সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষে ইসলামঃ আনু মুহাম্মদের গুরুতর তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১৫ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৫৬:৪১ রাত
(‘বাংলাদেশের পাঁচ বিপদ’ কলামের প্রেক্ষিতে, ৫নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত)
আমরা যা-কে পুঁজিবাদ বলি, কোন বিশেষ সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিভাষা পরিহার করে, আল্লাহ তাঁর নিজস্ব সুন্নাহ কালোত্তীর্ণ ভাষায় তা এক বাক্যে বলেছেন এভাবে-
‘বেশী বেশী পার্থিব স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা তোমাদের গাফেল করে রেখেছে’(১০২:০২)।
অর্থাৎ, বেশী বেশী পাওয়ার(extended reproduction) প্রতিযগিতায় কেউ যদি পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে গাফেল(unconscious/falsely conscious) হয়ে- পরিণামে প্রকৃতি পরিবেশ ও মানবিক সমাজ ব্যবস্থাপনার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে, সে-ই পুঁজিবাদী। আর এই পুঁজিবাদীদের ক্রমপরিবর্তিত তাবৎ স্ববিরোধী তত্ত্ব সমষ্টিই হলো পুঁজিবাদ!
কার্ল মার্ক্স ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক ও বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় আদিম সাম্যবাদের পর দাসবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদিকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা বলে, সেই ক্রমধারায় সমাজবাদকে মানবজাতির ভবিষ্যত বলে যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছেন, ইতিহাস বোঝার জন্য তা খানিকটা কাজে লাগলেও, তা-কে অমোঘ মনে করার কোন কারণ নেই। বরং সমূহ বিপদ আছে! সেই বিপদই আজও মার্ক্সবাদীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! সেই বিপদেই এখনও বন্দী আমাদের প্রিয় লেখক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও! সে প্রসঙ্গে একটু পরে যাই।
ইসলাম ঐতিহাসিক বাস্তবতা বা অনিবার্যতা বলে কোনো কিছুকেই ছেড়ে দেয় না। অনিবার্যতা কোনো কিছুর বৈধতার জন্য যথেষ্ট নয়! স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হিসেবে প্রতিটি ঘটনা-প্রপঞ্চের জন্যই মানুষ দায়ী। তাই ঐতিহাসিক নয়, আল্লাহর বান্দা ও প্রতিনিধি হিসেবে তাকে আল্লাহর বিধান তথা সার্বভৌমত্বের বিচারে জাস্টিফাইড হতে হবে। সে কারণে ইসলাম,- সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক অনিবার্যতা প্রমাণ করার প্রয়োজনে দাস সমাজব্যবস্থা, সামন্তবাদ কিংবা পুঁজিবাদকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা বলার ঘোর বিরোধী। বরং সমাজবাদসহ যেখানে যে-যুগেই মানুষ মানুষের উপর প্রভূত্ব করেছে ও করছে সেখানেই ইসলাম মুক্তির বাণী নিয়ে হাজির হয়। এই মুক্তির জন্যই ইসলামের প্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণী হচ্ছে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। -সৃষ্টিকর্তা নয়, পালনকর্তা নয়, রহমান নয়, রাহীম নয়, আর কিছুও নয়, ইসলাম বলছে- আল্লাহকে ইলাহ মানার জন্য! একমাত্র ইলাহ! মানব ইতিহাসের শুরু থেকে সর্বত্র এই একটি বাণী নিয়েই ইসলাম হাজির হয়েছে। ইসলামে আর সমস্ত কাজের মানদন্ড, এবং শেষ কথাও এটিই- হে মানুষ, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই তোমার। কোনো বিধানদাতা, হুকুমকর্তা কিংবা সার্বভৌমত্বকারী নেই।
এই পবিত্রতম বাক্যের মাধ্যমে ইসলাম একই সাথে দু’টো কাজ করে। যুগের সাম্রাজ্যবাদীকে সতর্ক করে দেয় সে। হুশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দেয় – ‘তুমি’– তোমার চেলা-পেলা, সৈন্য-সামন্ত, তত্ত্ব দর্শন, প্রচার প্রোপাগান্ডাসহ অবৈধ। তুমি সীমালংঘনকারী। তোমার রবের অনুগ্রহের শুকরিয়া না জানিয়ে, তার খলিফা হিসেবে মানুষের মধ্যে সাম্য, ইনসাফসহ আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তব রুপায়নের পরিবর্তে তুমি তাঁর বাঞ্ছিত মানবিক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছো। সো, মানুষ হয়ে অমানুষের মতো মানুষের উপর অবৈধ ছড়ি ঘোরানোর পৈশাচিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসো। বেরিয়ে এসো- তোমার এই জবরদস্তি কর্তৃত্বের মিথ্যাচার ভন্ডামি ধাপ্পাবাজি জোচ্ছুরির বেসাতি থেকে। আত্ম-সমর্পণ করো- তোমার রবের সার্বোভৌমত্বে। (পুঁজিবাদী- সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে, মনে প্রাণে এই আত্ম-সমর্পনের অর্থই মুমিন হওয়া, মুসলমান হওয়া…)
অন্যদিকে, সেই একই বাক্য, সর্বহারা মজলুম গণমানুষের প্রতি তার আহ্বান বৈপ্লবিক। ইসলাম এই সব অসহায় দূর্বল প্রোলিতারিয়েতকে বলে- আল্লাহ ছাড়া আসলে তোমার আর কোনো ইলাহ নেই। তুমি কোন শয়তানের প্ররোচণায় তাগুতের সার্বভৌমত্ব মেনে নিচ্ছ!? –আনে’ বুদুল্লাহ ওয়াজতানে’বুত তাগুত- আল্লাহকে মেনে চল, তাগুতকে, সাম্রাজ্যবাদকে অস্বীকার করো! এই তাগুত সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদ- এরা আল্লাহর প্রতিপক্ষ, মানুষেরও! তুমি যদি আল্লাহর শত্রুদের প্রতিপক্ষে রাসূল নির্দেশিত কৌশলে হঠকারীতার পরিবর্তে কার্যকরভাবে দাঁড়াও- তুমি আনসারুল্লাহ! আল্লাহর সাহায্যকারী! নামসর্বস্ব আনসারুল্লাহ নয়!
এই তাগুত সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় হতে পারে! এই সাম্রাজ্যবাদ হতে পারে জাতীয়, আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক! এর প্রতিপক্ষে যদি তোমরা কার্যকর জনশক্তি গড়ে তুলতে পারো, তা যে নামেই ডাকো- সেটিই হিযবুল্লাহ! আল্লাহর দল! তারপর, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব্বের সপক্ষে যদি তুমি মৃত্যুবরণ করো, আল্লাহ জীবনের অধিক মূল্য দিয়ে তোমার মৃত্যুকে কিনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। যদি তুমি তুমি তুমি মিলে তোমরা নির্যাতিত হও, মজলুম হও- আল্লাহ ওয়াদা করেছেন- সেই নির্যাতিতের দেশ এবং সেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তোমাদের হাতে তুলে দেবেন। কেনো দেবেন?... তাঁর প্রতিনিধিত্বের, তাঁর খিলাফাতের দায়িত্ব পালন করতে। খিলাফাত মানে সেই রাষ্ট্রব্যাবস্থা- যার সীমানায় কোন কাঁটাতার উঠে না। যার মানব-বিধ্বংসী কোন স্বার্থপরতা নাই। আল্লাহর যে কোন বান্দা চাইলে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সেখানে নিরাপত্তা লাভ করতে পারে। শুধু তাই নয়, সেই রাষ্ট্র হয়ে উঠে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের অনন্য হিফাজতকারী। না, পরিবেশবাদীদের চাপে পড়ে কিংবা কোনো বিপর্যয় আশংকায় বাধ্য হয়ে নয়, বরং আল্লাহর এই সৃষ্টিজগতের মানবিক ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে!
এই হলো- ইসলামের সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলা এবং বিজয় পরবর্তী অবস্থানের প্রাথমিক ও কিঞ্চিত কথা-বার্তা।
এখন,
ইসলামপন্থিদের নিয়ে জনাব আনু মুহাম্মদ যদি বলেন- “পশ্চিমা ব্যবস্থার তারা বিরোধিতা করে; তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের জৈবিক বিন্যাস, তার মানুষ ও পরিবেশবিধ্বংসী ব্যবস্থা তাদের মনোযোগের বাইরে, ধর্মীয় গোষ্ঠী বিরোধিতাই তাদের মুখ্য। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে।”
তখন রাগ লাগে। কষ্ট পাই। বলি, সেই হাবিল কাবিলের যুগ থেকে ছোট-বড় সমস্ত পুঁজিবাদ- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইসলাম একাধিক্রমে লড়াই করে আসছে। আর আজ বাংলাদেশের ‘জনৈক’ আনু মুহাম্মদ, ইসলাম হতে মুসলমানদের লেগ-বিহাইন্ডের সুযোগ নিয়ে, তত্ত্বসর্বস্ব মার্ক্সিজমের উন্মাদনায় বলছেন কিনা- “পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী আবহাওয়ার মধ্যে, কোথাও তার সহযোগী হিসেবে, কোথাও তার বিরোধিতা করতে গিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের ধর্মপন্থী রাজনীতির বিস্তার ঘটছে।” আরো বলেছেন- “… বরং বর্তমান ধরনে এই রাজনীতির বিস্তার দেশে দেশে মানুষের মুক্তির লড়াইকে বাধাগ্রস্ত করে বিশ্বের শোষক–নিপীড়ক যুদ্ধবাজ জালেমদের শক্তিকেই স্থায়িত্ব দিচ্ছে।” হা.হা..হা…
হাসি নয়, সত্যি…(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১০৮৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যথার্থ বলেছেন, সহমত
আনু মোহাম্মদ বা আবুল মকসুদ বা ফরহাদ মাযহার- সব বামদের অন্তরেই বিদ্যমান আগ্নিগিরির প্রচন্ড জ্বালা-
কারণ তাদের স্বপ্নের "ইজম" পুঁজিবাদের মোকাবিলা করতে পারেনি, অথচ সেই পূরণো "আফিম" ইসলামই আজ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পুঁজিবাদসহ সকল অনৈতিক মতবাদের মোকাবিলা করে চলেছে!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
...ফরহাদ মজহারের অবশ্য ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে! সত্যে তাঁর শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের জন্য দোয়া করুন...
কিন্তু আমার এখনো মনে হয় যে, উনি তাঁর আদর্শকে ইসলামের মোড়কে মোড়াতে চাচ্ছেন-
আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন!!
তবে আমাদের কাজ হলো- তাঁকে সতর্ক-অধ্যয়ন এবং সূক্ষ্ণ পর্যালোচনা একই সাথে বিভ্রান্তিকর যে কোন ব্যাখ্যা সাহসের সাথে চ্যালেঞ্জ করা...
ইনারা এটাই বুঝতে চাননা যে ইসলামই প্রকৃত সমবন্টন কে নিশ্চিত করে যা সাম্রাজ্যবাদ এর বিরোধি।
আল্লাহ চান তো এ অবস্থা বেশী দিন থাকবে না, আমাদের তরুণরা চ্যালেঞ্জ করবে...
মন্তব্য করতে লগইন করুন