ইসলামী শরীয়ার কালোত্তীর্ণ প্রায়োগিক নমনীয়তা: ‘শ্বশুরবাড়ীতে বউদের দায়িত্ব’ এবং ‘যৌথপরিবার’প্রসঙ্গ(লাস্ট পার্ট)
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১০:১২:১১ রাত
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা কেউই কিন্তু বলিনি শ্বশুর-শ্বাশুরির প্রতি দায়িত্ব পালন বউদের উপর ‘নাম ধরা’ শর্তহীন ফরজ বা ওয়াজিব। বরং ইসলাম কেন তা বউদের ওপর সরাসরি বাধ্যতামূলক করেনি তার যৌক্তিকতাও খানিকটা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি(দেখুন-)। কেউকেউ দেখলাম অপ্রাসঙ্গিকভাবে রান্না-বান্না নিয়েও অনেক দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখিয়েছেন। আমরা বলেছি- ইসলামের অনন্য ফ্রেমওয়ার্কের চৌহদ্দিতে সবাই তাদের সুবিধামতো দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবে। কে বাজার করবে, কে মাছ কুটবে, কে বেগুন ভাজি করবে- এগুলো ইসলাম এভাবে বলবে না, বলে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কোন ক্ষেত্রেই না। এভাবে বললে সেটি অন্যকিছু হতো, ইসলাম হতো না। হজরত ফাতেমা আ. এর জীবনে আমরা কী দেখি? তিনি এজন্য শুকরিয়া আদায় করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সংসারের নানাবিধ কাজের মধ্য গৃহস্থালির কাজের দায়িত্বই তাঁকে অর্পণ করেছেন। আমাদের দেশে যেহেতু গৃহস্থালির কাজের মধ্য রান্না-বান্নাও একটি, সো, নারীরা সেটি করে। পরিস্থিতিভেদে সেটির ব্যতিক্রমও হয়। এসব নিয়ে নাম ধরে ফরজ-ওয়াজিব খোঁজা নিতান্তই অর্থহীন।
০২.
তারপর-
‘যে ব্যক্তি পেট পুরে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে সে প্রকৃত ঈমানদার নয়’(বায়হাকী)।
এই যে দায়িত্ব, একজন মুসলমানের প্রতি অন্যজনের দায়িত্বে ইমানের সংযুক্তি, সেই সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে এক পক্ষে শ্বশুর অন্যপক্ষে শ্বাশুরি চিরতরে মাহরাম হয়ে ওঠা, মেয়ের জন্য নিজের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব একান্তই লঘু করে দেয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ টেনে- স্ট্যাটাস, নোট, কমেন্ট সর্বত্রই আমাদের বক্তব্য ছিল- ‘আমরা সবাই দায়িত্বশীল, সবাইকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’(বুখারি, মুসলিম)। সুতরাং, শ্বশুরবাড়ির প্রতি তথা শ্বশুর-শ্বাশুরির প্রতিও বউদের দায়িত্ব আছে। একে পারষ্পরিক দায়িত্বও বলা যায়। দায়িত্ব বউয়ের প্রতি শ্বাশুরির, শ্বাশুরির প্রতি বউ। শরীয়ার মাকাসিদও তা’ই। বিযুক্তি নয়, সংযুক্তি। ভাঙা নয়, গড়া। স্বার্থপরতা নয়, সম্প্রীতি। উদাসীনতা বা দাসত্ব নয়, দায়িত্ব।
আবার দায়িত্বের ব্যাপারেও আমাদের অবস্থান একদম পরিষ্কার, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। দায়িত্ব প্রত্যেকের সামর্থের সীমায়, সর্বাবস্থায় পারষ্পরিক। এবং দায়িত্ব মাত্রই খেদমত করা নয়। কেউ কারো খবরদারি মেনে নেয়াও নয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা শুধু ফোনে খোঁজ নেয়াও হতে পারে। দায়িত্বকে আমরা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অর্থে এনেছি যে, কেউ যেনো একে অন্য থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে চিন্তা না করতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, এখানে আমাদের কেউ দায়িত্ব মুক্ত হয়ে উঠলে দেখা যাবে অনেক ফরজ ওয়াজিবও তখন পালন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। আবার স্বামীর আনুগত্য বলতেও আমরা বারবার বলেছি সেটি হবে- শরীয়ার সীমা ও স্ত্রীর সামর্থের ভেতরে। তাছাড়া বউদের প্রতি শ্বশুর-শ্বাশুরির দায়িত্ব নিয়েও কথা আসতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে, শ্বশুর-শ্বাশুরির প্রতি বউদের দায়িত্বকে আমরা প্রথমত এবং সার্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক/মানবিক/সামাজিক/পারিবারিক দায়িত্ব বলছি। এবং তা মাকাসিদে শরীয়া, শরীয়ার সামগ্রিক মূলনীতি এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। এরসাথে বউ-শ্বাশুরির ঝামেলাকে এক করে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। সেই দ্বন্দ্ব মোটেই ফিকহ বা ধর্মতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নয় যে, ‘শ্বশুরবাড়ির প্রতি বউদের কোন দায়িত্ব নেই’- প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বরং এর ভেতর দিয়ে অন্তত এই মুহূর্তে, বাংলাদেশের সমাজে এমন বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে, যেখান থেকে বউ-শ্বাশুরি-সন্তানসহ আমরা কেউই রক্ষা পাবো না। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসি।
কেউকেউ এখানে আবার নারীমুক্তি প্রসঙ্গ আনতে চাইবেন। বলতে পারেন- নারীদের ওপর দায়িত্বের দুর্বহ বোঝার কথা। সত্য বলতে কি, এধরণের বিবেচনা-বিচ্যুত কথা-বার্তা পাশ্চাত্যের ‘নারীমুক্তি’ রোগেরই উপসর্গ। অবশ্য পশ্চিমাদের ইতিহাসকে যারা মানবজাতির ইতিহাস জ্ঞান করে, তাদের জন্য এ খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, দূরদর্শী ধ্যানে প্রতিটি সমাজের তাৎক্ষণিক দায়িত্ব পালনের সাধনাই প্রথমত ব্যক্তিকে এবং শেষত সে সমাজকেও মুক্তি দিতে পারে। একজন মানুষ সচেতনভাবে তার প্রতি নির্ধারিত দায়িত্ব যতটুকু পালন করতে পারে ততটুকুই সে মুক্তি দাবী করতে পারে। এবং প্রকৃতপক্ষে ততটুকুই সে মুক্ত। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, বাঙ্গালী মুসলমান নারীদের সম্মুখে- ইসলামের কাঙ্ক্ষিত প্রগতির অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এর চেয়ে বেশী অতীতে কোনো সময়ই ছিলো না। এবং সেটি পাশ্চাত্যের ‘নারিমুক্তি’ এজেন্ডা ছুঁড়ে ফেলে, সমূহ পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়েই সম্ভব। সমাজের/পরিবারের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নিজের কর্তব্য নির্ধারণের ওপরই নির্ভর করবে, এ জাতির নারীরা এবংকি এ জাতি, কতদূর এগুবে।
০৩.
মূল আলোচনায় আসা যাক। আমাদের কতিপয় ভাই-বোন পূর্বাপর কথায় কথায় ফরজ-ওয়াজিব আওড়াতে খুব পছন্দ করছেন। যেনো শরিয়ার এই পরিভাষাগত ফরজ-ওয়াজিব ছাড়া আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই, থাকেনা। মানুষের নৈতিক, সামাজিক, মানবিক এমন অনেক দায়িত্ব কি ইসলামে নেই, যেগুলো ফরজ-ওয়াজিব হিসেবে আমরা ডিফাইন করিনি/করিনা কিংবা করতে পারি না, আবার উপেক্ষাও করতে পারিনা? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আমাদের দায়িত্বসমূহের প্রাইওরিটিও কী চেঞ্জ হয় না? উপরের আলোচনায় আমরা কি দেখলাম- প্রতিবেশীকে খাওয়ানো কি আমাদের জন্য ফরজ? ওয়াজিব? কিন্তু পরিস্থিতি বিশেষে তাকে ‘অন্নদান’ আমাদের ঈমান-অবিচ্ছিন্ন দাবী হয়ে ওঠে। আবার প্রতিবেশীকে শুধু কথা দিয়ে কষ্ট দেয়ার খবরে রাসূলুল্লাহ জনৈকা অধিক নফল সালাত, নফল সাওম আদায়কারী মহিলাকেও জাহান্নামী ঘোষণা করার হাদীসটি আমাদের জানা আছে। উনারা অবশ্য এসব শুনতে রাজি নন। উনাদের এক কথা- ওটা কি ফরজ!?- সেটা কি ওয়াজিব?!
