‘মধ্যযুগীয়’ মানে কী
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্দাল ০৯ জুন, ২০১৩, ০৭:৫৭:৩১ সন্ধ্যা
মধ্যযুগ ও বর্বরতা-এই দুইটি শব্দকে সুশীল সমাজের অনেকেই সমার্থক বিবেচনা করিয়া থাকেন। অমানুষিক ও নির্দয় কার্যকলাপকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলিয়া বিশেষায়িত করিবার প্রবণতা মোটেও বিরল নয়। কাহারও নীতি-আদর্শ ও চিন্তাধারার নিন্দা করিতেও এই বাগধারাটি হামেশাই ব্যবহূত হইয়া থাকে। অতঃপর কৌতূহলী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিতে পারে যে, ইতিহাসের কোন সময়টি আসলে মধ্যযুগ? সেই সময়ে কিইবা এমন ঘটিয়াছিল, যাহার জন্য প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক এবং ঔপনিবেশিকতার কালপর্ব ছাপাইয়া মধ্যযুগের বর্বরতা অমোচনীয় হইয়া গিয়াছে, সভ্যতার ললাটে কলঙ্কচিহ্ন হইয়া রহিয়াছে! এক্ষণে এই বিষয়ে কিঞ্চিত্ আলোকপাত করা যাইতে পারে বৈ কি।
ইতিহাসবিদগণ পাঁচ শত খ্রিষ্টাব্দ হইতে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালপর্বকে মধ্যযুগ বলিয়া আখ্যায়িত করেন। এই সহস্রবর্ষের ইতিহাস বিশ্বময় ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং মুসলমান শাসকদের বিজয়গাথায় পরিপূর্ণ। আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে মধ্যযুগের ঊষাকাল ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদের (সা.) রিসালতের মাধ্যমে। নির্জন হেরাগুহায় নবীর (সা.) নিকট আল্লাহুতায়ালা অবতীর্ণ করেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। মদীনায় রাষ্ট্রগঠন এবং মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়া অবসান ঘটে আরবের বর্বর যুগের। খোলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফতের সময়ে সূচিত হয় ইসলামের বিজয় অভিযান। ইসলামের প্রেরণায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে পুনর্জাগরণ ঘটে। ফিলিপ কে, হিট্টি লেখেন, ‘হাজার বছর পাশ্চাত্য অধীনতায় থাকার পর পুনরায় আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্য।’ পতন ঘটে রোম সাম্রাজ্যের। বাইজেনটাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য মুসলিম খেলাফতের অধীনে চলিয়া আসে।
মধ্যযুগের ইতিহাস এমন নয় যে, অবিমিশ্র সুখ ও সমৃদ্ধির। আবার এমনও নয় যে, বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় ইতিহাসের সকল কালপর্বকে ইহা ছাড়াইয়া গিয়াছিল। মানবিকতা ও বর্বরতা, সুশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতা, উত্কর্ষ ও অনুত্কৃষ্টতা সব কালেই কমবেশি ছিল এবং আছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের বিকাশ ও বিজয়ের সহস্র বর্ষকে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদগণ বর্বরতার যুগ হিসাবে কেন বিশেষায়িত করিয়াছেন তাহা সহজেই অনুমেয়। অথচ এই মধ্যযুগে জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, শিল্প-সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তার বিপুল বিকাশ ঘটে।
আমরা যদি উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যযুগের মূল্যায়ন করি, তাহা হইলেও দেখিতে পাওয়া যায় উত্কর্ষ অর্জনের অব্যাহত প্রয়াস। মধ্যযুগে আমাদের এই উপমহাদেশ কোনো অখণ্ড সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল না। পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসন হীনবল হইয়া যাইতে শুরু করে। এগার শতকের আগে পর্যন্ত এই উপমহাদেশে মুসলমান শাসকের আগমন ঘটে নাই। ১১শ এবং ১২শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ রাজ্যই মুসলমানদের দখলে চলিয়া যায়। মুসলিম বিজয়ের পর উপমহাদেশে সামাজিক সম্পর্কের নূতন মেরুকরণ শুরু হয়। হিন্দু-মুসলমানের মেলবন্ধন রচিত হইতে শুরু করে এই সময়ে। বিদেশাগত মুসলমানরা যেমন এই অঞ্চলের সনাতন সংস্কৃতির অনেক কিছুই মানিয়া নেয়, তেমনই সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও বহিরাগত জীবন-সংস্কৃতির বহু কিছু আপনার করিয়া লয়। গোটা মধ্যযুগ ধরিয়া ভারতবর্ষে দেখা যায় শক্তিশালী গ্রামীণ সমাজ এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল। শাসকগণ বহু জনহিতকর কাজ করিয়াছেন। প্রজাপালনে তাহাদের বদান্যতা ছিল যথেষ্ট। সুলতানি আমলে উপমহাদেশে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের সবিশেষ উত্কর্ষ সাধিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এই সময়ে নবতর বিকাশের পথ খুঁজিয়া পায়। অন্যদিকে এই মধ্যযুগের শেষভাগে আসিয়া ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হইলে সাহিত্য-দর্শন এবং চিন্তা জগতে যুক্ত হয় নূতন মাত্রা। ঐতিহাসিক ম্যাগনাকাটা সনদের মাধ্যমে ব্রিটেনের রাজনীতির নূতন বিকাশ ঘটিতে শুরু করে।
তাহারপরও ইহা অসত্য নয় যে, মধ্যযুগে বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে নৃপতি এবং সামন্ত শ্রেণীর অত্যাচার-শোষণ অব্যাহত ছিল। আর, এই উপমহাদেশে বৈদিক যুগ হইতে চলিয়া আসা ক্রীতদাস প্রথাও বহাল ছিল যথারীতি। ছিল সতীদাহ প্রথা। এইসব নৃশংসতা ও অমানুষিকতার কোনোটিই কিন্তু মধ্যযুগের সৃষ্ট নয়, সর্বব্যাপীও নয়। দেশ-কাল ও পাত্রের প্রভেদ ছিল। কাজেই কোনো একটি যুগকে বিশেষায়িত করিবার আগে ইতিহাসের নিবিড় পাঠ একান্ত প্রয়োজন।
[বি: দ্র: লেখাটি ১৪ মে মঙ্গলবার ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়। বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে]
বিষয়: বিবিধ
১৩২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন