কবি ফররুখ আহমদ: বৈপ্লবিক স্বাতন্ত্র ও শত্রুমিত্র
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ২১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৮:৩৯:১১ রাত
(১৯অক্টোবর। শোষিত বঞ্চিত মজলুম মানবতার পক্ষে প্রবল কবি ফররুখ আহমদের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। হৃদয়ের অতল থেকে সমূহ শ্রদ্ধাঞ্জলি এই মহান বিপ্লবী কবিকে...)
ফররুখ স্বতন্ত্র- আমাদের সাহিত্যবোদ্ধারা বলেন।
তারপর আমরা শুনি- তাঁকে পড়তেই হবে!
পড়বো তো অবশ্যই। কিন্তু স্বাতন্ত্র? স্বাতন্ত্র কোথায়??...
কেউ কেউ হয়তো উপমার অভিনভত্ব, অলংকারের চমৎকারিত্ব, রুপক ও বিষয় বৈচিত্রসহ ইত্যাকার নন্দনতাত্ত্বিক পর্যালোচনা হাজির করবেন। চমৎকৃত হবো আমরা। একচক্ষু হরিণ কতিপয় অসৎ সাহিত্য সমালোচক এবং তাদের অনুকরণে সৃষ্ট কলেজ-ভার্সিটির পন্ডিতরুপী ভেড়ার পাল এবং তাদের আগ্রাসনের বাইরে এসে ‘ফররুখ প্রতিভা’ আবিষ্কারে আমরা নিশ্চিত বিস্মিত হবো! ফররুখ, দি গ্রেট!
কিন্তু প্রশ্ন হলো- বিকশিত প্রতিভার উপর কেনো এই অবাঞ্ছিত আগ্রাসন এলো? নন্দনতত্ত্ব কি করে এমনতরো শত্রু তৈরী করতে পারে?! তা যদি না হয়, কোথায় তবে ফররুখের এই সব গোঁয়ার শত্রুদের আভির্ভাব-উৎস?
একি ফররুখের রাজনৈতিকতা? তাঁরও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রাসঙিকতা ধারণ করা? এবং তার উপর অটল থাকা? হতে পারে। তার উপর ব্যাপার হলো ফররুখ বিক্রি হননি! নিজেকে বিক্রি করতে পারেননি তিনি অন্য অনেক বিজ্ঞজনদের মতো। (‘মহিয়ষী’ জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল কিংবা ‘মহামতি’ শামসুর রাহমানদের মতো যদি প্রকাশ্যে কিংবা নিভৃতে অবলীলায় ভীড়ে যেতে পারতেন, সমূহ অর্থ সম্মানে সমাদৃত হতেন তিনিও নিশ্চয়!) হ্যাঁ, ‘আগ্রাসনের’ এটা একটা কারণ বটে। ছোটোখাটো নয়, বড় কারণ। আধিপত্যবাদীদের প্রতিপক্ষ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট, যে- আপনি বিক্রি হবেন না! কিন্তু ফররুখের প্রতি শত্রুতায় প্রতিপক্ষের এলার্জি আরও গভীর, আরও গোপন কোনো প্রদেশে! কোথায় শত্রুতার সে পৈশাচিক আস্তানা?...
দুই.
বলতে পারেন- এ এক ঐতিহাসিক শত্রুতা, আদর্শিক ধারায় প্রবাহিত। এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমাদের অন্তত নজরুল পর্যন্ত যেতে হবে! তখন সহসা আমরা দেখে ফেলবো- ‘নজরুলের শত্রুরা ফররুখেরও শত্রু’! আগে থেকে কিছু না কিছু ধারণা না থাকলে, কেউ কেউ খানিকটা বাকরুদ্ধও হয়ে পড়তে পারেন। তারপর সংবিত ফিরে পেয়ে আরো আবিষ্কার করবেন- ‘.. নজরুলের সব ‘বন্ধু’রা কিন্তু ফররুখের বন্ধু নয়’।
তাহলে নজরুলের সাথে ফররুখের সম্পর্কই বা কি, পার্থক্যটাই বা কোথায়?...
এ প্রশ্ন নিয়ে এগুতে গেলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন! তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করেন- নজরুল-ফররুখের আলোচনায় আপনি কেনো নাক গলাতে আসছেন আবার! উনি মুচকি হেসে বলবেন- নজরুলের সাথে আমার সম্পর্ক যতোটুকু, ফররুখের সাথে ততটুকুই পার্থক্য নজরুলের! আপনার আমার মাথা ঘুরতে পারে! কয়কি ব্যাটা! হ্যাঁ, অনেকেই আছেন, যাদের দেখে আমরা নজরুলের ভক্ত/বন্ধু ভাবি। নির্মম সত্য হলো- ওরা শুধু নজরুলের রবীন্দ্রাংশটুকুরই ভক্ত(ঐ যে বললেন- নজরুলের সাথে আমার সম্পর্ক যতটুকু..)।
আর তাই অনন্য মানবিক নজরুলের বৈপ্লবিক অংশটুকু ‘এই’ নজরুল ভক্তরা বুঝতেও চায় না, খুঁজতে চাইবে কি? আমরা যে বলি- ' নজরুল সংগীতে' অনেক নজরুল বিরোধী সংগীতও আছে! এই রবীন্দ্রাংশটুকুই সেই নজরুল বিরোধী অংশ! নজরুল অবশ্য তা খুব ভাল ভাবেই মনে রাখতেন! ... রাখতেন বলেই মানুষের সপক্ষে সংগ্রামের বিপরীতে তার মাঝে দৃষ্টিকটূ কোনো রবীন্দ্রপনার প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়নি! প্রেম ছিলো তাঁর বিপ্লবেরই অনুসঙ্গ। কবিসুলভ বাড়াবাড়ি কোথাও কোথাও হয়তো ছিলো, কিন্তু তাঁর যঞ্জা-বিক্ষুব্দ জীবন সাক্ষ দেয়- কখনোই তিনি তাঁর বিপ্লবকে অতিক্রম করে যান নি। যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে পরিহার করেছেন রাবীন্দ্রিক ধারার নান্দনিক কাপুরুষতা। এবংকি প্রচলিত-সূফিগিরি অতিক্রম করা তাঁর সুগভীর আধ্যাত্মিকতাও স্তিমিত করতে পারেনি সেই সত্যনিষ্ঠ বিদ্রোহ!
সেই নজরুলদ্রোহের ঠিক একই ধারায় এসেছিলেন ফররুখও। অধিকতর আদর্শিক সংহতি নিয়ে। তাই নজরুলের “অন্ধকারে এসেছিলাম/ থাকতে আঁধার যাই চলে/ ক্ষণিক ভালো বেসেছিলাম/ চিরকালের নাই হলে..”-টাইপ রাবীন্দ্রীক লুকোচুরি ফররুখে নেই। এজন্যই নজরুলের ‘চুদুর-বুদুর’বন্ধুরা ফররুখের পাশে ঘেষতে পারে না। ফররুখ তাদের মুখোশ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন! আমরা বুঝতে পারলাম নজরুলের প্রকৃত বন্ধু যাচাইয়ের মানদন্ড হলো ফররুখ! এখানে এসেই ফররুখ একদম একা হয়ে যান!
এবং এখানেই তিনি সীমাহীন আকাশের শাহীন। দীঘল রাত্রির ঘুমের পাড়ায় অতল সুপ্তির মাঝে একাকী জেগে থাকা ডাহুক। এখানেই কংকাল কথা বলে উঠে তাঁর সাথে, জেগে উঠে এই পিশাচ সভ্যতা-সৃষ্ট ‘লাশ’।
এখানেই তিনি পাঞ্জেরী, সাত সাগরের সিন্দাবাদ!
তিন.
নজরুল যদি হয় দাউ দাউ করা আগুন, ফররুখ হবে সেই আগুনের ছাইচাপা গভীরতা। ওরা নজরুলের রবীন্দ্র সংশ্লিষ্ট অংশ বুঝে বর্ণচোরা ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভাব দেখানোর সুযোগ ফেলেও ফররুখকে মোটেই গ্রহণ করতে পারে না। আত্মস্থ করতে গেলে ওদের অভ্যস্ত জীবন গোলমেলে হয়ে উঠে, আভিজাত্যের সমস্ত বিলাসী ছক এলোমেলো হয়ে যেতে চায়। তাই নজরুলের প্রতি আক্রোষ থাকলেও ফররুখের প্রতি তীব্র ঘৃণা। কারণ তাকে কোনভাবেই গ্রহণ করা যায় না। বর্জনও করা যায় না। না যায় মোকাবিলা করা যায়। না অতিক্রম করা যায়! এখানেই পরাজিত, নিদারুণ পরাজিত ফররুখের সমস্ত শত্রুরা। -একবার তাঁকে সরকারী টাকায় হজ্জ করার প্রস্তাব দেয়া হলো। ওরা চাইলো ফররুখকে লোক দেখানো শ্রদ্ধার মোড়কে করুণা দিয়ে গ্রহণ করতে। ফররুখ তাগুতি রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিপক্ষে শতাব্দীর অন্যতম সেরা কথাটি বলেছেন- খান্নাসের টাকায় হজ্জ করলে হজ্জ হয় না।
কী ভয়ানক ব্যাপার!
