বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা: জনৈক তরুণের উদ্বেগ ও আহ্বান

লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:১৯:১৫ রাত

(দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১০জুলাই প্রকাশিত ফরহাদ মজহারের কলামটির প্রেক্ষিতে )



‘দিল্লী বাংলাদেশকে তার একটি উপনিবেশের অধিক কিছু গণ্য করে না’

ফরহাদ মজহারের অবস্থান এক্ষেত্রে বরাবরের মতোই স্পষ্ট। গুলশানের ঘটনা পরবর্তী কলামেও(দেখুন নয়া দিগন্ত অনলাইন, ৮জুলাই) তিনি তা’র পুনরাবৃত্তি করেছেন। এদিকে চায়নাকে ঠেকাতে ‘ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি’ যুক্তরাষ্ট্রও ইন্ডিয়া ‘তোয়াজ়ে’ ‘তোলা তোলা’ অবস্থায়। এবং ‘সে কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লির নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে’ ওয়াশিংটনের ‘স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থ অথবা অক্ষম’। সে কথাও তিনি বলেছেন স্পষ্ট করে।

(কথা হলো, ওয়াশিংটনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতায় কি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কিছু আসে যায়? বর্তমান মগের মুল্লুক বিশ্বব্যবস্থায় ‘নিজের মুরোদ’ই মূলত শেষ কথা।)

০২.

‘নিজের মুরোদ’ ব্যাপারটি মাথায় রেখে এবার তাহলে দেখা যাক, দিল্লির সেই নীতিটা কী? ফরহাদ ভাইয়ের জবানে শুনুন-

‘বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের নীতি আর দিল্লির নীতি অভিন্ন। সেটা হলো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুক এবং তা দীর্ঘ করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করুক’

একে বারে সাফ কথা। ইতোপূর্বে বহুবার তিনি বিভিন্ন কায়দায় একথা বলেছেন। তাঁর ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ কোন অবস্থান প্রেফার না করে পেছিয়ে কথা বলার অভিযোগ থাকলেও এখানে তিনি একান্তই অকপট। সমগ্র ‘দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে বিচার’ না করা- দিল্লির এই নীতির পরিণাম সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হলো-

‘…দিল্লি ও ভারতীয় গোয়েন্দারা বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রতি যে নির্বিচার সমর্থন দিয়ে এসেছে সেটা আত্মঘাতী নীতি বলা যায়। এর ফল হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে দিল্লির বিরোধকে তীব্র করা’

আত্মঘাতী নীতি?... কার জন্য আত্মঘাতী?...

০৩.

ইন্ডিয়ার ‘আত্মঘাতী নীতি’! তো তাতে বাংলাদেশের কি?... সে কথাও বলেছেন তিনি-

‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন , সহিংসতা বিস্তৃতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার পেছনে দিল্লির মদদ, সমর্থন ও সক্রিয় অবস্থানই’ অর্থাৎ, সেই আত্মঘাতী নীতিই ‘প্রধান কারণ’। শুধু তা’ই নয়, এরচেয়ে ভয়ংকর কথাটি বললেন পরের লাইনে-

‘নিরাপত্তা পরিস্থিতির সংকট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহণ করবার ক্ষেত্রে এটাই মূল কারণ’।

তার মানে কী দাঁড়ালো। দিল্লীর যে নীতিকে তিনি দিল্লীর জন্য আত্মঘাতী বলছেন, সেটি একই সাথে বাংলাদেশ-ঘাতীও বটে। তা এটি কিভাবে দিল্লীর জন্য আত্মঘাতী তা তিনি বিস্তারিত বলেননি। কিন্তু সেটি কিভাবে বাংলাদেশ-ঘাতী তা বোঝার জন্য উপরোক্ত লাইন দু’টিই যথেষ্ট।

তবে,

তাঁর এই গভীর পর্যবেক্ষণ, স্পষ্টবাদী প্রকাশভঙ্গীর সাথে শেষের কথাগুলো ক্যামোন বয়স্ক ও বেমানান মনে হলো। এবং সেদিকে ফরহাদ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ এই পোস্টের প্রধান কারণ। কলামের একেবারে শেষের দিকে এসে তিনি বললেন- ‘ভারতের জনগণকে এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে নিজেদের ভূমিকা পর্যালোচনা না করে ক্রমাগত ইসলাম ও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চর্চা আগুনে ঘি দেওয়ার অধিক কিছু করবে না। এই সময় দরকার চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও দূরদৃষ্টি। দরকার পরস্পরকে বোঝা ও জনগণের পর্যায়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা’।

হতাশাব্যঞ্জক কথাটি দু’লাইন পরেই বললেন-

‘দিল্লী বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তার নিজের স্বার্থে আরও জটিল করে তুলবে নাকি দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র ও শান্তির স্বার্থে বিচক্ষণ ভূমিকা গ্রহণ করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়’।

সেই সাথে সকরুণ ভঙ্গীতে খানিকটা ভয়ও দেখাতে চাইলেন ভারতকে-

‘প্রতিবেশীর চালে আগুন লাগলে নিজের ঘরের চালে আগুন ধরা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র’।

০৫.

আপনার কাছে মনে হতে পারে, উপরের কথার সাথে নিচের কথাগুলো বেমানান কিভাবে হলো? সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার ভার নিজ নিজ স্কন্ধে নিয়ে আসুন পুরো বিষয়টা আবার একটু চোখ বুলাই-

দিল্লী যদি সত্যি সত্যিই ‘বাংলাদেশকে তার একটি উপনিবেশের অধিক কিছু গণ্য না করে’-

যদি ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা বিস্তৃতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার পেছনে দিল্লির মদদ, সমর্থন ও সক্রিয় অবস্থানই’ ‘প্রধান কারণ’ হয়-

যদি ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতির সংকট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহণ করবার ক্ষেত্রে’ দিল্লীর এই নীতিই ‘মূল কারণ’ হয়-

আরো কথা আছে-

যদি ‘দিল্লীর বাংলাদেশ নীতির কারণে’ই ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক প্রান্তে এসে ঠেকে’ থাকে-

এবং

‘বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের নীতি আর দিল্লির নীতি’ যদি ‘অভিন্ন’ই হয়-

আর ‘অবস্থা’ যদি ‘এখনই এমন’ হয় যে ‘হাসিনার প্রবল আগ্রহ ভারতের সামরিক-গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও কর্মকর্তাদের ঘাড়ে ভর করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায় পালন, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজটা করা’র-

তাহলে

এই গুরুতর অবস্থায়-

বাংলাদেশ কিংবা ভারতের কিংবা উভয় দেশের ‘শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক জনগণকে’ শুধু বিশেষ কিছু ‘উপলব্ধি’র উপদেশ দিয়ে একজন প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীর কলাম শেষ হতে পারে না। ফরহাদ মজহারের তো নয়ই। যদিও উপলব্ধি ব্যাপারটির সমাপ্তি বলে কিছু নেই এবং সেই উপদেশ তিনি দিতেই পারেন। কিন্তু উনি উনার উপলদ্ধি যেভাবে পেশ করলেন তাতে তো এটাও সহজে উপলব্ধ হচ্ছে যে ব্যাপারটি শুধুই উপলব্ধির পর্যায়ে নেই। আবার মিডিয়া ও চিন্তা সাম্রাজ্যবাদের এ যুগে উপলব্ধির মাল-মসলা জনতার বিবেকের সম্মুখে উম্মোচণ করাও সে-ই যুদ্ধই বটে।

আবার জন্মলগ্ন কিংবা তারও পূর্ব হতে ইন্ডিয়ার যে ভয়ংকর কুৎসিত ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোবৃত্তি কিংবা পরদেশ দখলের যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী বৈশিষ্ট্য তার ইতিহাসের ডিএনএ’তে প্রকটভাবে বিদ্যমান- সেটি সম্মুখে রেখে যে চিন্তক উপরোক্ত সাম্প্রতিক অনুসিদ্ধান্তে যান, তাঁর কাছে দিল্লীর ভূমিকা কিভাবে এখনও ‘দেখার বিষয়ে’ পর্যবসিত হতে পারে! আর তিনি যদি জাতির প্রতিরক্ষা-চিন্তক হন তাহলে তো নয়ই। তাঁকে যে প্রতিপক্ষের সবচেয়ে খারাপ আক্রমণটি বিবেচনা করেই চিন্তা দাঁড় করাতে হয়!

আর এটা কখনো হতে পারে না যে, বাংলাদেশ কারও লাগানো আগুনে জ্বলবে আর এদেশের স্বাধীনসত্তার দাবীদার মুক্তিকামী মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখবে কখন তাদের ভস্মকারী শিখা সেই অগ্নি-সংযোগকারী প্রতিবেশীর চালে লাগছে…। ইশ! কতোই না ভালোবাসা নিয়ে, ঢের বেশী সকরুণ কন্ঠে ফরহাদ ভাই বলছেন- ‘এতোটুকুই শুধু বলা যায় প্রতিবেশীর চালে আগুন লাগলে নিজের ঘরের চালে আগুন ধরা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র’।

কিন্তু চেয়ে চেয়ে দেখার সকরুণ চিন্তা নয় আমাদের সিদ্ধান্ত হতে পারেনা। ফরহাদ ভাই যে আগুনের আশংকা করছেন যদি তা সত্যিই হয়, তাহলে বলব- আসুন ফায়ার সার্ভিসকে তৈরী থাকতে বলি, তৈরী করতে চেষ্টা করি। ফায়ার সার্ভিস যদি লেন্দুপ দর্জি হয়ে উঠে, কিংবা ওঠার আশংকা থাকে- তাহলে আসুন আমাদের জগ-গ্লাস-বালতি-বল সব হাতের কাছে এনে রাখি। সে কাজটি কিভাবে করা যেতে পারে সেই রুপকল্প পেশ না করা পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের এই গুরুত্বপূর্ণ কলামটি উদ্বেগজনকভাবে অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

কিন্তু আশা করা অসংগত নয় যে, ফরহাদ ভাই বিদ্যমান সংকটের গতি-প্রকৃতির সাথে বাংলাদেশের ভবিষ্যত গতি-প্রকৃতি কিভাবে জড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে চিন্তা করছেন। পাশাপাশি পররাজ্য-অনুগত সরকারের ফ্যাসিস্ট ভূমিকার প্রেক্ষিতে- ‘বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’ ও ‘গণপ্রতিরক্ষা’ ধারণার পূনর্মূল্যায়নপূর্বক আমাদের ‘নিজের মুরোদ’ সৃষ্টিতে নতুন পথ-পদ্ধতি আবিষ্কারে কার্যকর দিক-নির্দেশনা তিনি দিতেই পারেন…

আমরাও পারি এগিয়ে যেতে আরো কিছু দূর...

বিষয়: রাজনীতি

৮৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File