বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘শ্রেণি’আন্দোলন: বাস্তবতা ও ভবিষ্যত
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১১:৫৪:০৬ রাত
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোর ‘বৈষম্য’, ‘অবনমন’ এবং ‘অসম্মানে’র প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের আমাদের বেশীর ভাগের অনুভূতি হলো- তাঁরা দেশের সর্বোত্তম গুণী মানুষ। সাচিবিক আমলাদের তুলনায় তাদের পদমর্যাদা ‘বেশী না হোক’, কম হতে পারেনা! জ্ঞানার্জন, জ্ঞানদান, জ্ঞানসৃষ্টিসহ ‘আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরদের’ প্রতি আমাদের এই শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সেটুকুর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হচ্ছে? -কেন?... এরমানে কি এই নয় যে, তাঁরা আমাদের কাছে ‘সর্বোত্তম গুণী’ হলেও আমাদের সরকারের কাছে নন! সরকারের কাছে আমলারাই বড়, বেশী ‘গুণী’। কিভাবে হলো??...
বি.শিক্ষক-আন্দোলনে পক্ষে-বিপক্ষ খোঁজার চেয়ে এ প্রশ্নের মীমাংসা বেশী জরুরী। আমাদের চিহ্নিত ‘গুণ’ এবং সরকারে প্রত্যাশিত ‘গুণ’ মধ্যে পার্থক্য কোথায় এবং সে পার্থক্য সৃষ্টির ইতিহাস কি? আমরা যে মানদন্ডে ‘গুণ’ বিবেচনা করছি, আমাদের সরকারের কাছে কি অন্য কোনো ‘মানদন্ড’ আছে??...
অন্যদিকে, অন্য একটি প্রণিধানযোগ্য অংশের প্রশ্ন হলো, আমলাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের তো আমরা গুণী বলেই জানতাম। গুণী কেন? -তাদের মেধার সাক্ষর এবং নিরবধ্য জ্ঞানসংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি। কিন্তু উনারা তো যোগ্যতার ভিত্তিতে যাচ্ছেন না। যদি মেধাবীরা শিক্ষক না হন, জ্ঞানচর্চার চেয়ে অন্যকিছু চর্চাই যদি প্রাধান্য পায়- তারপরও কি আমাদের ধরে নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই সর্বোত্তম গুণী? আর গুণী না হলে তার আবার সম্মান কী? ‘অসম্মানে’র প্রসঙ্গ তুলে আন্দোলনেরই-বা কী বৈধতা? আর ‘বৈষম্য’ কিংবা ‘অবনমনে’র ব্যাপারটি তাদের শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গিরই ব্যাপার। সো, সে জায়গা থেকে আন্দোলন সমাজের আর দশটি শ্রেণি-আন্দোলন থেকে পৃথক না।
এখানে প্রশ্ন হলো- শিক্ষকদের নিয়োগ দিচ্ছেন কারা? -সরকার। সো, মেধার মানদন্ড মেইনটেইন না করার জন্য তো সরকারই দায়ী, শিক্ষকরা নন। একইভাবে দলীয়-লেজুড়ভিত্তিক আধিপত্য কিংবা অবাঞ্ছিত পদোন্নতির প্রক্রিয়ার জন্যই বা কারা দায়ী? -আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হয় কিভাবে? -আমাদের রাজনীতিক জ্ঞান-চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিকতা, জাতি হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক গন্তব্য-সচেতনতা ইত্যাদির সংশ্লেষে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে- আন্দোলনের উৎসমূল নির্ণয় না করে, এর পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করার ভেতরে আমাদের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ নেই।
তাহলে ঘটনা কি দাঁড়ালো- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘সর্বোত্তম গুণী’ মানুষ বলছি আমরা! তাদের মধ্য সর্বোচ্চ নির্লজ্জতার সাথে দলীয় রাজনীতির ভেজালও ঢোকাচ্ছি আমরা! আবার তাদের যোগ্যতাহীন করে তোলার প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন রেখে- যোগ্যতাহীনও আমরা বলছি! গুরুতর ব্যাপার…
তারপর জ্ঞানের ময়দান থেকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে তাদের পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে বিতর্কও করছি আমরাই! কেউকেউ বলতে পারেন, আমরা করলাম কই- আমরা তো তাদের মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, অনবধ্য জ্ঞানচর্চার সুযোগ প্রদানসহ জাতির সর্বোত্তম গুণী ব্যক্তি হিসেবে তাদের সকল চাওয়া যথাসম্ভব চাওয়ার আগেই তাদের নিকট হাজির করার পক্ষপাতি। কিন্তু…
“বিশ্ববিদ্যালয় চায় বিশাল বড় “স্বাধীনতা তোরণ”, দেয়ালে দেয়ালে ইতিহাসের মুর্যা ল, বিশিষ্ট ব্যাক্তির ভাস্কর্ষ, আবক্ষ মূর্তি, জলের ফোয়ারা আর নতুন নতুন সীমানা দেয়াল। বিশ্ববিদ্যালয় মৃত ইতিহাসে মুখ লুকোতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয় চায় না মেধাবীরা এখানে থাকুক, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার মত লোকজন এখানে তৈরি হোক”। https://www.facebook.com/alauddin.m.r/posts/1053839694666218?fref=nf
বিশ্ববিদ্যালয় চায় না মানে সরকার চায় না। সরকার চায়না মানে পার্টি চায়না, চাইতে পারেনা। কি ভয়ংকর ব্যাপার- এখানে আমাদের মেধাবীরা থাকবে, সারা দুনিয়ার ইলম মন্থন করে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার মত আলোকিত লোকজন তৈরি হবে এখানে… বিশ্ববিদ্যালয় চাইবে না কেনো? সরকারেরই-বা কি সমস্যা??...
০২.
হ্যাঁ, সমস্যা আছে বৈ কি! এখানে সরকার মানে তো জাতির নয়, কার্যত পার্টির বলা যায় বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এবং পার্টি রাজনীতিতে বিশেষত তৃতীয়বিশ্বে(যারা গণতন্ত্রকে মিনিমাম প্রাতিষ্ঠানিকৃত করতে পারেনি) সরকার মানেই পার্টির ক্ষমতা, মুষ্ঠিমেয়’র আধিপত্য। ফলে সর্বত্র দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিচরণই যেন নিয়তি। বিশ্ববিদ্যালয়ও তার অর্থাৎ, পার্টির একটি বড় ক্ষেত্র। ফলে এমনও হয় যে, শিক্ষকের পরিবর্তে একপর্যায়ে দলীয় মেধাবীরাও নয়- নিয়োগ পায় বিশেষ গোষ্ঠীর মাস্তানরা। এক দুজন নয়, ঝাঁকেঝাঁকে! তখন বিশ্ববিদ্যালয় মেধা ও জ্ঞানচর্চার চেয়ে দালালি, মাস্তানি ও লেজুড়বৃত্তির চর্চাক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই সাথে জনগণের আবেগ-অনুভূতি-শ্রদ্ধা ও সংহতির স্থান হতে ছিটকে পড়ে। গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ক্ষমতালিপ্সু সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের কাছেও তার মূল্য কমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়কেও তখন সে তার অধঃস্তন নগণ্য লাঠিয়াল হিসেবেই বিবেচনা করে! তারপর যখন মনে করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে শিক্ষক-লাঠিয়ালের চেয়ে বেশী প্রয়োজন আমলা-লাঠিয়াল- তখন সে তাই করবে, যা করা উচিত! বর্তমান সরকারও তাই করছে! বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তোলা ‘বৈষম্য’, ‘অবনমন’ এবং ‘অসম্মান’ প্রশ্নের দৈশিক গোড়া/মূল এখানে।
এজন্যই দেখা যায়, বাজেটে লূটপাটের খাত বলে পরিচিত অংশেই বেশী বরাদ্ধ হচ্ছে। শিক্ষা চলে যাচ্ছে অনেক নীচে। কারণ আমলাদের সন্তুষ্টি বেশী দরকার ‘সরকারের’। হচ্ছেও তা’ই। আমলারা সরকারের পার্টি নেতাদের মতো ‘বাগ্মীতা’ ফলাতে শুরু করেছেন সংগত কারণে। ইত্যাদি ইত্যাদি…
এর পরের প্রশ্ন হলো- আমাদের পার্টিগুলো এমন কেনো? আমাদের সরকারই-বা এসব কেনো করে? তার এককথায় উত্তর হচ্ছে- গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, তার আদর্শরুপ দূরে থাক- বিচ্যূতরুপ হিসেবেও আমরা সে রকম কোন গণরাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মার্কিন পূঁজি-বিকাশের স্বার্থে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রয়োজনে ভূখন্ডগত সমূহ-শর্তাধীন স্বাধীনতা পেয়েছি মাত্র! এর ভেতর দিয়েও যেটুকু বিকশিত হওয়ার সুযোগ ছিল- আমাদের বিভক্তির রাজনীতি সেটিকেও অংকুরে বিনষ্ট করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। অর্থাৎ, যদি জাতি হিসেবে সতন্ত্রভাবে বিশ্বসভায় দাঁড়াতে না চাই-
অন্যদের সাথে আমার যদি কোনো তফাৎ না থাকে-
কিংবা আমি যদি চাই সে তফাৎ, সেই স্বাতন্ত্র না থাকুক-
তাহলে আমাদের এতো জ্ঞানচর্চারই বা কী প্রয়োজন! ওদের চিন্তাই আমাদের চিন্তা, ওদের সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতি, ওদের ফিল্মই আমাদের ফিল্ম, ওদের শত্রুই আমাদের শত্রু- তাহলে আমাদের এতো জ্ঞানচর্চার কি দরকার, আমাদের গবেষণা, সৃষ্টিশীলতা কিংবা উদ্ভাবণী চিন্তার পরিপালন নিষ্প্রয়োজন! আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত তো নিতে হচ্ছে না। আমাদের নানা কিসিমের বন্ধুরা যেহেতু আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে দিচ্ছে এবং দিয়েও দিচ্ছে- সো আমরা ওসব জামেলায় কেন যাবো!?... বিশ্ববিদ্যালয় নামে ‘কিছু জিনিস’ আছে, থাক না! সবদেশে আছে, আমাদের দেশে না থাকলে লোকে কি বলবে! সুতরাং, ওগুলো থাক! অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের পার্টির/গোষ্ঠীর যতটুকু কাজে লাগে ততটুকুতে বাঁচিয়ে রাখতে চায়!!
এ বিষয়টি যদি আমাদের কাছে ক্লিয়ার হয়, তাহলে আমরা বলে দিতে পারি- চলমান বি.শিক্ষক আন্দোলন তার লক্ষ্য কতোটুকু পূরণ করতে পারবে তা নির্ভর করছে- তারা কতটুকু ‘জানুযারি সরকারের’ কাজে লাগছে তা, অথবা তারা সরকারের ক্ষমতায় কতোটুকু হুমকি সৃষ্টি করতে পারছে তার উপর। কিন্তু একটি জাতি ‘মেরুদন্ডী’ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে তার বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের সম্মান-স্বাধীনতা-সচ্ছলতা দিতে পারে না। পারবে না। বুঝবেও না।
সুতরাং, যে জাতি এখনও জাতি হিসেবে পরিগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি, সে জাতির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়োগ পেলেই শিক্ষক হন না। তাকে জাতি গঠন-প্রক্রিয়ায় নিজ গরজে গণ-সশ্লিষ্ট হয়ে সংগ্রামশীলতার ভেতর দিয়ে শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক…
বিষয়: বিবিধ
১০৪৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...
মন্তব্য করতে লগইন করুন