ফররুখ ইমাম হোসাইনের একজন যোগ্য উত্তরসূরীর ভূমিকায় দেখিয়ে গেলেন- কিভাবে অস্ত্র-শস্ত্রের সাজসাজ প্রাচূর্য ছাড়া, সৈন্য-সামন্ত ছাড়া, সুবিশাল ভক্ত অনুরক্ত জমিদারি ছাড়া কি করে পুঁজিবাদী খান্নাসদের প্রতিপক্ষে নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লড়ে যেতে হয়। মূলত এখানেই ফররুখ অবিসংবাদিত সাতন্ত্রের সর্দার।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৯ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঘুম ভাঙাতে চাই...
ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধিতের আহজারি তাঁর কবিতায়!
সৌভাগ্য আমার আজ।
ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধিতের আহজারি তাঁর কবিতায়!
সৌভাগ্য আমার আজ।
আহমদ ছফা একটুও মিথ্যা বলেননি।
অবশ্য তাঁর মতো সত্য বলার মানুষ এ দেশে খুব বেশী জন্মেনি...
সাত সাগরের মাঝি, পান্জেরি দুটো কবিতাই অসম্ভব পছন্দের আমার!
ভালো লেগেছে আপনার লেখাটি!
কবিতা দু'টো আমারও খুব পছন্দের! আপনি তাঁর আরো দুটো কবিতা-'ডাহুক' এবং 'লাশ' পড়ে দেখতে পারেন,
অনেক ভালো লাগবে...
আবার- "নজরুল যদি হয় দাউ দাউ করা আগুন, ফররুখ হবে সেই আগুনের ছাইচাপা গভীরতা।" যুগই নজরুলকে 'দাউ দাউ করা আগুন' করেছে, যুগই ফররুখকে 'আগুনের ছাইচাপা গভীরতা' দিয়েছে। তাঁদের মৌলিক সাযুজ্য কোথায়?-তাঁদের সংগ্রাম! স্থান ও কালকে ধারণ করে তাঁরা মজলুমের সপক্ষে মাথা উঁচু করে উচ্চকন্ঠ হয়েছিলেন।
আর যদি তুলনা কোথাও এসেও যায়, তা শুধু তাঁদের এই সংগ্রামের প্রকৃতি ও ধারা বোঝার প্রয়োজনে। দুজনকে দুপাশে রেখে তুলনা নয়...
অনেক ধন্যবাদ, সবুজ ভাই...
আবার- "নজরুল যদি হয় দাউ দাউ করা আগুন, ফররুখ হবে সেই আগুনের ছাইচাপা গভীরতা।" যুগই নজরুলকে 'দাউ দাউ করা আগুন' করেছে, যুগই ফররুখকে 'আগুনের ছাইচাপা গভীরতা' দিয়েছে। তাঁদের মৌলিক সাযুজ্য কোথায়?-তাঁদের সংগ্রাম! স্থান ও কালকে ধারণ করে তাঁরা মজলুমের সপক্ষে মাথা উঁচু করে উচ্চকন্ঠ হয়েছিলেন।
আর যদি তুলনা কোথাও এসেও যায়, তা শুধু তাঁদের এই সংগ্রামের প্রকৃতি ও ধারা বোঝার প্রয়োজনে। দুজনকে দুপাশে রেখে তুলনা নয়...
অনেক ধন্যবাদ, সবুজ ভাই...
ফররুখ ইমাম হোসাইনের একজন যোগ্য উত্তরসূরীর ভূমিকায় দেখিয়ে গেলেন- কিভাবে অস্ত্র-শস্ত্রের সাজসাজ প্রাচূর্য ছাড়া, সৈন্য-সামন্ত ছাড়া, সুবিশাল ভক্ত অনুরক্ত জমিদারি ছাড়া কি করে পুঁজিবাদী খান্নাসদের প্রতিপক্ষে নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লড়ে যেতে হয়। মূলত এখানেই ফররুখ আবিসংবাদিত সাতন্ত্রের সর্দার। দারুণ লিখেছেন শাহাদাত ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন