ইসলামে ‘শ্বশুরবাড়ি’ ও ‘যৌথ পরিবার’ বিতর্ক: বাংলাদেশি এক ইসলামিস্ট বোনের স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১০:৩১:২৯ রাত
জনৈকা রাবেয়া বসরী ওহী সম্প্রতি তার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘শ্বশুরবাড়ীর প্রতি দায়িত্ব পালন’ - এই টার্ম টার উৎপত্তি ইসলাম থেকে আসে নি। কোরানে বা হাদীসে কোথাও বলা হয়নি, "হে নারী জাতি। শ্বশুরবাড়ীর মানুষদের প্রতি তোমাদের এই এই দায়িত্ব। সবসময় তাদের অনুগত হয়ে থাকবে”।
শুধু তা-ই নয়। এরপর লিখলেন- “মূলত এটা হিন্দু ধর্মের একটা রীতি। সানতন ধর্মের "কণ্যাদান" প্রথা থেকে এর উৎপত্তি।” এরপর কন্যাদান প্রথা ব্যাখ্যা-পূর্বক তার সোশাল-এনথ্রোপোলজিক্যাল জ্ঞানের জানান দিলেন- “যৌথ পরিবারের উৎপত্তিও এখান থেকেই এসেছে”।
এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে এবং একটি ইউটিউব লিঙ্কের বরাত দিয়ে তিনি ফতোয়া দিলেন- “যৌথ পরিবার ইসলাম-সম্মত নয়”। এবং বললেন- “ইসলামী রীতি হচ্ছে একটা মেয়েকে শুধু তার স্বামীর আনুগত্য করতে হবে, স্বামীর পরিবারের নয়, বা স্বামীর আত্মীয়স্বজন কারো নয়। স্বামী ছাড়া আর কেউ তাকে ইনস্ট্রাকশন দেয়ার বা তার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার রাখে না”। আরো বললেন- “স্ত্রীকে একটা প্রাইভেসীপূর্ণ পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া স্বামীর দায়িত্ব”। (দেখুন-https://www.facebook.com/CreatorsMessage/posts/10205627116258115?fref=nf)
০২.
‘প্রাইভেসীপূর্ণ পরিবেশ’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন, ক্লিয়ার না। তবে এর মধ্য- ‘তুমি, আমি আর আমাদের সন্তান/ এই নিয়ে আমাদের পৃথিবী’-জাতীয় একটি নিরেট পুঁজিবাদী টোন আছে। ‘স্বামী ছাড়া আর কেউ তাকে ইনস্ট্রাকশন দেয়ার বা তার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার রাখে না’- এরমানে কী? স্বামীই সর্বেসর্বা? স্বামী যা বলবে তা-ই মেনে নিতে হবে? তাহলে তো বিতর্ক শেষ।
ইসলাম যেহেতু স্বামীর আনুগত্য করতে বলেছেন, আর স্বামী যদি বলে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির প্রতি এই এই করো, তাহলে তা-তা করাও তো ইসলামেরই নির্দেশের আওতায় চলে আসে।
কিন্তু মিসেস রাবেয়া এবং এই প্রকৃতির ‘আধুনিক’ নারীরা তারস্বরে তখন বলে উঠবেন- না..না… আমরা তা বলিনি। স্বামী যা খুশি তা নির্দেশ দিতে পারেন না। আসলেও তা-ই, স্বামীও আসলে যা খুশি তা-ই নির্দেশ দিতে পারেন না। তাহলে উনি যে বললেন- ‘স্বামী ছাড়া আর কেউ…’-সে ব্যাপারে একটু পরে আসছি…
০৩.
ইসলাম মূলত ভালোবাসা-স্নেহ-মায়া-মমতাপূর্ণ সুন্দর একটি পরিবার চায়। সেটি একক হতে পারে, যৌথও হতে পারে। ইসলামী নৈতিকতা ও নির্দেশনার সীমানায় হতে পারে আরো নানা ফর্মের। রাসূলুল্লাহ বলেছেন- যারা বড়দের শ্রদ্ধা করেন না, ছোটদের স্নেহ করেন না, এবং যারা সৎ কাজের আদেশ দেন না ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করেন না- তারা আমাদের কেউ নন। সাংঘাতিক ব্যাপার!
তাহলে ইসলামের আহ্বান হচ্ছে-
আসুন আমরা একটি সুন্দর পরিবার গড়ি।
যেখানে ইসলাম শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি না হোক, শুধু বড় বা বৃদ্ধ হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে রেখেছে। যেখানে পূত্রবধূ না হোক, শুধু বয়সে ছোট হওয়ার কারণে স্নেহ করা দায়িত্ব বলে দিয়েছে- সেখানে কী আর-কিছু বলার অপেক্ষা রাখে?
ইসলাম কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপায় না(০২:২৮৬)। হতে পারে, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি কেনো, স্বয়ং স্বামীর প্রতি কোন দায়িত্ব পালনে কখনো কখনো যে কারোই কষ্ট হতে পারে। তিনি চাইলে তা নিরসনের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারেন। ইসলাম মোটেই পুরুষতান্ত্রিক নয়, আবার নারীতান্ত্রিকও নয়। স্বামীর আনুগত্য ফরজ বলে ইসলাম সর্বাবস্থায় সেটিকেই নারীর গন্তব্য করে ফেলেনি। তাকে নিজের জন্য সর্বোত্তম সমাধান বেছে নেয়ার অপশন দিয়ে রেখেছে। যেমন- সূরা নিসার ৩৪ আয়াতে স্বামীকে পরিবারের ‘ব্যাবস্থাপক’ নিযুক্ত করার পরের আয়াতে আবার বলে দিয়েছেন-
“আর যদি কোথাও তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিগড়ে যাবার আশংকা দেখা দেয় তাহলে পুরুষের আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ এবং স্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ নির্ধারণ করে দাও৷ তারা দুজন সংশোধন করে নিতে চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসা ও মিলমিশের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন ৷ আল্লাহ সবকিছু জানেন , তিনি সর্বজ্ঞ৷”
তাহলে মিসেস রাবেয়া যে বললেন- ‘স্বামী ছাড়া আর কেউ তাকে ইনস্ট্রাকশন দেয়ার বা তার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার রাখে না’- এর মানে কী? আসলে তো স্বামীও যা খুশি তা ‘ইনস্ট্রাকশন’ দিতে পারেন না, করতে পারেন না ‘ইন্টারফেয়ার’ও! তাহলে তিনি যে আগ বাড়িয়ে স্বামীকে সর্বেসর্বা বানিয়ে দিচ্ছেন!
০৪.
হ্যাঁ, এ এক জটিল মনঃস্তত্ত্ব! এই মনঃস্তত্ত্বের একটি দিক এই হতে পারে যে, স্বামীকে আপাত ‘সর্বেসর্বা’ করে তুলে(যদিও এই স্বামী-সর্বস্বতাও হিন্দু ধর্ম-প্রসূত) পরিবার বিচ্ছিন্ন করে প্রকারান্তরে নিজের মতো করে তোলার সচেতন বা অর্ধচেতন খায়েশ।
আমরা একশ্রেণির নারী-পুরুষ আছি যারা- নিজেদের পুঁজিবাদী জীবন-কাঠামোর উপর ইসলামের ব্যানার ঝুলিয়ে ‘গাছেরটাও তলারটাও’ খাওয়ার বন্দোবস্ত করি। অনেকের কাছে ফিদ-দুনিয়া হাসানাতাও, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও’এর অর্থও তা’ই। যেমন ধরুন- নামাজ পড়বো কিন্তু দামী জায়নামজ, সুখোষ্ণ পরিবেশ ছাড়া চলে না! রোজা রাখবো, সাহরী ও ইফতারে বিপুল খাদ্য সমাহারে সংযমের মূল চেতনা মাঠে মারা যাক সমস্যা নেই!
এই সব মহিলাদের মনোবৃত্তিও অনেকটা তা’ই। পর্দা করবো দামী হিজাব না হলে চলে? ফজরের নামাজ না হয় পড়লাম কিন্তু তারপর লম্বা ঘুম দিতে হবে যে! নাস্তা বানাতে মন চাইলো না, দামী নাস্তা কিনে আনলাম ইত্যাদি… এই তালিকায় পুঁজিবাদের আরো অনেক ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদী খায়েস যুক্ত হতে পারে…। এসবই খারাপ, তা বলছি না। কিন্তু কেউ যদি এটিকেই স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে নিতে চায়, এবং চালিয়ে দিতে চায় ইসলামের নামে- তখন আসলে বিতর্কে জড়াবো না জড়াবো না করেও জড়িয়ে যাই।
যেমন ধরুন- কোনো কারণে যৌথ পরিবার, অর্থাৎ, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি…এড হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রে উপরোক্ত খায়েশ হয়তো আপাতত পূর্ণ হয়ে ওঠেনা। তাই বলে, ইসলামের পারিবারিক শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসার চিরন্তননীতিকে অনুপ্রাণিত না করে, ফতোয়া দিয়ে দেবো- ‘যৌথ-পরিবার ইসলাম-সম্মত নয়’?
তাহলে তো ‘বৃদ্ধ-নিবাস’কে ইসলাম-সম্মত করে নিতে হয়। কারণ- যৌথ পরিবার না থাকলে বৃদ্ধ মা-বাবারা কোথায় যাবে। আর বাবা-মা থাকলে অন্যান্য ছোট দু’এক জন ভাই-বোনও থাকতে পারে। আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা খুব স্বাভাবিক। এমন হয়নি যে আমরা একটি/একাধিক সন্তান আমাদেরর মা-বাবাকে দেখা-শোনার জন্য আলাদাভাবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ রাখি।
তাছাড়া অর্থনৈতিক ব্যাপারই কি যথেষ্ট? বৃদ্ধ বয়সে মানুষ যে তার আপনজনদের অন্তরঙ্গ সঙ্গ চায় তার কি হবে? সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- আজকের বউ ‘আমি’ই তো আগামী কালের শ্বাশুড়ি, আমি কি আমার জন্য একই অবস্থা কামনা করি? আমি যদি করেও থাকি, ইসলাম আমার জন্য সেটি কামনা করে না। এজন্যই ইসলাম এতো সুন্দর। “…হতে পারে কোন জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না ৷”(০২:২১৬)
সো, আপনি যদি সত্যিই একজন ইসলামিস্ট হন- তাহলে ‘প্রাইভেসিপূর্ণ পরিবেশ’ নয়, পর্দার মধ্যে থেকে আপনার দায়িত্ব পালন করুন। ইসলামে কন্যাদানের কোনো বিষয় নেই। একই ভাবে স্ত্রৈ্ণ(স্ত্রী-বশ) হওয়ারও কোনো ব্যাপার নেই। সেটিও হিন্দু ধর্ম থেকেই এসেছে। হিন্দু মেয়েরা শিবের পূজা করার এটাও একটা কারণ যে শিব স্ত্রৈণ ছিলেন।
০৫.
বলে রাখা ভালো- উপরের আলোচনায় শুধু মিসেস রাবেয়ার স্ট্যাটাসের লিখিত অংশটুকু বিবেচনা করা হয়েছে। যদি কেউ বিষয়টিকে ইসলামের ফিকহী অবস্থান থেকে সিদ্ধ করতে চান, তাহলে আলোচনার ধরণ অন্যরকম হবে। পুরো বিষয়টি তখন ফিকহ-শাস্ত্রের সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষপট-জনিত নমনীয়তার দিকে গড়াবে। সে অলোচনা প্রয়োজন হলে অন্যদিন করা যেতে পারে…
বিষয়: বিবিধ
১৭৪০ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর আলোচনা / জবাব
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
আপনাকেও ধন্যবাদ।
অপরিচিত কারো ব্লগ পড়ে আন্তরিক মন্তব্যের জন্য...
যাজাকাল্লাহ...
পরিচিত হবার আগে সবাই "অপরিচিত" থাকে
পরিচয় দেয়া-নেয়া আমাদের জীবনবৃত্তকে প্রসারিত এবং বৈচিত্রময় করে!
সত্যিই, পরিচিত হওয়ার আগে সবাই অপরিচিতই থাকে।
অনেক ধন্যবাদ। যাজাকাল্লাহ...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
যাহাকাল্লাহ...
কারও কারও কাছে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি থাকা, সাথে দু-একজন ছোট ভাই-বোন থাকা মানেই যৌথপরিবার... তাদের যুক্তি হলো- শ্বশুড়ের পরিবার এড হয়ে তো দুই পরিবার হয়ে গেলো...
এটি মূলত একটি স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে লিখা, যেটিতে শ্বশুড়বাড়ির প্রতি বউদের দায়িত্বের আলোচনা থেকেই যৌথ-পরিবার প্রসঙ্গ এসেছে...
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...
ইসলামের নামে কথা বলার আগে আমাদের জেনে-শুনে দু'দশ বার ভেবে কথা বলা উচিত।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ...
ধন্যবাদ এমন একটি সময়োপযোগী পোস্টের জন্য ।
চমৎকার সাহসী কমেন্ট করেছেন...
অনেক ধন্যবাদ। যাজাকাল্লাহ...
http://www.bd-first.net/blog/blogdetail/detail/5188/mdmasumbillah/47774#.Vp1fMDN-4e8
http://www.firstbd.net/blog/blogdetail/detail/6441/shahadat.fbw/73555#.Vp6M3k8ifIU
মন্তব্য করতে লগইন করুন