কলামিস্ট মিনার রশীদের একটি লেখা -‘আলকায়েদা’দের চেনা না গেলেও ‘আলফায়েদা’দের চেনা যাচ্ছে
লিখেছেন লিখেছেন জাকির হোসাইন আজামী ১২ মার্চ, ২০১৪, ০৮:১৪:৩৮ রাত
পশ্চিমা দেশের এক নিঃসন্তান দম্পতি। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে সমস্যাটি স্বামী ভদ্রলোকের। সন্তান লাভের জন্য স্ত্রীর আগ্রহ এতে বোধ হয় আরেকটু বেড়ে যায়। ঘটনাটি টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে বেবি তৈরির আগেকার। কাজেই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ প্রয়োগ করে আইনের ভেতর থেকেই তারা একটি উপায় বের করে ফেলে। অন্য এক ভদ্রলোকের সাথে একটি লিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে তিনি ‘ফাদারিং’-এর প্রাথমিক কাজটুকু করে দেবেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা হিসেবে আছে চুক্তিবদ্ধ এই ভদ্রলোকের তিন-তিনটি সন্তান। দু’টি সন্তান হওয়ার পরই এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে পড়বে বলে সাব্যস্ত হয়।
সন্তান উৎপাদন ছাড়া অন্য কোনো আবেগগত কাজে এই চুক্তির অপব্যবহার করা যাবে না। স্বামী ভদ্রলোক সাফ সাফ জানিয়ে দেন, লিখিত এই কায়দাটি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের ফায়দা নেয়া যাবে না। থার্ড পার্টি ভদ্রলোক সব শর্তই খুশি মনে মেনে নেন। কারণ তার জন্য লিখিত এই কায়দার মধ্যেই যথেষ্ট ফায়দা নিহিত রয়েছে।
কিন্তু টার্গেটকৃত সময় পার হয়ে গেলেও কাক্সিত ফল আসছে না। স্বামী ভদ্রলোক সঙ্গত কারণেই অস্থির হয়ে পড়েছেন। মনে করেছেন যে, বদমাইশ লোকটা চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করছে। মনের ক্ষোভে আদালতে কেইস ঠুকে দেন। আদালতকে অভিযুক্ত লোকটি জানায়, ‘মহামান্য আদালত! চুক্তিমতো আমি আমার চেষ্টায় একটুও গাফিলতি করিনি।’
সব কিছু শুনে বিজ্ঞ আদালত লোকটির মেডিক্যাল চেক আপের নির্দেশ দেন। মেডিক্যাল টেস্টে বেরিয়ে আসে যে, এই লোকটিও সন্তান জন্মদানে অক্ষম!
কাজেই ঘটনাটি এখানেই শেষ না হয়ে সবেমাত্র শুরু হয়। এক সমস্যার সমাধান করতে এসে নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বিরাট প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে তার নিজের তিন-তিনটি সন্তান হলো কিভাবে? নিজে এক ‘কায়দা’ করতে এসে জানতে পারল আরেক ফায়েদার খবর।
কাজেই আলফায়েদা গ্রুপ যত গোপনে এবং নিরাপদেই এই ফায়দা গ্রহণ করুক না কেন, একদিন-না-একদিন কোনো-না-কোনোভাবে তা বেরিয়ে আসে। যে লোকটি অপরের স্ত্রীকে এইভাবে কায়দায় পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছিল, সে নিজেও জানত না যে, তার ওপর অন্য আরেকজন মহা ফায়েদা লুটছিল। কাজেই পশ্চিমা সমাজে এসব ক্ষেত্রে কে যে ‘আলকায়েদা’ আর কে যে ‘আলফায়েদা’, তা বোঝা দুষ্কর।
মুসলিম বিশ্বের পারিবারিক জীবনে এটি মহামারী আকারে দেখা না দিলেও রাজনৈতিক জীবনে এই আলকায়েদা আর আলফায়েদা গ্রুপের মহামারী লেগেছে। খায় একজন আর বিল ওঠে অন্যের নামে। কাজেই সারা বিশ্ব আজ এই আলকায়েদা আর আলফায়েদার চক্করে পড়ে গেছে। কারা আলকায়েদা আর কারা পেছনের আলফায়েদা, তা-ও পুরা রহস্যাবৃত হয়ে পড়েছে। এখন ধীরে ধীরে আসল পরিচয় বেরিয়ে আসছে।
আলকায়েদা গ্রুপটি কাদের সৃষ্টি এবং কাদের উদ্দেশ্য সাধন করছে, তা নিয়ে পুরো বিশ্ব অন্ধকারে। মুসলিম নাম ও আবেগ ব্যবহার করলেও এদের দ্বারা মুসলিম বিশ্বের কোনো উপকার হচ্ছে না। বরং সার্বিক ক্ষতিটি প্রকৃত অর্থেই ভয়াবহ।
অ্যানালগ যুগের মানুষ চিলে কান নিয়েছে বললেই চিলের পেছনে দৌড়ানো শুরু করত। ডিজিটাল যুগের মানুষ চিলের পেছনে দৌড়ানো শুরু করার আগে কানে হাতটি দিয়ে বসে। মূল ধারার মিডিয়া কোনো নিউজ বা ভিউজ ছড়ানোর সাথে সাথে অলটারনেটিভ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো সক্রিয় হয়ে পড়ে। সাইবার জগতের দেয়ালের লিখনগুলো মানুষের চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। সত্য-মিথ্যার একটা টাগ-অব ওয়ার শুরু হয়ে যায়। সত্য ডোবাতে চায় মিথ্যাকে। আর মিথ্যা ডোবাতে চায় সত্যকে। শেষমেশ সত্যটি দিবালোকের মতো ঝলঝল করে ভেসে ওঠে। তা ছাড়া সত্যের ভেসে ওঠার একটা নিজস্ব (buoyancy power) শক্তি থাকে। আর মিথ্যাকে অন্য একটি বাহ্যিক শক্তি দিয়ে ভাসিয়ে রাখতে হয়।
আল-জাওয়াহিরির একটি অডিও বার্তা নিয়ে একই খেলা শুরু হয়েছিল। অডিও বার্তাটি ইন্টারনেট জগৎ থেকে মূল প্রচারে এনেছে সরকারের অন্ধ সমর্থক হিসেবে পরিচিত একটি অনলাইন পত্রিকা ও একটি টিভি চ্যানেল। এই বার্তাটি প্রচারের সাথে সাথেই ফায়দা নিতে সরকারি দলের বাচাল গোছের কয়েকজন নেতা বিরোধী দলের আলকায়েদা কানেকশন নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। জাওয়াহিরি তিনবার বাংলাদেশে সফর করেছেন বলে মতিয়া চৌধুরী জানান।
সাগর-রুনির হত্যাকারীর খবর যে সরকার ও তার গোয়েন্দারা এখনো বের করতে পারল না, তারা জাওয়াহিরির এই গোপন সংবাদটি জেনে গেলেন। এই খবরটি কেন তিনি এত দিন গোপন রেখেছিলেন, তা-ও এক বিরাট প্রশ্ন! তারা জাওয়াহিরির মন্তব্য এবং বিরোধী দলের মন্তব্যে কথিত মিলটি খুঁজে পেয়ে রীতিমতো উল্লসিত হয়ে পড়েন। সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, এই সংবাদটি প্রচার হওয়ায় তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। শুধু জয় নয়, অডিও বার্তাটি নিয়ে উৎফুল্ল ছিল পুরো আওয়ামী মহল
।
কিন্তু কেন যেন মাঝপথে থেমে যেতে হয়। সম্ভবত সাইবার জগৎ সক্রিয় হয়ে পড়ে। সত্য ঘটনাটি উদঘাটিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় বা সত্য অনেকটাই উদঘাটিত হয়ে পড়ে। পুরো মিশনটি হিতে বিপরীত হওয়ার উপক্রম শুরু হয়। এই প্রচারণার পরবর্তী সম্ভাব্য ধাপগুলো কী হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়ে যায় সাইবার (ইন্টারনেট) জগতে। কী প্রক্রিয়ায় তারা প্রপাগান্ডা চালায়, সেই মেকানিজমটি জনগণের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে। আলকায়েদা নিয়ে মূল পর্যবেক্ষকেরাও প্রচারের ধরন দেখে অবাক হয়ে পড়েন।
অডিও বার্তাটি আমেরিকার এক স্টেট থেকে ছাড়া হয়েছে বলে সরকার ঘোষণা করে। কিন্তু এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয় টাঙ্গাইল থেকে। ব্যারিস্টার আন্দালিব মন্তব্য করেন, আলকায়েদার ডিজিটাল হেড কোয়ার্টার এখন টাঙ্গাইলে। সাইবার জগতে একটি কার্টুন ছড়িয়ে পড়ে। কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর অপরাধে জেলখানায় আটক এক দাগি আসামি। তার ক্যাবিনে নব আগন্তুককে জিজ্ঞেস করছে, ‘ওহে যুবক, কোন অপরাধে ঢুকেছো?’ যুবকটির জবাব, ‘ফেসবুকে লাইক দেয়াতে’।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্র ব্যবহার করে জেনেছে, এ দেশে আলকায়েদার মতো সংগঠনের বিস্তার লাভের সম্ভাবনা খুবই কম। ধর্মীয় উগ্রবাদের চেয়ে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ এ দেশে বড় সমস্যা। এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। আলকায়েদার মতো কঠিন জঙ্গি হওয়া কাদামাটি দিয়ে গড়া এই দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর বর্তমান সরকারের ভয়াবহ নিপীড়ন ও অত্যাচারের পরও তারা চরম পন্থার দিকে যাচ্ছে না। বরং পরম ধৈর্যের সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফ্রাংকেনস্টাইনকে ঘাড় থেকে নামানোর উপায় খুঁজছে। কাজেই বিশ্ববাসীও বাংলাদেশকে একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবেই দেখতে পেয়েছে।
তবে রাজনৈতিক ফ্যাসিস্ট গ্রুপটির সাথে ধর্মীয় জঙ্গি গ্রুপটির একটি সাজুয্য লক্ষ করা যায়। তাদের সফটওয়্যারে সামান্য ধর্মীয় ইনগ্রেডিয়েন্ট ইনস্টল করে দিলে সহজেই ধর্মীয় জঙ্গি হয়ে পড়তে পারে। জেএমবির সাথে শুধু আত্মীয়তার সম্পর্কই ছিল না। চারিত্রিক গঠনেও অনেক মিল লক্ষ করা গেছে।
এ দেশে আলকায়েদার অস্তিত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা এবং সন্দেহ থাকলেও আলকায়েদা থেকে ফায়দা নেয়া আলফায়েদা গ্রুপটির অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের মুখ থেকে এই ধরনের কথায় চরমভাবে হতাশ হয়েছে এ দেশের ‘আলফায়েদা’ গ্রুপটি। কারণ তারা চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আলকায়েদা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। বেগম খালেদা জিয়াকে বড় লাদেন এবং তারেক রহমানকে ছোট লাদেন হিসেবে ঘোষণা তো করেই রেখেছে। কাজেই বিশ্ববাসী বুঝে গেছে, কোন ফায়দাটি নেয়ার জন্য তারা এ রকম ‘আলকায়েদা’ ‘আলকায়েদা’ বলে চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কলকাতার ইউএস কনসুলেটে সন্ত্রাসী হামলা হলে এই আলফায়েদা গ্রুপটি যারপরনাই উল্লসিত হয়ে পড়ে। রীতিমতো মিষ্টি খাওয়াখাওয়ি শুরু করে দেয়।
সন্দেহ নেই, আলকায়েদার মতো গ্রুপগুলো মুসলিম জাহানের সুখের ঘরগুলো পোড়াচ্ছে। আর তাতে আলফায়েদা গ্রুপগুলো নিজেদের ভেজা কাপড়গুলো শুকিয়ে নিচ্ছে। বাদবাকিরা ঘুমাচ্ছে, মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক হতাশায় নিজেদের মাথার চুল ছিঁড়ছে।
তবে সবচেয়ে বড় অংশটি বরাবরের মতোই ঘুমিয়ে আছে। জানি না, এদের মরণঘুম কখন ভাঙবে কিংবা আদৌ ভাঙবে কি না। মুসলিম বিশ্বের বিষফোঁড়া এই আলকায়েদাকে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নির্মূল করতে হলে এই আলফায়েদা গ্রুপটিকেও আইডেন্টিফাই বা চিহ্নিত করা অতীব জরুরি। বাংলাদেশে এই আলফায়েদাদের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এই আলফায়েদা গ্রুপটির লোভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ দেশে আলকায়েদার প্রকৃত হুমকিটিও দূর করা সম্ভব হবে।
আলকায়েদার কথা শুনে এ দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আলফায়েদা গ্রুপটি কেন যেন উল্লসিত হয়ে ওঠে। কারণ যারা কোনো দিন এ দেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদেও পাস করতে পারত না, সেই আলফায়েদারা আজ বিনা নির্বাচনে এমপি হয়ে মন্ত্রীও বনে গেছেন। তারা এখন পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নও দেখছেন। আলফায়েদাদের এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারে একমাত্র আলকায়েদা। শায়েখ দুলাভাইয়ের মতো কাউকে ধরে যদি আসল পীরের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায় তবে তো সোনায় সোহাগা। এভাবে পৌঁছতে না পারলেও ধোলাই খালের প্রযুক্তি নিয়ে মোজা বাবুরা তো রয়েছেনই।
এ দেশে জঙ্গিবাদের ত্রাস সৃষ্টি করেছিল জেএমবি। এই গ্রুপটি সম্পর্কে চারদলীয় জোট সরকারের অসহনীয় ও অমার্জনীয় অজ্ঞতা ছাড়া কোনোরূপ সম্পৃক্ততা চোখে পড়েনি। এটি নিয়ে ভবিষ্যতে অ্যাকাডেমিক গবেষণা শুরু হলে আরো অনেক জিনিস বেরিয়ে আসবে। জেএমবির এক নেতা জেলখানায় জামায়াত নেতাদের ইমামতিতে নামাজ পড়তেও অস্বীকার করেছিল। তেল আর পানি দু’টিই তরল হলেও এরা পরস্পরের সাথে মিশে না। তেমনি জামায়াত আর জেএমবির মধ্যকার আদর্শিক সম্পর্ক। দু’টি দলই ইসলামিক হলেও একটি অন্যটির সাথে মিশে না। কাজেই জঙ্গিবাদ প্রজেক্টের পেছনের পরিকল্পনাবিদেরা এই জায়গাটিতেই সম্ভবত ভুল করে ফেলেছিলেন।
রাজনৈতিক কৌশলে এবং ধর্মীয় চেতনায় ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করা দু’টি দলকে একই ব্র্যাকেটে নিয়ে আসা হয়েছে এই বিশেষ ফায়দাটি নেয়ার উদ্দেশ্যে। বামপন্থী সর্বহারাদের কাজকর্ম নিয়ে সুশীল বামপন্থীদের কখনো দোষারোপ করা হয় না। অথচ ইসলামি জঙ্গিদের কাজের জন্য এক মুহূর্ত না ভেবেই ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ ও আলেম-ওলামার ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বাধীন গবেষণার সব রাস্তা বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়ালপনার মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার পরও এর সুফল পাচ্ছে জামায়াত। এই দলটির ওপর যত নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, তারা তত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সরকার ও সরকারবান্ধব মিডিয়ার জামায়াত পলিসি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারির ‘তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানটিতে তরুণ নেতা আন্দালিব যখন বাস্তব এই কথাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন পাশে বসা এক ভদ্রমহিলা শিবিরের প্রচার ও প্রশংসা হয়ে যাচ্ছে বলে প্রমাদ গোণেন। দুয়েকবার আন্দালিবকে স্মরণও করিয়ে দেন। ক্যামেরার সামনে তা বেশ উপভোগ্য হয়ে পড়ে।
জঙ্গিবাদী প্রচারণার মূল টার্গেট হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলা। আওয়ামী লীগের এই ট্র্যাপটি পুরাপুরি ধরতে না পারায় প্রায়ই বিএনপির নেতারা বিভিন্ন টকশোতে বিপদে পড়েন। টকশোগুলোতে প্রথমেই তারা প্রতিপক্ষের টোপটি গিলে ফেলেন। মুসলিমপ্রধান এই দেশটিতে মধ্য ডান বিএনপির রাজনীতি হুবহু তার প্রতিপক্ষ বামঘেঁষা আওয়ামী লীগের মতো হবে না। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বের বিরাট অংশ কেন যে একটা হীনম্মন্যতায় ভোগেন, তা স্পষ্ট নয়। কাজেই টোপটি গেলার পর বাকি সময়টি তাদের কেটে যায় বিএনপি যে জামায়াত থেকে ভিন্ন, তা প্রমাণ করতে। আমার মনে হয় এই নেতারা জিয়ার ১৯ দফার সবগুলো দফা উচ্চারণ করতেও হয়তো বা সঙ্কোচ বোধ করবেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যোগ করেছিলেন, এ কথাটিও বলতে জিয়ার এই সৈনিকেরা ভয় পাবেন। তরুণ আন্দালিব এই সব নেতা ও বক্তাদের জন্য মডেল হতে পারেন। তিনি অনেক সত্য কথা বললেও জামায়াত-শিবির হয়ে পড়েননি।
আলকায়েদা ও জঙ্গি নিয়ে আওয়ামী লীগ আজ যে ফায়দা নিচ্ছে, তা বিএনপির নেতাদের এই ধরনের দোদুল্যমান মানসিকতার কারণে। কবি নজরুল একবার রক্তকে ‘খুন’ বলায় কবিগুরু আপত্তি করেছিলেন। তখন নজরুল জবাব দেন, ‘বিশ্বকাব্য লক্ষ্মীর একটি মুসলমানী ঢঙ রয়েছে। কাজেই বাংলা কাব্যলক্ষ্মীকে দুটো ইরানি জেওর পড়ালে তার জাত যায় না, বরং তাকে আরো খুব সুরত দেখায়।’
একইভাবে বিশ্বরাজনীতির খ্রিষ্টান ঢঙ, ইহুদি ঢঙ, হিন্দু ঢঙের মতো একখান মুসলমানি ঢঙ রয়েছে। এই ঢঙটি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই জিনিসটিই বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া বিষয়টি নিয়ে মিন্মিন্ করলে দেশের এতসংখ্যক মানুষ জিয়ার নামে আজো এত আন্দোলিত হতো না। খালেদা জিয়াও চমৎকারভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, ‘আমরা ডানের বামে এবং বামের ডানে।’ কাজেই আওয়ামী লীগ যেভাবে তার ভালোবাসা ও ঘৃণার কথা বলবে তা থেকে বিএনপির ভালোবাসা ও ঘৃণা ভিন্ন হতেই পারে।
বিএনপির এই নেতারা মনে করেন, বোবার শত্রু নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বোবারও শত্রু তৈরি হয়ে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক জগত নিজেদের নিরপেক্ষতার শেষ প্রমাণ হিসেবে এখানে এসে বিএনপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বিষয়টি অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে চিন্তার ফ্যাশন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে যতটুকু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক কাজ করা দরকার ছিল, বিএনপি তা করেনি। এর পুরো ফায়দা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করছে। কাজেই আলকায়েদা নিয়ে আওয়ামী লীগের এই আলফায়েদা চেহারাটি দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
আসলে আমরা সবাই আগুন নিয়ে খেলছি। ভয়াবহ এই খেলায় আমি আপনি কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। একদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত হয়তো থাকবে না। কিন্তু দেশটিকে তো টিকে থাকতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে এর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব।
কাজেই আসুন, আমাদের সবার হুঁশ এখনো ফিরিয়ে আনি। আলকায়েদা ও আলফায়েদার গেমটি অত্যন্ত মারাত্মক। অন্যজনকে কুৎসিত বানিয়ে নিজেকে সুন্দর দেখানো ঠিক নয়। আসুন, অন্যের সৌন্দর্যের চেয়ে নিজেকে অধিকতর সুন্দর বানিয়ে পুরো দেশ ও বিশ্বকে আরো সুন্দর ও নিরাপদ বানিয়ে ফেলি।
14
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৬ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন