তবু ইসলামের কথাই বলতে হবে… খসড়া-০৩ (কমিউনিজম প্রশ্ন)

লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৩:৪৭:০৯ রাত







তাহলে কমিউনিজম?..

০২.

ইসলামকেই আমরা এই দানবীয় সভ্যতার নজরদারি ও আধিপত্য উচ্ছেদে মানবজাতির শেষ এবং একমাত্র গন্তব্য বলছি। এবং বলছি যে, এ কোনো নতুন কথা নয়। ইতিহাসের প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা সাক্ষ্য দিচ্ছে- শুধু ইসলামই ফিরে আসে। ফিরে এসেছে যুগে যুগে, ইসলাম নামেই। তার আরেক মানে হলো- মানবজাতির দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম তথা জালিম-মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসেরই একটা গভীর বিস্তৃত এবং উজ্জ্বলতর অংশ।

কথাগুলো আমরা মোটেই আবেগে বলিনি। কমিউনিজমের ‘খোদা এবং অবতার’ কার্ল মার্ক্সকে টেনে এনেই বলেছি। মানবজাতির অজস্র সহস্র বছরের ইতিহাসকে কোনো কথা-বার্তা ছাড়াই প্রিমিটিভ কমিউনিজম নাম দিয়ে গায়েব করে দেবেন, ছট করে চলে আসবেন হালের দাস যুগে- এটা ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ তো নয়ই, বস্তুনিষ্ঠ পাঠও হতে পারেনা। যদিও নাম দিয়েছেন- ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই একই কথা মধ্যযুগ/ধর্মযুগ/সামন্তযুগ ইত্যাকার প্রোপাগান্ডার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। রক্ত-হৃদয়-বুদ্ধিবৃত্তিতে সর্বাঙ্গসুন্দর পূর্ণাঙ্গ মানবিক অনুভূতিতে আখেরি রাসূলের অনবদ্য ও অনিন্দ্য নেতৃত্বে রচিত ইতিহাসের উজ্জলতম পৃষ্ঠাগুলো না বোঝা কিংবা বুঝতে না চাওয়ার স্পর্ধা নিয়েও বলেছি।

আমাদের শেষ কথা ছিলো- সো, যা'ই হয়েছে, আর যা'ই হচ্ছে কিংবা হোক, মানবজাতিকে, আজ হোক কাল হোক, সেই ইসলামের কথাই বলতে হবে...

০৩.

তাহলে প্রশ্ন কমিউনিজমের কী হবে?...

বিশেষ করে বাংলাদেশের ‘ভালো’ ইসলাম-জানা সম্ভবত একমাত্র কমিউনিস্ট ফরহাদ মজহার যখন বলছেন- ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…’। এখন নয়, বলছেন ২০১২সাল থেকে। সে লেখা ২৪এবং ২৫ডিসেম্বর ছাপা হয়েছিলো তখনকার তুমুল জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশে। ভিন্ন নামে এসেছিলো নয়া দিগন্তে, ১২মে ২০১৬সালে। চিন্তা সাইটে এখনও নিশ্চয়ই আছে। তার ভাষায়-

‘…কমিউনিজম শেষ হয়ে গেছে এটা একটা বাজে গুজব’। ‘বরং আমাদের দাঁড়াতে হবে কমিউনিজমেরই পক্ষে, যেখানে আস্তিক/নাস্তিকের ভেদ দিয়ে রাজনীতি ঠিক হয় না, ঠিক হয় কে জালিম আর কে মজলুম সেই বিভাজন দিয়ে’। তারপর সেই কমিউনিজমের কর্মযজ্ঞের বিস্তৃতি নিয়ে বলেছেন- ‘…গরিব ও নিপীড়িত মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে কমিউনিজম সন্তুষ্ট নয়,… বরং নিপীড়িতের নজর দিয়ে জগত ও ইতিহাসকে দেখা, সব কিছুকেই নিপীড়িতের নজরদারির মধ্যে আনা এবং সব মানুষের স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করা।’ অসাধারণ! হাউ নাইস আ ‘কমিউনিজম’! শুধু এটুকুন না, পুরো লিখাটাই অসাধারণ! বিশেষ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলোর দিক থেকে। এটি তাদের অবশ্য পাঠ্য হতে পারে। এবং যত দিন না তারা তা আত্মস্থ করতে পারছে, তত দিন সেটি নিত্য পাঠ্যও হতে পারে। আবার কমিউনিস্টদের সাথে অন্তত বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের কথা বলার একটু মুচকি হাসি বিনিময় করার দিগন্ত উম্মোচিত করার জন্য তিনি ব্যাপক সাধুবাদও পেতে পারেন। পেতে পারেন নয়, আমরাও উনাকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রসন্ন বোধ করতে চাই।

০৪.

কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…’ বললেও, উনার আত্মবিশ্বাসে ‘মজাদার’ রকমের ঘাটতি আছে। সেই সাথে অন্যের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়ার চিন্তাও লক্ষণীয়। দেখুন-

‘…কমিউনিজম শেষ হয়ে গেছে এটা একটা বাজে গুজব। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই যতদিন থাকবে ততদিন কমিউনিজম কায়েমের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো ঘাটতি হবে না। হতে পারে ভিন্ন নামে, হয়তো ভিন্ন পতাকা হাতে তার আবির্ভাব ঘটবে। হয়তো ভিন্ন ঐতিহাসিক আর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাকে যেভাবে বুঝেছি সেই বোঝাবুঝির মধ্যে ভুল আছে, অসম্পূর্ণতা আছে’।

কমিউনিজম শেষ হয়ে গেছে এটা একটা বাজে গুজব। ঠিক কথা। আমরাও বলি- কমিউনিজম মোটেই শেষ হয়নি। বাংলাদেশের মতো একটি বিপুল সংখ্যাধিক্যের মুসলিমদেশে ইসলাম সম্পর্কে সমূহ জ্ঞানের অধিকারী ফরহাদ মজহারের মতো চিন্তাবিদ দার্শনিক যদি নিজেকে কমিউনিস্ট পরিচয় দিতে অধিকতর সাচ্ছন্দ বোধ করেন, সেখানে আমরা কি করে বলি যে কমিউনিজম শেষ হয়ে গেছে!...

‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই যতদিন থাকবে ততদিন কমিউনিজম কায়েমের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো ঘাটতি হবে না’। তাও সত্য, আসলে কিছু মানুষ তো থাকবেই। কিন্তু গন্ডগোল হলো- ‘হতে পারে ভিন্ন নামে, হয়তো ভিন্ন পতাকা হাতে তার আবির্ভাব ঘটবে’ নিয়ে, এর মানে কি? এ কথাটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ! এটা বুঝলে আমরা হয়তো পরের লাইনটিও বুঝে ফেলতে পারবো।

তো ‘ভিন্ন নামে’ ‘ভিন্ন পতাকা হাতে’র… মানে কী হতে পারে? মানে কি এই নয় যে,

হে দুনিয়ার কমিউনিস্টরা! জালিমের বিরুদ্ধে মজলুম যদি কোথাও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, হতে পারে ‘ভিন্ন নামে’ ‘ভিন্ন পতাকা হাতে’- তাদেরকে তোমরা অপর ভেবো না?...

(চমৎকার ব্যাপার! এতো প্রসঙ্গান্তরে আল্লাহর কথারই প্রতিধ্বনি যেনো...

‘স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন, আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করেছি, কাল যদি অন্য একজন রসূল এই শিক্ষার সত্যতা ঘোষণা করে তোমাদের কাছে আসে, যা আগে থেকেই তোমাদের কাছে আছে, তাহলে তোমাদের তার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে …’০৩:৮১)

যদি তাই হয়, এবং যদি কমিউনিজমের উপর আমরা এতোদূর আস্থা না রাখতে পারি যে- কমিউনিজম স্বনামে, স্ব-নীতি কৌশলসহ হাজির হবে, তাহলে ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…’ বলার কী অর্থ?... জালিমের প্রতিপক্ষে যদি ‘অন্যকিছুর’ও অন্যপতাকা হাতে অন্যনীতি-কৌশল নিয়ে আরো প্রবলভাবে মজলুমের পক্ষে হাজির হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় তাহলে শুধু শুধু কমিউনিজমের কথাই-বা বলতে হবে কেনো? এটা কি ফরহাদ ভাই প্রতীকী অর্থে বললেন? নাকি এর আভিধানিক অর্থ সাম্য, সমতা ইত্যাদি অর্থে? সে রকম কিছু হলে তো অতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলার দরকার নেই যে, ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…’

০৫.

তাছাড়া কমিউনিজমে যেহেতু ঈমান-বেঈমানের ব্যাপার নেই, স্বর্গ-নরক টাইপ কোনো ধর্মীয় সংস্কার নেই সুতরাং, তা থেকে বেরিয়ে আসা মনস্তাত্তিক দিক থেকেও অনেক সহজ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তারপরও তিনি কমিউনিজম ছাড়বেন না! তার কাছে জালিম আর মজলুমের লড়াই মানেই কমিউনিজম! ‘কমিউনিজমকে যে নামেই ডাকি, কিছুই আসে যায় না’।

যদি ভিন্ন কোনো নামে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই জারি হয়, সে লড়াই তিনি মেনে নেবেন বটে, কিন্তু চিহ্নিত করবেন কমিউনিজম হিসেবে!

আগামীকাল যদি ইসলামও এ লড়াইয়ে নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করে (যদিও ইসলাম সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে, সেই হাবিল-কাবিল থেকেই কোনো অবস্থায় জালিমের প্রতিপক্ষে তার লড়াই মুলতবী রাখেনি এবং ভবিষ্যতের শেষ সম্ভাবনাময় দিনটি পর্যন্ত- ইলা ইয়াওমাল কিয়ামাহ, তা নিরবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখবে, সে প্রসঙ্গে আমরা একসময় বলবো) তখন তিনি ইসলামকেও কমিউনিজম নামেই চিহ্নিত করবেন! এবং বলবেন ইসলাম কমিউনিজমেরই অন্য নাম, ‘কমিউনিজমকে যে নামেই ডাকি, কিছুই আসে যায় না’…

এ যেনো ভুল প্রেমিকার প্রতি অর্থহীন, ক্ষেত্রবিশেষে ধ্বংসাত্মক পক্ষপাতিত্ব! ইসলামের প্রতি উনাদের দূর্বার আকর্ষণ। কিন্তু কখনোই সর্বান্তকরণে ইসলাম গ্রহণ করতে চান না। কারণ ইসলাম বৌদ্ধ ধর্ম নয়... এখানে মন চাইলে সাড়ম্বরে 'সিনেমা হলে' যাওয়া যায় না। মন চাইলেই লালনের আখড়ায় বেলেল্লে কিংবা বিহ্বল হয়ে থাকা যায়না... মন চাইলেই নিত্য-নতুন তরুণী-তন্বীদের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠা যায় না... অর্থাৎ, শুধু চিন্তার বিচ্ছুরণ কংবা কথার ফুলকি নয়, বরং স্রষ্টাকে সাক্ষী রেখে মানুষের পৃথিবী ও মানবতার প্রতি প্রতিশ্রুত জীবন যাপন ইসলামে অপরিহার্য... মন চাইলেই আপনি সেই নৈতিক, কর্মীক ও আধ্যাত্মিক বাঁধনে নৈমিত্তিক আসা-যাওয়া করবেন তা অসম্ভব...

সুতরাং, ইসলামকে যত ‘সুন্দর’ বলুন, গভীরভাবে উপলব্ধি করুন- ইসলামের গন্ডী উনাদের ধাতে সয় না। তখন প্রয়োজন হলে, ইরানের কমিউনিস্টরা যা করেছেন- মুর্তাজা(আল্লাহর প্রিয়) অভিধায় সিক্ত হযরত আলীকেও কমিউনিস্ট বানিয়ে নেবেন! উম্মতের লুকমান আবু যার’কে বানিয়ে দেবেন সমাজতন্ত্রী! এবং কমিউনিস্টদের মোমিন হতে না বলে, উলটো বলে দেবে- ‘…তোমরাই মোমিন’…

প্রথম প্রেমের স্মৃতি একটু বেশিই দাগ কাটে ঠিক, কিন্তু তাকে অনর্থ আশায় নিরন্তর বয়ে বেড়ানো কতটুকু ঠিক? কিছুটা আরাম হয়তো বোধ হয়, কিন্তু প্রকৃত যন্ত্রণা লালিত হয়ে শাখা-প্রশাখা ছড়ায়! তাতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই ক্ষতি বৈ উপকার হয় না…

০৬.

‘…হয়তো ভিন্ন ঐতিহাসিক আর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাকে যেভাবে বুঝেছি সেই বোঝাবুঝির মধ্যে ভুল আছে, অসম্পূর্ণতা আছে’

কার্যত এবং সমূহ তত্ত্বগত সংকটে নিপতিত মূমুর্ষূ কমিউনিজম সম্পর্কে এ হলো ফরহাদ মজহারের আশার দিক। অর্থাৎ, বিশ্ব ইতিহাসে কমিউনিজমের বৈপ্লবিক ভূমিকা চিরতরে খতম হয়ে গেছে অনেকের মতো তা তিনি মেনে নিতে নারাজ। শুধু ‘সেই বোঝাবুঝির ভুল’ এবং ‘অসম্পূর্ণতা’টুকু জালাই করে নিলেই হলো। কমিউনিজম আবার দাঁড়িয়ে যাবে!...

ভালো কথা।

যেকোনো মতাদর্শই যখন তার ‘স্থানিক ও কালিক’ রুপায়নের ক্ষেত্রে গিয়ে বড় কোনো ব্যার্থতায় নিপতিত হয়, যা হতে পারে বলে সে মনে করতো না, সেক্ষেত্রে ব্যার্থতা-পরবর্তী সময়ে তার অনুরাগী কর্মী-সমর্থকদের মাঝে এধরণের ভাবনা উদয় হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এখন কেউ যদি মনে করেন সেই ‘ভুল’ এবং ‘অসম্পূর্ণতা’ নতুন বাস্তবতায় অতিক্রম করা সম্ভব, তাহলে তার মতাদর্শের দিক থেকে তিনি তা করতে চাইতেই পারেন।

অর্থাৎ, ফরহাদ মজহার যদি ‘বদ্ধ, সংকীর্ণ ও ইসলামী আতংকের রুগী হয়ে বাংলাদেশে হাজির’ থাকা কমিউনিজমকে নতুন করে নির্মাণ করতে চান, সেজন্য যদি ‘কমিউনিজমের দিক থেকে ধর্মকে বিচার করবার সঠিক নীতি ও কৌশল সম্পর্কে’ নিরন্তর আলোচনায় প্রবৃত্ত হন, এবং যদি মনে করেন- ‘আমাদের দেশে আগামী দিনে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী আদর্শগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে ইসলাম প্রশ্নের একটা মীমাংসা দরকার’, এবং কমরেডদের ‘এই বাস্তবতাটুকু’ মানানোর কায়মনো প্রয়াস চালান যে- ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম নিয়ে আলোচনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই’, তারপর ‘সেই দিক থেকে কমিউনিস্টদের মধ্যে কীভাবে আলোচনা হলে তা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে সেই দিক নিয়েও’ বিস্তর চিন্তা-গবেষণা করেন এবং করতে থাকেন, তাতে কারো কোনো বিশেষ মাথা ব্যাথার কারণ থাকতে পারেনা। থাকবেই-বা কেন?...

০৭.

কিন্তু কেউ যদি ‘আধা ইসলাম আধা কমিউনিজমে’র নতুন কোনো দীন-ই-ইলাহী রচনার স্বপ্নে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, তাহলে সমূহ মাথা-ব্যাথার অবকাশ আছে বৈ কি!

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইনসাফ প্রশ্নে ইসলাম কোনো ধর্মে বর্ণে আপোস করে না। একজন একচ্ছত্র খলিফার বিপরীতে একজন সামান্য বিধর্মী ইহুদীর মামলা জেতা ইসলামে ইতিহাস নিতান্তই স্বাভাবিক দৃষ্টান্ত। একইভাবে জালিম-মজলুমের দ্বন্দ্বেও আস্তিক-নাস্তিক ভেদ ইসলাম অস্বীকার করে। ইসলাম বলে- মজলুম আর আল্লাহর মাঝে কোনো আড়াল থাকেনা(বুখারি)। আপনার মুসলমান ভাই যদি জালিম হয়, তার নির্বিচার পক্ষপাত নয়, বরং তাকে প্রতিরোধ করুন, জুলুম থেকে বের করে নিয়ে আসুন- এটাই আপনার ভাইয়ের জন্য সাহায্য(বুখারি)। যদি সে অত্যাচারী শাসক হয়, তার প্রতিপক্ষে সত্য উচ্চারণ করুন, সেটাই সর্বোত্তম, আফজালুজ-জিহাদ(আহমদ, তিরমিজী)। ইসলাম বলে- আল্লাহ নিজের উপর জুলুমকে হারাম করেছেন, হারাম করেছেন তার বান্দাদের উপরও(বুখারি, তিরমিজী/কুদসী)। ‘একটি বেতের আঘাতের জন্যও কিয়ামতের দিন প্রতিশোধ নেওয়া হবে'। ‘এমনকি তা যদি একটি চড়-থাপড় বা লাথির পর্যায়েও হয়ে থাকে’(আহমদ)। এ তো কতিপয় হাদীসের সারাংশ মাত্র।

অন্যদিকে আল্লাহর কিতাব, কুরআন যেনো জালিমের প্রতিপক্ষে নিরন্তর লড়াইয়ের ময়দানেই আছে। কুরআনের এপ্রোচ ক্যামোন দেখুন-

‘এ জালেমরা যা কিছু করছে আল্লাহকে তোমরা তা থেকে গাফেল মনে করো না(১৪:৪২)… তারপর আল্লাহ সতর্ক করে দিচ্ছেন! ক্যামোন সতর্ক! ‘এ জালেমদের দিকে মোটেই ঝুঁকবে না’, ঝুঁকলে? -‘জাহান্নামের গ্রাসে পরিণত হবে’ ‘এবং তোমরা এমন কোন পৃষ্ঠপোষক পাবে না যে আল্লাহর হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারে, আর কোথাও থেকে তোমাদের কাছে কোন সাহায্যও পৌঁছুবে না (১১:১১৩)…

এটা জালিমদের পরিণতি নয়, জালিমদের দিকে ঝোঁকার পরিণতি! আর জালিমদের কি হবে?... আল্লাহ হুমকি দিয়ে বলছেন, বেশী তাড়াহুড়ো করো না, ‘…খুব শীঘ্রই জানতে পারবে(২৬:২২৭)। শুধু তা’ই কী! আল্লাহ তাঁর কিতাবের পরিচয় দিচ্ছেন কিভাবে! এই হলো আমার অবতীর্ণ কুরআন, মানবতার বন্ধু মুমিনদের জন্য এ হলো নিরাময় এবং রহমত আর জালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না(১৭:৮২)।

এই হলো ইসলাম। জালিম ও মজলুমের দ্বন্দ্বে ইসলামের অবস্থান। একজন মুসলমান যখন জালিমের প্রতিপক্ষে দাঁড়ায়- তার ঈমানী দায়িত্ব থেকেই দাঁড়ায়। মুসলমান হিসেবেই দাঁড়ায়। পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি থেকেই দাঁড়ায়। জালিমের প্রতিপক্ষে আল্লাহ ও তাঁর আখেরি রাসূলের অবস্থান একজন মুমিনকে এতোদূর সাহসী ও নি:শঙ্ক করে তোলে যে ফেরাউন এজিদদের মতো ভয়ংকর অপশক্তি সমূহকে বিশেষ কোনো উত্তেজনা ছাড়াই তীব্রভাবে থোড়াই কেয়ার করতে পারে!

০৮.

তো… মায়ের কাছে নানার বাড়ির কাহিনী বলার মতো- কোনো কোনো পক্ষ এখন জালিম ও মজলুমের দ্বন্দ্বে এতোটাই অনর্থ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছেন যে, তারা আস্তিক-নাস্তিক, ইহকাল-পরকাল ভেদ তুলে ফেলতে চান। বলেন- ‘পরকালের কথা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই বরং মোমিনের কাজ’। তাছাড়া- ‘পরকালের কথা তো আমরা ইহকালেই বলি’, সুতরাং, ইহকাল-পরকালের ব্যাপার একপাশে রেখে ‘রাজনীতিটা’ ঠিক করো। বাক্যের মারপ্যাঁচে ছট করে ধরা না গেলেও, এ ধরণের কথা যারা বলেন, প্রকারান্তরে তারা ইসলামের ভিত্তিমূলেই আঘাত করেন। তাওহীদ-রিসালাত-আখিরাতের ভিত্তিভূমি থেকে মুসলমানদের ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বের করে নিতে চান।

তারা হয়তো মানবতার প্রতি কোনো সদিচ্ছা থেকেই করতে চাইছেন। কমিউনিস্ট এবং ইসলামিস্ট এক করার অভিপ্রায় থেকেও তা হতে পারে। কিন্তু এটা যথার্থ পন্থা না। এবং বলতে গেলে পন্থাই না, অন্যকিছু। জালিমের প্রতিপক্ষে ইসলামপন্থিদের দাঁড়ানোর যে ভিত্তি, সেই তাওহীদ সেই রিসালাত সেই আখিরাত যদি অপ্রাসঙ্গিক কিংবা অগুরুত্বপূর্ণই হয়ে ওঠে, তাহলে ঐক্যের আর থাকলো কী, ইসলামিস্ট গ্রুপটাই তো বিধ্বস্ত হয়ে গেলো। অবশ্য তখনই কেবল ফরহাদ মজহারের ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…’ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আরো কিছুটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরী হবে। ফরহাদ মজহার কি তা’ই চান?(!) হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। এতোটা সাহস কী উনার আছে? কে জানে?... হয়তো আছে। হয়তো আমরা তাঁকে যতটুকু চিনি, তিনি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কিছু!... হতে পারে।

০৯.

কিন্তু ঈমানদারদের একটা অজেয় দূর্গ আছে। একটা পরীক্ষিত রক্ষাকবজ আছে।

‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’

আল্লাহর কিতাবের ১০৯নম্বর সূরার ০৬নম্বর আয়াত। এর মানে কিন্তু- সেকুলারিজম নয়। বরং উল্টোটা। সত্য থেকে মিথ্যা, ইসলাম থেকে জাহেলিয়াত আলাদা করে ফেলা। আস্তিকতা-নাস্তিকতা অথবা ঈমান ও অংশীবাদের পদচারণা আলাদা করে দেয়া। ইহকাল-পরকালের ভেদ সুস্পষ্ট করে দেয়া।

ইসলাম বলে- ‘জ্ঞান তোমাদের হারানো সম্পদ, যেখানে পাও কুড়িয়ে নাও’, জ্ঞানের জন্য কাফির মুনাফিক আমেরিকা চীন সর্বত্র বিচরণ করুন আপনি, সমস্যা নেই। কিন্তু কেউ যদি বলে তুমি আমার কমিউনিজম একটু মেনে নাও, আমি তোমার ইসলামও একটু মেনে নেবো- তাহলে তাকে ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ বলা ভিন্ন ঈমানদারের কোনো গতি থাকেনা।

কেউ আবার একে মানবিক সম্পর্কের দিক থেকে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবরুদ্ধতাও ভাববেন না। এই ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’এর ভেতর মদীনার রাষ্ট্রের মতো অভূতপূর্ব উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা পরিসর বসবাস করছে। আজকের সভ্যতার ‘সভ্য’রা বিজ্ঞান-দর্শনের হাজারো কলকাঠি নিয়ে যতই নড়াচড়া করুক, সেই একান্তই মানবিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানবজাতি ঐ একবারই দেখেছিল। যাঁরা তাঁদের দ্বীনের প্রশ্নে কোনো অংশীবাদের শিকার হয়নি। চিন্তা করুন। সেই ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’এর ভেতর শান্তির জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধির মতো কুন্ঠাহীন ছাড়ও ছিল। আল্লাহর রাসূল নিজ হাতেই কেটে দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ শব্দটি! এরচেয়ে বেশি আর কী হতে পারে?... শান্তির জন্য, সহাবস্থানের জন্য, ঐক্যের জন্য ইসলামের চেয়ে সহিষ্ণু উদার ক্ষমাপরায়ণ আর কে?... এসবই রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সত্যপন্থী সাথীরা করেছেন। করেছেন কিন্তু ভেদ-অভেদ বিবেচনায় রেখেই, দেউলিয়া হয়ে নয়…

১০.

যদিও ইসলাম মতাদর্শগতভাবে সেলফ-প্রটেকটেড, কেউ চাইলেই এর একটা ব্যাখ্যা দিয়ে পার পেয়ে যাবে, তা সন্দেহাতীতভাবেই অসম্ভব। তবু যেকোনো বিকৃতির প্রতিপক্ষে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপই মুমিনের কাজ। কারণ ইসলাম নিয়ে মানুষ যেখানে যতটুকু বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, সেখানে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কিংবা আধ্যাত্মিকভাবে ততটুকু কিংবা তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানবজাতি।

সুতরাং, ‘ভুল’ এবং ‘অসম্পূর্ণ’ কমিউনিজম তো নয়ই। আবার ‘আধা ইসলাম আধা কমিউনিজম’ও নয়, একত্বের ধর্ম সমস্ত খন্ডায়নের তীব্র প্রতিপক্ষে-

‘…তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের ওপর ঈমান আনলে আর কিছু অংশের সাথে কুফরী? তোমাদের মধ্যে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে। এবং আখেরাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে? তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন’(০২:৮৫)।

আমাদেরকে বরং সেই সন্দেহাতীত নির্ভূল এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামের কথাই বলতে হবে… এবং পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হবে ইসলামেই, কুরআনের আহ্বান-

‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো, এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না’…(০২:২০৮)

বিষয়: রাজনীতি

১০১৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

377445
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০৯:০১
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক অনেক ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ
377478
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০৯:৩৫
শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ!...

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File