ঈজিপ্টে বিপর্যয়ঃ রাজতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্য, সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি এবং বাংলাদেশ

লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১০ জুলাই, ২০১৩, ১২:৪৯:০৮ রাত



ফেনী আর লক্ষীপুরে দৌঁড়াদৌঁড়ি। এর মাঝে মিশর-বিপর্যয়সহ অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। অনেক কথাই জমে উঠেছে মনে। তার কয়েকটি না বললেই নয়…

অনেকেই আমরা খুব ভালো করেই জানি- ইখওয়ান নেতৃত্বাধীন মুরসি-সরকার, পৃথিবীর আর দু-দশটি সরকারের মতো নয়! এ সরকার যুগযুগ ধরে মিশরের জনগণের হাজারো কুরবানীর ফসল! সুতরাং এ বিপর্যয়ও খুব সাধারণ কোনো ঘটনা নয়! এই বিপর্যয় একটি মানবিক, ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারেরই বিপর্যয়। এই বিপর্যয়কে ঘিরে উদিত হয়েছে বেশকিছু দিক নির্দেশক তারকা। এই দিক নির্দেশনা শুধু ঈজিপ্ট নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মুক্তিকামী মানবিক আন্দোলনের জন্যই! সেই প্রেক্ষিতে,

প্রথম কথা হলো-

সকল বিপ্লব বা পরিবর্তনেই মূলত একটি পশ্চাদগামী প্রবণতা বিদ্যমান থাকে। তার উপর পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মানুষের সপক্ষে কোন পরিবর্তন বরদাস্ত করতে ইচ্ছুক নয়। তারা প্রথমত, ‘ডিভাইড এন্ড রুল’এর ভিত্তিতে একটি জাতির উপর আধিপত্যকে স্বাভাবিক করে তুলে, সে অবস্থায় আধিপত্য অব্যাহত রাখতে চায়! দাসত্বমুক্ত সম্মানজনক নাগরিক অধিকার বা মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে যে কোন সংঘবদ্ধ সচেতন তৃতীয় শক্তিকে তারা 'হেফাজতের' মতো নৃশংস করে হলেও প্রতিহত করবে। যদি কোথাও কখনো তা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে-

দ্বিতীয় উপায় হল- তাদের(সেই সচেতন শক্তির) রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকানো।

তা না পারলে পরে, বিরোধী পক্ষকে বিবিধ বিশেষ সুবিধাসহ ক্ষমতা দখলে ইন্ধন যোগায়! শুরু করে অর্থ, মিডিয়া, গোয়েন্দা সাহায্যসহ বিশ্বাসঘাতকতার অনুকূলে তাবৎ সহযোগিতা প্রদান। ঈজিপ্টে এই সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের তাবেদারদের তৃতীয় ফর্মূলাও ব্যর্থ হয়েছে।

তাদের চতুর্থ আশ্রয় হলো- জন-বিচ্ছিন্ন উচ্চাকাঙক্ষী সেনা-চক্র। যে কারণেই হোক ঈজিপ্ট এটিকে যথযথ মোকাবিলা করতে পারেনি। যাই হোক, কোন মানবিক রাষ্ট্র যদি এখানেও উৎরে যায় তাকে আরো দু’টি অগ্নিগিরি অতিক্রমের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এর একটি হলো- লুণ্ঠনবাদীদের চাপিয়ে দেয়া কমান্ডো অভিযান কিংবা সরাসরি সামরিক আগ্রাসন।

আর অন্যটি হল- ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অবরোধ। যা ফার্সিয়ান’রা এখনো মোকাবিলা করছে…

তবে যাই ঘটুক। ঈজিপ্টের ব্যাপারে আমরা এটুকু আশাবাদী যে,

রক্ত ও অশ্রুর যোজনায়

যুগ-যুগান্তরের সংগ্রামের মোহনায়

তাঁরা যখন একবার জাতিগতভাবে জেগে উঠেছে

সমস্ত বাধা-বিপত্তি তাঁদের পদ-যুগলকে সুদৃঢ়ই করবে শুধু

আগ্রাসন- ক্রমাগত শক্তিশালী করে তুলবে তাঁদের হস্ত-যুগল

তাবৎ ষড়যন্ত্র তাদের হৃদয়ের উদারতা, মহিমা এবং গভীরতা ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করবে না আর...

তামাম বিপ্লবী আত্মার অভিভাবক ঈজিপ্টের সহায় হোক!...



দ্বিতীয় কথা হলো- তাবেদার সৌদি সরকার নিয়ে।

এই সৌদি সরকার মূলত বহু-পুরান পাপী! অনেকেই খুব সুস্পষ্টভাবে এবং অনেক আগ থেকেই তা জানেন। মিশর প্রশ্নে তারা, অর্থাৎ সৌদি সরকার, আরো একবার নিজেকে দিগম্বর করে ছাড়লো। যে বিপর্যয়ে বিশ্বজড়ে মুসলমানদের হৃদয় রক্তাক্ত, নিদ্রাহীন নয়ন অশ্রু প্লাবিত- সেখানে, বিপর্যয়ের হোতা সাম্রাজ্যবাদী লাঠিয়াল- সেই পরাজিত সামরিক প্রেতাত্মার পৈশাচিক প্রত্যাবর্তনকে সবার আগে নাকি ‘স্বাগত’ জানিয়েছে কথিত, ‘খাদেমুল হারামাইন’ সরকার।

‘খাদেমুল হারামাইন’!

(তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মাসজিদে হারামের খিদমত করাকে ওদের কর্ম-কান্ডের সমতূল্য করে নিয়েছ,

যারা ঈমান এনেছে অল্লাহ ও আখিরাতের উপর এবং যারা সংগ্রাম করেছে আল্লাহর পথে?

আল্লাহর কাছে এরা দু’পক্ষ সমান নয়, আর আল্লাহ কোনো জালিম জাতিকে হিদায়াত দেন না।

-সূরা তাওবা-১৯)

শুধু তাই নয়, শুনলাম- অবৈধ রাজতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে নাকি দালাল-সামরিক সরকারের সপক্ষে ‘খায়রাত’ তোলাতোলিও হচ্ছে। কত্তোবড় ‘হারামী’ হলে- ঈজিপ্টের জনগণ, মুসলিম উম্মাহ এবংকি একটি মানবিক বিপ্লবেরও প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে একটি মুসলিম দেশ- অতোটা নগ্নভাবে, আমাদের জানা নেই! এরাই কি তবে, মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এবং ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া উদ্ভাবিত সেই শাসনতান্ত্রিক বিদআতের জারজ উত্তরাধিকারি?...

হে কাবার মালিক!

ইসলামের এই আলখেল্লা-ধারী, যারা-

হযরত ইব্রাহীম এবং

হযরত মুহাম্মদের মানবিক বিপ্লবের শত্রু!

তাদের বিষধর হস্তক্ষেপ হতে উম্মাহ’কে হিফাজত করো…



তৃতীয় কথা হলো-

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’কে নিয়ে।

যে কারণেই হোক- ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে নীরবে- সুকৌশলে এড়িয়ে সৌদি-কেন্দ্রিক রাজতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যের সাথে অবচেতন সম্পর্কের সপক্ষে জামায়াতের এতোদিনকার ব্যাখ্যা(যেমন, ইরানে গণতন্ত্র ছিলো না; সেখানে রাজতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র বিরাজিত ছিল; বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা ইরানের ন্যায় অতোটা নির্যাতিত নয় যে, সেকিউলার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি, বিষয়টি অনেকেরই হয়তো অজ্ঞাতে থাকতে পারে... যাই হোক,) আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির রায় পরবর্তি বাংলাদেশ, এবং হেফাজত প্রশ্নে সরকারের নৃশংসতার ভেতর দিয়ে তা সমূলে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং, জামায়াতের বৈপ্লবিক উত্থানের দিক থেকে, মিশর প্রশ্নে এটি এখন পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।

মনে রাখতে হবে, মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক প্রাপ্যের নগণ্য অংশ(গুটিকয়েক ব্যাংক, বীমা, এনজিও’র মাধ্যমে) পরিশোধের বিনিময়ে তারা যদি মিল্লাতের খিলাফাত পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা তথা ইসলামী আন্দোলন সমূহের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায়, তাহলে তা যে নামেই সহ্য করা হোক, হবে সুস্পষ্ট এবং সংঘাতিক আত্মঘাতী!

আবার, সৌদি সরকারের সাথে সাথে মার্কিন সরকারের প্রতি জামায়াতের যে ‘দূর্বলতা’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-উদ্ভূত কিছু ‘সুশীল’-শিবিবের মার্কিন-প্রীতি শংকাজনক না হলেও, সামান্যতম অসতর্কতায় তা আশংকাজনক পরিণতিতে পর্যবসিত হতে পারে! প্রচলিত আভিজাত্যে উন্নিত তীব্র স্বার্থান্বেষী সুচতুর রুপসী রমণীর পাল্লায় পড়লে যা হয় আর কী! জেনে রাখা ভালো- সমস্ত সভ্যতা-সংস্কৃতি, বুদ্ধি-সুদ্ধি নিয়ে মার্কিন সরকারও মূলত তা’ই! সেই স্বার্থোদ্ধার পর্যন্ত! আপনাকে ফাঁকা করে ফেলা পর্যন্ত… লম্পট রমনীর মতো লুতুপুতু করতে অভূতপূর্ব পারঙ্গম!!...

আমরা আবেগবশত শূন্যগর্ভ হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তের কথা বলছি না। তবে বর্ণচোরা সৌদি-কেন্দ্রিক রাজতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীলতা এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভূ ‘আমেরিকা’কে ক্ষেত্রবিশেষে কৌশলে এবং প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে হলেও মোকাবিলার পথ-পদ্ধতি স্পষ্ট করতে না পারলে, বিপ্লবের প্রশ্নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সাবালকত্ব প্রাপ্তি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

আল্লাহ মাফ করুন…

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১৮৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File