রাজাকার তালিকায় নতুন সংযোজনঃ সত্য বার বার ফিরে ফিরে আসে
লিখেছেন লিখেছেন আমিন ইউসুফ ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:২৩:১৩ রাত
দেশের সবাইকে হেদায়েত করা আমার কম্ম নয়। তা করতেও চাইনা।
তবুও কিছু বন্ধু বান্ধব আছে, কিছু ছোট ভাইরা আছে, আর আছেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাইরা ঃ বাস্তব জীবনে, আছে ফেবুর ভার্চুয়াল জগতেও।
তাদের জন্যই মাঝে মাঝে দু চার শব্দ ব্যয় করি।
অরন্যে রোদন সবসময় নিষ্ফলা নাও হতে পারে। গহীন জঙ্গলে আপনার সাহায্যার্থে কেউ এগিয়ে না আসুক, বনের পশুদের দ্বারাও আপনি উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখা তার চেয়েও নিষ্ফলা, অকার্যকর।
একে খন্দকারের বই ও তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামীলীগ, তার সমমনা দল্গুলি ও পরগৃহে পালিত বুদ্ধিজীবীদের আস্ফালন শধু দৃষ্টিকটুই নয়, দুর্ভাবনার বিষয়ও। ছোটবেলা থেকে মিডিয়ার কল্যানে জেনে এসেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হল প্রগতিশীল আর ধর্মকর্মে বিশ্বাসীরা কিংবা ধর্ম নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করেন তারা প্রতিক্রিয়াশীল। বড় হতে হতে শুধু তার বিপরিত চিত্রটাই চোখে পড়ছে।
শাহবাগে যখন ফাঁসির জন্য আন্দোলনের ব্যবস্থা করা হল। আমার অনেক বন্ধুরাই তাতে যোগদান করল। আমার বন্ধুরা সবাই নিরাপরাধ শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক ছিল তাই দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিপুল তৃপ্তি নিয়ে তারা ঘরে ফিরল। কিন্তু কুশীলবরা ঘরে ফেরেনি।
সময়ের আবর্তে সংশয়বাদীরাই সঠিক বলে প্রমানিত হল। শাহবাগ যে যুদ্ধাপরাধীদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের জন্য দলমত নিরপেক্ষ আন্দোলন ছিলনা তা বুঝার জন্য এখন আর আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।
শাহবাগের কথা কেন আসল? কারন এই শাহবাগের মঞ্চেই তৎকালীন আওয়ামি সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রি, ঘাতক দালাল নিরমুল কমিটির নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এ কে খোন্দকার দাবি করে বলেছিলেন, বিচার আবার কি, দু চারটাকে ফাঁসি দিয়ে দিলেই হয়।
সেদিনের তার বক্তৃতায় যারা হর্ষধ্বনি করেছিল, তালি বাজিয়েছিল তারা আজকে তাকে রাজাকার ডাকতে কুণ্ঠাবোধ করছেনা।
জাতি আরেকটা নতুন সত্য আবিস্কার করল। জেড ফোরসের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের পর আরেক কমান্ডার খোন্দকার সাহেবও যে তলে তলে রাজাকার ছিল জাতিকে জানিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তাদেরকে দিতেই হবে।
এ দ্বারা বারবার প্রতিষ্ঠিত একটা সত্য আবারও স্পষ্ট হল। শাহবাগে যারা জাগ্রত হয়েছিল তাদের টার্গেট ব্যক্তি ছিলনা , ছিল আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধ তাদের ব্যবসা। উদ্দেশ্য হাসিলের উৎকৃষ্ট উপকরণ।
অথচ একে খোন্দকার তার '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' বইয়ে নতুন কোন কথা বলেন নি। এ কথাগুলো নিকট অতীতে আমরা তাজউদ্দিনের কন্যার কলম থেকে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা নিরপেক্ষ গবেষণা করেন তাদের থেকে জেনেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মুখ থেকে শুনেছি। খন্দকার লিখেছেনঃ
* ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয়বাংলার পর জয় পাকিস্থান বলে বক্তব্য শেষ করেন।
* আওয়ামীলীগের কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিলনা।
* মেজর জিয়ার ঘোষণাটিই আসলে দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে একত্রিত করে একটি সর্বাঙ্গীণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।
* আর জিয়াকে এ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধু চিরকুট পাঠিয়েছিলেন বলে যে গল্প রচিত হয়েছে তা মিথ্যা।
আমি আমার ব্যক্তিজীবনে দেখেছি যার যা অভাব সে সেই বিষয়ে বেশি পারদর্শিতার ভান করে। নিজের কমতি আড়াল করার এটা একটা কুটিল কিন্তু সহজাত প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুকে সর্বক্ষেত্রে উচ্চাসনে বসানোর আকুতি, কারনে অকারনে জিয়াউর রহমান নিয়ে অশালীন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, যত্রতত্র রাজাকার শব্দের অপব্যবহারের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা বারবার এই সত্যটাকেই প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন।
এবার কিছু কনফিউশসনের কথা বলি। শাহবাগিদের কথা সত্য ধরে, প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালদের কথাকে অখণ্ডনীয় মেনে নিলে কি তাহলে দাঁড়াচ্ছেঃ
* দেলাওয়ার হুসাইন সাইদি রাজাকার।
* মতিউর রহমান নিজামি রাজাকার।
* আব্দুল কাদের মোল্লা রাজাকার।
* জেড ফরসের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান রাজাকার।
* সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল রাজাকার।
* সেক্টর কমান্ডার মীর শউকত আলি রাজাকার।
* টাঙ্গাইলের বাঘ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি রাজাকার।
* সর্বশেষ সংযোজন মুক্তিযুদ্ধের উপ প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম একে খোন্দকারও রাজাকার।
এ রকম বহু উদাহরন দেয়া যায়। কলেবর বড় করতে চাইনা। কিন্ত প্রশ্ন হল এদের মধ্যে তাহলে কোন বিভাজন নেই? তবে সামনে হয়তোবা আমরা রাজাকারের প্রকারভেদ নিয়ে নতুন কোন সংজ্ঞার আবির্ভাব দেখতে পাব। যেমন বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধা হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করা আবশ্যক নয়। ভারতের ছাপাখানায় মুদ্রিত পাঠ্যবইয়ে বড় বড় হরফে লেখা থাকবেঃ
রাজাকার দুই প্রকার। এক, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল কিন্তু এখন আর আওয়ামীলীগ করেনা।
দুই, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি আর এখন আওয়ামীলীগও করেনা।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ নিজের বিবেক দিয়ে বিচার করতে ভুলে গেছে। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য নির্ভর করছে কিছু সম্পাদকের পত্রিকা আর টিভির উপর। পশ্চিমে এটাকে বলা হচ্ছে নয়া সাম্রাজ্যবাদ কিংবা দূর-নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদ। এর একটা তাজা উদাহরন দেয়ার লোভ সংবরন করতে পারছিনা।
বিশ্বকাপে মেসির গোল্ডেন বল পাওয়া যে যথার্থ ছিলনা মারাদোনার এমন এক বক্তব্য নিয়ে কথা হচ্ছিল ঢাবি থেকে পাশ করা, বাংলাদেশে ই কমার্সের একজন তরুন উদ্যোক্তা ছোট ভাইয়ের সাথে। সে জানতে চাইলে মারাদোনার এই উক্তি আমি কোথায় দেখেছি। আমি বাংলাদেশের একটি পত্রিকার নাম বললাম। সে তো হাসতে হাসতে খুন। কিছুটা তাচ্ছিল্য কিছুটা করুনার স্বরে সে আমাকে বলল, ওইটা তো একটা দলীয় পত্রিকা। এই দেশে কেউ এটা পড়েনা। আমি বিস্মিত হলাম। একটা উচ্চশিক্ষিত ছেলে স্পোর্টসের নিউজটাও বিচার করছে পত্রিকা সম্পাদকের ব্যক্তিবিশ্বাসের ভিত্তিতে! পরে গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ সহ আন্তর্জাতিক পত্রিকার রেফারেন্স দিলে তার অবিশ্বাস দূর হলেও বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুন সমাজের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা ভেবে আমি শিউরে উঠি। সে ছিল দূর নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদের একজন নিরীহ বলি মাত্র।
এরকম হাজারো লাখো তরুনের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। উদ্যমী, পরিশ্রমী কিন্তু বিভ্রান্ত। বিচারবুদ্ধিহীন কিন্তু মেধাবী। এদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ অথচ এরাই অনিচ্ছাকৃত পক্ষপাতদুষ্ট। দূর থেকে এদের পেছনে খাটছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অলক্ষ্যে, অজান্তে। যতদিন এই তারুন্য অন্যের মতকে নিজের মতের সাথে আপোষ করতে থাকবে ততদিন এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কবি আবদুল হাই শিকদারের মত বলতে হবে, ' এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিল'। কিংবা আনিসুল হকের মত লিখতে হবে, ' জল্লাদের এই উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না'।
আজ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভালবাসি , স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে নিঃসঙ্কো্চে সর্ব উচ্চে স্থান দেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীদের সব কথায় সায় না দিয়ে শাহবাগে যোগ দেই নি, বিচার বিশ্লেষণ না করে যুক্তির উপর অন্ধ আবেগকে স্থান দেইনি তাদের জন্য সুখবর এটাই যে যুগে যুগে সত্যটা উদ্ভাসিত হয়ে এসেছে। এখনো তাই হচ্ছে। তাই সত্যাশ্রয়ীদের মনোবেদনার বহু কারন থাকলেও তা সাময়িক। মিথ্যার আগুন যতই সর্বনাশা হোক না কেন সত্যের বারিধারায় সে বারে বার স্তিমিত হয়েছে, নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
লন্ডন, ০৭/০৯/২০১৪
বিষয়: রাজনীতি
১৪৬৯ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ।
অথচ যারা এমন গালাগারি করে তারা ইতর শ্রেণীর পর্যায়ে পড়ে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
অবস্থা এমন পর্যায়ে যাবার আশংকা আছে যে , অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করাদের বেশীর ভাগই রাজাকার বলে গন্য হবে । জিয়া তো হয়েছেনই , কাদের সিদ্দিকীও হয়েছেন - সর্বশেষ সংযোজন হলেন খন্দকার সাহেব ।
মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা আসছে সামনে - অনেক বড় বড় ফ্রন্ট ফাইটার মুক্তিযোদ্ধার খেতাব হারাবেন চেতনা বিমুখতার কারণে।
অনেক ধন্যবাদ।
তবে আমার প্রশ্ন জাতীয় বীরদের নিয়ে। যে বীরেরা জীবন বাজি রেখে একাত্তরে জগৎসেরা পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের পরিচিতি আজ কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে? বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তারা একাত্তরের বীরদের কিভাবে দেখবেন?
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে যে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা সবাই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তা ছিলেন। এদের অধীনেই সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকসহ বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুরসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের অনেকে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত ছিলেন, কেউ বা ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন, আবার অনেকে দেশপ্রেম বোধ থেকে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
সেক্টর কমান্ডার সবাই জাতীয় বীর হিসেবেই পরিচিত। স্বাধীনতার পরপরই তারা রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হন। এসব পুরষ্কারের চেয়েও তারা এদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালবাসা পেয়েছিলেন সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় পাওনা। আর শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করে একটি জাতিকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেয়া তাদের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। কিন্তু সেই বীরেরা দিনে দিনে কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছেন?
মেজর এম এ জলিল ছিলেন বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দেশপ্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তিনি জাসদ নামে ওই সময়ের মেধাবী তরুণদের নিয়ে দল গঠন করার পরই তাকে নানাভাবে স্বাধীনতা বিরোধী বলা হত। ১৯৮৪ সালে তাকে জাসদের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেন। সাথে সাথেই এক শ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। শুধু বক্তৃতা বিবৃতিতেই নয় তাকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করে অনেক লেখালেখিও হয়েছে।
সিলেট অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে তিনি চাকরিচ্যুত হন এবং দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সাথে সাথেই এই মুক্তিযোদ্ধা এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে হয়ে গেলেন রাজাকার। তাকে রাজাকার বলে গালি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক বক্তৃতা হয়েছে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১ নম্বর সেক্টর ও পরবর্তিতে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও রংপুর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সেরও প্রধান। তাকে শুধু রাজাকার নয়, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা ধারণ করে তিনি যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তানের চর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ঢুকে পড়েছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এমনই হাজারো কথা বলা হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে।
৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ এস ফোর্সেরও প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ কেউ স্বাধীনতা বিরোধী বললেও পরবর্তিতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি রাজাকার গালি থেকে বেঁচে যান।
সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও পুরো টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা ও পাবনা জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে এক বিশাল বেসামরিক সেক্টর গড়ে তুলেছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। একাত্তরে বীরত্বের কারণে আতঙ্কিত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে উপযুক্ত পুরষ্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে সম্বোধন করতো। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে বলতেন বঙ্গবীর। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র বীরোত্তম খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ থেকে সরে গিয়ে যখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ করলেন তখনই তিনি হয়ে গেলেন রাজাকার।
এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ প্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। স্বাধীনতার পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল হন এবং বিমান বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি এর প্রতিবাদে বিমান বাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বলেই এতদিন আমরা জেনে এসেছি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য এ কে খন্দকার ১৯৭৩ সালে বীর উত্তম খেতাব এবং ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক পান।
এক সপ্তাহ আগেও তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশবাশীর কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বই প্রকাশের পরই তিনি পাকিস্তানের চর হয়ে গেছেন। সংসদেও তাকে গালাগালি করতে সবাই সরব। কেউ বলছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পরিকল্পনা নিয়ে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঢুকে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী এই বীর যোদ্ধাকে কেউ বলছেন খন্দকার মুশতাকের দোসর। কেউ তার বই বাজেয়াপ্ত করতে বলছেন। বলছেন গ্রেফতার করতে। রাজাকার বলতেও কেউ দ্বিধা করছেন না। পত্র পত্রিকা আর টেলিভিশনের টক শো এখন তাকে নিয়েই ব্যস্ত।
জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় একাত্তরের এমন অনেক নায়ককেই আজ খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করছেন রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের দায়িত্ববান ব্যক্তিরা। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেখেছেন তারাও কিন্তু এদের উপস্থাপন করছেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে। এই বীরদের অনেকেই ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। অনেকেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজাকার গালি শুনছেন। এরাও একদিন বিদায় নেবেন। যারা আজ এদের রাজাকার বানাচ্ছেন তারাও একদিন বিদায় নেবেন। কিন্তু বেঁচে থাকবে দেশ। আসবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর জ্বল জ্বল হয়ে জ্বলবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক অধ্যায়। কিন্তু আগামী প্রজন্ম এই গৌরবজনক অধ্যায় সম্পর্কে কতটা জানতে পারবে? তারা কি জানবে সেক্টর কমান্ডারদের একটা বড় অংশ ছিল রাজাকার কিংবা পাকিস্তানের চর?
সাময়িক সুবিধা কিংবা বাহ্বা কুড়ানোর জন্য আমরা হয় তো আজ জাতির এই বীরদের সমাজের সামনে হেয় করছি, গালাগালি করে পচাচ্ছি। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখছি আমাদের সন্তানদের কথা? কোন বীরদের সামনে রেখে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই। নইলে ইতিহাস যেমন আমাদের ক্ষমা করবে না তেমনই ক্ষমা করবে না আগামী প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম আমাদের মরণোত্তর বিচার করবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন