শরিয়া মূলনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা: প্রসঙ্গ ‘যৌথপরিবার’ এবং ‘শ্বশুরবাড়িতে বউদের দায়িত্ব’
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৯:৩৮:৫৭ রাত
“...এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট নিজ নিজ অধিকার দাবি করে থাক আর আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন"(০৪:০১)।
০২.
ইসলাম শ্বশুরবাড়ির প্রতি নারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে নাম ধরে নির্দেশ করেনি। অনাহুত তার্কিকদের ভাষায় ফরজ-ওয়াজিব করেনি। আমরাও বলছি তা’ই। শুধু তা’ই নয়, এই নিঃশর্ত-বাধ্যতামূলক না করাকে আমরা বরং বলছি সমূহ কল্যাণদায়িণী! ইসলামের অনন্যসাধারণ দূরদর্শী ইনসাফ! ইনসাফ বউ’র প্রতি। আবার মা-বাবার প্রতিও!
বউ’র প্রতি ইনসাফ- প্রথমত, সংসারের গুরুত্বপূর্ণ ইগজেকিউতিভ বা কার্যনির্বাহী হিসেবে তার ওপর আছে স্বামীর আনুগত্যের ভার। দ্বিতীয়ত,অন্যের সন্তান হিসেবে নিজের মা-বাবার প্রতিও তার কিছু লিখিত-অলিখিত দায়-দায়িত্ব আছে। এখন শ্বশুর-শ্বাশুরির দায়-দায়িত্বও যদি নিঃশর্তভাবে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তা নিঃসন্দেহে জুলুমই হবে।
আবার পিতা-মাতার উপরও ইনসাফ, কিভাবে? -শুধু বউয়ের ওপর দায়িত্ব পড়লে মা-বাবার যথাযথ অধিকার হতো না। কারণ বউ আসে একটি অনির্দিষ্ট সময় পর, সে পর্যন্ত মা-বাবার প্রতি দায়িত্বপালন স্থগিত হয়ে যেতো। দ্বিতীয়ত, বউ আসে সন্তান-সূত্রে, এবং সংগত কারণে সন্তানের সাথেই তার ফাংশন বেশী থাকে। শ্বশুর-শ্বাশুরির প্রতি তার দায়িত্বপালন স্বতঃস্ফূর্ত নাও হতে পারে।
অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণেই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বপালন সহজ হয়, বউয়ের নয়। মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব একচ্ছত্র করে দিয়ে বউয়ের সাথে দায়িত্বপালন জনিত সমস্ত টানাপোড়েনও ইসলাম বন্ধ করে দিয়েছে।
ইসলাম বলছে-
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না, তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে করো শিষ্ঠাচারপূর্ণ আচরণ(১৭:২৩)। (আরো দেখুন- লুকমান:১৪, আহকাফ:১৫)। সন্তানের জায়গা থেকে এখানে মিসেস ওহী’দের 'ইসমাইল মেংক' যুক্তি কাজ করে না। (দেখুন-https://www.facebook.com/shahadat.s...)। যা'ই হোক, ওটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
০৩.
এখন প্রশ্ন হতে পারে পিতা-মাতার প্রতি এই দায়িত্ব কি ছেলে মেয়ের সমান-সমান? রাসূলুল্লাহ বলেছেন কুরআনের একাংশ অন্যাংশের তাফসীর, আসুন প্রথমে আমরা কুরআনে খুঁজে দেখি। কুরআন বলছে-
“পুরুষ নারীর কর্তা। কারণ, আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এ জন্য যে পুরুষ ধন-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং, পুণ্যময়ী স্ত্রীরা আনুগত্যপরায়ণ হয় এবং পুরুষদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্বাবধানে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে” (০৪:৩৪)।
কুরআন এখানে পুরুষকে নারীর কর্তা ঘোষণা করে তার অনুগত্য নারীর উপর বাধ্যাতামূলক করেছে। এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার অধিকার হিফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। স্ত্রীর দায়িত্ব এখানে স্পেসিফাই(খাস) করার পর, আম আয়াতের দায়িত্ব তার ওপর শর্তাধীন বা লঘু হয়ে যাচ্ছে। কারণ স্বামীর আনুগত্য, এবং তার অনুপস্থিতিতে তার সংসারের দায়িত্ব নারীর কাধে বর্তানোর পর অন্যত্র অবস্থানরত পিতা-মাতার দায়িত্ব নারীকে ইসলাম সমান ভাবে দেয়নি। মীরাস বন্টনের ক্ষেত্রেও সেটি স্পষ্ট করা হয়েছে, এবং পিতা-মাতার দায়িত্ব বেসিক্যালি পুরুষ সন্তানের উপরই দেয়া হয়েছে। নারীর দায়িত্বগুলো হাদীসেও সেভাবেই এসেছে-
“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে, রমযানের সাওম পালন করবে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে এবং স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে- জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা করে, সে দরজা দিয়ে প্রবশে কর।” (আহমদ)।
তবে মেয়েরা যতদিন মা-বাবার কাছে থাকবে, এবং পরবর্তীতে যতটুকু সুযোগ সামর্থ হবে তাকে অবশ্যই পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব, একই শিষ্ঠাচারপূর্ণ সদয় আচরণ করতে হবে। এবং সেটুকুর মধ্যেও ‘উহ’ না বলার বিষয় প্রযোজ্য। কিন্তু পিতা-মাতার খেদমতের অজুহাতে কোনভাবেই সংসার ভাঙ্গার কোনো অবকাশ নেই। (দেখুন-https://www.facebook.com/shahadat.s...)
০৪.
উপরে বর্ণিত সূরা নিসার চৌত্রিশ নম্বর আয়াত থেকে আমরা দেখছি-
এক. পুরুষ নারীর কর্তা, নেতা, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, ক্যাপ্টেন ইত্যাদি যা'ই বলার বলতে পারেন।
দুই. পূণ্যবতী নারীরা সেই কর্তা বা স্বামীকে মেনে চলে, তথা অনুগত্যপরায়ণ হয়।
তিন. স্বামীর অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্বাবধানে স্বামীর অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।
আসুন এগুলো খানিকটা ক্লারিফাই করা যাক।
প্রথমত, পুরুষ নারীর কর্তা। কুরআনে শব্দটি হলো 'কাওয়াম। যার অর্থ হলো ব্যবস্থাপক বা তত্ত্বাবধায়ক। বলা যেতে 'লিগাল এন্ড র্যাশনাল লিডারশীপ'। তার আদেশ নিষেধের সীমা কতটুকু? স্কলাররা বলছেন- শরীয়ার সীমা এবং স্ত্রীর সামর্থ যতটুকু। কেউ কেউ অবশ্য এ নিয়ে কূট-তর্ক করেন। তোলেন স্বামীর আদেশ-নিষেধের যৌক্তিকতার প্রশ্ন। আচ্ছা, কোনটি যোক্তিক, কোনটি অযোক্তিক তার ফয়সালা যদি স্ত্রীর হাতে থাকে তাহলে স্বামীর আনুগত্য করতে বলার কী মানে থাকতে পারে? সুতরাং, স্বামীর কোনো আদেশ আপাত অযৌক্তিক মনে হলেও শরীয়তে ও সামর্থের সীমানায় স্ত্রীকে অবশ্যই আনুগত্য করতে হবে। 'স্বামী যখন নিজ প্রয়োজনে স্ত্রীকে ডাকবে তখন সে যেন তাতে সাড়া দেয়, যদিও সে চুলায় (রান্নার কাজে) থাকে (তিরমিযী, নাসাঈ)।
(তবে ইসলাম এখানে স্বামীর দিক থেকে তার আদেশ-নিষেধে ফিল্টার বসিয়েছে, মাতা-পিতার পর স্ত্রীর প্রতি সদয় সুন্দর আচরণ ও তার অন্যান্য হকের ব্যাপারে ইসলাম সবচেয়ে বেশী সতর্ক করেছে, শাসিয়েছে এবং আল্লাহর ভয় দেখিয়েছে! স্ত্রীর কাছে ভালো হওয়াকে ইসলাম স্ট্যান্ডার্ড করেছে। টোটাল উদ্দেশ্য হলো- স্ত্রীকে এতোটা সচেতন করা যেন স্বামীকে কর্তৃত্ব ফলাতে না হয়, আবার স্বামী এতোটা সদয়-প্রেমিক করে তোলা যেন স্ত্রী কোথাও তার উপর 'কর্তৃত্ব' অনুভব না করে। এবং সেটাই হতে পারে আদর্শ ইসলামী পরিবার।)
দ্বিতীয়ত, পূণ্যময়ী নারীরা হয় আনুগত্যপরায়ণ। এটাকে আমরা প্রেম-পরায়ণও বলতে পারি। একজন পুরুষ ভালোবেসে কি না করতে পারে একটি নারীর জন্য! ঠিক তেমনি নারীরাও। আল্লাহ তাদের ফিতরাত বর্ণনা করছে এভাবে- তারা হয় আনুগত্যপরায়ণ! স্বামীর জন্য কিছু, আরো কিছু করতে পারার এই যে আকুতি প্রয়াস! এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ-
“সর্বোত্তম স্ত্রী হচ্ছে, যখন তুমি তার দিকে তাকাও- তোমার অন্তরে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। যখন তুমি কোনো আদেশ করো, সে তা পালন করে। যখন তুমি অনুপস্থিত থাকো সে তোমার ধ-সম্পদ ও তার ওপর তোমার যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ করে।”(নাসাঈ)
এখানে আমরা আনুগত্যের সীমা-নির্দেশও পেয়ে যাই। স্ত্রীর দায়িত্বের চৌহদ্দিও অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যায়।
তৃতীয়ত, তারা স্বামীর অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্বাবধানে স্বামীর অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে। হাদীস গেঁটে স্কলাররা বলছেন, এখানে ‘হিফজুল গাইব’ বাক্যাংশের মাধ্যমে স্বামীর যাবতীয় জিনিস, যা তার অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর নিকট আমানত হিসেবে রক্ষিত থাকে, তার হিফাজত বোঝানো হয়েছে। যেমন উপরোক্ত হাদীস। বলা হচ্ছে- ‘যাবতীয় অধিকার’।
"হে মুমিনগণ! জেনে শুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং বিশ্বাসঘাতকতা করো না তোমাদের পরস্পরের আমানতের ক্ষেত্রেও"(০৮: ২৭ )।
০৫.
তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বামীর উপস্থিতেতে স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীর আনুগত্য। স্বামীর সম্মতি ছাড়া তার ঘরে কাউকে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া, এবংকী তার অনুমতি ব্যতীত নফল রোযাও বৈধ নয়!(বুখারী,মুসলিম)। এক্ষেত্রে আনুগত্যের সীমা কী হতে পারে তা আমরা ইতোপূর্বে বলেছি- এক. শরীয়ার সীমা, দুই. স্ত্রীর সামর্থ।
আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে কুরআন বলছে- আল্লাহর হেফাজত ও তত্বাবধানে স্বামীর অধিকার সংরক্ষণের কথা। এখানে 'আল্লাহর হিফাজাত ও তত্ত্বাবধানের' এক অর্থ হতে পারে- আল্লাহ তার জন্য যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন, আল্লাহর স্মরণে লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করা।
হাদীস ব্যাখ্যা ‘যাবতীয় অধিকার’। এরমানে স্ত্রীর নিজের হিফাযত থেকে শুরু করে স্বামীর পছন্দ-অপছন্দ পর্যন্ত। ‘…তোমাদের অধিকার হল, তারা যেন ঐ সব লোককে তোমাদের বাড়ীতে প্রবেশ করার অনুমতি না দেয়, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)। এরমধ্যে রয়েছে স্বামীর ঘর-সংসার, ধন-সম্পদ সব। ‘…স্ত্রী তার স্বামী-গৃহের দায়িত্বশীল এবং তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’(বুখারী,মুসলিম) এখন প্রশ্ন হলো স্বামী-গৃহের মধ্যে স্বামীর মা-বাবা পড়েনা? যাবতীয় অধিকারের মধ্যে কী স্বামীর দায়িত্বের আওতায় আছে এমন সব কিছুর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্বও বর্তায় না?
একইভাবে ইসলামের সামগ্রিক পারিবারিক সংস্কৃতির গন্ডিতে যেখানে নারীকে বাস্তবিক কারণে তার নিজের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব হালকা করে দেয়া হয়েছে সেটি তো সংগত কারণেই তার শ্বশুর-শ্বাশুরির দিকে আসে না?
যারা বলে বর্তায় না, তারা 'শ্বশুর-শ্বাশুরির দায়িত্ব' ইসলাম থেকে আসেনি প্রচার করে স্বামীর পরিবারে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আবার নিজের পিতা-মাতার প্রতি খেদমতের কথা বলে সংসার ভাঙ্গা ছাড়া উপায় দেখে না! শেষে হয়তো দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে নিরুপায় চোখের জলে নিজেকে ভাসিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের সমাধানে এগুবে। আল্লাহ মাফ করুন। “মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎকর্মে নিষেধ করে”(০৯: ৬৭ )। পক্ষান্তরে “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করে”(০৯: ৭১ )।
০৬.
"আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে(০৪:৩৬)।
আল্লাহ নির্দেশ দেন ন্যায়-নীতি, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের এবং নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ ও অবাধ্যতা-বাড়াবাড়ি হতে৷ তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো(১৬:৯০)৷
বিষয়: বিবিধ
১৪০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন