জ্ঞান বনাম অভিজ্ঞান- একটি মৌলিক বিশ্লেষণ

লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ০৪:৪০:৩৯ বিকাল



জ্ঞান এই শব্দটি আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক বিষয়। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সঠিক পরিবেশ, উত্তম বই নির্বাচন বা বিষয়বস্তু নির্ধারন, পাঠের উদ্দেশ্য, শিক্ষা লাভের মানগত পদ্ধতি এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মূল্যায়নের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমসহ অনেক মৌলিক উপাদান এই পরিধির ব্যাপক বিস্তৃতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।

সত্যকে জানা হল জ্ঞান এবং সত্যকে অনুধাবন করার আত্মিক শক্তির নাম অভিজ্ঞান। এই দুটি শব্দের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান।

জ্ঞান হল শব্দের সমাহারে অর্থপূর্ণ অভিজ্ঞতার আদান প্রদান আর অভিজ্ঞান বিষয়টি সার্বিক অনুভব অনুভূতির সমন্বয়ে জীবন্ত আহ্বান। জ্ঞানে রয়েছে প্রচুর শাখা প্রশাখা। যেমন শিল্প সাহিত্য, জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদি। অভিজ্ঞানে মিশে আছে সত্য হতে উৎসারিত আলোকচ্ছটার চেতনমুখ স্পন্দন।

আমরা প্রায়শঃই জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে যে দৃশ্যপট লক্ষ্য করি তার অনেকখানি অংশই জুড়ে আছে অপরিপক্ক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত, জাগতিক জীবনের উদ্দেশ্যজনিত গ্লানিকর অভিজ্ঞতা এবং পরিতাপদগ্ধ অনুভূতি। সত্য মিথ্যা নির্ণয় ও পার্থক্য করার ক্ষেত্রে আকাশচুম্বী আপোষকামী মনোভাব। যে বীজের উৎপত্তি হয় এই ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞান আহরণের মূল শেকড় থেকেই।

বিদ্যমান জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্য ও ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি তাই সৃষ্টিকূলের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি না হয়ে হচ্ছে অভিশাপতুল্য। দিনে দিনে শুধুই বাড়ছে জঞ্জালপূর্ণ সমস্যার পাহাড়। তাই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত পরিসরে যাঁরা হক প্রতিষ্ঠার কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তা কার্যকরীভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে মনে হয় না। পরিদৃষ্ট- অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হল বৃহৎ পরিসরে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের চিন্তা ব্যতিরেকে এবং সমস্যার মূল শেকড় চিহ্নিত না করে অনেকেই তাঁদের স্ব স্ব চিন্তা, গবেষণা ও কর্মে পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট রয়েছেন। আর এভাবেই মাথার পচনের দুর্গন্ধ ক্রমশঃই ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেহে।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতেই হয়, আল্লাহ্‌র প্রিয় হাবীব (সাঃ) কে সত্যের বাণী প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করার মানসে কোরাইশ নেতৃবর্গ পিতৃব্য আবু তালেবের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব পেশ করে। তাদের দাবী ছিল নবী (সাঃ) ইসলাম ধর্ম প্রচার না করলে তাঁকে আরবের রাজত্ব, ধন সম্পদ ও অতিশয় রূপবতী রমণী প্রদান করা হবে। এভাবে অনেক প্রলোভনে প্রলোভিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নবীজিকে উচ্চতর ক্ষমতায় আসীন করাসহ ভোগ বিলাসের সর্বাধিক সুযোগ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী। কিন্তু তিনি কি সত্য নীতির প্রশ্নে আপোষ করেছেন?

বরং আমাদের প্রিয়তম রাসূল (সাঃ) দৃঢ় চিত্তে বলেছেন, আমাকে যদি এক হাতে সূর্য এবং অন্যহাতে চাঁদও এনে দেয়া হয় তদুপরি আমার কর্ম ও উদ্দেশ্যের সরিষা পরিমাণ হেরফের হবে না।

পরিণতিতে বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি কি একাই প্রতিবাদে লিপ্ত ছিলেন না? অন্যায় শক্তির সাথে কোন রকম আপোষ প্রদর্শন ছাড়াই! আর এখানেই উদিত হয় অভিজ্ঞান বিষয়টির মূল তাৎপর্য। আজকের অনেক বোদ্ধা এবং যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দানকে খুবই ভয় পান। তাঁরা অনেকেই ভীষণ ভালোবাসেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় জীবনটাকে, পদ মর্যাদাকে এবং আপন স্বজনকে। স্বার্থের কণা পরিমাণ বিপরীতে গেলে তাঁরা অন্য এক মুসলিম ভাইয়ের গলায় ছুরি বসাতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেন না।

তাইতো বিশ্ববাসী বিস্ময়ভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে দেখছে দ্বীনের মূলনীতি সীসাঢালা বৃহৎ ঐক্যের বিপরীতে ভাই ভাইয়ের মধ্যে বিবদমান চরম ঘৃণ্য অবিশ্বাস্য লড়াই। যুৎসই ইসলামের ছায়াতলে বসেই। আর এর মূল কারণ অভিজ্ঞানের অনুপস্থিতি। তাঁরা মুখে যা বলে কর্মে তাঁদের অভিজ্ঞতার প্রয়োগ সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। আর এভাবেই প্রাজ্ঞহীন জ্ঞান নির্বুদ্ধিতাকে এবং জুলুমকে প্রসারিত ও প্রলম্বিত করছে। মজলুমের আহাজারিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হলেও জালিমের বিরুদ্ধে জানবাজি রেখে দাঁড়ানোর হিম্মত আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। এভাবেই সংকটপূর্ণ পরিবেশ দিনে দিনে মরণব্যধিতে রূপ নিচ্ছে। এখন আর উন্মুক্ত পথে ঘাটে নয় খোদ নিজের ঘরেই ধর্ষিত হচ্ছেন মা বোনেরা। উদারতাপূর্ণ প্রাণ এবং পরিশীলিত জ্ঞানের অভাবে বিষাক্ত পাপের পঙ্কিলতায় ভরে যাচ্ছে মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস।

বিশ্বজুড়ে মুসলিম গোষ্ঠীর বিরাজিত দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার মূল কারণ অনেকাংশে এখানেই নিহিত। তাইতো কয়েক কদম পর পর জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ এবং অনেক ঘরে কোরআনে হাফেজ তৈরি হলেও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনপ্রকার নিশ্চয়তা, মঙ্গল বা উপকার সাধিত হচ্ছে না।

অধিক সূর্যের আলো যেমন প্রাণীকূলের জন্য ক্ষতিকর, অবিরাম প্রবল বর্ষণে যেমন বন্যার কারণে জীবন ও সম্পদহানি ঘটে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগের পরিণতিও ঠিক তেমনি। দেহে কঠিন রোগ বাসা বাধলে আমরা চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়ে নিরাময়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি অন্যথায় রোগের উপসর্গ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ব্যবস্থা পত্র মেনে চলার পাশাপাশি ঔষধ সেবন অপরিহার্য হয়ে উঠে। জ্ঞান অভিজ্ঞানের বিষয়টিও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে এবং চিকিৎসা পত্র যথাযথভাবে প্রয়োগে বিলম্বিত হলে চরমতম জিল্লতিপূর্ণ পরিণতি হবে অবধারিত।

জ্ঞান প্রদর্শনের মূলে তাই দৃশ্যতঃ হয় শুধুই অন্তঃসারশূন্যতা। একটু গভীরে গেলে মনে হয় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্য কেবলিই পার্থিব সুখশান্তি এবং বিলাসপূর্ণ জীবন। অনেক ক্ষেত্রে আবার তাদের শিক্ষার অস্তিত্বই দ্বিধাপূর্ণ। এই সংকটপূর্ণ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তা, ব্যর্থতা, ঔদাসীন্যতা, নিবীর্যতা ও নৈরাশ্যগ্রস্ততার জালে অক্টোপাসের ন্যায় আটকে আছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে জ্ঞানের জগতে বুদ্ধিদীপ্ত ও আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত মনে হলেও তাদের আত্মিক শক্তি ও নৈতিকতাবোধ অন্ধকার এক ভয়াবহ তমসাচ্ছন্ন তিমিরে ঢেকে আছে। ইসলামের দুশমনদের বিষাক্ত খেলায় তারা জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।

যে জ্ঞান পুরুষোচিত গুণাবলী হতে বিবর্জিত, যে মানুষ ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বীরের ভূমিকায় সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় সে জ্ঞান কদর্যপূর্ণ, কলুষিত এবং মূল্যহীন তো বটেই। সে জ্ঞানে না আছে মানবতার আদর্শিক মূল্যবোধ এবং না থাকে সেখানে সৃষ্টির প্রেমের উপজীব্য কোন অভিজ্ঞানের বাস্তবমুখী চেতনার জীবন্ত উদ্দীপনা।

এই বাস্তব পরিসরে, পরিশেষে আকুতিভরা নিবেদন-আসুন দিশেহারা জনগোষ্ঠীকে বলিষ্ঠ সত্যকে স্পর্শ করার শক্তির যোগান দেই। জ্ঞানের সুদূর আকাশ ভেদ করে সফল প্রেমের মঞ্জিলের সন্ধান উন্মুক্ত করি। যেখানে তৈরি হবে জ্ঞানের সাথে অভিজ্ঞানের অভিভূত করা চিরঞ্জীব এক বাস্তব মিলন মোহনা। এভাবেই আগামী প্রজন্ম হয়ে উঠবে আমাদের গৌরবের এবং সম্মানের ধারক ও বাহক। মুক্ত বিশুদ্ধ বায়ুতে সবাই তারা প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচার মত বাঁচতে শিখবে। ইতর প্রাণীর মত নয়।

কেননা লোভী লজ্জিত জাতির কলঙ্কিত তিলক গলায় পরে অপমানজনক ও অবমাননাকরভাবে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকার চেয়ে সত্যাশ্রয়ী মৃত্যু অনেক সৌভাগ্যের এবং মহামূল্যবান। বিকৃত রুচির চেয়ে অসার দেহ অনেক বেশী শ্রেয়ঃতর। তেমনি ধর্মহীন পাণ্ডিত্যের চেয়ে অনেক ভাল কলুষমুক্ত অজ্ঞতা।

আজ এই চরম ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা মূলতঃ সঠিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞানের স্রোতধারায় প্রবিষ্ট হয়ে সেই মহাসত্যের সীমাহীন সৌন্দর্যের সুপ্তিকে হৃদয়ে ধারণ করতে চাই। যেখানে রয়েছে এহলৌকিক এবং পারলৌকিক অনিঃশেষ সুখ শান্তির অপরিসীম মধুরতম মিলন মোহনা এবং বিশুদ্ধ আত্মার বিচ্ছুরিত অমূল্য অলংকরণ। যে চিরন্তন সত্যের জ্ঞান আহরণে এবং অমূল্য সত্য অনুধাবনের সাথে মিশে থাকবে এক আকাশচুম্বী অবিস্মরণীয় মানব প্রেম ভালোবাসার অপ্রতিরোধ্য আলোকোজ্জ্বল ফল্গুধারা।

বিষয়: বিবিধ

১১৭৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386367
২৩ জানুয়ারি ২০১৯ বিকাল ০৫:১৬
আমি আল বদর বলছি লিখেছেন : অসম্ভব ভাল লাগলো প্রিয়। আসলে সঠিক সময়ে সঠিক জিনিসই তুলে ধরেছেন

মুসলিমদের বদলাতে হবে বদলে দিতে হবে এই বিশ্ব
৩০ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ০৩:৫৮
318242
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam respected brother for your inspirational comment. Jajakallah
386370
২৩ জানুয়ারি ২০১৯ সন্ধ্যা ০৭:২৩
কুয়েত থেকে লিখেছেন : জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া এক কদম এগিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই । আমরা আছি শুধু সমালোচনা করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটির জন্য
৩০ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ০৪:০০
318243
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam respected brother. You are absolutely right. Jajakallah
386371
২৪ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ১২:১৪
আকবার১ লিখেছেন : আপু, আমাদের জয়নাব আল গাজালী মত।
৩০ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ০৪:০৩
318244
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam respected brother. I would like to be though I am very much aware about my limitations. I get inspired and become extremely encouraged from her life. Jajakallah

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File