নারীমুক্তি না মানবমুক্তি: ইসলামের বৈপ্লবিক ফয়সালা
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৮:৫৪:৪১ রাত
ইসলামে নারীমুক্তির আলাদা কোনো এজেন্ডা নেই। মজার ব্যপার হলো- এই না থাকাই মানব ইতিহাসে নারীমুক্তির সব চেয়ে বড় এবং সর্বোৎকৃষ্ট পদক্ষেপ। অবাক ব্যাপার! হ্যাঁ। ‘মানুষ’ প্রসঙ্গের পরিবর্তে নারী বা নারীমুক্তির বিচ্ছিন্ন ধারণা যাদের সমাজ থেকে এসেছে- সে সমাজে নারী আসলে ‘মানুষ’ ছিলো না। সাধারণরা শুধু নয়, তাদের অনেক বাঘা বাঘা দার্শনিক নারীকে হীন(inferior), ‘অর্ধ-মানব’ ইত্যাদি বলে ‘জ্ঞান’ চরিতার্থ করেছেন। পাপাত্মা, শয়তানের দোসর ইত্যাকার নারকীয় অভিধা ছিল নারীর জন্যই নির্দিষ্ট। অনেকে তো নারীর আত্মা আছে কী নেই, সেই ভাবনায় বয়স বাড়িয়েছেন শুধুশুধু। কেউ কেউ হয়তো পটলও তুলেছেন অমীমাংসিত অবস্থায়। সেই সুযোগ নিয়ে যুগের সুবিধাবাদীরা তাদের নিজস্ব সংজ্ঞায় নারীমুক্তির এজেন্ডা হাজির করেছে…
কিন্তু ইসলামের এপ্রোচই আলাদা। বৈপ্লবিক। ইসলাম এসে সরাসরি ঘোষণা করলো- ইয়া আইয়্যুহান নাস, ক্বুলু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তুফলিহুন…। - হে মানবজাতি, সবার সার্বভৌমত্বে বিদ্রোহ করো, আল্লাহ ছাড়া; এখানেই তোমাদের সাফল্য, এখানেই মুক্তি।
ইসলামের এই প্রথম ঘোষণা- প্রকারান্তরে নারীমুক্তিরও মহাসনদ। কিভাবে?- আসুন দেখা যাক,
প্রথমত,
‘মানবজাতি’ সম্বোধনে ইসলাম লিঙ্গ-নির্বিশেষে নর-নারীকে একাকার করে দিয়েছেন। কারো বিশেষ মর্যাদা কিংবা কুখ্যাতি(যেমন- নারীর কথিত আদিপাপ ইত্যাদি)’র ইতিহাস চিরতরে তিরোহিত করে দিল। এবং এও স্পষ্ট হলো যে- মানব সৃষ্টির মৌলিক উপাদান(দেহ, মন, আত্মা) নারী-পুরুষে সমান সমান। যেটুকু পার্থক্য তার জন্য কেউ কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব ফলাতে পারে না। (শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো আল্লাহ-ভীতি, আল্লাহর প্রতিনিধিত্বে মানবজাতি ও সৃষ্টিকুলের ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থাপনা...)
এরপর,
ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া আর সবার আইন-প্রনয়ণ ক্ষমতা(হুকুম করার ক্ষমতা/ সার্বভৌমত্ব) অস্বীকার করতে। যদি পুরুষতন্ত্র বলে কিছু থেকে থাকে তা’ও! অর্থাৎ, পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে নারীমুক্তি আরো সহজ হয়ে গেলো। স্বয়ং পুরুষও এখানে তার তন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য। কারণ কারো তন্ত্রগিরি দাদাগিরি পুরুষগিরি দেখানোর জন্য স্রষ্টা এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন নি। এর ভেতর দিয়ে ইসলাম পুরুষতন্ত্রের থিসিস শেষ করে দিয়েছে। শুধু তা’ই নয়, পুরুষতন্ত্রসহ যত তন্ত্র-মন্ত্র আছে সব কিছুর প্রতিপক্ষে ইসলাম ‘নৈতিকতা’সম্পন্ন নারী-পুরুষের একটি সুসংহত আন্দোলন সৃষ্টি করেছে। ইসলাম বলেছে ইমানদার নারী-পুরুষ একে অন্যের সহযোগী। সুতরাং, ইসলামের সাথে মিশিয়ে পুরুষতন্ত্রের যে বয়ান হুমায়ুন আজাদ সাহেব কিংবা ‘মুহতারামা’ তাসলিমা নাসরিন এবং তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা হাজির করতে চান, ইসলামের এই প্রথম ঘোষণাই তাদের অনেক আগেই নাকচ করে রেখেছে। আজ থেকে নাকচ করে দিচ্ছি আমরাও। তবে হ্যাঁ, ইসলাম নিয়েও যে কারো কথা থাকতে পারে, ইসলামের স্রষ্টাই মানুষকে সে অধিকার দিয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে আমাকে পাগলামি ও ছাগলামি ছেড়ে, ইসলামের সামগ্রিক এবং বিশুদ্ধ অখন্ডতা পর্যালোচনা করেই কথা বলতে হবে। সে দরোজা সবার জন্য কিয়ামাত পর্যন্ত টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস খোলা…
সর্বশেষ,
ইসলাম বলছে, এখানেই তোমাদের মুক্তি। তোমাদের মানে নারীদের কিংবা পুরুষদের নয়, মানুষের। মানুষ মানে নারী ও পুরুষ উভয়ই। তার মানে মুক্তিপ্রাপ্তদের মাঝে নারী বা পুরুষ নয়, বরং নারী-পুরুষ উভয়ই, অর্থাৎ, মানুষ থাকবে- আবার খুব স্বাভাবিকভাবে দূর্দশাগ্রস্থদের মাঝেও। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ঘটনাটা আসলে মানবমুক্তির। নারীমুক্তির বা পুরুষমুক্তির নয়। কারণ নারীমুক্তির প্রতিবন্ধক পুরুষরাও তো মুক্ত নয়। আবার নারী-নির্যাতনে সিদ্ধহস্ত বিপুল সংখ্যক নারীর মুক্তিই বা কিভাবে…? আর হ্যাঁ, এখানে এসে কারখানাবাদীদের নারীমুক্তি এজেন্ডা উদোম হয়ে পড়ে। কারখানায় শ্রমিকের অভাবেই যারা একদা মুক্তির খোঁলস পরিয়ে নারী প্রসঙ্গ টেনে এনেছিল। তারপর থেকে সেই পূঁজিপতিরা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে নারীকে নানা কারখানায় ছড়িয়ে মুক্তিদাতার প্রচন্ড দাপটের সঙ্গে পর্ণো কারখানা পর্যন্ত নিয়ে গেছে…
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অবশ্য নারীমুক্তি আন্দোলন খুব স্বাভাবিকভাবে এই স্বার্থান্বেষী নোংরামী থেকে ভিন্ন হতে পারতো। এগুতে পারতো ইসলামের হাত ধরেই, খুব ভালোভাবে । বেগম রোকেয়া শুরুও করেছিলেন। কিন্তু অন্তত দুটি প্রধান কারণে তা ভেস্তে গেছে। প্রথমত, হঠকারীতা! একটি সর্বাঙ্গ-সুন্দর সংস্কার আন্দোলনে যে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, আবেগ, পর্যায়ক্রমিক নিরবিচ্ছিন্ন কর্মসূচী দাবি করে, তা হয়ে উঠেনি। ইতোমধ্যে নারীমুক্তির আড়ালে নিজ নিজ দেহজ কামনার মুক্তি চাওয়া বেলেল্লে ‘ফিরিঙ্গি’ নারীদের অনুপ্রবেশ আন্দোলনের অভিমুখই চেঞ্জ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এদেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সেই নারীবাদীদের তোলা ইসলাম প্রশ্ন, এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা শুরু না করেই রাজনীতি টেনে আনা। ফলে এদেশের নারীমুক্তির ব্যাপার আর এদেশের না থেকে, সেটি সেই কারখানাবাদী, কালক্রমে আজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নীলনকশা হয়ে উঠেছে। সাথে সেই সাম্রাজ্যবাদীগোষ্ঠী হতে নগদপ্রাপ্তি তাদের এতোটাই গাফেল করে রেখেছে- নারীমুক্তির নামে নারীর সর্ববৈ সর্বনাশও তাদের এ পথ থেকে রুখতে পারবে বলে মনে হয় না।
তার মানে নারীমুক্তির এই ধ্বজাধারীরাও মুক্ত নয়। সামাজিকভাবে তারা সাধারণত বেলেল্লে গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত, রাজনৈতিকভাবে ইসলাম বিদ্বেষী বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদীর সাথে, অর্থনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজিপতিগোষ্ঠীর সঙ্গে। এবং খুব স্বাভাবিক, বুদ্ধিবৃত্তিভাবে পাশ্চাত্যের মতো তাদের নারীমুক্তির খুঁটিও মানবিক আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে কারখানার খুঁটিতে বাঁধা। ফলে নারীমুক্তি মানে যে শুধু নারীর হাতে টাকা থাকা কিংবা ক্যামেরার সামনে নগ্ন হতে হতে নাচতে থাকা বা ইত্যাকার কিছু নয়; বরং এর চেয়েও ভিন্নতরো বা অধিক কিছু; মুক্তি মানে যে আত্মারও মুক্তি, মনের ভেতর যে মন থাকে তারও; তা তারা বুঝে না। এবং বুঝতে চায়ও না। বুঝলে যে আর ভোগ হয় না! বিজনেস হয় না! রাজনীতিও না!! এজন্যই নারী স্বাধীনতার কথা ওরা বলে বটে, অথচ কোন নারী যদি সামান্য হিজাব পরার স্বাধীনতা চর্চা করতে চায়, সেটুকুও তাদের সহ্য হয় না। এতোটাই অসহ্য যে, এনিয়ে পার্লামেন্ট পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়। কোন পার্লামেন্ট? হ্যাঁ, এই পার্লামেন্টের প্রভূ- পুঁজিবাদ। এখানে পুঁজিই সার্বভৌম, একমাত্র ইলাহ। নারীর, পুরুষের, মানবজাতির এই আসল শত্রুকে আড়াল করতেই সর্বত্র তৈরী করা হয়েছে কাল্পনিক পুরুষতন্ত্র। বলাই বাহুল্য, সেই কল্পনায় শক্তি যুগিয়েছে এবং যোগাচ্ছে স্বয়ং শয়তান ক্যাপিটালিজম। অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, বিভিন্নভাবে সৃষ্ট শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী ও পুরুষ লাঠিয়াল দিয়ে। এবং দেশে দেশে অধিষ্ঠিত বশংবদ সরকার দিয়ে।
এজন্যই এই নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হলেও, সরকারপ্রধান হলেও নারীমুক্তির কোথাও কোনো গুণগত পরিবর্ত্ন হয় না। তা তো দূরে থাক, নিজের দলীয় ক্যাডারদের হাত থেকেই একটি ধর্ষণও ঠেকাতে পারেন না তারা। ধর্ষণের উদযাপিত সেঞ্চুরিও অবলীলায় হজম করে নেন। অর্থাৎ, তারা নারী/পুরুষ যা’ই হোক, সেই ভোগ-বিজনেস-রাজনীতি’তে আকন্ঠ অবরুদ্ধ! আগেও দেখেছি আমরা- এই নারী, এই পুরুষদেরও মুক্তি দরকার। তারা মুক্তি না চাইলে তাদের সাথে সুস্পষ্ট ফায়সালা দরকার। নারীর স্বার্থে, পুরুষের স্বার্থে, মানুষ তথা মানবজাতির স্বার্থে।
হ্যাঁ, সেই বৈপ্লবিক ফায়সালাই ইসলাম দিয়েছে। বলেছে, তুমি তোমার ভাইকে/বোনকে সাহায্য করো- যদি সে মজলুম হয়, এবং যদি সে জালিম হয় তা’ও! কিভাবে? –তাকে জুলুম থেকে বিরত রেখে। এরচেয়ে সুন্দর ফয়সালা আর কি হতে পারে?
অর্থাৎ, মানবজাতির সচেতন অংশের দায়িত্ব হলো তার গাফেল অংশের, মজলুম অংশের এবং কি জালিম অংশেরও সংশোধন। বিস্তৃত ও গভীর কর্ম-পরিকল্পনা(Action Plan) এবং সামগ্রিক প্রস্তুতি গ্রহণ।
এই দায়িত্ব পুঁজিবাদের লাঠিয়াল কোনো NGO বা MNC’র পক্ষ থেকে নয়। বরং, তাঁর প্রতিনিধিত্বের এই গুরুভার অর্পণ করেছেন নারী ও পুরুষের মহান স্রষ্টা স্বয়ং। এবং জবাবদিহিতাও তাঁরই কাছে...
বিষয়: বিবিধ
৯৭৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবা্দ...
অনেক শুকরিয়া..
মন্তব্য করতে লগইন করুন