সুশীলদের নজরুল-ভীতি এবং রবীন্দ্র-প্রীতিঃ সংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিতে
লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১৭ জুন, ২০১৩, ০৬:৩১:০৫ সকাল
আমরা বলে ছিলাম- নজরুল উত্থাপিত সুগভীর-ইসলামের সুউচ্চ মানবিক বৈপ্লবিকতা যারা ধারণ করেন তারা জানেন যে বিশ্ব বিশেষত, এ উপমহাদেশের ইসলামি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নজরুল-পর্যালোচনা অনিবার্য। এবং অপরিহার্য- রবীন্দ্র ও রবীন্দ্রকেন্দ্রীক ষড়যন্ত্র মোকাবিলাও! এবং এ দু’টো কাজ একসাথে করাই হবে সর্বাধিক ফলপ্রসু। আর তা করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো রবীন্দ্র মোকাবেলার প্রশ্নে নজরুল পর্যালোচনা।
তাছাড়া প্রশ্ন তুলেছিলাম- রবীন্দ্র-মোকাবেলায় নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা এতো তীব্র কেন?... নজরুলের কথা উঠলেই কেন রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েন? কিংবা রবীন্দ্রনাথ আসলে নজরুল?
এর মূল কারণ কি তাঁদের সমসাময়িকতা?... কাব্য-সাহিত্য কেন্দ্রিক কোনো গোপন প্রতিযোগিতা?... নাকি সম্পুর্ণ অন্যরকম ভিন্নতর কিছু??...
যদি রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টিকর্মের উপর আমরা একটু মনযোগী দৃষ্টি দেই তাহলে দেখবো- সামাজিক ঘটনা সমুহের নির্যাস চরিত্রে রুপায়ন, নন্দনতাত্ত্বিক গভীরতা, হিন্দু সমাজভিত্তিক মানবিক মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লষণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বৈষয়িক জীবন-জ্ঞানের সূত্র- ইত্যাদির মাধ্যমে যে রহস্যজগত তিনি তৈরি করেছেন তা মানুষকে এক বিমূর্ত বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। সাহিত্যে এ আফিম-ওয়ার্ল্ড বিনির্মান করতেই তিনি এসেছেন কিনা, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু মরীছিকার সে সান্ত্বনাজগত তিনি তৈরি করেছেন এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতার নেপথ্যে আছে তারই বাস্তব জীবন। একদিকে তার কবিসুলভ স্পর্শকাতর মন, অন্যদিকে অভ্যস্ত আভিজাত্যের খায়েস।
কিন্তু নজরুল? একদিকে দেখেছেন- 'কতিপয়ে'র আভিজাত্যের সাঁজোয়া যানে কিভাবে পদদলিত হচ্ছে মানবতা, আকন্ঠ নিমজ্জিত জাতের নামে বজ্জাতিতে! অন্যদিকে- ‘দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ পেরুতে প্রতিশ্রুত গণমানুষের মুক্তির আতীব্র আকাঙ্ক্ষা। আভিজাত্যের খায়েস না থাকলে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নজরুলের পুর্বসূরিও হতে পারতেন। তাতে সত্যিকার অর্থেই মানবতা উপকৃত হতে পারত, সাহিত্যে বৈচিত্রের কোনো ঘাটতি ছাড়াই। আর সাহিত্য তো মানুষের জন্যই, 'কতিপয়ে'র জন্য নয়।
০২.