মাকাসিদে শরীয়ার সাথে একান্তই সংগতিপূর্ণ, যেটি শরীয়া মূলনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনায়(দেখুন-) আমরা দেখেছিলাম- দুটো গ্রাউন্ড থেকে শ্বশুর-শাশুরির প্রতি বউয়ের দায়িত্বপালন ওয়াজিব হয়ে যায়। প্রথমত, স্বামীর আনুগত্যের জায়গা থেকে। স্বামী যদি শরীয়ার সীমা ও স্ত্রীর সামর্থের ভেতরে তার পিতা-মাতার প্রতি কোন কর্তব্য পালনে নির্দেশ দেয়, স্বামীর আনুগত্য সূত্রে এই দায়িত্ব পালন স্ত্রীর জন্য ওয়াজিব। কারণ, সূরা নিসার চৌত্রিশ নম্বর আয়াত স্বামীর আনুগত্যকে ‘একাজ ওকাজ’ বলে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। এবং সুন্নাহর ভাষায়ও সেটি সামগ্রিক। যেমন, হাদীস বলছে- ‘যা নির্দেশ করবে তা-ই করবে’…।।
দ্বিতীয়ত, স্বামীর পিতা-মাতা যদি স্বামীর গৃহেই অবস্থান করে তাহলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার অধিকার হিফাযতের অংশ হিসেবে শ্বশুর-শ্বাশুরির প্রতি দায়িত্ব পালন বউদের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। দায়িত্ব পালনের ধরণ অবশ্য ভিন্নভিন্ন হতে পারে। সেটি ছোট-বড় খেদমত থেকে শুরু করে খানিকটা আন্তরিক সঙ্গদান কিংবা সার্বিক তত্ত্বাবধান, এবংকী খোঁজ খবর নেয়াও হতে পারে।
এ পর্যন্ত বলে আমরা রেখে দিতে পারি। এ হলো প্রাসাদাসক্ত সেকেলে সুন্নিদের ফিকহ বা ফতোয়া চর্চার ‘অলস’ প্রক্রিয়া। রাজা-বাদশাদের খানাপিনা খেয়ে, তাদের ব্যবস্থাপনায় বইপত্র ঘেঁটে, মানতিক/যুক্তিবিদ্যার পরিত্যক্ত পদ্ধতিতে এটা-ওটা মিলিয়ে(কিয়াস করে) একটা ফতোয়া দিয়ে দিলাম। তারপর যারা মানলো তারা একপক্ষ, যারা মানলো না তারা অন্যপক্ষ। এরপর গ্রুপিং, দালাদলি, কাঁদা ছোঁড়াছোঁড়ি ইত্যাদি…
০৪.
কিন্তু সমস্যা আসলে এসব ফরজ-ওয়াজিব নির্ণয়, ফতোয়া প্রদান ইত্যাদি নয়। সমস্যা আরো গভীরে। মানব সমাজ কলেজ-মাদ্রাসার কোনো ক্লাস নয় যে, ফতোয়া ঘোষণাই এখানে যথেষ্ট! বরং ফতোয়া গ্রহণক্ষম একটি কার্যকর জনগোষ্ঠী তৈয়ারই এখানকার পয়লা চ্যালেঞ্জ। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা সেই ফর্মূলাই প্রয়োগ করেছেন মানব জাতির ওপর। শুধু প্রয়োগ করেননি, সেটিকেই প্রায়োগিক মূলনীতি হিসেবে অক্ষয় করে রেখেছেন তাঁর কিতাবে। সেভাবেই এসেছে নামাজ-রোজা-হজ্জ্ব-যাকাতের বিধান… সেভাবেই হারাম ঘোষিত হয়েছে মাদক-সামগ্রী… সেভাবেই নিষিদ্ধ হয়েছে রিবা…
অর্থাৎ, একটি সমাজে ইসলামের কোনো মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি সামগ্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। পরিবেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত ইসলাম সেই সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের প্রেক্ষিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকেই পরিচালিত হবে। এবং সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে- স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে শরীয়ার মূলনীতি মাকাসিদে শরিয়ার অনুগামী হয়ে ক্রমধারা নীতি অবলম্বন করে। তার মানে, ফতোয়া দাতার অন্যান্য সমূহ-যোগ্যতা নিস্ফল হয়ে যায়, যদি তিনি সমাজের ইসলামিক বিনির্মাণের সংগ্রাম/প্রক্রিয়া থাকে বিযুক্ত থেকে যান। এবং এজন্যই মক্কা-মাদীনা-আল আজহারের ব্যাপক উপস্থিতিতেও মাওলানা মওদূদী, হাসান আল-বান্না, ইউসুফ আল কারযাভীদের প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্য হয়ে ওঠে, এবং সংগত কারণেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের উপযোগিতা।
বিষয়টি বোঝার জন্য, ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার ধারণাটি আমরা আরো গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারি। আমাদের বুঝতে হবে, প্রথমত, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ। কারণ সকল পর্যায়ের সমস্ত ব্যবস্থাপনার প্রায়োগিক নীতিমালা এতে সন্নিবেশিত আছে। কিন্তু অপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায়? হ্যাঁ, দ্বিতীয়ত, অপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায়ও পূর্ণাঙ্গ। মানব সমাজের এমন কোন অবস্থা সৃষ্টি হবে না, যে অবস্থায় ইসলাম তার অনুসারিদের জন্য সামগ্রিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে রাখেনি। আরো স্পেসিপিক বলতে গেলে, তৃতীয়ত, ইসলাম প্রত্যেকটি মানুষের(every single individual) যেকোনো সময় এবং যেকোনো স্থানের জন্যও পূর্ণাঙ্গ।
এবং এটাই ইসলামের অনন্য কালোত্তীর্ণ বিশ্বজনীন সৌন্দর্য্য।
অর্থাৎ, একটি অনৈসলামিক/ সেমি ইসলামিক সমাজে ইসলাম যখন দাঁড়ায়- ইসলাম বারবার তাওহীদের ঘোষণা দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় মহাজাগতিক নিরবিচ্ছিন্ন সংযুক্তির একক অখন্ডতা। সেই সাথে ইসলাম তার চিরন্তন মাকাসিদ নিয়েই একটি সমাজে প্রবেশ করে। তার কালজয়ী মূলনীতির চোখেই সে সমাজের দিকে তাকায়। সমাজে ভালো ও শরীয়ার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ এবং নিদেনপক্ষে সাংঘর্ষিক নয়, এমন প্রত্যেকটি রীতি(উরফ)কে ইসলাম আত্মস্থ করে। এভাবেই এগোয় ফতোয়া তৈয়ার প্রক্রিয়া। ফতোয়ার একটি ডেফিনেশন এই হতে পারে যে, এটি স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় মাকাসিদে শরীয়ার অভিমুখে ইসলামের নীতিমালার সাথে সংগতিপূর্ণ প্রায়োগিক সমাধান।
০৫.
কারো কারো হয়তো মনে আছে, আমরা প্রথম যে নোটটি লিখেছিলাম- শিরোনামে ছিলো- ‘বাংলাদেশী এক ইসলামিস্ট বোনের স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে’। এই যে ‘বাংলাদেশী’ বলা, তা সচেতনভাবেই। কারণ, কেউ যদি কোনো ফতোয়া দিতে চায়, মাকাসিদে শরিয়া ও শরীয়া মূলনীতি পর্যালোচনার পর তাকে অবশ্যই সে সমাজব্যবস্থার সর্বশেষ অবস্থার পূংখানুপূংখ বিশ্লেষণ করতে হবে, তার কাছে থাকতে হবে সেই সমাজের যতদূর সম্ভব সুদূর অতীতের ঐতিহাসিক চিত্র এবং মনস্তত্ত্ব। তারপর দেখতে হবে তার সাম্প্রতিক প্রবণতা। তাই যে জমিনের জন্য ফতোয়া হবে, ফতোয়াদাতাকে যথাসম্ভব সেই জমিনেরই একজন হতে হয়। অন্যদের থেকে আমরা পদ্ধতি নিতে পারি, চিন্তা নিতে পারি, পর্যালোচনার সূত্র নিতে পারি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। তাই, আমেরিকায়-বৃটেন-জিম্বাবুয়ে-ইতালি বসে ইউটিউবে লেকচার শুনে বাংলাদেশে ফতোয়া ছাড়ার কোনো অবকাশ নেই। আবার নারীমুক্তির কাতারে দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে অর্থহীনভাবে শিথিল করে ফেলারও সুযোগ নেই। (এর আগে পুরুষতন্ত্র প্রতিরোধের নামে এদেশের নারী সমাজকে পুরুষ-বিদ্বেষী করে তোলার প্র্য়াস আমরা দেখেছি। মুক্তির নামে একটি পক্ষ তাদেরকে তাদের পিতা-ভাই-স্বামীর প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে) সমাজকে কাঠামোগত এবং মূলগতভাবে এগিয়ে নেয়ার ওপরই এসব ব্যাপার ছেড়ে দিতে হবে। সমাজের ওপর আরোপ করে নয়।
আপনি বাংলাদেশের সমাজে দেখুন, এই সমাজের ট্রেন্ড কী? –ভেঙ্গে যাচ্ছে…। অন্য দিকে গড়ে ওঠার অমিত সম্ভাবনার দিগন্ত। কারা ভাঙছে? –সাম্রাজ্যবাদী দাজ্জাল-ভ্রাতাদের স্থানীয় লাঠিয়াল ও তাদের সামরিক বুদ্ধিবৃত্তিক বুর্জোয়া প্রেতাত্মারা। অন্যদিকে ইসলামিস্টরা। মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধ, তাওহীদের সামগ্রিক চেতনা এবং সমাজব্যবস্থাপনার যোগ্যতার্জনের মাধ্যমে তারাই একমাত্র গড়ার কারিগর হওয়ার সামর্থ রাখে। ভাঙ্গন-উন্মূখ পরিবার-ব্যাবস্থার স্বার্থপরতা-জনিত শিথিল বন্ধনকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে তারাই। তাদের সতেজ দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে পরিবার থেকেই শুরু করতে পারে আমাদের মেরুদন্ড সোজা করে রাখার জিহাদ। এখানে প্রতিকূল পরিবেশ, অসচ্ছলতাসহ অন্যান্য অজস্র সমস্যাসংকুল অবস্থায় ধৈর্য-দয়া-সহিষ্ণুতা-দায়িত্বশীলতার সাথে আমাদের বিপুল সংখ্যক মা-বোন হাসি মুখে সংসার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও। পুরুষরাও তাদের নানা সীমাবদ্ধতা ও বেকারত্ব সব মিলিয়ে চেষ্টা করে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর। এভাবেই হয়তো ‘মৃত্যুপুরীতে’ও বেঁচে যাচ্ছে কোনো কোনো পরিবার। অজস্র সমস্যার মাঝে এটুকু সম্ভাবনা আমাদের প্রবোধ দেয়। একজন ইসলামিস্ট এ পরিবেশের উন্নতি চাইবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, একে আরো প্রীতিপূর্ণ ও একই সাথে অধিকতর শরীয়াসম্মত করতে জোর প্রয়াস চালাবে। কিন্তু ইসলামিস্ট না বলি, একজন সভ্য মানুষের জন্য এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে, তিনি এই সম্প্রীতির সম্পর্ক, যেটি এখানকার মানুষের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত, সেটিকে এবংকী ফিকহ-সমর্থিত ‘উরফ(সামাজিক রীতি)’ বিবেচনার বাইরে রেখে শুধুমাত্র ফরজ-ওয়াজিবের ধুয়া তুলে সংসারকে একটি ব্যবসায়িক/বাণিজ্যিক ‘চুক্তি’ আকারে হাজির করতে। মোটেই অস্বীকার করছি না, স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে ইসলাম হয়তো ওরকম চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্কের অনুমোদন দেয়, এবং মেনে নিচ্ছি বিয়েটাও একটা চুক্তি। কিন্তু ইসলাম তো চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় নিরুপায় অবস্থায়, ইলেভেনথ আওয়ারে। তাও পরিবার সুরক্ষার লক্ষ্যেই। কিন্তু ইসলামের তৃপ্তি তো দয়া-মায়া-স্নেহ ভালোবাসাময় পরিবারেই। সেই পরিবারের জন্য ইসলামের নিরবিচ্ছিন্ন আকুতিতে সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই আপ্লুত হয়। আমাদের সমাজে বিরাজিত এই বৈচিত্র্যময় পারিবারিক বন্ধনের আভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার সুযোগে যারা সমস্ত পরিবার ব্যবস্থাকে ‘শুরু’ থেকেই নিছক একটি চুক্তিতে পর্যবসিত করতে চান, তারা আত্মঘাতী। এবং ভ্রাতৃঘাতী দুষ্টচক্রেই আবর্তিত হচ্ছেন। -কিভাবে? আসুন সেদিকেও খানিকটা দৃষ্টি দেয়া যাক।…
০৬.
এখানে, এখন, আপনি যদি ফরজ-ওয়াজিবের কথা তোলেন, তা তো শুধু এক দিক থেকে উঠবে না। অন্যদিক থেকেও উঠবে। তখন দেখা যাবে, স্বামীর পক্ষ থেকেও প্রশ্ন উঠছে- স্ত্রীর লিখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ স্বামীর ওপর ওয়াজিব নয়। স্ত্রীর ভরণ-পোষণও নিয়ে স্বামীরা রিলাক্স বোধ করতে পারেন। কারণ কুরআন বলছে, ‘বিত্তবান তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত, সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে’( তালাক:৭)। এক স্ত্রীর মাধ্যমে যখন স্বামীর সামগ্রিক সহযোগিতার ব্যাপার ইসলামের নামে নিগৃহীত হবে, তখন অন্তত স্বচ্ছল পুরুষদের পক্ষ থেকে আসতে শুরু করবে বহুবিবাহ প্রসঙ্গ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, এক স্ত্রীকে ‘কথিত’ ফরজ/ওয়াজিব দায়িত্ব পালনার্থে যেটুকু লাগে সেটুকু শুধু সময় দেবে(আবদুল্লাহ ইবনে উমর প্রমুখরা সেটি বের করেছেন- চল্লিশ দিনে একদিন)। কারণ, স্বভাবতঃই দ্বীনদার ইসলামিস্ট স্বামী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ‘লানত’ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এবং তার জান্নাতকে আগলে রাখতে মা-বাবার খেদমতে তার অবসর উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত করবেন।
তারপর নিজের অনুপস্থিতির সময়টুকুতে ভিন্ন কাউকে নিয়োগে যে বাড়তি খরচ হবে, সেটি তার নিজস্ব পারিবারিক খরচ থেকে সেটি কাট হবে। এতে প্রথমত যা হবে, অন্তত আমাদের সমাজে বিশেষত ইসলামিস্টদের মাঝে যেটুকু পরিবারিক সুকুন বা প্রশান্তি আছে সেটি বিপর্যস্ত হবে। এবং সেই স্বপ্নও একদিন সবার অলক্ষ্যে উবে যাবে। ফলশ্রুতিতে সমাজভীরু বা খানিকটা আল্লাহভীরু তরুণ-তরুণীদের মাঝে বিবাহভীতি প্রকট আকার ধারণ করবে। সৌদি আরবের মতো এদেশেও আমরা শুনবো অমুক প্রখ্যাত ফকীহ মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন বিয়ে করেননি। বিয়ে করলে যে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন ব্যাহত হবে!! তারপর সমাজের ভাঙ্গন-প্রবণতার সাথে আরো বিপুল তরুণ-তরুণী ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় দেখতে দেখতে যুক্ত হয়ে পড়বে। পর্দার ফরজও তখন ক্রমাগত আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। তারপর এক ধরণের সামাজিক নৈরাজ্য। এবং সে নৈরাজ্য মনে হয় পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে বেশীই হবে। কারণ আমাদের এতো বেশী জনসংখ্যা, এতো বেশী প্রবাসী, এতো তরুণ-তরুণী, সেই সাথে এতো বিধ্বস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা! আর বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানীদের সাথে আমরা যারা বিয়েকে আরো সহজ করার কথা ভাবি, একইসাথে, তাদের স্বপ্নও অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।
একপর্যায়ে, শারিরিক মানসিক আর্থ-সামাজিক এবং উদ্ভূত অন্যান্য জটিল প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবার ভেঙ্গে যাবে। পরিবার ভাঙ্গার পর মেয়েটির যাওয়ার জায়গা কোথায়? সন্তানাদি থাকলে তাদের কি হবে? অর্থাৎ, শ্বশুর বাড়িতে বউদের দায়িত্বপালন না করার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরবর্তী পরিস্থিতি সমাধানে ইসলাম প্রতিশ্রুত বিকল্পসমূহ কি আমাদের সমাজ নিশ্চিত করতে পেরেছে? -পারেনি। আগে তো সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের মূল কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে উপরি কাঠামো নিয়ে ফরজ-ওয়াজিব কপচানো নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা নয় কি?...
০৭.
সুতরাং, আমাদের মুফতিদের এই মুহূর্তের দায়িত্ব হলো, উপোরোক্ত বিষয়সমূহসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যাপার সমূহ বিবেচনা পূর্বক বাংলাদেশের আর্থ-সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে বিপর্যয়-রোধী এমন একটী ভারসাম্যপূর্ণ ফতোয়া জেনারেট করা যাতে আমরা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অবস্থান থেকে সংগতিপূর্ণভাবে ইসলামের অভিমূখে এগুতে পারি, এবং হতে পারি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অধিকতর শরীয়া-পাবন্দ।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
বিষয়: বিবিধ
১২১০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর ও যথার্থ বলেছেন
কতিপয় বিশেষজ্ঞের কথা বাদ রাখলে, আমাদের দেশের হাজার হাজার ওলামায়ে কিরামের মধ্য থেকে "মাকাসিদে শরীয়া" সম্পর্কে স্বচ্ছ শিক্ষা ও জ্ঞান রাখেন এমন সংখ্যা কত???
প্রকৃতপক্ষে আমরা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও জীবনাচরণ বর্জন করে কেবলই পূঁথিগত বিদ্যা জাহির ও স্বার্থপরতার অনুসারী এক অদ্ভূত জাতিতে পরিণত হয়েছি- যাদের কথা ও কাজের তথা অন্তর ও বাইরের মিল পাওয়া অলীক কল্পনা মনে হয়!! যতসামান্য ব্যতিক্রমীরা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান!!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ছেলে যে তার বাবা মায়ের সেবা করতে বাধ্য , তাতেই বাগড়া বাঁধায় , এটাই সমস্যা সৃষ্টি করে ।
এখনকার স্ত্রীরা বিয়ের পর পরই স্বামীকে তার বাবা মা ভাই বোনদের কাছ থেকে আলাদা করতে উঠে পড়ে লাগে ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন