্ন’- ইত্যাকার কূটনৈতিক বাক্য, নিষ্প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কারণ, একজন ইসলামকে সবদিক থেকে প্রত্যাখ্যান করে, বিবেচনার অযোগ্য ভেবে রাজনীতি করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন। আরেকজন তাকে হিকমত শিক্ষা দিচ্ছেন যে, ওভাবে প্রত্যাখ্যান নয়, ওটারে আমলে নিয়ে মোকাবিলা কর। এখানে নীতির কী?... শেষ পর্যন্ত সেই কৌশলই সার কথা হয়ে দাঁড়ায়, হেকমতই আমূল নীতি হয়ে যায়। কিন্তু সুদূরপরাহতই থেকে যায়- ইসলাম কে বোঝার যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গী! (সে জন্যই দেখা যায়, সেই বড় বড় কমিউনিস্টরা এখন সাড়ম্বরে হজ্ব করে এসে বিপুল ‘ঈমানদারি’ প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছেন। ইসলাম মোকাবিলার নিউ কমিউনিস্ট ভার্সন বটে!)
তারমানে সারমর্মে আমরা যা পাই- ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা’ থেকে মুক্ত হয়ে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের ‘বদ্ধমূল ধারণা’ নাকচ করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিক থেকে ইসলামকে দেখার যে সবক ফরহাদ ভাই দিলেন, তা নতুন কিছু না হয়ে- একই বদ্ধডোবায় কিঞ্চিত অবস্থান বদলের মতোই হয়ে গেল। একই দৃষ্টিভঙ্গীর বিছানায় খানিকটা গড়াগড়ি দেয়ার মতো। বলা যায়, এসবই আসলে একই দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাওয়া। একই কর্দমে লুটোপুটি...
অর্থাৎ, উনি যতই হাঁক-ডাক তুলে বাঘের মতো বের হন না কেনো, পেচনের দরজা দিয়ে সেই একই এপ্রোচেই প্রবেশ করলেন, খুবই সন্তর্পনে, বিড়ালের মতো। হেরফের যা হলো শুধু রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা-সঞ্জাত ইসলাম মোকাবিলার ধরণে, ইসলাম দেখার এপ্রোচে কোনো হেরফের হয়নি।
০৬.
তাহলে যা বলছিলাম- মামলাটা আসলে বস্তুগতঅর্থে জানা-বোঝার নয়।
মামলা ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তেরও নয়।
মামলা হলো এপ্রোচের, মামলা দৃষ্টিভঙ্গীর। ইসলাম নিয়ে উনার জানা-শোনা, চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে বটে, তাও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কমিউনিজমের রাজনীতির প্রয়োজনে, যা আগেই বলেছি; কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গীতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। সেই একই এপ্রোচেই উনি ইস্তেকামাত...।
এখন কি বলবেন, উনার এপ্রোচ ভুল?...
-মোটেই না। দৃষ্টিভঙ্গীও যথার্থ। অর্থাৎ, তার জায়গা থেকে তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সচেতনভাবে এই এপ্রোচ, এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গী একজন বস্তুবাদীর দৃষ্টিভঙ্গী।
এই এপ্রোচ একজন কমিউনিস্ট কমরেডের এপ্রোচ।
অর্থাৎ, তিনি ইসলামকে দেখছেন সেই বস্তুবাদী এপ্রোচ থেকে। কমিউনিজমের জায়গা থেকে। কমিউনিস্ট রাজনীতি উত্তরণের প্রয়োজনে। এটা তিনি করতেই পারেন। বাংলাদেশের আরো বামপন্থিরা সেটা নানা ভাবে করছেন। সে কাজ- বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনু মুহাম্মদ, নূরুল কবীর’রাও করছেন। এ নিয়ে ইসলামের দিক থেকে ‘দাওয়াহ’ ভিন্ন অন্য প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। তিনি তার বিশ্বাসকে, তার রাজনীতিকে প্রস্ফুটিত করার প্রয়াস চালাতেই পারেন।
কিন্তু উনি যে সময়ে সময়ে রীতিমত ইসলামপন্থি ইসলামিস্ট ঈমানদার সেজে বসেন!?...
হ্যাঁ, এটাই হলো ঘটনা। এবং তা যথেষ্ট গুরুত্বের দাবী রাখে বৈকি।
এটা বোঝার জন্য আপনি সূরা বাকারার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতের দিকে খেয়াল রাখতে পারেন-
‘আর যখন তাদের বলা হয়েছে , অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো তখন তারা এ জবাবই দিয়েছে- আমরা কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো? -সাবধান! আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না’(০২:১৩)।
এর পরের আয়াতটিও সমান প্রাসঙ্গিক। এর বেশী কিছু এখানে না বলাই শ্রেয়। শুধু বলি আয়াতের প্রতিটি শব্দ সাংঘাতিক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ করুণ- ...‘তাদের’কে কী বলা হচ্ছে?...আর তারাই বা উত্তর দিচ্ছে কী?... আর আল্লাহ তা’লা কাদেরকে ‘সাবধান!’ করছেন?... কী বলে সাবধান করছেন?...
(অসমাপ্ত)
বিষয়: রাজনীতি
৯৫৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
[দু'বার হয়ে গেছে, একটা মুছে দিন!]
খুব সুন্দর বলেছেন, যথার্থ বলেছেন, সহমত
তবে কম্যুদের ইসলামের কাছে আনার যে পথ তিনি তৈরী করতে চাচ্ছেন সেটাও তাদের আত্মহত্যার আরেকটা ক্ষেত্র তৈরী করবে ইনশাআল্লাহ!!
ধন্যবাদ। আসলেই তো দুবার পেস্ট হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, প্রার্থনা করি আপনার কথাই সত্য হোক। সেই সাথে আমাদেরও জ্ঞান গ্রহণ, পর্যালোচনা, প্রতিরোধ-বিতর্ক চলুক। আমরা পড়াও ছাড়বো না, ‘ধরা’ও ছাড়বো না।
আবারো ধন্যবাদ আপনাকে…
মন্তব্য করতে লগইন করুন