রবীন্দ্রনাথের এই আভিজাত্যের খায়েস তাকে কবিদের নৈরাজ্যকর জীবনধারা থেকে রক্ষা করেছে বটে। দিয়েছে প্লেটো, এরিস্টটোল, গ্যাটে-টাইপ জীবনধারা(রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাইস্তিকে একবার এরকম লিখেছিলেন- যেখানে বড় অপরাধী হওয়া অসম্ভব সেখানে সাধু থাকাই শ্রেয়)। কিন্তু নজরুল! নৈরাজ্যকর জীবন কিংবা সুফীপনার মেকি আভিজাত্য কোনোটাই নজরুলকে আবিষ্ট করতে পারেনি। নজরুলকে রক্ষা করেছে তার সংগ্রাম, গণমানুষের সপক্ষে তাঁর বৈপ্লবিক অবস্থান। এবং এটাই কারণ- রবীন্দ্র প্রসঙ্গে নজরুল এসে পড়ার! এবং এজন্যই নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতিযোগিতা’ কখনওই কাব্য-সাহিত্যে থাকেনি সীমাবদ্ধ থাকেনি(এই যে ধরুন- রচনার পরিমান, গুণগতমান ইত্যাদির মধ্যে)। তা কাব্য-সাহিত্যের সীমানা পেরিয়ে গ্রাস করেছে সমগ্র জীবন-দর্শন! তাই তো নজরুল যা’ই রচনা করুক, যত কমই রচনা করুক, তার জীবনদর্শন এতো তীব্র ও গণমুখী(we are 99.99%) যে- তার মোকাবিলায় রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্বে পরিশোধিত অপরিমেয় ভাঁড়ারও যথেষ্ট নয়! সুতরাং তাকে গুম করে দেয়া রবীদ্র-অস্তিত্ত্বের জন্য অপরিহার্য। তাঁকে ভুলিয়ে দিতে না পারলে যে রবীন্দ্রনাথ পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মানুষের মুক্তির স্পৃহার কাছে বারবার প্রকম্পিত হবে তাঁর অশ্লীল আভিজাত্য। প্রতিনিয়ত দংশিত হবে তাঁর বিবেক। তাকে নিয়ে মোটেই জমে উঠবেনা সুশীলদের কাল্পনিক আস্ফালন। সুতরাং তাকে আটকাও, বাকরুদ্ধ করে দাও। যতদূর সম্ভব তার প্রকাশনা ঠেকাও। প্রচার নিরুৎসাহীত কর। তাঁর রচনার তাৎপর্যের পরিবর্তে খুঁত বের কর, নন্দনতাত্তিক মারপ্যাঁচে তাকে সায়েস্তা করার চেষ্টা কর।(বোঝার জন্য হালের মাহমুদুর রহামানকে সম্মুখে রাখতে পারেন।)
অর্থাৎ, আমরা যা দেখছি নজরুল তাঁর জীবন, জীবনদৃষ্টি, জীবন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে সাহিত্য জগত ও দর্শন তৈরী করেছেন তা পুরোপুরি রবীন্দ্রপ্রতিকূলে। রবীন্দ্রনাথের জীবন, জীবনদৃষ্টি, জীবনভোগের আভিজাত্যের মধ্য দিয়ে তৈরি ধাঁধার পৃথিবী- সে যতো বড়োই হোক মধুর হোক, নজরুলের সম্মুখে নিষ্প্রভ এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিষ্প্রয়োজনও হয়ে উঠে! নজরুলের যে সাতন্ত্রের কথা আমরা বলি, রবীন্দ্রবলয় ভাঙ্গার কথা বলি- এটি তা’ই।
আরো গভীরভাবে দেখতে গেলে বলতে হয় নজরুল আসলে কোনো বলয়ে প্রবেশও করেননি, ভাঙ্গেনওনি(তার রবীন্দ্রপ্রিয়তা ছিল স্রেফ সাহিত্য রস ও নন্দনতাত্ত্বিক উপভোগ-সংশ্লিষ্ট, রবীন্দ্রনাথের নজরুলপ্রিয়তা ছিলো অবশ্য বিস্ময় থেকে)। বরং তার বলয় গড়ে উঠেছিলো সম্পুর্ণ আলাদা ভাবে, এবং বেড়ে উঠেছে অন্য যেকোনো বলয়ের প্রতি চ্যালেঞ্জিং হয়েই। একটি আলাদা বলয় তৈরীতে যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শক্তি, সাহস, পৃথক মনোভঙ্গি, দ্ব্যর্থহীন জীবন দর্শন এবং সুগভীর আধ্যাত্মিকতা দরকার- সবই ছিল নজরুলের মাঝে, পূর্ণমাত্রায়। এবং বিষয়বস্তু উপলব্ধির যতটুকু মৌলিকতা সাহিত্যে আঙ্গিক পরিবর্তনে যথেষ্ট, নজরুল কুন্ঠাহীন ভাবেই সে মৌলিকতা ধারন করতেন।
যাই হোক, এই সংগ্রামের পথ এবং আভিজাত্যের পথই হলো- দু’জনের মধ্যকার তফাৎ। দু’টোই মুখোমুখি। একটিকে গ্রহণ করলে বর্জন করতে হয় অন্যটি, অবশ্যসম্ভাবিভাবে। কারণ একটি আসে নির্যাতিত জনমানুষের ভেতর থেকে, অন্যটি সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের রক্তপায়ী নির্দেশ হতে। তাই একটির টিকে থাকা অন্যটির মোকাবেলার সাথে যুক্ত। ভাবুন, সবাই যদি এই রবীন্দ্রানুসারী হয়- তাহলে শোষণই স্বাভাবিক হয়ে উঠে, নান্দনিকও। আর যদি নজরুলানুসারি হয় তাহলে?... তাহলে সে ‘জাতি’ হয়ে উঠবে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নিদারুণতম মৃত্যুঘন্টা।
০৩.
‘আমাদের লোক’ হওয়ার আকুতি হয়তো রবীন্দ্রনাথের ছিল। কিন্তু আভিজাত্যের হিফাজত বনাম মানবতার হিফাজত- ইতিহাসের এই চিরন্তন দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত অনুভূতি উপলব্ধি জ্ঞান অভিজ্ঞতা খ্যাতিসহ দাঁড়িয়াছেন অভিজাততন্ত্র, খোলামেলা বললে সেই জুলুমতন্ত্রের সপক্ষে(কারণ এই অভিজাততন্ত্র সর্বদাই গণ-মানুষকে নতজানু করে রাখার পক্ষে- যা জনগণের চেতনাহীনতাকে পুঁজি করে শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ, উপনিবেশিকতা কিংবা সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়)। সেই দাঁড়ানোর মনস্তাপ থেকেই তৈরী হয়- এই মায়ার জগৎ! আহা! রবীন্দ্রনাথ! এখানে কে তাঁর সমকক্ষ?
এজন্যই তো রবীন্দ্রনাথ সুশীলদের এতো প্রিয়!..-সত্যের সপক্ষে সংগ্রামহীনতা মানুষের জীবনে যে বেদনাময় প্রাকৃতিক বিরহ সৃষ্টি করে- রবীন্দ্রসঙ্গীত-সাহিত্য তাদের জন্য অভূতপুর্ব উপাদেয় মলমের আরাম, সান্তনা বিশেষও বটে।
অথচ নজরুল?- তাঁর কবিসুলভ ভাবালুতা, উদাসীনতা, রাজনৈতিক অপরিপক্কতাসহ দাঁড়িয়েছেন এ ‘মাটির বুকের কথা’ শুনাতে! ছফার ভাষায়- একজন কবি যতোটুকু পারে তারচেয়ে বেশী দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়ানো!... এ জন্যই, হ্যাঁ এজন্যই- নির্যাতিত মানুষের বেদনায় নজরুলের এক ফোটা অশ্রু ভুলে থাকতে এবং ভুলিয়ে দিতে রবীন্দ্রনাথকে চাষ করতে হয়েছে শত শত ‘কলা’ বাগান। আর এখানেই নজরুল অনন্য- “খোদার আসন আরশ ছেঁদিয়া” ওঠা “চির উন্নত শির”। এবং এখানেই রবীন্দ্রনাথ নত শির! এই 'নজরুলে'র দিকে তাকাবে ভাবলেই পিলে প্রকম্পিত হতো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের! আর বঙ্গদেশী এসব পা চাটা সাম্রাজ্যবাদী সুশীলরা তো কোন ছাই!
বিষয়: সাহিত্য
১৯৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন