সখী (ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন নাসিমা খান ২০ জুন, ২০১৩, ০৪:৩৫:১৯ বিকাল
সখী
নাসিমা খান
দিন দিন সখী শুকিয়ে যাচ্ছে । চোখের নিচে কালি পড়েছে ,শরীরের সেই আবেদন আর আর নেই,গায়ের রঙের সেই বাহারী চটক হারিয়ে গেছে ।সখীর চেহারার মাদকতা, শরীরের টলটলে ভাব, চোখের তারায় বানের ডাক সব যেন খেয়ে ফেলেছে ভাতের কষ্টে ।কতনা যুদ্ধ করলো ভাগ্যের সাথে তথাপী ক্ষুধার রাক্ষসটাকে সখী হারাতে পারেনি ।সখীর জীবনটাকে নিকড়ে চিপড়ে একেবারে রশীন করে দিয়েছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা ।গেল বছর এত দুর্দশা ছিল না তার ।শরীরের নাচুনি ছিল উপভোগের মত।গাঁইয়ের মেম্বাররা পর্যন্ত তার সঙ্গে খাতির নিয়ে কথা বলত ।চোখের ইশারায় ডাকত তাকে ।-সখী ,এদিকে একতু আসবি ?সখী চিবুক উঁচু করে , ডাগর চোখ দুটি তুলে ধরে বলত-কেন মেম্বার,ঘরে কি তোমার খরা চলছে ?
-তোর গতরে যে জোয়ারের ডাক। ঘরের কলসীতে রাখা পানিতে মন ভরে না যে ।
-তো এখানে ডুবতে এলে ? তুমি একেবারেই ডুবে মরবে ।
-পারবি তো সব উজার করে নিতে ?
সখী হেসে ওঠে ।সে হাসিতে তার সারা শরীরে বিদ্যুত চমকায় ।মেম্বার সভয়ে তাকায়-রাত বিরাতে বেরুতে পারিস না ?
-তাহলে কি তোমার পদের মর্যাদা একটু বাড়বে গো মেম্বার সাহেব ?
-তুই যদি ঐ মরা বেটাকে ছেড়ে আসতে পারিস ,পেট ভরে খেতে পাবি, ভালো কাপড় পরতে পাবি, থাকবি বেশ ।
সখীর পরাণের ভিতর কে যেন খামছে ধরে । ঐ মরা বেটা তার জানের থেকে প্রিয় । ও যে তাকে পথের সন্ধান দিয়েছে ।না হলে কোথায় ভেসে যেত সখী । মা বাপ মরা মেয়েটাকে বুকে আগলে রেখেছে সদ্য ফোটাঁ মুরগীর বাচ্চার মত ।বুকের ভিতর নিয়ে বলেছে-নারে সখী তোরে ছাইড়ে কোথাও আমি যাবো না, আলোমতী দুইডে গাঁই দিতে চাইছে ।তিনের একচলা ঘরসহ তিন কাঠা জাগা দিতে চাইছে, আমারে সে লোভে টানেনি। কেবল তোর চারপাশে আমার এ পোড়া মনটা ঘুর ঘুর করে ।কেবল আমার দিগি তুই একটু নজর রাখিস , আর আল্লাহ আল্লাহ করে করে বাকি জীবন কাটায়ে দিস ।পারবি নে ?
সখী পরাণ মাঝির বুকে মাথাটা রেখে বিড়ালের মত গদ গদ স্বরে বলেছে –খুউব পারবো ,এই শফত করলাম, মরার আগে তোমারে আমি ছাড়বো না । জ়ীবন ভরে আমারে এই বুকের মাঝে লুকায়ে রাইখো ।
বেশ কাটছিল ওদের ।পরাণ মাঝি বৌঠা টানে , টার চোখের তারায় সখীর ছবি চক চক করে ওঠে ।প্রাণের আকুতি কমাতে সে ছুটে আসে ঘরে ।সখী উঠোনে ধান নাড়ে । কাপড় নাড়ে । পড়ান মাঝী সখীকে হড়িয়ে ধরে ।বলে-নারে স্খী ,বৈঠা যে আর চলে না ,কেবল তোর তানে মনটা ঘরে ছুটে আসে ।কিসের যাদুযে তোর দেহ মনে ।কেবল যেন আমারে পাগল করবার জন্য তোর জন্ম হইছে ।
সখী হাসে –হলি হইছে, আমার সবি তো তোমার জন্যি ,লুটে পুটে নাও ।আমি তো না করিনি ।
সখীর নিঃশ্বাসেও যেন পরাণ মাঝি মিশে থাকে ।মেম্বারের কথায় তাই সে চমকে ওঠে ।কলিজার মাঝে কে যেন খামছে ধরে ।ঠোট উল্টিয়ে সে হাসে ।তারপর মেম্বারের দিকে কটাক্ষ করে –ভালো কইছো মেম্বার সাহেব ,ঐ মরা বেটা আমারে যা দিছে , আমেরিকার বিল ক্লিনটনও তা পারবে না , আর তুমি তো…।
কণ্ঠে যার এমন জোর । শরীরে যার এত শক্তি , বুকে যার এত বল-সব কিছু নিমেষে শেষ হয়ে গেল । আল্লাহ এমনই হয়তো চান ।গেল বছর চৈত্র মাসের কড়া রোদ্রে হাপাঁতে হাপাতে ছুটে এলো পরাণ মাঝি ।-সখীরে বুকের মধ্যি কেমন যেন করে ।ব্যথ ব্যাথা করে ।
সখী উদবিগ্ন হয়ে বলে রফিক ডাক্তারের কাছেরতে দুট গ্যাসের ওষুধ আনলি পারতে /
-ভাবলাম ঘরে আসলি সাইরে যাবে নে ।
সখী ছোটে ডাক্তারের কাছে ।ওষুধ নিয়ে আসে ।তার পরাণ মাঝি ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ,সখীর শরীরে যেন ব্যাথার বীণ বাজে ।বুকের ভিতর কি যেন একটা দাপাদাপি করে । ওষুধ খেয়ে পরাণ মাঝি শান্ত হয় ।বলে-সখীরে এখন বুঝি শরীলডার ভিতর একটু আমেজ লাগে , তুই শুয়ে পড় ।
সখী পরাণ মাঝির মেলে ধরা হাতের উপর মাথাটা রাখে ।মনে মনে বলে –আল্লারে, আমার প্রাণের স্বামীরে তুমি ভালো কইরে দাও, দরগায় এক কুড়ি কৈ মাছ দেবো ।
সৃষ্টিকর্তা সখীর প্রানের বায়না শোনে না । পরাণ মাঝি স্ট্রোক করে ।তার বাম পাশটা পড়ে যায় ।সে বিছানা ধরে ।সংসার চালানো যে কতটা যন্ত্রনার সখী বুঝতে থাকে ।মেম্বার বাবু ,ফাড়িঁর বড় দারোগা , আইয়ুব চোরা, সবাই তাকে একটু উস্কে দিয়ে দেখতে চেয়েছে ।সখী তার ইজ্জতকে ঝিনুকের মুক্তার মত আগলে রেখেছে। মেম্বারকে ধরে সে রাস্তা পরিস্কারের কাজ নিয়েছে ।তবে বিনিময়ে তাকে মেম্বারের সাথে রসের কথা বলতে হয়েছে। মনের ভিতর পাপের জন্ম হয়েছে ভেবে কষ্টে সখীর অন্তর ফেঁটেছে ।আবার নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়েছে-“আমি তো আর শরীলডারে মেলে ধরিনি ।কেবল প্রাণের স্বামীর মুখে চারটে ভাত দেওয়ার জন্য রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় কাজ করেছি ।মেম্বারের সাথে ঐ একটুখানি কথায় তো”।
সারাদিন রাস্তায় কাজ করে যখন ঘরে ফিরেছে ।পরাণ মাঝির বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বলেছে-,মাঝিরে তোমার কষ্ট হচ্ছে ? মাঝি জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলে । সখী বুঝতে পারে না তার সবটা ।পরাণ মাঝি তাই মাথা ঝাকায় ।তার কষ্ট হচ্ছে না ।চোখের পানি তার চিক চিক করে উঠে । তার সখীর চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে । সখীর গতরে সে আতরের গন্ধ পেত ।এখন তার দেহে কেবল আষ্টের গন্ধ ।পরাণ মাঝি শুকে শুকে কষ্ট পায় ।সখীকে বুকের মাঝে লেপটে নিতে ইচ্ছা করে ।কিন্তু সে শক্তি তার নাই । ডান হাতটা তুলে সখীর মুখে হাত বুলায় ।কেমন খস্খসে সে ত্বক ।ডান হাতে কাছে টানে সখীকে ।বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে সখী ।বলে-,মাঝি , মাঝিরে বুকের মধ্যে এ কিসের জ্বালা পোড়া ?
পরাণ মাঝি জড়িয়ে জড়িয়ে বলে ,আমারে তুই ভৈরবের পানিতে ফ্যালাইয়া দে ।
সখী চিৎকার করে ওঠে-আমার মরা মুখটা তুমি দেখতে চাও ?
আঁতকে ওঠে পরাণ মাঝি –তুই হাজার বছর বাঁইচে থাক ,আমি তোর মধ্যি বেহেস্ত পাইছিরে ।
সখী পরান মাঝির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় তার দেহটা দুলতে থাকে ।পরাণ মাঝির পোড়া চোখেও পানি আসে ।কাঁদতে কাঁদতে সখীর পিঠে হাত বুলায় ।সখী চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় । কি যেন শোনার চেষ্টা করে সে ।পরান মাঝির দিকে তাকায়,-শুনতি পাচ্ছো মাঝি ?
-কি ?
-রাততিরির বুক ভাইঙ্গে দিয়ে ট্রেন আসতিছে ।তারপর উৎফুল্ল হয়ে বলে-, ট্রেন দেখপা মাঝি ?
পরাণ মাঝি অসহায়ের মত তাকায় । তার এই ছোট্র ঘরে চাঁদের আলো ঢোকে না ।চালের উপর পলিথিনের ব্যাগ ,নারিকেল পাতার ডগা,পঁচা তালের পাতা ।ট্রেনের হুইসেল শোনে সে ।মনে হয় ট্রেন বুঝি তার বেদনায় করুন সুরে কাঁদে ।সখীর দৃষ্টি আর এখানে নেই ।কোন দূর স্বপন লোকে সে যেন হারিয়ে গেছে ।বলে-“চলো মাঝি ,আজ নদীর ওপারে যাইয়ে ঐ ট্রেনে উইঠে দূরে কোথাও চলে যাই , যাবা মাঝি ?
পরাণ মাঝী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তার বুকের উপর যে ব্যাথাটা ঝুঁড়ির মত চেপে বসে আছে সে তা বোঝাতে চায় না । সখীর জীবনটা বুঝি ব্যার্থ হয়ে গেল ।
পরাণ মাঝি চোখ বোজে ।
সখী দরজা খুলে বাইরে আসে ।আকাশে পূর্ণ চাঁদের কিরণ ।উঠোনে সে বসে পড়ে ।ওই পারে রেলষ্টেশন ।ভৈরবের বুক শান্ত । ভৈরবের তীর ঘেষে তাদের ঘর ।ঐ নদীতে পরাণ মাঝির বৈঠার শব্দ আর ছলাৎ ছলাৎ ঝপ ঝপ করে পড়ে না ।সখীর চোখে পরাণ মাঝির শক্ত বাহু ,চওড়া বুকের ছাতির বহর নেচে নেচে খেলা করে ।
বর্ষায় ভৈরবের বুকে যেন মাতম ওঠে ।ভৈরবে ভাঙন ধরে ।সখী মনে মনে বলে -,এবার কি তোমার সময় হয়েছে ভৈরব ?
সারাদিন কাজ করে ঘরে ফেরে সখী ।পরাণ মাঝি তাকিয়ে থাকে ।দেখতে দেখতে সখী যেন তালপাতার সেপাই হয়ে যাচ্ছে ।মরা খেজুর গাছের মত রুক্ষ হয়ে জাচ্ছে ।সখীর ঘরে বর্ষার পানি থৈ থৈ করে ।পঁচা কাঁদায় কেঁচো ওঠে ।পোকা ওঠে ।সখী তার ভিতরে পা গলিয়ে চলে ।ছোত্ত একটা তক্তো পোষে শূয়ে শূ্যে পরাণ মাঝি কি সব যে ভাবে সখী তাকাতে পারে না ।আল্ললাহ কে ডাকে । বলে-,আমার পা দুটো অবশ কইরে দিয়ে, তানারে তুমি ভালো কইরে দাও ।
প্রবল বর্ষণে রাস্তার কাজ বন্দ হয় ।ঘরে আহারের বন্দোবস্ত নাই ।পরাণ মাঝি ক্ষুধায় কাতরাতে থাকে ।-সখী এক গ্লাস পানি হবে ?
সখী কলসির পানে তাকায় । জানে পরাণ মাঝির ক্ষিধে পেয়েছে । পানি খেয়ে কি পেট ভরে । সখীর সহ্য হয় না ।সে কেঁদে ফেলে । কিছু না বলে সাঁই সাঁই করে করে ঘর থেকে বের হয়ে জায় সে । পরাণ মাঝি চিৎকার করে ওঠে,- “তোর চোখে আগুন দেখেছি সখী তুই ফিরে আয় ।“
সখী ফেরে না ।আল্লাহর পরে রাগে তার মাথা খারাপ হয়েছে ।মেম্বার ঘরের বারান্দায় বসে সিগারেট ফুঁকছে । সখীকে দেখে বলল-, কি রে সখী /
সখী নির্লিপ্তভাবে বলে-ঘরে কো খাবার নেই।
মেম্বার সাহেব মুচকি হেসে বলে ,- তোর গতরেও তো আর আগের মত জোর নেই । সখী ক্ষয়ে যাওয়া মনে সাহস নিয়ে তাকায় ।সব কিছুই তার অর্থহীন মনে হয় ।পেটের ক্ষুধার কাছে আজ তার কাছে সব কিছু মিথ্যে মনে হয় ।বলে,- পরখ করে দেখপা মেম্বার ?আগে কিছু জোগাড় তো দাও ।
মেম্বার ক্ষুধার্ত কুকুরের মত তাকায় । কুকুরের মত কুই কুই শব্দ করে ।সখীর মুক্তোর মত ইজ্জত ,কেন্নর মত গুটিয়ে থাকা গতর , ভেঙ্গে পড়ে ক্ষুধার কঠিন ইস্পাতের আঘাতে ।
সখী মাথা নিচু করে দাঁড়ায় ।মেম্বারের শক্ত বাহুর ভিতর সখীর ক্ষীণ শরীরটা কাঁপতে থাকে ।
সে উদভ্রান্তের মত হাত পেতে টাকা নেয় ।মোড়ের দোকান থেকে রুটি কেনে ।পরাণ মাঝি আজ দু’বেলা অভুক্ত আছে ।
ঘরের দরজা খুলেই চমকে ওঠে সখী ।পরাণ মাঝির দেহটা খাট থেকে অর্ধেক ঝুলে আছে ।
সে তাকিয়ে আছে । সখী হাটু গেড়ে বসে পড়ে । পরাণ মাঝি আর নেই । সখী ভৈরবের তীরে দাড়ায়।বর্ষায় ভৈরব্র বুক টান টান হয়ে আছে । সখী সব কছু হারিয়ে একেবেরেই ভার শূন্য । সে ঝপাৎ করে পানিতে পড়ে । নদীর পানি তাকে ধাক্কা দিয়ে তীরে ছুড়ে মারে ।ভৈরবের উত্তাল স্রোতও যেন থমকে গেছে ।পরান মাঝির মত সেও আর তার দেহটাকে ছুতে চায় না ।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন