***গৌরি বালার আত্বকথা***

লিখেছেন লিখেছেন মুক্ত কন্ঠ ০৫ জুন, ২০১৩, ০৪:৪১:৩৭ বিকাল



-Shelim_sameer

পড়ন্ত বিকেল। সুর্য্য তার লালীমা ছড়িয়ে দিয়ে অস্তাচলকে রাঙ্গিয়ে বেলাকে বিদায়ের জানান দিচ্ছে। দেবদাস বাড়ির পাশের খেলার মাঠ থেকে দৌড়ে এসে মায়ের ঘরে প্রবেশ করল।  জানালার শিক ধরে বাহিরের দিকে উদাস নয়নে থাকিয়ে থাকা গৌরির আচল খামচে ধরে প্রশ্ন করে মা! মা! তুমি সত্যি করে বল আমার বাবা কোথায়?

গৌরি মুখ ফিরিয়ে পেছনে দেবদাসের দিকে একবার তাকিয়েই আবার জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।  একটু বিরক্তির সুরে বলে : তোকে কতদিন না বলেছি তোর বাবা বিদেশে আছে!

: বিদেশেতো মন্টুর বাবাও থাকে। মন্টু বলেছে তার বাবা দুই তিন মাস পর পর তার মাকে চিঠি পাঠায়। তার মা ও  চিঠি দেয়। কই আমার বাবাতো তোমাকে চিঠি পাঠায়না? তুমিও তো বাবাকে চিঠি লিখনা! কেন মা! বাবা চিঠি দেয়না কেন? বল মা! গৌরীর আচলে দেবদাসের কচি হাতের টানাটানি বাড়তে থাকে।

: তোর বাবা অনেক দুরের বিদেশে থাকে। ওখান থেকে চিঠি আসে না।

: কিন্তু মা মন্ঠু যে বলল.....

: মন্ঠু কি বলল?

: মন্ঠু বলল তার মা বলেছে পাশের গ্রামের অরণ্য কাকা নাকি আমার বাবা!

গৌরি আনমনে প্রশ্নটা করেছিল। কিন্তু ছেলের উত্তরটা শুনে বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। দুই কান গরম হয়ে গেল। কান দিয়ে ভন ভন করে যেন গরম বাতাশ বেরুতে লাগল। শির শির করে গা শীতল করা কি একটা যেন ঘাঢ় থেকে পিঠ বেয়ে নীচের দিকে নামল। হতভম্ভের মত গৌরি চেয়ে থাকল অবুঝ ছেলেটার দিকে। এতটুকুন ছেলের বাকপটুতায় এমনিই সে ত্যাক্ত বিরক্ত। প্রতিদিন তার হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু আজকে তার মুখের শেষ বাক্যটা শুনার জন্য কোন ভাবেই সে প্রস্তুত ছিলনা। এমন প্রশ্নের মুখোমুখী হবে কোনদিনও সে ভাবেনি। মুখের ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে সে।

মায়ের এমন অবস্থা দেখে দেবদাসও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কিছুটা ভয়ও পেল। মায়ের এমন চেহারা কোনদিনও সে এর আগে দেখেনি। ইত্যবসরে উঠোন থেকে হাক শুনা গেল- কইরে দেবু! এদিকে আয় দাদা ভাই। দ্যাখ তোর জন্য কি এনেছি!

দেবদাস দৌড় দিল বাইরের দিকে।

গৌরি যেন হাফ ছেড়ে বাচল। মনে মনে বাবাকে ধন্যবাদ জানাল এ সময়ে এসে পড়ে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করায়।

গৌরি ধপ করে বসে পড়ল শোবার খাটে।  পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেটার হাহাকার সে যেন অনুভব করতে পারছে। বুকটা বেদনায় মুচড় দিয়ে উঠল। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে কোঁলের দিকে ঝুকে পড়ল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার । কিন্তু কাদতে পারছেনা। দুষটা নিজের। কেদে কি লাভ। তদুপরি এখন কাঁদলে বাবার কষ্ট আরও বাড়বে। এমনিতেই আমার কারণে বাবার এই কাহিল অবস্থা। নাহ্ আমি কোনভাবেই বাবাকে আমার কষ্টের কথা জানান দিতে চাই না। আমার যত কষ্ট হয় হোক তবুও আমার মনের ব্যাথাটা আমার মনেই চেপে রাখব। বাবা জানুক আমি সবকিছু ভূলে নিজেকে সামলে নিয়েছি। গৌরি তার দেহটা সপে দিল বিছানায়। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা গুজল।

গৌরীর বুকের ব্যাথাটা একসময় তপ্ত অশ্রু হয়ে দুচোঁখ ফেটে বেরিয়ে এল। দুহাতে বালিশটাকে আকড়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদল সে। আজ অনেকদিন পর গৌরি এভাবে কাঁদছে। অবশ্য এই কান্নাটা তার জন্য ভালই হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে বুকের ভেতর চেপে রাখা জমাট কষ্টগুলো আজ অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এসেছে। এতে তার বুক অনেকটা হালকা হবে।

গৌরি যে খাটে শুয়ে আছে এখানেই একদিন সে আর অরণ্য দুজন দুজনকে একান্ত আপন করে নিয়েছিল। ভালবাসার দুর্লঙ্ঘ টান সেদিন দুজনকে একাকার করে দিয়েছিল। মিলনের চরম সুখে দুজন অবগাহন করেছিল। মনে পড়ে, সেদিন যখন মিলনের চরম সুখ সাগরে সাতার কেটে দুজন তৃপ্তিতে পরম পূলকিত। অরণ্য বলেছিলঃ গৌরি! তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটা ধন্য। আমার মত সুখী মানুষ দুনিয়ায় অন্যটি নেই। কথা দাও তুমি আমারই থাকবে!

: আমি তোমারই আছি। তোমারই থাকব। তুমিও কথা দাও কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না!

: কি বলছ তুমি! আমি তোমাকে ছেড়ে যাব এটা কল্পনাও করতে পারি না।

এটা কয়েক বছর আগের কথা। গৌরির বাবা চন্ডিদাস কোর্টের একজন জেষ্ঠ্য উকিল ছিলেন। তার সহকারী হিসেবে কাজ করত পাশের গ্রামের যুবক অরণ্য কুমার চক্রবর্তী। পেশাগত ঘনিষ্টতার সুবাদে গৌরিদের বাড়ীতে তার যাতায়াত ছিল। এরই সুবাদে গৌরি আর অরণ্যের মধ্যে ঘনিষ্টতা সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। সরল বিশ্বাসে গৌরি একসময় নিজের সর্বস্ব ভালবাসার মানুষ অরণ্যকে সপে দেয়। সময় গড়িয়ে যায়। গৌরি অরণ্যের ভালবাসাও দিন দিন সর্ববিনাশী ঝড়ের রুপ ধারণ করে।

গৌরি বুঝতে পারে সে অন্তঃসত্বা। অরণ্যকে জানায়। অতি সত্বর বিয়ের কথা বলে । অরণ্য তার আসল চেহারায় আবির্ভূত হয়। ঝড় গৌরির উপর তার বিনাশী ছোবল হানে। গৌরির জীবন তছনছ হয়ে যায় কিন্তু অরণ্যের কিছুই হয় না। অরন্য বিয়ে করতে অস্বিকৃতি জানায়। গৌরির বাবাও বিয়ের চাপ দেয়। কিন্তু অরণ্য গৌরীর সাথে সম্পর্ককেই অস্বীকার করে বসে। দিন যায় মাস গড়ায়। গৌরির ঝড় বিধ্বস্ত কুঠির আলোকিত করে আসে দেবদাস চক্রবর্তী। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। কম বয়সেই সে কথাবার্তায় খুব বাকপঠু হয়ে উটে। গৌরির বাবা প্রায় সময় বলে, এই বাকপঠুতার বদৌলতেই আমার দেবু পরিণত বয়সে অনেক প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।

গৌরির স্বপ্ন তাড়ীতের মত অবস্থা। অরণ্যের সাথে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছু ছবির মত একের পর এক চোখের সামনে দৃশ্যায়িত হচ্ছে। অজান্তেই তার দুচোঁখ দিয়ে নীরব অশ্রুর দুটি ধারা গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজছে।

দুই মাস পর।

ফরহাদ তার বাবাকে প্রশ্ন করে, বাবা! তুমি বিদেশ থেকে চিঠি পাঠাওনি কেন?

: ওখান থেকে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা নেই।

: যেখান থেকে চিঠি পাঠানো যায় ওখানে যাও না কেন?

: ওখানে...ওখানে....

আব্দুর রহমান আমতা আমতা করতে লাগল। কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না। পাশে থেকে ছালেহা বেগম বলে উঠলঃ

দেবু! কি হচ্ছে? এত প্রশ্ন কেন? তোর বাবা আর বিদেশে যাবে না। খুশি তো?

দেবদাসের নাম এখন ফরহাদ রহমান। কয়েকদিন আগে গৌরির বিয়ে হয়েছে চন্ডিদাসের অফিসের মহুরী সৎ ও সরল মানু্ষ আব্দুর রহমানের সাথে। গৌরি এখন মুসলিম পরিবারের বধু। তার পরিবর্তিত নাম রাখা হয়েছে ছালেহা বেগম। ভালবাসার মানুষের কাছে প্রতারিত হলেও আব্দুর রহমানের সাথে দাম্পত্য জীবনে সে খুবই সুখী। এই ক'দিনেই স্বামীর ভালবাসা দিয়ে সে তাকে আপন করে নিয়েছে।

প্রায় সাড়ে চার যুগ পর।

ছালেহা ও আব্দুর রহমান ইহকাল ত্যাগ করেছে অনেক আগেই। ফরহাদ রহমান এখন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট। নতুন দেশটি সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সবই আছে তার। নানা চন্ডিদাসের ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী বাকপঠুতার বদৌলতে একজন প্রভাবশালী নেতার আসনে সে জায়গা করে নিয়েছিল ঠ্কিই। কিন্তু নেতা হিসেবে যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা সে অর্জন করতে পেরেছিল রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সে ততটুকু ব্যর্থ বলে প্রমানিত হয়েছে। 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।' এ ক্ষেত্রে কথাটার প্রতিফলন ঘটেছে অক্ষরে অক্ষরে। নবজাতক দেশটিকে সাজাতে এবং স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে যে নিবিড় যত্ন-পরিচর্যা এবং অভিভাবকত্বের প্রয়োজন ছিল তা দিতে সে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীন দেশকে পরিচালনায় পার্শবর্তি একটি ক্ষমতাধর দেশের হস্তক্ষেপ নগ্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে; নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্তের চেয়ে ঐ দেশের ইচ্ছার গোলামী সে মাথা পেতে নিয়েছে। পরবর্তীতে তার মেয়ে হাসু পারিবারিক সূত্রে ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয় এবং সেও তার বাবার পথই অনুসরণ করে । প্রতিবেশি ঐ দেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই নিজেকে ধন্য মনে করে।

ফরহাদের পারিবারিক বংশ পরিচিতিতে আব্দুর রহমানের পূর্বপুরুষের নাম থাকলেও ছালেহা বেগমের মৃত্যুর সাথে তার বংশের নামও নিশ্চিন্ন হয়ে যায়। ফরহাদের বংশধরদের কাছে ছালেহা বেগম এখন একটি অপরিচিত নাম। ....

বিঃ দ্রঃ গল্পটির কাহিনী সম্পূর্ন কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোন ব্যাক্তি বা স্থান-কাল-পাত্রের সাথে এর সাদৃশ্যতা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ব্যপার।

বিষয়: বিবিধ

২৫২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File