ছোট গল্প " কষ্টের অনলে সাগর জ্বলে " পর্বঃ ২
লিখেছেন লিখেছেন কবি ও ঔপন্যাসিক শাহ্ আলম শেখ শান্ত ১২ আগস্ট, ২০১৩, ১০:১৮:১৮ সকাল
আব্বা নিজের নাম ব্যতীত অন্য একটি কার চিহ্ন বা বর্ণ লিখতে অক্ষম ছিল । সখের বেশেও একদিন স্কুলের ভেতর প্রবেশ করেনি । বড় ভাই তাকে হাতে ধরে স্বাক্ষর শিখিয়েছেন । জানার স্পৃহা সমন্ধে উত্সাহ উদ্দীপনা শান্তনা পেতাম শুধু মাত্র মায়ের কাছ থেকে । আর অন্যদের নিকট ছিলাম চক্ষুশুল ।আমার সঙ্গ তাদের মনে হত তিক্তময় । মায়ের আশ্বাস আমার জীবনে বিন্দু মাত্র মিথ্যে হয়নি । বিজ্ঞান নিয়ে মেট্রিক ও আই এ পাশ করেছি বেশ সম্মানজনক ফলাফলে । আর উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়ে অনার্স পড়ছি । এখন ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী তাই শৈশবের অজ্ঞত বিষয় সমন্ধে বেশ অবগত । মানুষের হরেক রকম জানার বা দেখার কৌতুহল থাকে আমিও তাদের থেকেও ভিন্ন নই । আমার হঠাত্ বড় স্বাধ জাগল বিভিন্ন পেশার মানুষের অবস্থা জানতে । তারা কেমন আছে ? তাদের মনে কি সুখ ও শান্তি আছে ? তাদের কি কোন দুঃখ কষ্ট আছে ? থাকলে তা কিসের জন্য ? আর প্রধান উদ্দেশ্য হলো একজন সুখি ও শান্তিপূর্ণ মানুষ খুঁজে বের করা । তাই একদিনের সাংবাদিক হওয়া আবশ্যক । ফলে বিষয়টি ফোন করে জানালাম শাহেদকে । সে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু । অল্প সময়ে সাংবাদিক জগতে অনেক সুনাম ও সুখ্যাতির পদ চিহ্ন রেখেছে । অসম্মতি না করে বলল,শুক্রবার হলে উত্তম হয় । আমি মহা আনন্দ অনুভব করলাম । একদিনের সাংবাদিক হতে পারব বলেই । শুক্রবার শাহেদ ও ক্যামেরা ম্যান আমার বাসায় হাজির । নাস্তা সেরেই আমরা মাঠে নেমে পরলাম । ক্যামেরা ম্যানকে পূর্বেই নির্দেশ করেছি অতি যত্নেরসহিত ভিডিও করতে । সর্ব প্রথম এক বৃদ্ধ ভিক্ষারির সাক্ষাতকার নিতে শুরু করলাম । শুরুতেই সালাম দিয়ে বললাম , চাচা বেয়াদবি মার্জনা করবেন । বলেন তো ভিক্ষাবৃত্তি কি ভাল কাজ । " না , বাবাজি " । তাহলে করেন কেন ? " মোর কপালোত যে ন্যাকা আচিল,বাবা " । ভাষায় বুঝলাম রংপুরা লোক । আপনার ছেলে মেয়ে নেই ? কোন জবাব এলো না । লক্ষ্য করে দেখলাম , বেচারার মুখটি মলিন চোখ দুটি অশ্রুতে ছল ছল করছে । পুনরায় শুধালাম , কাঁন্নার স্বরে উত্তর দিল , " নাই "। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না । কারণ নিঃসন্তান লোকের দর্শন হাজারেও একজন জোটেনা । তাই বললাম , আপনি বুঝি মিথ্যা বলছেন । সত্য কয়া কি নাব ? এ বলেই একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল । আমি চুপ থাকলাম ,এর উত্তর আমার কাছে নেই । দু হাতে চোখের পানি মুছে বলতে লাগল , " মোর তিন বেটা , বেটি নাই " । " ছোডো থাকতে মোর বউ কলেরায় মারা যায় " । " মাসুম বাচ্চাগুলের কষ্টের কতা চিন্তে করি, আর বিয়ে করং নাই " । "কামলা কিশ্শেন খাডিয়ে বেডা তিনটেক বড় কইচ্চং "। আমি কৌতুহলের জিজ্ঞাসিলাম , পড়া লেখা লেখা শেখাননি ? " স্কুলোত পাডাইচং ঠিকে ,কপাল পোড়ারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলা খেলাইচে " । অল্প বয়সে বিয়ে পাগল হইলো , সবাইকে বিয়ে দিনু । মনে মনে আশা কন্নু এবার বসিয়ে খাবার পাইম । কিন্তু সবাই মোর ঘাড়ত ভিক্ষের ঝোলা দিয়ে জুদে খায় । মোক কিছু দিলে বেডার বউয়েরা ঝগড়া করি নাড় ভুড়ি ধুইয়ে ফেলায় । এই জন্যে ওমারগুলেক মুক্তি দিয়ে শহরোত আইচ্চোং । এ করুণ কাহিনী শুনে মনে ভীষণ পেলাম । একটি লম্বা শ্বাঃস ছেড়ে বেদনা হালকা করে বললাম , চাচা এখন কেমন আছেন ? " ভাল নাই " । কেন ? " ফকিরের সংখ্যা যে হারে বাইত্তেছে ,তাতে করি আসল ফকির ভিক্ষে পায়না "। " অনেক আলসিয়ে মানুষ এই পেশায় নাইম্চে , কিন্তু চেহারা দেইকলে মনে হয় হা ডু ডু খেলার পেলেয়ার । সামনের দিনে এমন অবস্থা হইবে ফকিরের জ্বালায় মানুষ ঘর থাকি বাইরে হবার নয় । একজন ভিক্ষারির মুখে এমন গুরুত্বপূর্ণ সত্য কথা আমাকে অবাক করে দিল । আরও আশ্চার্য হলাম চাচার বিবেকশুন্য পশুরতুল্য ছেলেদের কথা ভেবে । বিদায় নিলাম এখান থেকে । শাহেদ আমাকে বললো , "তুই হবি ভাতে মরা সাংবাদিক" । "কেন " ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম । সাক্ষাতকারে জীবন বৃত্তান্ত শুনলে মরণের পরেও সাক্ষাতকার শেষ করতে পারবিনা । পরবর্তী সাক্ষাতকারগুলো খুবই সংক্ষেপে নিলাম । এদের অধিকাংশই যুবক-যুবতী ও তরুণ-তরুণী । কেউ ভুগছে ব্যর্থ প্রেমে । কেউ মনের মানুষ খুঁজতে মরিয়া হয়ে ছুটছে । কারো আবার মনের মানুষ ৭-৮ জন করে ।রুটিন করা আছে ,কবে কার সাথে সারাদিন কাটাবে ? কোথায় কোন পার্কে কোন লেকে বসবে । কোন রেস্টুরেন্টে লান্স হবে ? কি রকম খাবারের আইটেম থাকবে ? নৈশ্য ভোজ কোথায় হবে ? খাবারের ব্যবস্থা কেমন হবে ? সবকিছু পূর্ব থেকেই নির্ধারিত করা । সপ্তাহের দৈনিক দিন তার মহা ব্যস্ততা । একজনের মন জোগাতে অন্য জনকে কষ্ট দিতে হয় , মিথ্যা বলতে হয় অহরহ । এতেও সুখ নেই শান্তি নেই , সর্বক্ষণ দুঃচিন্তায় ব্যস্ততায় সময় কাটে । একজনের সঙ্গে ঘোরার সময় অন্য জন দেখলো কি না , এ সংশয় অশান্তিতে ভোগায় । স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারেনা ,পরাধীনতার অনলে পুড়ে ছাই হয় । আবার অনেকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সুজন মিলছে না ।কেউ আবার ব্যর্থ প্রীতির অনলে পুড়ে কৃষ্ণ হয়ে নেশার রাজ্যে বসত করছে । মূল্যবান জীবনটাকে অপদার্থে পরিনত করছে স্বহস্তে । পোশাক শিল্পের কয়েকজন শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ,তাদের কেহ কেহ দু বেলা ডাল ভাত জোটাতে অক্ষম । অনেকে শহর সংসারে পরাজিত হয়ে গাঁয়ে প্রত্যাবর্তন করছে । রোদে পিঠ পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জীবন বাঁচার জন্যে অবিরাম লড়ছে । আমার মতে এর মূল কারণ নিম্ন বেতন । তাতে দ্রব্যমূল্যের আকাশ চুম্বি অগ্রগতি । সেই সাথে বাড়িওয়ালাদের ভাড়া বাড়ানোর অমানবিক অত্যাচার । সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের লোকদের বাস করা দুর্বিসহ । পরে কয়েকজন ডাক্তারের সাক্ষাতকারে বুঝলাম । কেউ কেউ রোগি দেখতে দেখতে চরম বিরক্তিবোধ করে । এক এক জন রোগির ভাগ্যে মিনিট পাঁচেকও সময় জোটেনা । ডাক্তার সাহেব রোগীর সমস্যা শোনার পূর্বেই ব্যবস্থাপনাপত্র লিখে ফেলেন । আর এ লেখা সাধারণ কোন শিক্ষিত জনের পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন । আর এমনও ডাক্তার আছে যার ললাটে পুরো দিনে দু একটি রোগি জোটেনা । সংসার চালানোর দুঃচিন্তায় ভোগছে ।যাকে বলা হয় ভাতে মরা ডাক্তার । কেহ কেহ অনিরাময় পীড়ায় আক্রান্ত ডাক্তার হয়েও আরোগ্য করতে অক্ষম । মোট কথা এরাও কোনভাবেই সুখে নেই , শান্তিতে নেই ।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন