ছোট গল্প
লিখেছেন লিখেছেন নাসিমা খান ০১ জুন, ২০১৩, ১০:০৭:১৮ রাত
তিন্নির চিঠি
নাসিমা খান
চোখ মুছে উঠে বসে তিন্নি ।আর কান্না নয়,জীবনের শেষ চিঠি লিখে ইতি টানবে এ বিরহী জীবনের ।এ ভারী শরীরটাকে বয়ে বয়ে সে এখন ক্লান্ত ।যেমন ক্লান্ত হয় সারাদিন দাড় বেয়ে মাঝি, প্যাডেল চালিয়ে বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা ।ঘুমহীন আখি, মূমূর্ষ ক্যান্সার রুগি ।ফোন নয় ,কি হবে আর এ কণ্ঠস্বর শুনিয়ে ,তার চেয়ে এই ভালো ,লিখে রাখুক তার জীবনের শেষ কিছু কথা ।
প্রিয় বাবুল
এখন আর তোমাকে এ সম্বধনে ডাকা ঠিক হবে না জানি , তবু শেষ বেলায় এ ভুল টুকু করে গেলাম ।স্টান্ডার ফ্যামিলি বলে খ্যাত চেৌধুরী বাড়ির মেয়ে আমি ,ঐ স্টাটাস বজায় রাখার জন্য বাবা তোমাকে খুজে খুজে বের করলেন , পাত্র হিসাবে তোমার মত যোগ্য পাত্র নাকি তখন বিরল ।প্রাইভেট ক্লিনিকের ডাক্তার , অসুবিধা নাই ,এমবিবিএস ডাক্তার বলে কথা ।মহা জাক জমকে বিয়ে হলো ,তোমার বাড়িতে গিয়ে কিছুটা অবাক হই,তোমার বোন জজকোটের এডভোকেট, মা রেডক্রিসেন্ট এর সম্মানিত সদস্য , বাবা বড় নেতা । উনি অতিশয় আল্লাহ ভক্ত মানুষ, দলীয় মান মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি সেপারেশন থাকেন ধান মন্ডির বাসাতে ।ভোর হলে কেবল আমাকে দেখি সারা বাড়ি ,শ্বাশুরী, ননদ আর তোমার সকাল হয় দুপুর বারোটায় ,ডিসপেনসারিতে যাও বিকাল , মা বের হন, ননদ বের হন বারোটায় , আর দেখা পায় রাত বারো টাতে, সারাটা দিন এবিশাল বাড়িতে আমি একা ,এই তিন্নি সেই তিন্নি, যে ভার্সিটির উদ্যান মাতিয়ে রাখতো তার নিস্কলুষ রিনিঝিনি মিস্টি হাসিতে,চঞ্চল চাহনী, দূরন্ত ছুটে চলা, সব কিছু থেমে গেল এই প্রাসাদের মাঝেই ।সকাল কাটতো একাকি ,বিকাল কাটতো একাকী আর ঘুমাতাম কেঁদে কেঁদে ।কখন তুমি এসে ঘুমাতে বুঝতেও পারিনি, একটা সন্তানের তৃষ্ণা আমাকে অস্থির করে তোলে , তুমি তখনও বলছো তোমার সময় হয়নি, কিন্তু আমার সময় যে আর কাটে না ,কোন কিছুতেই আমার অভাব নেই, শুধু নেই তোমার অবসর, নেই আমাকে ভালোবাসার কোন মানুষ ,একাকিত্ব আমাকে দহন করেছে, আমাকে ভিতরে বাইরে নিশ্ব করেছে, তবু তোমার সময় হয়নি ,হঠাৎ করে আমার ভীষণ জ্বর হলো ,তোমাকে ফোন দিলাম ,তুমি না এসে তোমার সহকর্মী এহসান কে পাঠালে, আমি তখন জ্বরে কাঁপছি, মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করছি , বিয়ের পর যত্নের সাথে একটি হাত আমাকে স্পর্শ করলো ,সে হাত এহসানের ।আমাকে সারাদিন খাওয়ানো ,আমার মাথায় জলপট্টি দেওয়া সবই এহসান করলো , এরপর ওর কাজ হলো নিয়মিত আমাকে তদারকি করা ,খোজ নেওয়া,মাঝে মাঝে ওর গাড়িতে করে আমাকে ঘুরানো ।প্রতিদিন বাইরে থেকে এসে আমার কান্নায় বুকটা ভেংগে যেত ,তোমাকে বলতাম ,তুমি বলতে, এহসান ভালো ছেলে ,মাঝে মাঝে ঘুরে এসো।
আমার প্রতি তোমার এই উদাসিনতা আমাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিলো এহসানের দিকে ।একদিন ধানমন্ডির লেকের কাছে শ্বশুর আমাকে এহসানের সাথে হাত ধরা অবস্থায় দেখলেন, তোমাকে জানালেন ,তুমি একটুখানি নড়ে উঠলে, বললে ,এহসানের সাথে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই ,বাবার চোখ ভালো নয় ,তোমাকে শুধু সন্দেহ করবে ,সে আমি চাই না ।আমি আকুল হয়ে বললাম ,বাবুল ববাবাকে দোষ দিচ্ছ কেন , তোমার চোখ কেন কিছু বলছে না ? তুমি কেন আমাকে এহসানের সাথে বাইরে যেতে দিচ্ছ ?তুমি হাসলে, বললে বিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা থাকে না ।
হাযরে বিশ্বাস !এহসাননের আকুলতা, তার সংগ তার ভালোবাসা আমাকে পাগল করে তুললো, তোমার নির্লুপ্ততা আমাকে কষ্ট দিতে লাগলো ,এক সময় এহসান ছাড়া আমার সব কিছু শূন্য মনে হতে লাগলো ।, তোমার বাড়িতে থাকা অবস্থায় তোমাকে আমি ডিভোর্স নোটিশ পাঠালাম, নেটিশ টা আমার হাতেই এলো, তুলে রাখলাম তোমার তিন নম্বর ফাইলে ।তারপর এক কাপড়ে একদিন তোমার বাড়ি ত্যাগ করলাম ।ডিভোর্সের তিনমাস পরে আমরা বিযে করলাম ।এহসানরে সকাল হতো ভোর পাঁচটায়,নামাজ পড়ে আমরা দুজন হাটতে বেরুতাম, ওর ইচ্ছায় বোরকা ও পরিধান করলাম ,সুন্দর জীবন যাপন করছিলাম ,হঠাৎ তোমার অসুস্থতার খবর পেলাম এহসানের কাছে, ও বিলাপ করছিলো ওর ভুলেই নাকি তুমি মরতে বসেছো ।আমি চলে আসার পর থেকে তুমি চেম্বারে যাওনি একদিনও ,কারো সাথে কথা বলতে না, কিছুই বলতে না, হাসতে ভুলে গিয়েছো ,সব নাকি এহসানের প্রতি তোমার অপরিসীম বিশ্বাসের পরিনতী। আমার মনে সন্দেহ জমলো তাহলে কি তুমি আমাকে নয়, এহসানকেই বেশি ভালোবাসতে ,আমার জন্য নয়, এহসানের বিশ্বাসঘাতকতায় তুমি এমন নির্বাক হয়ে গেছ, তাহলে কি আমি তোমার জীবনে একটা পুতুল ছিলাম ? এহসানই কি জীবন্ত ? আমার চলে আসাটা তোমার কাছে এহসানের প্রলোভন মনে করলে ?আমি কি এভাবে আসতে পারতাম না ? কেন থাকতাম তোমার সংগহীন সংগী হয়ে ?এসব প্রশ্নের উত্তর আমি সেদিন পেলাম ,যেদিন হাসপাতালে,তুমি তোমার ক্লান্ত আখি দুটো তুলে, বললে, কেন গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে ? আমি কি তোমার কাছে এতই অপাক্তেয় ছিলাম ? যে সুখের আশায় তুমি এহসানের ঘর আলোকিত করলে ? আমার জীবনটাকে করলে অর্থহীন ?
বাবুল আমিঐ দিন বুঝে গেলাম ,আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই ।ঘরে এহসানের ব্যাকুল ক্রন্দন, তোমার অভিযোগ ,সব কিছু আমার জন্য, তুমি যখন এ চিঠি পাবে, তখন হয়তো আমার লাশ ,লাশ কাটা ঘরে, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও ।
ইতি
তিন্নি
অসুস্থ বাবুল দেৌড়াচ্ছে, এহসান চেম্বার থেকে ছুটে চলেছে বাসার দিকে, ওদের একটায় লক্ষ্য তিন্নিকে বাঁচাতে হবে !!!!!!!কিন্তু তিন্নির লাশ এখন ডোমেরা ব্যবছ্ছেদ করবে ।বাবূল ক্ষীন স্বরে বলছে, তিন্নি একা যেও না ,আমাকেও সংগে নিয়ে যাও ।
নাসিমা খান
সেল ফোন:০১৭২৭৪৭২৫৩৭
ইমেইল:
বিষয়: সাহিত্য
১৫৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন