রাজনীতিবীদ হিসেবে গোলাম আযম:এবনে গোলাম সামাদ(নয়া দিগন্ত)
লিখেছেন লিখেছেন শুভ্র কবুতর ২০ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:৩০:৪৩ সকাল
১৯০৬ সালে ডিসেম্বর
মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়
তদানীন্তন নিখিল ভারত
মুসলিম ‘শিক্ষা সম্মেলন’।
এতে যোগ দেন তদানীন্তন
ভারতের বিশিষ্ট মুসলিম
নেতৃবৃন্দ। নেতৃবৃন্দ স্থির
করেন, শিক্ষা সম্মেলন
শেষে এই
উপমহাদেশে মুসলমানদের
রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের
জন্য একটি রাজনৈতিক দল
গঠন করা যায় কি না,
সে প্রসঙ্গে আলোচনার। ২৯
ডিসেম্বরে শিক্ষা সম্মেলন
শেষ হয়। ৩০ ডিসেম্বর
শিক্ষা সম্মেলনের
প্যান্ডেলে ভারতের বিভিন্ন
প্রদেশ থেকে আগত
নেতারা ঢাকার নবাব
সলিমুল্লাহর
সভাপতিত্বে সিদ্ধান্তে আসেন
যে, মুসলিম লীগ
নামে গড়া হবে এই
উপমহাদেশের মুসলমানদের
স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য
একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল।
১৯০৭ সালের মার্চ
মাসে আলিগড়ে এক বিশেষ
সভায় গ্রহণ করা হয় মুসলিম
লীগের গঠনতন্ত্র। মুসলিম
লীগের প্রথম বার্ষিক
সম্মেলন হয় ১৯০৭ সালের ২৯
ডিসেম্বর করাচিতে।
এতে সভাপতিত্ব করেন
আদমজী পীরভাই। এভাবেই শুরু
হয় এই উপমহাদেশের মুসলিম
রাজনীতি। ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ
অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত
মুসলিম লীগ সম্মেলন। এ
সম্মেলনে ফজলুল হক উত্থাপন
করেন ঐতিহাসিক লাহোর
প্রস্তাব। যাতে বলা হয়,
তদানীন্তন ভারতের
মুসলিমপ্রধান অঞ্চল
নিয়ে গঠিত
হতে হবে একটি পৃথক রাষ্ট্র,
পাকিস্তান। এর আট বছরের
মধ্যে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট
জন্ম নেয় পাকিস্তান।
কোনো রাজনৈতিক
আন্দোলনের এত অল্প সময়ের
মধ্যে এ রকম সাফল্য
রাজনীতির ইতিহাসে যথেষ্ট
বিরল ঘটনা। পাকিস্তান
আন্দোলন ঠিক
একটি ধর্মনৈতিক আন্দোলন
ছিল না। যদিও ইসলাম ছিল এর
অন্যতম উপাদান। পাকিস্তান
আন্দোলনের ভিত্তি ছিল
মুসলিম জাতীয়তাবাদ। যার
উদ্ভব হতে পেরেছিল এ
উপমহাদেশে উগ্রহিন্দু
জাতীয়তাবাদের
প্রতিক্রিয়া হিসেবে। প্রখ্যাত
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Percival
Spear বহুল পঠিত The Oxford
History of India (১৯৫৮)
বইতে বলেছেন, The Pakistan
movement nationalism over the
Islamic conception of a separate
culture and so converted a cultural
and religious entity into a separatist
political force. এর
টানা বাংলা করলে দাঁড়ায়Ñ এই
উপমহাদেশের মুসলমান
নেতারা মুসলিম
জাতীয়তাবাদকে রূপ দিতে চান
ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের
পোশাকে। ইসলামি সংস্কৃৃতির
স্বাতন্ত্র্য ও ধর্ম
চেতনাকে তারা করে তুলতে পারেন
একটি রাজনৈতিক শক্তি।
কিন্তু এই জাতীয়তাবাদের
মধ্যে ছিল বেশ
কিছুটা অসঙ্গতি; যা মুসলিম
নেতৃবৃন্দের
চোখে আগে ধরা পড়েনি।
ভাষা জাতীয়তাবাদের
একটি বিশেষ উপকরণ।
সারা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমান
এক ভাষায় কথা বলতেন না।
তাদের মধ্যে ছিল ভাষাগত
পার্থক্য। পার্থক্য ছিল
ইতিহাসের ধারায়। যেমনÑ ১৩৩৮
থেকে ১৫৭৬ পর্যন্ত
বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল
একটি পৃথক স্বাধীন
সালতানাত।
যাকে বলা হতো সালতানাত-ই-
বাঙ্গালা। এই স্বাধীন
সুলতানদের
শাসনামলে ঘটতে পেরেছিল
বাংলা ভাষার বিশেষ বিকাশ।
সাবেক পাকিস্তানের দুই
অংশের মধ্যে ছিল ১৭০০
কিলোমিটারের ব্যবধান।
ইতিহাস, ভাষা ও ভূগোলের এই
ব্যবধান পাকিস্তান হওয়ার পর
পেতে থাকে বিশেষ প্রকটন।
গোলাম আযম
প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ভাষার
কথা আসছে। কারণ
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিয়েই
গোলাম আযমের
রাজনীতি জীবনের শুরু।
গোলাম আযম ১৯২২ সালে ৭
নভেম্বর জন্মেছিলেন ঢাকায়।
তার বাল্যশিক্ষা লাভ
ঘটে মাদরাসায়। উর্দু ভাষার
সাথে তার পরিচয় ছিল। ঢাকায়
জন্মে এবং মাদরাসায় পড়েও
তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ
নিয়েছিলেন
বাংলাকে পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম
ভাষা করার আন্দোলনে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন
যে, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ
বা পূর্ব
পাকিস্তানে সরকারি ভাষা উর্দু
করার কোনো প্রস্তাব ছিল না।
প্রস্তাব ছিল, কেবল
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
সরকারি ভাষা হবে একমাত্র
উর্দু। এখানে আরো উল্লেখ
করা প্রয়োজন যে, বঙ্গীয়
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের
ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ
বৈঠকে, ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭
সালে প্রস্তাব নেয়া হয় যে,
উর্দুকে পূর্ব বাংলার
সরকারি ভাষা করা হবে না,
অর্থাৎ
ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন হয়,
তা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের
দাফতরিক ভাষা নিয়ে। পূর্ব
বাংলার সরকারি কাজকর্মের
ভাষা কী হবে তার সিদ্ধান্ত
নেয়ার অধিকার ছিল
তদনীন্তন পূর্ব বাংলার
প্রাদেশিক আইনসভার। এর
সাথে পাকিস্তান সরকারের
কোনো যোগাযোগ ছিল না।
প্রাদেশিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
নেয়ার অধিকার ছিল
প্রাদেশিক আইনসভার।
বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন।
কারণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের
ইতিহাস প্রসঙ্গে লেখা বেশির
ভাগ গ্রন্থতেই থাকতে দেখা যায়
যথেষ্ট অস্পষ্টতা।
একটি গানে বলা হয়েছেÑ
ওরা আমার মুখের
ভাষা কাইড়া নিতে চায়। কিন্তু
পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের
ভাষা কেড়ে নেয়ার
কোনো কথা তখন উঠেছিল না।
এখন একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন
করা হচ্ছে মাতৃভাষা দিবস
হিসেবে। কিন্তু
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে মাতৃভাষা আন্দোলন
হিসেবে চিহ্নিত
করা ঐতিহাসিকভাবে যথাযথ
হচ্ছে বলে মনে করার
কোনো কারণ নেই।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের
আরম্ভকাল হিসেবে ধরা যায়
১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চকে; কারণ এ
সময় জিন্নাহ সাহেব ঢাকায়
এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমাবর্তন
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন,
উর্দুই হবে পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র
সরকারি ভাষা। এর পরদিন
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের
সভায়ও তিনি বলেছিলেন একই
কথা। সমাবর্তন
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা করেছিলেন জিন্নাহ
সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদ।
এ প্রতিবাদ দিয়েই আরম্ভ
হতে পেরেছিল
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
জিন্নাহ সাহেব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন
অনুষ্ঠানে এবং ঢাকার
রেসকোর্স
ময়দানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন
বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায়; উর্দু
ভাষায় নয়। আসলে উর্দু
জিন্নাহ সাহেবের
মাতৃভাষা ছিল না। আর
তিনি প্রাঞ্জলভাবে উর্দু
ভাষায় বক্তৃতা দিতেও পারতেন
না। তার মাতৃভাষা ছিল পোর
বন্দরের প্রচলিত
গুজরাটি ভাষা। জিন্নাহ সাহেব
১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর
ইন্তেকাল করেন।
প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত
আলী খান। লিয়াকত
আলী ছিলেন ভারতের উত্তর
প্রদেশের লোক।
পরে তিনি আসেন
পাকিস্তানে। তার
মাতৃভাষা ছিল উর্দু। লিয়াকত
আলী সাহেব ১৯৪৮ সালের
শীতকালে ঢাকায়
এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
জিমনেসিয়াম মাঠে এক বিরাট
ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেন।
তিনি তার এ বক্তৃতায় বলেন,
একমাত্র উর্দুই
হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
সরকারের সরকারি ভাষা।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা করেন এর প্রতিবাদ। এ
সময় গোলাম আযম ছিলেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
সংসদের সাধারণ সম্পাদক
(জিএস)। তিনি পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম
ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ
করার জন্য লিয়াকত
আলীকে নিজ হাতে প্রদান
করেন
স্মারকলিপি (Memorandum)।
কাজটি ছিল খুবই সাহসের।
কারণ এ সময় পাকিস্তানের
নেতাদের
কোনো বিরোধিতা করলেই
তাকে সন্দেহ
করা হতো ভারতের চর হিসেবে।
আর সাধারণ মানুষের
কাছে হতে হতো লাঞ্ছিত। পূর্ব
বাংলার অনেক অভিজাত
মুসলিম পরিবারে উর্দু ভাষার
চল ছিল। ঢাকার মুসলমানদের
ওপরও ছিল উর্দু ভাষার প্রভাব।
এ সময় গোলাম আযম পড়েন
ঢাকার একদল মানুষের হাতে;
যারা প্রহার করতে চায়
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার
দাবি করেছেন বলে। গোলাম
আযম তাদের উদ্দেশে বলেনÑ
ভাই, আমাকে মারতে হলে,
আমাকে তার আগে কিছু
বলতে দিন।
তিনি জনতাকে লক্ষ্য
করে বলেন, কেন
তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে?
জনতা তার বক্তৃতা শুনে শান্ত
হয়। গোলাম আযম ও তার
সাথে আরো যে ক’জন ছাত্র
ছিলেন, তারাও সম্ভাব্য
প্রহারের হাত
থেকে পেতে পারেন রক্ষা। এ
ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন
মোহাম্মদ তোয়াহা, তার এক
বিশেষ সাক্ষাৎকারে। তোয়াহা এ
সময় ছিলেন ঢাকার ছাত্রদের
মধ্যে একজন জনপ্রিয় নেতা।
গোলাম আযমের
চেয়ে তিনি ছিলেন অধিক
পরিচিত। গোলাম আযমের
সাথে তোয়াহা সেই দিন
আটকা পড়েছিলেন
মারমুখী জনতার হাতে। কিন্তু
গোলাম আযমের
বক্তৃতা পেরেছিল
জনতাকে শান্ত করতে। এ কম
কৃতীর পরিচায়ক নয়। গোলাম
আযম কেবল যে লিয়াকত আলীর
হাতে সাহস করে মেমোরেন্ডাম
দিয়েছিলেন, তাই নয়।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যোগ
দিয়েছিলেন
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে।
লিয়াকত আলী ১৯৫১ সালের ১৬
অক্টোবর
রাওলপিন্ডিতে নিহত হন
ঘাতকের গুলিতে। লিয়াকত
আলীর পর ক্ষমতায় আসেন
খাজা নাজিমুদ্দিন।
তিনি ছিলেন ঢাকার লোক।
কিন্তু খাজা পরিবারের
মাতৃভাষা বাংলা ছিল না।
খাজা পরিবারে প্রচলিত ছিল
উর্দু। খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২
সালে ২৬
জানুয়ারি করাচি থেকে ঢাকায়
এসে পল্টন ময়দানে এক বিশাল
জনসভায় বলেন, একমাত্র উর্দুই
হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
সরকারের সরকারি ভাষা। শুরু
হয় ঢাকায়
বিশেষভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
১৯৫২ সালের ২১
ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকায়
মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ
করেন। মিছিলের ওপর
চলে গুলি। মারা যান তিনজন।
তারা অবশ্য কেউই
মিছিলে ছিলেন না। ছিলেন
বেশ কিছু দূরে। কিন্তু এই
গুলি চলার পর সারা পূর্ব
পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন
গ্রহণ করে বিপ্লবী রূপ।
ভাষা আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল
ছাত্রদের মধ্যে। ছাত্রদের
অন্যতম বক্তব্য ছিল, উর্দু
কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র
ভাষা হলে বাংলা যাদের
মাতৃভাষা, তারা কেন্দ্রীয়
সরকারে প্রতিযোগিতামূলক
পরীক্ষা দিয়ে পেতে পারবেন
না ওই পদে চাকরি। কেন্দ্রীয়
সরকারের কর্তৃত্ব
চলে যাবে উর্দুভাষীদের হাতে।
তারাই হয়ে উঠবেন
সারা পাকিস্তানের প্রকৃত
শাসক। বায়ান্নর
ভাষা আন্দোলন লাভ
করতে পেরেছিল সাধারণ
জনসমর্থন। এর অনেক কারণ
ছিল। সাবেক পাকিস্তানের
মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের
বেশি ছিলেন বাংলাভাষী।
বাংলাভাষীরা প্রদান করতেন
সাবেক পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় রাজস্বের অর্ধেকের
বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের পাট
ছিল সেই সময়ের পাকিস্তানের
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের
প্রধান উপায়। কিন্তু এই পাটের
ব্যবসায় চলে গিয়েছিল
উর্দুভাষী ব্যবসায়ীদের হাতে।
কারণ পাট ব্যবসায় করার
মতো পুঁজি তাদের হাতেই ছিল;
পূর্ব পাকিস্তানের
বাংলাভাষী মুসলমানের
হাতে নয়। ১৯৫২ সালে চলেছিল
কোরিয়ার যুদ্ধ। পাটের
চাহিদা গিয়েছিল যথেষ্ট
বেড়ে। কিন্তু পূর্ব
পাকিস্তানের পাটচাষিরা এই
চাহিদা বৃদ্ধি থেকে লাভবান
হতে পারছিলেন না।
উর্দুভাষীদের
বিরুদ্ধে সৃষ্টি হতে পেরেছিল
বাংলাভাষী কৃষক জনতার বেশ
কিছু বিরূপতা। ভাষা আন্দোলন
তাই হয়ে উঠতে পেরেছিল খুবই
জোরালো। এ সময় গোলাম আযম
ছিলেন রংপুরের কারমাইকেল
কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিভাগের প্রভাষক।
তিনি প্রভাষক অবস্থায়ই
রংপুরে যোগ দেন
ভাষা আন্দোলনের মিছিলে।
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
গোলাম আযমের চাকরি চলে যায়।
সরকারপক্ষ থেকে প্রস্তাব
দেয়া হয় যে, গোলাম আযম
যদি মুচলেকা দেন, তিনি আর
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করবেন
না;
তা হলে ফিরে পেতে পারবেন
তার চাকরি। কিন্তু গোলাম
আযম মুচলেকা দিতে অস্বীকার
করেন। সেই সময় এতটা মানসিক
শক্তি খুব কম লোকেরই ছিল।
গোলাম আযমের
পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
সম্পর্কে আমরা খুব জানি না।
তিনি যোগ দেন
জামায়াতে ইসলামীতে।
তিনি বাল্যে মাদরাসার ছাত্র
ছিলেন। হতে পারে তার
ইসলামি শিক্ষার এই
পটভূমি তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল
ইসলামপন্থী হতে। আজ গোলাম
আযমের বিচার হচ্ছে।
বলা হচ্ছে যে, তিনি ১৯৭১-এ
যুদ্ধে নিয়েছিলেন
পাকিস্তানের পক্ষ।
তিনি পাকিস্তানের পক্ষ
নিয়েছিলেন, কারণ
তিনি চাননি সাবেক
পাকিস্তান ভেঙে যাক। এ
ছাড়া তিনি মনে করেছিলেন,
ভারতের সহায়তায় সাবেক
পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ঠিক
হবে না। কারণ, এর
ফলে বাংলাদেশ প্রকৃত
স্বাধীনতা না পেয়ে চলে যেতে পারে ভারতের
নিয়ন্ত্রণে। যেমন
হয়েছে কাশ্মিরের দশা।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত
হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।
পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের সদস্য
হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। পাকিস্তান
ছিল
আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত
স্বাধীন দেশ। ভারত চাচ্ছিল
সাবেক
পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত
করতে। যেটা গোলাম আযম
সমর্থন করতে পারেননি।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য
যে, গোলাম আযম পাকিস্তান
সরকারকে বলেছিলেন ১৯৭০
সালের ভোটের
রায়কে মেনে নিতে এবং শেখ
মুজিবের হাতে ক্ষমতা প্রদান
করতে। কিন্তু তার
সে কথাকে মূল্য দেয়া হয়নি।
১৯৭১-এর পরিস্থিতি ছিল খুবই
জটিল। আওয়ামী লীগের অন্য
নেতারা ভারতে গেলেও শেখ
মুজিব
চেষ্টা করেননি ভারতে যেতে।
যদিও
তিনি ভারতে যেতে চাইলে যেতে পারতেন
খুবই সহজে। শেখ মুজিব ঠিক
কী চেয়েছিলেন,
আমরা তা জানি না। ১৯৭৪ সালের
৩০ অক্টোবর মার্কিন
পররাষ্ট্র দফতরের
সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জারকে ঢাকায়
কথোপকথনের সময় বলেন, ১৯৭১-
এর যুদ্ধ ছিল গৃহযুদ্ধ (Civil war)।
তিনি ১৯৭১-এর
যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলে উল্লেখ
করেননি। তার এই
কথোপকথনের দলিল ছিল
গোপন। ২০০৭ সালের ১১
অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্র
দফতর থেকে এই গোপন দলিল
প্রকাশ করা হয়। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩০ বছর
পরপর অনেক গোপন দলিল
প্রকাশ করা হয়। কারণ,
মনে করা হয়, এসব গোপন দলিল
প্রকাশ
করা হলে সুবিধা হবে ইতিহাস
গ্রন্থ রচনার। শেখ মুজিব
কিসিঞ্জারের
সাথে কথালাপের সময় ১৯৭১-এর
যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ না বলে কেন
গৃহযুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ
করেছেন,
তা আমরা বলতে পারি না। যদিও
আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর
যুদ্ধকে মহান মুক্তিযুদ্ধ বলেই
উল্লেখ করে থাকে। শেখ মুজিব
কী চেয়েছিলেন তা অন্য
কারণেও আমরা বলতে পারি না।
শেখ মুজিব ১৯৭০
সালে নির্বাচন করেছিলেন
ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত লিগ্যাল
ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার মেনে।
যাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান
হবে একটি প্রজাতন্ত্র।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান সব
সময় হবেন একজন মুসলমান, আর
রাষ্ট্রিক আদর্শ
হিসেবে পাকিস্তান
মেনে চলবে ইসলামি ভাবাদর্শ।
শেখ মুজিব এই শর্তগুলো মেনেই
করেছিলেন নির্বাচন। এর
মধ্যে কোথাও ছিল
না পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার
কথা। শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের
বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন,
তিনি হলেন পাকিস্তানের
মেজরিটি পার্টির নেতা।
তিনি নিজেকে ঘোষণা করেননি পূর্ব
পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের
নেতা হিসেবে। ভোটের রায়
মানলে সাবেক পাকিস্তান
ভেঙে যেত এরকম ভাবার
কোনো কারণ নেই। শেখ মুজিব
সাবেক
পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে চাননি।
তিনি ৮ জানুয়ারি বর্তমান
পাকিস্তান
থেকে মুক্তি পেয়ে যান লন্ডনে।
সেখানে গিয়ে সাংবাদিক
এ্যান্থনি মাসকারেনহ্যাসকে বলেন,
তিনি পাকিস্তান
ভেঙে দিতে চাচ্ছেন না।
বর্তমান পাকিস্তানের
সাথে রাখতে চাচ্ছেন
একটা বিশেষ সম্পর্ক।
যে সম্পর্ক
সম্বন্ধে তিনি পরে বিশদ
অবগত হবেন। আজ অভিযোগ
করা হচ্ছে, গোলাম আযম
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা চাননি। কিন্তু
প্রশ্ন তোলা যায়, ১৯৭১
সালে শেখ মুজিব ঠিক
কী চেয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে।
গোলাম আযমকে যদি অভিযুক্ত
করা যায় বাংলাদেশের
স্বাধীনতা না চাইবার জন্য;
তবে সেই অভিযোগ
উঠতে পারে আরো অনেকেরই
বিরুদ্ধে।
ব্যক্তিগতভাবে গোলাম আযম
আওয়ামী লীগের অনেক
নেতা সম্পর্কেই যথেষ্ট অবগত
ছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা,
তাজউদ্দীন আহম্মদ
সম্পর্কে বলেছেনÑ
তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট
পার্টির সদস্য। কমিউনিস্ট
পার্টির নির্দেশেই
তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগে।
তোয়াহা বলেছেন,
তাজউদ্দীনের মাধ্যমে ১৯৬২
সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট
পার্টি আওয়ামী লীগের সব
ভেতরের খবর পেত। ’৬০-এর
দশকের
মাঝামাঝি এসে তদানীন্তন
পূর্ব পাকিস্তানের
কমিউনিস্ট পার্টি দুই
ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ
গ্রহণ করে সাবেক সোভিয়েত
ইউনিয়নের পক্ষ। আর এক ভাগ
গ্রহণ করে চীনের পক্ষ।
তাজউদ্দীন হয়ে ওঠেন
মস্কোপন্থী। তাজউদ্দীন
ভারতে গিয়ে গড়েছিলেন
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।
এরকম
সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব
ছিল না অধ্যাপক গোলাম
আযমের পক্ষে। কারণ,
রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক
থেকে তিনি ছিলেন
কমিউনিজমের বিপক্ষে।
আমার মনে পড়ে, ১৯৭১-এর
ডিসেম্বরের যুদ্ধের কথা। ১৯৭১-
এর ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য
প্রবেশ করে তদানীন্তন পূর্ব
পাকিস্তানে। ডিসেম্বরের ৪
তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
জাতিসঙ্ঘের
নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব
ওঠায়, ভারত ও
পাকিস্তানকে নিজ নিজ
এলাকায় সৈন্য সরিয়ে নেয়ার
জন্য। কিন্তু ডিসেম্বরের ৫
তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়ন
ভেটো দিয়ে এই প্রস্তাব নাকচ
করে দেয়। ভারতীয় সৈন্য পূর্ব
পাবিস্তানে প্রবেশ করেছিল
প্রবাসী বাংলাদেশ
সরকারকে কোনো প্রকার
আইনগত স্বীকৃতি না দিয়েই।
আন্তর্জাতিক
জটিলতা এড়ানোর জন্য
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বরের ৬
তারিখে বাংলাদেশ
সরকারকে প্রদান করেন
স্বীকৃতি। ডিসেম্বরের ৭
তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ
পরিষদে প্রস্তাব ওঠায় যুদ্ধ
বন্ধের। প্রস্তাবটি পাস হয়।
কিন্তু ভারত মানে না এই
প্রস্তাব। ১৩ ডিসেম্বর
নিক্সন প্রশাসন সিদ্ধান্ত
নেয়, বঙ্গোপসাগরে নৌবহর
প্রেরণের। পরমাণু শক্তিচালিত
বিখ্যাত মার্কিন
বিমানবাহী জাহাজ (Enterprise)
ও ডেস্ট্রয়ারসহ
আরো কয়েকটি মার্কিন
যুদ্ধজাহাজ ভিয়েতনাম সাগর
থেকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রা করে।
কলকাতাসহ ভারতের সব বড় বড়
শহরে এ কারণে সৃষ্টি হয়
বিরাট উদ্বেগ।
আমি কলকাতা শহরে এ সময়
অনেককে বলতে শুনেছিলাম,
ইন্দিরা গান্ধীর উচিত
হয়নি যুদ্ধে জড়ানো। ভারত
জড়িয়ে পড়তে পারে একটা মহা সমরে।
১৪ ডিসেম্বর মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র আবার
নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব
উঠায় যুদ্ধ থামানোর।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন
এবারো প্রদান করে ভেটো।
কিন্তু বিশ্বজনমত
হয়ে উঠেছিল ভারতবিরোধী।
মার্কিন যুদ্ধজাহাজ
এগিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশের
তটভূমির দিকে। তা এসে পৌঁছায়
বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায়।
তার পর হঠাৎ
কী ঘটে আমরা জানি না।
পাকবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়,
ভারতের সেনাবাহিনীর
কাছে আত্মসমর্পণের। ভারত
পাকবাহিনীর সৈন্য ও
সেনাপতিদের
বন্দী করে বাংলাদেশ
থেকে নিয়ে যায় ভারতে। আর
তাদের ছেড়ে দেয় ১৯৭২ সালের ৩
জুলাই। এদিন স্বাক্ষরিত
হয়েছিল সিমলা চুক্তি, ভারত ও
পাকিস্তানের মধ্যে।
সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি।
সিমলা চুক্তি হয়েছিল
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে।
সিমলা চুক্তির দলিলে ১৯৭১-এর
যুদ্ধকে উল্লেখ
করা হয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধ
হিসেবে; বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে নয়। আজ
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অনেকের
বিচার করা হচ্ছে। তাদের সবাই
হলেন বাংলাদেশের নাগরিক।
পাকবাহিনীর
যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত
হয়েছিল, তাদের কারো বিচার
করা যায়নি। গোলাম আযম ১৯৭১
সালে গিয়েছিলেন করাচিতে।
তার দলের বিশেষ এক
সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য।
তিনি তদানীন্তন পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে ৩ ডিসেম্বর
যাত্রা করেন ঢাকার উদ্দেশে।
কিন্তু তাকে বহনকারী বিমান
ঢাকায় অবতরণ করতে পারে না।
ফিরে যায়
কলম্বো বিমানবন্দরে।
কলম্বো থেকে গোলাম আযম
চলে যান সৌদি আরবে।
সৌদি আরব
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট; তার
আগে নয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার
পর সৌদি আরবের পাসপোর্ট
নিয়ে গোলাম আযম
বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৮ সালের
৯ জুলাই। পরে তিনি ফিরে পান
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের
নির্দেশে বাংলাদেশের
নাগরিকত্ব। কারণ,
তিনি ছিলেন জন্মসূত্রে এ
দেশের মানুষ। গোলাম আযম
জানান, বাংলাদেশের প্রতি তার
আনুগত্য। তার
জীবনী সম্পর্কে এ যাবৎ
বিভিন্ন সূত্র
থেকে যা জানা যায়,
তাতে মনে হয়, তাকে এখন
যতটা ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর
প্রকৃতির মানুষ
হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে,
তিনি তা আদৌ ছিলেন না।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত তার
সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেবেন,
আমরা তা জানি না। এ
বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য
করতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু গোলাম
আযম সম্পর্কে আমাদের
পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন
যা বলে চলেছে, তার অনেক
কিছুই মিলছে না তার
সম্পর্কে আমরা যা জানি তার
সাথে। আমার সাথে তার
কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল
না। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার
সম্পর্কে বিশেষ কিছু
জানি না। তার
সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র
থেকে যেসব তথ্য পেয়েছি,
তা বিবৃত করলাম আমার এই
আলোচনায়। তোয়াহার
সাক্ষাৎকার
সম্পর্কে যা বলেছি, তার
বিবরণ পাওয়া যাবে মাহবুব
উল্লাহ সম্পাদিত ২০০৮
সালে প্রকাশিত মহান
একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থে ।
বইটি প্রকাশিত
হয়েছে ঢাকা থেকে।
তোয়াহা ছাড়াও
আরো কয়েকজনের সাক্ষাৎকার
আছে এই সঙ্কলনে। তারাও দু-
একজন মন্তব্য করেছেন গোলাম
আযম সম্পর্কে। তারা বলেননি,
গোলাম আযম ছিলেন একজন
ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ব্যক্তি।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও
কলামিস্ট.
বিষয়: রাজনীতি
১৪৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন