অনামী গল্প
লিখেছেন লিখেছেন আমিন ইউসুফ ১৮ মে, ২০১৪, ০৭:৩২:০৭ সন্ধ্যা
ক্যান আই হ্যাভ.........
আমি কি দুটো বার্গার ও কিছু চিপ্স পেতে পারি?
মাথাটা ঘুরিয়েই মেয়েটাকে দেখতে পায় রাশেদ। বয়স আট কি দশ হবে। চেহারায় লাজুক ভাব থাকলেও চোখে মুখে বয়সের সাথে মানানসই দুষ্টুমি। কিছু মানুষের দিকে তাকালেই মনে হয় সে বুঝি স্মিত হাস্যে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি সেই ধরনের। বিশুদ্ধ স্থানীয় উচ্চারনে ইংরেজি বললেও গায়ের রঙ দেখে রাশেদ বুঝতে পারে মেয়েটার পূর্বপুরুষ এই দেশে এসেছিল পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চল থেকে। মানুষ তার চরিত্র বদলায়, সংস্কৃতি বদলায় কিন্তু তার তার চামড়া সে বদলাতে পারেনা।
বিলেতে এসেছে ক' মাস হল রাশেদের। এসেই এই ফাস্টফুডের দোকানে কাজ নিয়েছে। রাশেদের ভালই লাগে। কত রঙের মানুষ এই দেশে। কেউ দুধের মত ফর্সা তো কেউ রাত্রির মত কালো। কারো দেড়শের মত খাড়া নাক আবার কারো নাক দেখলে মনে হয় জন্মের পরে মশা তাড়াতে গিয়ে বেচারার নাকটাকে কেউ বোধ হয় নৌকার মত মাঝখান দিয়ে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে।
এই বিচিত্রতা, ভিন্নতা রাশেদ উপভোগ করে। একটা সময় ছিল মানুষ তার নিজেদের মধ্যের ভিন্নতাকে সহ্য করতে পারতোনা, স্বীকার করতোনা। সভ্যতার হাত ধরে মানুষের ধ্যান ধারনা পাল্টেছে।
রাশেদ বার্গার বানানোতে মনোযোগ দেয়। খুব কঠিন কিছু নয়। অভ্যস্ত হাতে দুই মিনিটেই এক জোড়া বার্গার বানিয়ে ফেলে।
মেয়েটি তখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। দিনের এই সময়টাতে তেমন একটা ভিড় থাকেনা। না-দুপুর না-বিকেল এই সময়টা কাটতেও চায়না।
আচ্ছা, তোমার নাম কি? মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে রাশেদের।
জেনিফার!
বাহ! খুব সুন্দর নাম তো। তো জেনিফার, তুমি কি একাই এসেছো? তোমার বাবা-মা কোথায়?
মার কথা বলতেই জেনিফারের চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে উঠে। অনেক দিন হল মার সাথে দেখা হয় না রাশেদের। আচ্ছা মার কথা শুনলে রাশেদের চোখ কি ঝিলিক দিয়ে উঠে? কে জানে!
মা তো আমার সাথেই আছে। কী একটা কারনে অন্য দোকানে গিয়েছে। এক্ষুনি চলে আসবে। এক নিঃশ্বাসে উত্তর দেয় মেয়েটা।
বার্গার শেষ করে রাশেদ চিপ্স তৈরিতে মন দেয়।
জান, মা বলে এই সব খাবার নাকি স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়। কিন্তু আমার এগুলো অনেক ভাল লাগে।
মেয়েটা ততক্ষনে রাশেদের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
আর কি কি ভাল লাগে তোমার? রাশেদ জিজ্ঞাসা করে। তার কণ্ঠে কপট কৌতুহল।
জেনিফার একে একে তার পছন্দের কথা বলতে থাকে। তার প্রিয় খেলার কথা, বন্ধুর কথা। প্রিয় কার্টুনের কথাও বাদ যায়না। রাশেদ ভাবে এই ছোট্ট দেহে, ছোট্ট মস্তিস্কে শিশুরা এত কথা মনে রাখে কিভাবে! রাশেদের নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। চাকুরির সুবাদে তার বাবা থাকত দূর শহরে। রোজ রাতে মার মুখে গল্প না শুনলে রাশেদের ঘুম হত না। গল্পচ্ছলে সে ঘুমিয়ে পড়ত মার আঁচলে। পরে সমসাময়িকদের সাথে অলিখিত প্রতিযোগিতায় গল্পগুলি বলে তাক লাগিয়ে দিত সবাইকে।
রাশেদ ভাবে তার যদি এমন একটা মেয়ে থাকত। সন্তান নিয়ে রাশেদের কোন দুঃখ নেই। তবে একটা মেয়ে খুব করে চাইছিল সে।
রাশেদ বাইরে তাকায়। শীতের শেষে হাল্কা গরম পড়তে শুরু করেছে। এতেই অবশ্য এদেশের মানুষ দেশেহারা। জলের মাছ হঠাৎ ডাঙ্গায় পরলে যেমন দিক্বিদিক শুন্য হয়ে লাফাতে থাকে, এই গরমেই এদের সেই অবস্থা । কি পরবে আর কি পরবেনা ভাবতে ভাবতেই এদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। পরে দেখা যায় পঞ্চাশ বছরের যুবক যবুতিরা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে গরমের বাপের শ্রাদ্ধ করছে।
এই গরমে মেয়েটাকে বাইরে যেতে দেয় না রাশেদ। তার মা না আসা পর্যন্ত মেয়েটা এখানেই থাকুক। কিছুক্ষন গল্প করা যাবে মেয়েটার সাথে।
তোমার কি আর ভাই -বোন আছে? রাশেদ জিজ্ঞাসা করে।
আমার একটা ছোট্ট ভাই আছে। মা বলে দেখতে নাকি ঠিক আমার বাবার মত হয়েছে।
কেন তোমার কি তা মনে হয় না?
জেনিফারের মুখটা একটু গম্ভির হয়ে উঠে। বিলেতের আকাশের মত ফর্সা থেকে হটাত মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠে তার চেহারা।
না, বাবার মুখটা আমার মনে নেই। মা বলে, আমার বাবা নাকি বেঁচে নেই। কিন্তু আমি জানি আমার বাবা বেঁচে আছে। বড় হয়ে আমি বাবার সাথে দেখা করব।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও জেনিফার ঘেমে উঠে। তার ছোট্ট হৃদয়ের পুঞ্জিভূত দুঃখ কষ্ট আর অভিমানগুলো ঘর্মবিন্দু হয়ে বেরিয়ে আসছে।
অবশ্যই তোমার বাবার সাথে দেখা করবে।
এই দেশে এটা কোন বিচিত্র কিছু নয়। রাশেদ প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করে। জেনিফার সুবোধ বালিকার মত সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে। মেঘটাকে সরিয়ে তখন তার মুখে আবার আলোর ঝলকানি দেখতে পায় রাশেদ।
মেয়েটা এটা সেটা বলছে। কিন্তু রাশেদ খেয়াল করে বার বার মেয়েটা তার মার গল্পে ফিরে আসছে। পিতৃহীন মেয়েটার জীবনে তার মা-ই সব কিছু। রাশেদ মনোযোগ দিয়ে তার মার গল্প শুনে। পৃথিবীতে সব গল্পই একবার শুনলে আর শুনতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু মায়ের গল্প যতই শোনা হোক আরও শুনতে ইচ্ছে করে।
কথা বলার সময় এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য খেলা করে জেনিফারের চেহারায়। ঠোঁটের সাথে সাথে তার ভ্রু কেঁপে কেঁপে উঠে। মেয়েটা বড় হলে ভাল বক্তা হবে বোধ হয়। শ্রোতাকে ধরে রাখার ক্ষমতা আছে মেয়েটার।
তুমি তো অনেক সুন্দর করে কথা বলো!
প্রশংসা শুনে হাসে জনিফার। হাসাতে তাকে আরও সুন্দর লাগছে। একদল ধবল সারস তার মুখে যেন বার বার উঁকি মারছে।
আমার মা আরও সুন্দর করে কথা বলে। আমি যখন কোন দুষ্টুমি করি মা আমাকে মোটেও আঘাত করেনা। আমার সাথে কথা বলে, গল্প করে আমাকে ভুলটা শুধরিয়ে দেয়। আমার ছোট ভাইটা প্রায়ই আমার খেলনা নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। আমার স্কুলের বইগুলো উল্টো করে পড়তে থাকে। মাঝে মাঝে আমার রাগ হয়। জান, মার অজান্তে আমি ভাইটাকে মাঝে মাঝে তাই শাস্তি দেই। ভাইটা কাঁদতে থাকে। মাকে ডাক দেয়। মা সব ফেলে দৌড়ে আসে। আমার সাথে কপট রাগ দেখায়। ভাইটাকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সে বোকা।
ভাইকে বোকা বলেই জেনিফার আবার হেসে উঠে।
মার কথা সে বুঝেনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
জেনিফার কিছুক্ষনের জন্য থামে। ডিম ভেঙ্গে মুরগিছানার মত একজন ক্রেতার উদয় হয়। রাশেদ কাজে মন দেয়।
মেয়েটা ততক্ষনে টেবিলের উপর দু হাত ছড়িয়ে বসে আছে। ভাবলেশহীন। এত ছোট অবস্থায় মেয়েটার বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছে। রাশেদ জানেনা এর কারন কি, তবে এতে যে দুই ভাই বোনের কোন দোষ নেই এটা তো নিশ্চিত। তাহলে কেন এদের ভুগতে হয়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে রাশেদ। উত্তর খুঁজে পায়না। কেউই এর উত্তর খুঁজে পায়নি। রাশেদ সেটা জানেও।
সারাদিন আলো বিতরনের পরে সূর্যটাকে এখন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে পশ্চিমের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সে জানে পশ্চিমে তার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু, তবু সে চলছে। এই বিশ্ব চরাচরে কোন কিছুই থেমে থাকেনা। রাশেদের পূর্বপুরুষরাও থেমে থাকেনি, রাশেদও থাকবেনা।
মেয়েটার মুখে তার মার গল্প শুনে রাশেদের মনটা ভাল হয়ে উঠে। মেয়েটা মনে হয় তার মার মতই হয়েছে- গল্প বলায় দক্ষ। কথায় কথায় জেনিফার বুঝিয়ে দেয় মাকে নিয়ে কতটা গর্বিত সে।
রাশেদ মেয়েটাকে ফ্রিজ থেকে বের করে একটা পেপসি দেয়। পেপ্সিতে চুমুক দেয় জেনিফার। তার চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি।
দরজা ঠেলে একটা মধ্যবয়সী মহিলা ঢুকে দোকানে। সাথে একটা ছোট্ট ছেলে। চকিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে জেনিফার। তার মা চলে এসেছে। এতক্ষন ধরে সে রাশেদের সাথে গল্প করছিল মাকে বলে সে। মেয়েটার সাথে গল্প করে রাশেদের ভালই লাগছিল। মেয়েটার মুখে তার মার কথা শুনে মহিলার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে রাশেদের।
জেনিফার তার ভাইকে নিয়ে মার সাথে চলে যেতে উদ্যত হয়। ক্ষনিকের চেনা মেয়েটা কেমন যেন অচেনা লাগছে। রাশেদকে যেন সে কখনোই দেখেনি। বিস্মিত হয়ে রাশেদ তাদের চলে যাওয়া দেখে। মেয়েটা যেন কিছু লুকাতে চাইছে।
হঠাৎ করেই জেনিফারের মা মুখ ফিরিয়ে রাশেদের কাছে আসে। হাত নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে কী যেন বলতে থাকে।
আ......।আ.........।আ.........।
আ...।।আ......আ...।।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাশেদ। নিশ্চল হয়ে উঠে রাশেদের পৃথিবী। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। ততক্ষনে জেনিফার মার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
মা বলছে আমাকে এতক্ষন সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। একটু থামে জেনিফার। তুমি মনে করোনা আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলেছি। আমার মা সত্যিই খুব সুন্দর করে গল্প বলে।আমার মায়ের ভাষা আমি বুঝতে পারি। আমিও আর সবার মত মার গল্প শুনে রাতে ঘুমুতে যাই। ঘুমে স্বপ্ন দেখি আমার মা - বাবা দুজনেই গল্প করতে করতে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর আমরা দুই ভাই বোন প্রজাপতির মত এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
জেনিফার কখন চলে যায় রাশেদের মনে নেই। শুধু মনে আছে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাশেদ শুধু বলেছিল, কেন এমন হয়? দু ফোঁটা অশ্রুও তার গাল বেয়ে গড়িয়েছিল। কিন্তু সে খবর কেউ রাখেনি।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৯৫ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
০ এরকম অবস্থা বাংলাদেশের হতে বেশী বাকী নেই ।
চমতকার লাগলো
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ।
ভাল লাগলো।
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা এ ধরনের পরিনতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে দিন দিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন