সত্যের মহীরুহ হাসান তুসীর অজানা কাহিনী

লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০১:৪২:৩১ দুপুর





তুর্কীতে তখন সেলজুকি শাসনামল। মসনদে অধিষ্ঠিত সুলতান চেগরা বেগ। শাসকের কাছে সেসময় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভীষণ কদর ছিল। কোন তোষামোদি বা চাটুকারিতার নয়। মহল প্রহরীদের কাছে পূর্ব নির্দেশ ছিল, সাক্ষাৎপ্রার্থী যেকোন শিক্ষিত নাগরিক ও আলেমগণকে যেন যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সাদরে গ্রহণ করা হয়। যদিও সেলজুকিদের ছিল না চিরাচরিত কোন রাজকীয় বর্ণাঢ্য রাজদরবার। একদিন হঠাৎ এক সুদর্শন রুচিবান তরুণ যুবক চেগরা বেগের মহলের সামনে উপস্থিত। উদ্দেশ্যে সুলতানের সাক্ষাত। সাক্ষাৎপ্রার্থীর অবয়বে এবং পোশাক পরিচ্ছদে সভ্রান্ত বংশীয় ছাপ পরিস্ফুট। উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়েছিল আগন্তকের সারা চেহারায়। যে কোন ব্যক্তি প্রথম দর্শনেই বুঝে ফেলবেন যে, তিনি সাধারণ কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী নন। সুলতান মহলের প্রহরী বিনয়ের সাথে আগন্তকের পরিচয় জানতে চাইলো। আপনি কে এবং আপনার সাক্ষাতের কারণ কি? সুলতান জিজ্ঞেস করলে জবাবে কি বলবো?

আগন্তক বললেন- আমার নাম খাজা হাসান তুসী। আমার বাড়ী নিশাপুর। আমি নিশাপুরের ইমাম মুওয়াফিকের একজন ছাত্র। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফকীহ ও মুহাদ্দিস স্তর পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছি। আর আমার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য সুলতানকেই বলবো।

এরপর প্রহরী যখন সুলতানকে আগন্তকের কথা জানালেন, তৎক্ষণাৎ তিনি বললেন-

সাক্ষাৎপ্রার্থীকে কি ফকীহ বা মুহাদ্দিস বলে মনে হয়? জ্বি সুলতানে মুহতারাম! তাঁকে দেখে অভিজাত বংশের লোক বলে মনে হয়। তিনি পরিমিতভাষী এবং তাঁর পরনে আলেমের পোশাক। বর্ণনা শুনে সুলতান তাড়াতাড়ি মহলের অভ্যন্তরে আনতে বললেন প্রহরীকে। অল্পক্ষণের মধ্যে আগন্তক সালাম দিয়ে সুলতানের সামনে দাঁড়ালেন। সুলতান তাঁকে সম্মানের সহিত বসতে বললেন। তারপর সুলতান বললেন- হে যুবক! আমি জানি ইমাম মুওয়াফিকের ছাত্র হওয়া কত বড় গৌরবের এবং সম্মানের। আমাকে প্রমাণ দাও যে, তুমি ইমাম মুওয়াফিকের ছাত্র।

হাসান তুসী তাঁর অর্জিত সনদপত্র সুলতানের হাতে তুলে দিয়ে বললেন-আমি ফেকাহ, হাদীস শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়েও তাঁর কাছ থেকে গবেষণা করেছি।

তাহলে কি তোমার অধ্যয়ন পর্ব শেষ?

হাসান তুসী বললেন- আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এলেও শিক্ষার গণ্ডিতে আজীবন নিবেদিত থাকতে চাই। জ্ঞানের দিগন্ত সুবিস্তৃত, সমুদ্রের বিশাল জলরাশির ন্যায়।

মণি মুক্তা কেবল তাঁর হাতেই শোভাবর্ধন করে যে সাগরের তলদেশ থেকে ঝিনুকের খোলস থেকে উদ্ধারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এবং প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।

হাসান তুসীর বুদ্ধিদীপ্ত কথায় সুলতান চেরাগ বেগের চোখে মুখে আনন্দের উজ্জ্বল আভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

তিনি হাসান তুসীর বুদ্ধির তীক্ষ্ণ ধার পরখ করার জন্য বললেন- বই পুস্তক বিদ্যা দান করে- বুদ্ধি নয়। তুমি নিজেকে কতটুকু ধীমান ভাবো?

হাসান তুসী বললেন- নিজেকে যে বুদ্ধিমান ভাবে, সে আসলেই মূর্খ। যে ব্যক্তি নিজেকে যতটা বড় মনে করে সে আসলে ততটাই ছোট। বুদ্ধিমান এবং মূর্খের মীমাংসা কজনেই বা দিতে সক্ষম।

এবার সুলতান গুরুগম্ভীর স্বরে হাসান তুসীর কাছে জানতে চাইলেন, কোন ক্ষমতাবান রাজ্যপ্রধান যদি প্রজাদের নিকট অনেক জনপ্রিয় হতে চায় তাহলে তাঁর মধ্যে কি কি গুণাবলী বা মানবিক চিন্তাবোধ থাকা প্রয়োজন?

নির্লিপ্ত চিত্তে হাসান তুসী বললেন - সেই রাজ্যপ্রধানকে ধর্ম এবং দেশের জন্য হতে হবে আপোষহীন। প্রজাসাধারণের নিকট হতে হবে সুবিশাল আকাশের মত উদার, নরম কোমল কাঁদা মাটির মত স্বাচ্ছন্দ্যময়, শীতল পানির মত প্রশান্তিকর, কাকের মত সর্বদা সতর্ক, বাঘের মত নির্ভীক, ঈগলের মত সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কোকিলের মত সুমিষ্টভাষী এবং চন্দ্র তারকার ন্যায় বিশুদ্ধ পথপ্রদর্শক।

এসব গুণের সমাহার কি আমার মধ্য বিদ্যমান আছে? আড়ষ্টপূর্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন সুলতান।

দ্বিধা সঙ্কোচহীনভাবে হাসান তুসী বললেন – উত্তরে যদি হ্যাঁ বলি তাহলে তোষামোদি হবে। তোষামোদি আর মোনাফেকীর রূপ একই। মুনাফিক হওয়া আমার কাম্য নয়। আর যদি বলি সুলতানের মধ্যে গুণের কমতি আছে তাহলে আপনার অসন্তুষ্টির কারণ হবো। কারো মনকষ্টের কারণ হওয়া আমার ইচ্ছা বিরুদ্ধ।

সুলতান হাসান তুসীর কথা অতি মনোযোগের সাথে শ্রবণ করছিলেন। তাঁর জ্ঞানদীপ্ত কথা এবং প্রখর স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা জ্ঞাপনপুর্ব্বক স্নেহাসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- আচ্ছা তাহলে একটি বিষয় বল! আমার মধ্যে যদি এসব গুণের দু একটি ঘাটতি থাকে তাহলে কি বড় কোন ক্ষতি বয়ে আনবে!

যুক্তিপূর্ণ সুন্দর উপমা টেনে হাসান তুসী বললেন - মান্যবর সুলতান! তসবীহতে দানা থাকে একশটি আর গ্রন্থি থাকে মাত্র একটি। এই একটি মাত্র গ্রন্থ যদি খুলে যায় তাহলে তসবীহর সব দানাগুলো বিক্ষিপ্তাকারে চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। যদি এরূপ হয় যে, আপনার ত্রুটিপূর্ণ বিচ্যুতি সেই তসবীহর গ্রন্থটির মূল্যমান তুল্য! তাহলে আপনার অর্জিত অন্যসব গুণগুলো ছুটে যাওয়া গ্রন্থির তসবীহর দানার মত বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।

এবার সুলতানের মুখে আনন্দাচ্ছাস উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আবেগাপ্লুত হয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন- তোমাকে আমি আমার উপদেষ্টা মনোনীত করলাম। তোমার সত্যভাষিতা ও ন্যায়নিষ্ঠ নীতির স্বচ্ছতা প্রয়োগে তুমি যদি নির্মল নিটোল থাক তাহলে আমার ভবিষ্যৎবাণী হল- একদিন তুমি এই সালতানাতের ওযীরে আযম বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবে।

দীর্ঘ বাইশ বছর পর সুলতান চেরাগ বেগের পৌত্র মালিক শাহ্‌ যখন ক্ষমতায় আসীন তখন তাঁর এই ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হল। হাসান তুসী তাঁর অদম্য নির্ভীক সততা, স্পষ্টবাদিতা, স্বচ্ছ কর্মদক্ষতা, নির্লোভ কর্মপরিকল্পনা, জ্ঞানগর্ভ বিচক্ষণতা আর দুরদর্শীতার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন ওযীরে আযম এর সম্মানজনক পদমর্যাদায়। সেলজুকি সুলতানগণ এই মহান ব্যক্তি হাসান তুসীকে নেযামুল মুলক বা রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পরিচালক উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে হাসান তুসী নামটি উপাধির আড়াল হয়ে নেযামুল মুলক নামটি বিশ্ব পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করে।

আজো সেখানে সগৌরবে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া। পরবর্তীতে ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন জগৎবিখ্যাত সিপাহসালার সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী এবং মুসলমানদের মুকুটমণি খ্যাতনামা মনিষী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।



বিষয়: বিবিধ

১০৮২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384863
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত ১০:১০
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম আপি। পড়ে ফেললাম এক নিশ্বাসে ইস! মুসলিমরা যদি আজো জ্ঞান বিজ্ঞানের নেতৃত্বে থাকত! আপি ব্লগ ছেড়োনা
০১ মার্চ ২০১৮ রাত ০৮:৩২
317405
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন জনাবা!
আপনার...........
না আর পারলাম না। Crying
০১ মার্চ ২০১৮ রাত ০৯:৪০
317406
সন্ধাতারা লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ছোট আপি। আশায় বুক বাঁধি সোনালী দিনের প্রতীক্ষায়। মুসলিম উম্মাহ একদিন জাগবে, বিজয় কেতন উড়াবে রক্তাক্ত জমিনে।

তুমি লিখো না কেন আপু?
সময় সুযোগ করে মেসেঞ্জারে ফোন দিও, যদি ইচ্ছে করে।
তোমার জন্য নিরন্তর দোয়া এবং শুভকামনা।
384867
০১ মার্চ ২০১৮ রাত ০৮:৩৩
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
অনেক ভালো লাগলো। শুকরিয়া।
কেমন আছেন আন্টিমনি!
০১ মার্চ ২০১৮ রাত ০৯:৪৩
317407
সন্ধাতারা লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু আংকেলজ্বি। আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাল আছি।
অনেক দিন পর আপনাদের প্রেরণাময় উপস্থিতি ভীষণ ভাল লাগলো।
আপনারা কেমন আছেন সবাই? জান্নাতী পাখীটার খবর কি?
০৩ মার্চ ২০১৮ দুপুর ০৩:২৩
317413
আবু জান্নাত লিখেছেন : আলহামদু লিল্লাহ, জান্নাত এখন নূরানী ৩য় জামাতে পড়ছে, ওর একটি ছোট বোন আছে, ৯ মাস বয়স চলছে, "রাহমা বিনতে শরীফ" সবাই রাহমা বলেই ডাকে, দোয়ার আবেদন রইল। শুকরিয়া। Good Luck Good Luck
০৮ মার্চ ২০১৮ সন্ধ্যা ০৬:০০
317426
সন্ধাতারা লিখেছেন : Mashallah....great news......endless love n dua for all.
384941
১৯ মার্চ ২০১৮ দুপুর ১২:৫৫
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
আপুনি কেমন আছেন? অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম। আপনার লেখা পড়লে বরাবরেই লিখতে উৎসাহ পাই। দোয়া করবেন আমাদের জন্যে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File