ছোট গল্প " কষ্টের অনলে সাগর জ্বলে " পর্বঃ ৩
লিখেছেন লিখেছেন কবি ও ঔপন্যাসিক শাহ্ আলম শেখ শান্ত ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ১০:২০:২৬ রাত
বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাক্ষাতকারে জানতে পেলাম,তাদের হৃদয় ভরা কষ্ট । এ কষ্ট স্বল্প বেতনের লাগি নয় , নেই বেতন বাড়ানোর দুঃচিন্তাও। চাকুরির মেয়াদ দীর্ঘায়ীত করার জন্যেও নয় । এই কিছুদিন আগেও মানুষ গড়ার কারিগড় হিসেবে শিক্ষকের যে সম্মান ও মূল্যায়ন ছিল । এখন তার বিন্দুমাত্র শিক্ষকের ভাগ্যে জোটেনা । মাত্র কয়েক দিবস পূর্বেও সালামের জবাব দিতে দিতে শিক্ষকদের মুথের ফেনা বের হতো । অনেক উস্তাদ আবার বিরোক্তবোধ করত । এখন শিক্ষকরা সালামের বড় কাঙ্গাল , তবুও সারাদিন একটি সালামও ললাটে জোটেনা । শিক্ষার্থীরা বরং তাঁদের সমূখে বীরত্বের বেশে স্বগৌরবে পদচারণা করে । যদি আত্মসম্মান কমে যায় তাই ভেবে হয়তো সালামটুকু দেয়না । সম্মানিত শিক্ষক মহাদয় বলেছিলেন , অধ্যাপক হয়েও পরিচয় দিতে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় ,লজ্জাবোধ করি । শিক্ষকতা যেন আজ পৃথিবীর সর্ব নিম্ন মানের পেশা । এর চেয়ে কোন তারকা হলে সম্মান সুখ্যাতি ঘিরে রাখতো । অথচ তারা নরকের পথ প্রদর্শক । আসলেই শিক্ষকদেরকে যেন আজ অনেকেই হেয় করে । শুধু তাই না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা গুরুদের "কাক " বা " কাউয়া "ব্যাঙ্গাত্ক নাম দিয়েছে । শিক্ষকদের অবমাননা অবজ্ঞাই আমাদের শিক্ষার আজ অবনতি । এখান থেকে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে গেলাম । এখানকার দৃশ্য আমাকে মর্মাহত করল । কতক শিশু , কিশোর , কিশোরী , পাগল ,হতদরিদ্র , অসহায় নর ও নারী কয়েক স্তর ময়লাযুক্ত ছেড়া পড়ে শায়িত উন্মুক্ত মেঝেতে । এটাই তাদের বাসস্থান । তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঝড়-বৃষ্টি ,শীত-গ্রীষ্মকে বরণ করে নিয়েছে । মোট কথা এরা পথের মানুষ নামেই পরিচিত । আর এদের সন্তানদের নাম টোকাই । পেটের ক্ষিদা নিবারণের জন্য কাগজ ও পরিত্যক্ত জিনিস কুড়িয়ে বিক্রির মাধ্যমে ২-১ টাকা রোজগার করে । এর ফলে সমাজের ভদ্র সমপ্রদায় এমন নাম করণ করেছে । টোকাইদের নীচু মানুষ নামে স্বীকৃতি দিয়েছে সমাজের ঐ ভদ্র ব্যক্তিবর্গ । অনেক কোটিপতির কাছে এরা মানুষ নয় , ডার্স্টবিনের বর্জ্য । সামনে পড়ল একটি নিষ্পাপ ছোট শিশু । বয়স তিন থেকে সোয়া তিন হবে অনুমান করলাম । আদুল গায়ে একটি কলা খাচ্ছে যার অধিকাংশই পঁচা । তার নাকের শ্লেমা ( সর্দি ) সেই কলাতে মিশ্রিত হচ্ছে । আমি জানার অধির আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম , বাবু তুমি কি খাচ্ছ ? খুব জোরে উপর নিঃশ্বাসের দ্বারা শ্লেমা মুখে টেনে নিয়ে উত্তর দিল , " কলা " । ভাত খাওনি কেন ? " ভাতা নাই " । এ কথা শুনে আমার আঁখি থেকে জল আসার উপক্রম । বুঝতে আমার বাকি রইল না । এ মাসুম শিশুটার উদরে দিনে একবারও ভাত যায় না । একটু আধটু কলা , বিস্কুট এটা সেটা খেয়ে দিন অতিবাহিত করে । আমি অসহ্য বোধ করে হোটেল থেকে ভাত ও মাংসের ব্যবস্থা করে দিলাম । ভাত দেখেই শিশুটি হৃদয়ের আহ্লাদে মুচকি হাসি দিল । আমি আনন্দ অনুভব করলাম এ গর্বে যে , এক দন্ডের জন্য হলেও একটি অসহায় শিশুকে হাসাতে পারছি । যদিও আমার সাধ্য ছিলনা অনেককে হাসানোর । আমি উপলোব্ধি করলাম সকল জীব হাসতে জানে । কিন্তু দুঃখ কষ্ট আর অভাব নামের মস্ত বড় ভারি পাথর হাসিকে চাপা দিয়ে রাখে । এ শ্রেণির লোকেরা যে কেমন সুখে আছে ? তা কারও অজানা নেই । তাই সাক্ষাতকার নেয়া প্রয়োজন বোধ করলাম না । এর মধ্যেই জুম্মার সালাতের আযানের ধ্বনি কর্ণে পৌছিল । আমরা অনতিবিলম্বে মসজিদের পানে রহনা হলাম । এ শহরের বৃহত্তর মসজিদ , এটি তিন তলা বিশিষ্ট আয়তকার । মন কারানো অনেক নকশা ও কারুকার্যে পূর্ণ মসজিদটি । প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আমি শান্তি অনুভব করলাম । সালাত শেষে দেখলাম , অনেকে ইমাম সাহেবের সাথে করমর্দন ও কোলাকুলি করছে । ইমাম সাহেবের চেহারা বেশ উজ্জ্বল ও মনোমুগ্ধকর । এক নজর দর্শনেই আমার হৃদয় সাক্ষ্য দিল , ওনি নিষ্পাপ । তাঁর নুরানী চেহারায় পাপের চিহ্ন আছে বলে মনে হলনা । আমার জীবনে প্রথম নুরানী চেহারার মানুষ যদি দেখে থাকি , তা হলো একমাত্র এই ইমাম সাহেব । কথায় কথায় আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা আর শব্দহীন মিষ্টি হাসি । আমার হৃদয় নিঃসন্দেহে স্বাক্ষ্য দিল , আমি সুখি ও চিন্তামুক্ত মানুষের খোঁজ পেলাম । খুশিতে আটখানা হয়ে সাক্ষাতকার নিয়ে হতভম্ব হলাম !
আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল । তিনি সারারাত জেগে জেগে অঝোড় নয়নে কাঁদে আর আল্লাহর নিকট পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করে । কারণ ক্ষমতা নেই হিসাব দিয়ে স্বর্গে যাবে । তাঁর ক্রদনের আওয়াজ আস পাশের সবাই শোনেন । স্বচোখে যখন তাঁর অশ্রু ঝড়ানোর কৃষ্ণ নালা দেখলাম । তখন নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম আর ভাবলাম । একজন বিখ্যাত আলেম পাপের ভয়ে আল্লাহর ডরে কাঁদে । আর আমি কি করছি ?
হৃদয় পূর্ণ চিন্তা নিয়ে লান্স করতে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম । সেখানে একজন ব্যক্তির খাবারের ধরণ দেখে একেবারে থ হলাম । লোকটির কি মোটাগাটা শরীর ! লম্বায় ছ'ফুটের অধিক হবে , আন্দাজ করলাম । গায়ের বর্ন উজ্জ্বল শ্যামলা । দাড়ি নেই , ইয়া বড় গোফ , চুল মাঝারি । সমুখে তার গেটা ছয়েক মুরগির রোষ্ট , গরু ও খাসি বাদ যায়নি । আর আস্তা ইলিশ মাছ গোটা পাঁচেক , তিনটি রুই মাছের মুন্ড । এক হালি ডিম আরও অনেক কিছু সবগুলো বললাম না । এ দেশে এমন খাদক মানুষ আছে ! আমি স্বচক্ষে না দেখলে হয়তোবা কখনই বিশ্বাস করতাম না ।
বিষয়: সাহিত্য
২২২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন