আকাশের মুক্ত পাখি

লিখেছেন লিখেছেন নাসিমা খান ৩১ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৫৭:৫২ রাত



নাসিমা খান

যাকে নিয়ে লিখছি তিনি আর পৃথিবীতে নেই । তবু তাকে নিয়ে লিখছি। অনেক দিন থেকে মনের গভীরে একটা তাড়া অনুভব করছিলাম ।কিন্তু কি এক অজানা শংকা আমাকে বাঁধা দিয়েছে । তারপরও অনেক সাহস সঞ্চার করে লিখতে বসলাম । আল্লাহ আমার ভুল হলে, তার অবমাননা হলে , আমাকে ক্ষমা করে দিও ।

সারা দিন টিপ টিপ বৃষ্টি ,স্কুলে ছাত্র ছাত্রী নেই বললেই চলে , মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। মনটা যেন তার ফোনের জন্যই সচকিত ছিল ।ফোন ধরলেই সদা হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো ।

-কেমন আছেন ?

-ভাল

-আপনি?

-ভালো

-ওষুধ নিতে চেয়ে ছিলেন , বিকালে আসবেন চেম্বারে ?

কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম-হা ,আসবো ।

আমি কি জানতাম , আমার ওই যাওয়াটা আমার জন্য যেমন ভয়ানক হবে , তার জন্যও তেমনই ।কালিবাড়ি নদী পার হয়েছি ,প্রায় পাঁচটা বাজে ।ডাকবাংলা থেকে টেক্সি নিয়ে আটরা মিল গেটে পৌঁছালাম যখন তখন, ছয়টা বেজে গেছে ।আটরা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি ।মিল গেটে তার চেম্বার ছিল ।শখ করে হোমিওপ্যাথী পড়েছিলেন, স্কুল শেষে চেম্বারে বসতেন, এলাকাতে তার খুব সুনাম ছিল। তিনি ভাল শিক্ষকও ছিলেন, গণিতের টর্ট দিতে গিয়ে খুলনা পি টি আই তে তার সাথে আমার পরিচয় ।পরিচয় থেকেই উভয় ফ্যামিলির ঘনিষ্টতা ।

আমাকে ওষদ্গ দিতে দিতে প্রায় ছয়টা বিশ । টেক্সি , বাস, রিক্সা কিছুই যাচ্ছে না, শিরেমনিতে ট্রাক এক্সিডেন্ট, স্কুটার আর ত্রাক ড্রাইভারদের সাথে মারামারি , পথ বন্দ , এখন উপায় ? উনি বললেন, চলেন আমার বাইকে আপনাকে পৌঁছেদিই।

হায় রে সততা ! আমি বললাম- না, আমি কারো বাইকে চড়ি না, আপনি বরং আমাকে নতুন রাস্তা ধরে বয়রা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কোন ভ্যা্নওয়ালাকে সাহায্য করেন ।

ভ্যান পাওয়া গেল যখন, তখন প্রায় মাগরিবের আযান দিয়েছে ।তিনি বললেন, অন্ধকার রাস্তাতে নির্জন পথে একটা ভ্যানওয়ালাকে আমার বিশ্বাস নাই, আমি ওই পর্যন্ত যাই, কোন ব্যবস্থা করে আমি চলে আসতে পারবো ।

-তথাস্ত বলে আমরা ভ্যানে আসছি । টিপ টিপ ব্বৃষ্শ্বটি হচ্ছে । বিশ্ব রোড ধরে রায়ের মহল হয়ে বয়রা অভিমুখে আসছি , প্রথমে দেখলাম, একটা মোটর বাইক পাশ কাটিয়ে চলে গেল , বিশ্ব রোডের চারিপাশে চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের , এখনও আঁবছা আধারে কাজ করছে কোন ঘের মালিক বা চাষি ।রাস্তা ফাঁকা ছুনছান রাস্তা ।হঠাত ছয়টা মোটর বাইকে ছয়জন ষন্ডা মার্কা লোক আমাদের ভ্যান ঘিরে চক্কর মারতে লাগল । ভ্যান ওয়ালা ভ্যান রেখে দৌঁড় মারতে প্রস্তুত ।আমি চিতকার করে উঠলাম বাঁচাও বাঁচাও বলে ।ঘের থেকে ছুটে এলো কিছু লোক ।সাথে সাথে ডাকাত রূপি ওই ষন্ডাদের মুখোশ গেল পালটে ।মুখ খিস্তি করে অকথ্য শব্দ প্রয়োগ করলো ।ভ্যানওয়ালা কিছু বলতে যাচ্ছিল, ওকে প্রচন্ডভাবে পেটে আঘাত করলো ।ভ্যানওয়ালা কাঁদতে কাঁদতে ভ্যান নিয়ে দ্রুত যে পথে এসেছিল ,সে পথে পাড়ি জমালো ।

কথাবার্তায় বুঝলাম, ওরা রায়ের মহলের স্থানীয় গুন্ডা । ওদের উপর ঐ নিরিহ চাষিদেরও আধিপত্য , নির্জন রাস্তায় ওতপেতে থেকে পথচারীদের ব্লাক মেইল করে ওদের কারবার । কারো কিছু বলার নেই, স্থানীয় কমিশনারের নিকটজন ।

আমি একদৌঁড়ে পৌঁছে গেলাম, বিশ্বরোড রেখে রায়েরমহল বাযারের ভিতর ।সামনেই আমার খালা বাড়ি,

আমি পৌছে ছিলাম, কিন্তু তার কি হয়েছিলো বলার অপেক্ষা রাখে না , তার থেকে নগদ তিন হাজার টাকা, দুইটা মোবাইল ছিনিয়ে বলেছিল, উচ্চবাচ্য করলে, সম্মান নিয়ে টানা হেচড়া করবে ।

আমি ইচ্ছা করলে তাকে বাঁচাতে পারতাম। ওই মানুষ রূপি কিছু সয়তানের নিকট তাকে ফেলে কেন চলে আসলাম ? আমি নিরাপদে পৌঁছে একবারও তার কথা উচ্চারণ করিনি খালাত ভাইদের কাছে । কিন্তু কেন ? কি অপরাধ ছিল তার ?

আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিমুঢ় ছিলাম । ওদের একটা কথা আমার কানে এসেছিল- যা আছে দিয়ে দেন , না হলে আপনাকে চুল কেটে এখান থেকে ছেড়ে দেব ।

হে আল্লাহ! আমি জানি না, কি অমানুষিক যন্ত্রনায় তার সেই মুহুর্ত গুলো কেঁটেছিলো ।

বাড়ীতে ফিরে আমি কথাগুলো আমার ছোট ভাইয়ের সাথে শেয়ার করি । সে আমাকে পরামর্শ দেয়- আপাতত দুলাভাইকে তুমি বিষয়টা বলো না ।

আমার বিষয়টা আরো খারাপ মনে হয় , কেন বলব না ? আমি এর প্রতিকার চাই, আমি পুলিশের কাছে যেতে চাই । ওদের আমি চিনেছি ।

-না, আপু তুমি , এটা কোর না ।

-কেন ?

-সকলে তোমার মত সহজ নয়,

কিন্তু আমি সয্য করতে পারছিলাম না, যত কঠীন হোক ,ওদের শাস্তি চাই ।বলে ফেললাম ওকে ।কিন্তু আমার ছোট ভাইয়ের কথায় সঠিক হোল, সবাই আমার মত নয় ।

বললাম-কিছুই চাই না, তুমি আমার সাথে চলো, ওদের আমি চিনেছি ,ওদের সাস্তি চাই ।

কিন্তু ও কিছুই বলল না, নিরিবে আমাকে বিসর্জন দিলো ।আমারও রাগ তখন চরমে ,যার কাছে যাচ্ছি সেই সরে যাচ্ছে , কেন ? কিছু দুর্বিত্তরা যা খুশি তাই করবে ,মিথ্য সম্মানের ভয়ে কেউ কিছুই বলবে না ।

শরানপন্ন হলাম, আবুল সাহেবের স্ত্রীর কাছে ।

উনি নিরবে শুনলেন, কিছুই বললেন না ।

আবুল ভাইয়ের সাথে আমার আর কথা হয়নি ।যেদিন উনার ওয়াইফের সাথে কথা বললাম ,ওই দিন রাতে আবুল ভাই ফোন দিলো-একি করলেন আপনি , শ্রাবনী কে কেন বলেছেন ?

-মানে ? ভুলটা কি আমার ?

-না, প্লিজ, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে নিয়েই বাঁচতে , এবং আপনাকে নিয়েই মরতে চাই , আমাকে বিয়ে করবেন ?

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ।

-কি হয়েছে আমাকে বলবেন ?

আব্ল ভাই-গুমরে কেঁদে উঠলেন, পাঁচ মিনিট ধরে তিনি কাঁদলেন-তারপর বললেন-আমার বুকের ভিতর জ্বলে যাচ্ছে, আমি কেন ,আপনাকে ওই দিন ওষুধ নিতে আসতে বললাম, আপনাকে কেন যন্ত্রনার ভিতর ফেললাম ? আমি অপরাধী ।

-চুপ করেন , সময় সব ঠিক করে দিবে, পাগলামী করার দরকার নেই, শ্রাবনী কি বলেছে ।

-ও আমাকে বিশ্বাস করছে না, ওর ধারনা আমি, আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না,

-চুপ করেন, আর কখনও এসব কথা উচ্চারণ করবেন ,না ।

-আমি করতে চাই না, কিন্তু ও আমাকে ওই এক কথায় সারাক্ষন বলছে ।

-আমি ওদের নামে কেস করতে চাচ্ছি ।

আবুল ভাই চুপ করে থাকলেন , আমি আবারও বললাম-আমি ওদের নামে কেস করতে চাই, হেল্প মি ।

আবুল ভাই বললেন-কিছুই হবে না, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওরা কমিশনারের লোক, আপনাকে আমি কাঠ গড়ায় ঊঠাতে চাই না ।যা ঘটেনি , ওরা তাই বলবে, আপনাকে আর কলংকিত করতে চাই না, আমি আপনাকে অনেক ভালো জানি ।

আমি ফোন কেটে দিলাম । কাড়ো সাথেই আমার মিলল না, আমিই কি তবে ভুল পথে ? সরে দাঁড়িয়েছে স্বামী, সরে দাঁড়ীয়েছে ভাই, শ্রাবনী, আবুলও । তাহলে কাকে নিয়ে আমি লড়বো ?

তারপর সময়ের ব্যবধানে স্বামী ব্যক্তিটিও আমাকে বুঝতে পেরে বুঝিয়েছে, ওরা খারাপ মানুষ, ওদের সাথে লড়তে গেলে আমরা হেরে যেতাম ।

ভাদ্রমাসের এক দিন । ফোনটা বেজে ঊঠলো । আমার বান্ধবী রিনিয়া ফোন করেছে ।

-কেমন আছিস ?

-ভালো।

-তুই আবুল ভাইকে চিনতিস না ?

-হা।

-ওঁ, আজ সকালে মারা গেছে ,

-কিভাবে ?

-এটিও আপার, বিদায় অনুষ্ঠানে, বক্তৃতা দিচ্ছিল, হার্ট এটাক ।

আবুলের বয়স ছিল আমার সমান , অনেক প্রাণ বন্ত মানুষ, আকস্মিক ভাবে হয়ে পড়েছিল বিষন্ন ,আমি ছুটি নিয়ে বাসায় এসে , ছেলের বাবাকে বললাম আবুল আর নেই ।

আমার আগেই সে কাপড় পড়ে রেডি হলো,যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছালাম-ওর তখন দাফন হয়ে গেছে ।শ্রাবনী জড়িয়ে কেঁদে উঠলো-এতো দেরিতে আসলেন, ওতো চলে গেছে ।

-আমার চোখের কোনে পানি চিক চিক করে উঠলো ,সব দোষের উর্ধ্বে এখন সে, সে এখন মুক্ত আকাশের পাখি । কারো কোন দাবী নেই তার কাছে ।

বিষয়: বিবিধ

২৫৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File